
প্রতীকী ছবি
বঙ্গদেশের অমল মাধুর্য, বাংলা ভাষার অমৃত আবহের কাছে এ আকুল আকুতি কবি বিনয় মজুমদারের। ষাটের দশকের আশ্চর্য এ কবিকে আমরা জানি। যতটা তিনি কবিতায় ব্যতিক্রম, উজ্জ্বল এক মাছ তারও অধিক তিনি ব্যক্তিগত আধার-আঁধার জীবলাখ্যের কারণে।
রাজার ঘরে জন্ম না নিলেও রাজ্য জয় করা স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন গড়ার পথে পা বাড়িয়েছিলেন শৈশবে, অলৌকিক মেধায় প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিষ্ঠান পেরিয়েছেন সোনার মুকুট মাথায় নিয়ে; কিন্তু পাছে যে তাকে স্বদেশ- কবিতায় ধরেছে তা টের পায়নি পাছের কেউ। বিনয় বুঝেছে কবিতার স্পর্শ। আর যায় কই। মুকুট গেছে ছুটে, জুতা গেছে খুলে, কাঁধের লাল পাড় দোপাট্টা উড়ে গিয়ে তাঁর জন্য পাঠিয়েছে কবিতার মর্মর অথচ জাদুকরী কাব্য।
বিনয় দেখেছেন, পাড় কীভাবে ভেঙে যায়, পাড় কীভাবে গড়ে ওঠে। দু’পাড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে অবলোকন করেছেন সবকিছু তবে নড়ে-সরে দাঁড়াননি। কবিতার অনশ্বর এক চাঁদ তখন তার সামনে, তখন হয়তো ভেবেছেন চাঁদের দেশে যাবেন, চাঁদালোয় কাটাবেন জীবন; জীবন কাটাবেন কবিতার মতো সুশান্ত বঙ্গদেশে। সে ভাবনার হিতে বৈপরীত্য এসেছে, কবিতায় রমণীয় পয়ার, বস্তু-বাস্তবতার বিন্দু-বিসর্গ লিখতে লিখতে কখন যে বেলা ফুরিয়েছে, ক্ষুধার মহলে হানা দিয়েছে খিদা সে খেয়াল করেননি বঙ্গদেশের কবিতার নব জুয়াড়ী জওয়ান! দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, বন্ধুরা চাঁদা তুলে চালিয়েছেন একার সংসার, হাড়ির রান্না, কফি হাউসের কফির জোগান। তবু বিনয় বঙ্গমাটিতে বুক পেতে ঘুমিয়েছেন শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সোনার মেডেল পাওয়া এ গণিতজ্ঞ তিন বেলা চাইনিজ চাউমিনের লোভে, অভিজাত আর আভিজাত্যের তাড়নায় কথিত সুসভ্য, সুজাতি, ধনী দেশের প্রগাঢ় হাতছানির পরও পাড়ি জমাননি ভিনদেশে; স্বদেশের প্রতি, কবিতার প্রতি অকৃত্রিম এক ভালোবাসায়।
বিনয় মজুমদার কবিতার প্রতি কেমন পাগল ছিলেন, কী তার একাগ্র আগ্রহ ছিল তা এতকাল পর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে বলার অপেক্ষা রাখে যা তার অনেক আলোচনার সঙ্গে গৌণ মেঘের আড়ালে পড়ে থাকে- সেই দেশপ্রেম, বঙ্গদেশ, ভাষা, কবিতার প্রতি জেদ ধরার মতোই নিজ দেশে থাকার জেদ, অদ্বিতীয় ভাব-ভাবনা। বিনয় তার এক বলায় আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন জীবিকার করুণ সময়ের কথা, ‘ওরা চাঁদা তোলা শুরু করল বটে এবং দিয়েও ছিল বছরখানেক, বছর দেড়েক। তারপরে চাঁদা দেওয়া বন্ধ করে দিল। আমি অত্যন্ত, অতিশয় কষ্টে দিন কাটিয়েছি তারপর।
১৯৬৪ সালের পরে ১৯৭০ সালে আমি আমার বাবার কাছে চলে আসি। ৬ বছর আমি অত্যন্ত টাকার অভাবে ভুগেছি। টাকার অভাব দেখে বাবা আমাকে ১০০ টাকা করে দিত। আমি প্রতি মাসের পয়লা তারিখে বাড়ি এসে টাকা নিয়ে চলে যেতাম কলকাতায়।’ এরপর কি বিনয়ের টাকার অভাব ফুরিয়েছিল? না। কবিতার অবিনাশী নেশায় বিনয় যখন চুর, তারও আগে ঘর-সংসার, জীবিকার প্রয়োজনকে তুচ্ছ ভাবতে শুরু করে নতুন বাঁকের দিকে নাও ভাসিয়ে উত্তাল জলরাশিতে মাতাল, তখন দুর্গাপুর হোস্টেলে থাকাকালীন তাঁর বাবা বিপিনবিহারী মজুমদার এক চিঠিতে ছয় সন্তানের সবচেয়ে ছোট, তুখোড় বিনির্মাণী মেধায় ভাস্মর বিনয়কে লিখেছেন- “তোকে নিয়ে আমার চিন্তা। তোকে শুধু একটু ‘ভালো ভাবে আছিস’ দেখে যেতে পারলে শান্তিতে মরতে পারব।” বিনয় ভালো ভাবে থাকেনি। পাড়া, মহল্লা, নগর, শহর ছাড়িয়ে বিনয়ের কবিতা যখন দেশে দেশে বাংলা ভাষাভাষীর কাছে নতুন বিস্ময়- তখনও বিনয় একার দেশে একা পায়ে হেঁটে বেড়িয়েছেন ভালো না থাকায়। তার কবিতা ভালো থেকেছে কাব্যপ্রেমিকের কোঁচরে। বিনয় ভালো থাকেনি।
থাকতে পারতেন। অন্যরা যেমন ছিল, আছে। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে মেকানিক্যালে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট, রেকর্ড নম্বরসহ উত্তীর্ণ হয়ে স্টিল প্রোজেক্টে ট্রেইনি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। সরকারি চাকরি। মন টেকেনি। তাঁর বাবা ৯ জুন ১৯৬২-তে আবার লিখলেন, ‘সরকারি চাকরিতে শান্তি আছে, পেনশন আছে, ভবিষ্যৎ আছে। আমার ইচ্ছে তোর ট্রেইনিং শেষ হলেই তোকে বিয়ে দেব। ঐখানেই ২২৫ টাকা পাবি, ওই টাকাতে তোর চলে যাবে। তখন শান্তিতে থাকতে পারবি।’ ওই সালে ১৪ জুন তার বড় দাদা লিখলেন, ‘চাকরি করতে হলে যতটা তেল মারার ক্ষমতা ও পরিশ্রম করার ক্ষমতা দরকার, তা তোর নেই। উড়ুউড়ু মন নিয়ে সেটা কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়। মাইনের লোভে প্রাইভেট ফার্মে না যাওয়াই ভালো।’ শেষতক সব ছেড়ে কলকাতায় অন্যের বাড়িতে, কক্ষে থেকে, খেয়ে না খেয়ে কবিতার ফার্মে রাতদিন চর্চা আর তার প্রিয় গণিত নিয়ে নাজেহাল বসবাস।
এখানেই শেষ হলে ভালো হতো, শেষ হয়নি। গণিত যার হাতের তুড়ির বিষয়, গণিতের ক্যালকুলেশন আর ইকোয়েশন যার কাছে পান্তা ভাতের মতো, প্রথা ভেঙে যিনি আবিষ্কার করেছেন ভিন্ন বিভিন্ন ফর্ম তখন তার ডাক পড়েছে জার্মানির বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিভাগে অধ্যাপনার জন্য; জাপান থেকে উচ্চবেতন আর নিশ্চিত জীবনের সুযোগ-সুবিধাসহ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চাকরির আমন্ত্রণ, তৎসময়ে সারাপৃথিবীর কাঙ্ক্ষিত দেশ ইংল্যান্ডও চেয়েছে তাকে অথচ বিনয় ভ্রুক্ষেপও করেননি। ফিরিয়ে দিয়েছেন আরও বহু প্রস্তাব। তা কিসের জন্য! শুধুই কি কবিতা? ‘আমাকেও মনে রেখো’ কবিতায় মানবের যে চিরকাঙ্ক্ষিত স্বর নিহিত, কবির যে প্রার্থনাকাতর কামনা তা কোন্ মহত্ব বা পিপাসার ইঙ্গিত দেয়? বিনয় কবিতায় যে নাম কুড়িয়েছিলেন তরুণ সময়ে, তাকে নিয়ে The Statesman- পত্রিকায় যখন লেখা হয় Binoy Mujumdar has occupated a permanent pleace in the history of Bengali literature by writing the book ‘Fier Eso Chaka’. তখন চাইলে পৃথিবীর যে কোনো দেশে থিতু হওয়া, উপার্জনের পথ তৈরি করা বা চরম দারিদ্রে হিমশিম খাওয়া সময়েও বিনয় বলছেন, ‘কবিতা আর লিখব না, অন্তত এক বছর না, তার বদলে অঙ্ক কষব। একটা নতুন সিরিজ মাথায় এসেছে তাকে ঝালিয়ে দেখতে হবে। প্রয়োজন হলে ইংল্যান্ডের রয়েল সোসাইটির কোনো বিশারদকে দিয়ে পরীক্ষাও করতে পারি।’
তখন বোঝাই যায় বহিঃর্বিশ্বের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল আর সাধারণের চেয়ে উন্নত, যা ব্যবহার করে বিনয় উন্নত যে কোনো দেশে চাইলেই চলে যেতে পারতেন; কিন্তু তা তিনি করেননি শুধু কবিতাই না, বঙ্গদেশের, জন্মভূমির প্রতি একটা অপ্রকাশিত, অনুচ্চারিত, গোপন মায়ার টানে। শ্যামল, সবুজ ছায়া-কায়ার মায়ায় ভিনদেশি কোনো টানই তাকে টানতে পারেনি নানান প্রলোভনেও। হয়তো তার পোশাকটা দৃশ্যত তা বলে না, হয়ত তার কবিতা বারবার আমাদেরকে গায়ত্রীর কাছে টেনে নিয়ে যায়, তার নারী প্রেমের দিকে আমাদেরকে ধাক্কা দিয়ে পাঠিয়ে দেয়, ‘ফিরে এসো, চাকা’তে আটকে রাখে, কিন্তু কোনো ক্রমেই অনুজ্জ্বল না ষাটের আশ্চর্য ফুল বিনয় মজুমদারের বঙ্গপ্রীতি আর বঙ্গদেশের প্রতি তার অসাধারণ প্রেমানুভূতি, মাতৃভক্তি; না হলে তার বাংলা কবিতাও কি পারতো এতটা ঋব্ধ করতে বাংলা সাহিত্যের কবিতার ভূমিকে? তার আরও কবিতায় বিনয়কে আমরা পাই বাংলার প্রকৃতি ঘেষা আবহমান বাংলার চেনা পরিবেশের ভেতর এক নৈত্যিক দৃশ্যায়নে অথচ তাঁর এই প্রেমটি আলোচনায় নেই বললেই চলে; যা প্রকৃতই আশাহতের।
‘বর্ষাকালে আমাদের পুকুরে শাপলা হয়, শীত গ্রীষ্মে এই/ পুকুর সম্পূর্ণ শুষ্ক হয়ে যায়, পুকুরের নিচে ঘাস গজায়, তখন-/ পুকুরে শাপলা আর থাকে না, আবার সেই বর্ষাকাল আসে/ তখন পুকুরটিতে জল জমে পুনরায় শাপলা গজায়।/ এই হলো শাপলার কাহিনী, শাপলা ফুল শাপলার পাতা/ ছন্দে ছন্দে দুলে যায়, অনুপ্রাস, চিত্রকল্প ইত্যাদি সমেত।/ এবং পুকুরটিও চিন্তাশীল, সৃষ্টিশীল, পুকুরের আনন্দ-বেদনা পাতা হয়ে ফুল হয়ে ফুটে ওঠে পৃথিবীতে, এই বিশ্বলোকে। (বর্ষাকাল)
গ্রন্থসূত্র : ‘এক আশ্চর্য ফুল বিনয় মজুমদার’-
সম্পাদক : এহসান হায়দার ও স্নিগ্ধদীপ চক্রবর্তী