Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

সাহিত্যসমৃদ্ধ আফগান সংস্কৃতি

Icon

ইমরান মাহফুজ

প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৪:২৯

সাহিত্যসমৃদ্ধ আফগান সংস্কৃতি

ভৌগোলিক দিক থেকে আফগানিস্তান পাহাড়-পর্বতে ঘেরা এক রুক্ষ প্রকৃতির দেশ। সেই দেশটি এখন তালেবানের দখলে। বিশ্ব রাজনীতি এবং চরমপন্থার সংঘর্ষের বলি হচ্ছে পুরো একটি দেশ, কোটি মানুষ এবং হাজার বছরের সংস্কৃতি।

একই অবস্থা হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। তখনো আফগানিস্তান দখল করেছিল তালেবান। বর্তমানে এর নাম বললেই সামনে ভেসে আসে অস্থির জনপদ কিংবা ভয়ার্ত মানুষের ছবি। অথচ একসময় এই ক্ষত-বিক্ষত পটভূমির আগে শিল্প-সাহিত্যে সমৃদ্ধ ছিল দেশটি। কারণ তাদের রয়েছে বহু জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত শিল্প-সংস্কৃতিসমৃদ্ধ ঐতিহ্য। যাদের জীবনযাপনে বিভিন্ন উৎসবে থাকত সংগীত, পোশাকে হস্তশিল্প নির্মাণ, খাদ্যাভ্যাস, বিনোদন এবং ভাষা ও সাহিত্য কৌতূহলোদ্দীপক।

বহু জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম হাজারা। যদিও হাজারাদের অধিকাংশই মধ্য আফগানিস্তানের পার্বত্য অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত; যা হাজারজাত অঞ্চল নামে পরিচিত, তবে তাদের সঠিক সংখ্যা জানা নেই। কারণ সে দেশে কখনো সম্পূর্ণ জাতীয় আদমশুমারি হয়নি। ফলত সৈয়দ মুজতবা আলী তার দেশে-বিদেশে বইতে আফগানিস্তানের ইতিহাসকে ‘অরক্ষণীয়া মেয়ে’র সঙ্গে তুলনা করেছেন তাদের ইতিহাস লেখা হয়নি বলে। একইসঙ্গে দাবি করেছেন, আফগানিস্তানের ইতিহাস না জেনে ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্পূর্ণ করার কোনো সুযোগ নেই। তবে ধারণা করা হয়, আফগানিস্তানে হাজারাদের সংখ্যা আনুমানিক ২৭ লাখ এবং পাকিস্তানে তাদের সংখ্যা দেড় লাখের বেশি। বিভিন্ন দেশে হাজারাদের বসতি রয়েছে। তাদের অধিকাংশই শিয়া মুসলমান।

এর মধ্যে হাজারা জাতিগোষ্ঠীর উৎপত্তি কোথায় কিংবা প্রেক্ষাপট কী ছিল, তা নিয়ে সঠিক কোনো মন্তব্য করা যায় না। ‘‘পরিচয় প্রমাণ করার জন্য বিশ্বাসযোগ্য কোনো দলিলও নেই। বিশেষজ্ঞের মতামত পর্যালোচনা করে হুমায়ুন সারাবি চারটি মতবাদ উপস্থাপন করেছেন। এগুলো হচ্ছে মধ্য আফগানিস্তানের হাজারজাত এলাকার আদি অধিবাসী, জাতিগতভাবে মঙ্গোল অর্থাৎ মঙ্গোলদের বংশধর, মঙ্গোল-তুর্কি জাতিগোষ্ঠী এবং মিশ্র জাতি। তবে সর্বাধিক স্বীকৃত তত্ত্বটি হলো হাজারা সম্প্রদায় মিশ্র জাতি। এ তত্ত্বের ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়, একসময় কিছু সংখ্যক মঙ্গোল উপজাতি পূর্ব পারস্য ভ্রমণ করেছিল এবং বর্তমান আফগানিস্তানে আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। সেই দলটি তখন তাদের নিজস্ব সম্প্রদায় গঠন করে এবং পরবর্তী সময়ে হাজারা সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। হাজারা শব্দটি সম্ভবত ফার্সি শব্দ ‘হাজার’ থেকে উদ্ভূত।’’ (ফজল হাসান)

আফগানদের বিবাহ অনুষ্ঠান ঐতিহ্যগত ইসলামী নিয়মনীতি অনুসরণ করে। বেশির ভাগ বিয়েশাদি তাদের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কিংবা হাজারা জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। তবে মীর হেমতুল্লাহ্ সাদাতের ভাষায় বলতে হয় ‘দ্য আফগান এক্সপেরিয়েন্স রিফ্লেক্টেড ইন মডার্ন আফগান ফিকশন’ অর্থাৎ ‘আফগানদের জীবন অভিজ্ঞতার প্রতিফলন দেখা যায় আধুনিক আফগান সাহিত্যে’।

আল্লামা রুমি একসঙ্গে আফগানিস্তান আর তুরস্কের জাতীয় কবি। দুই দেশের বাইরেও ইরান মনে করে রুমি তাদের জাতীয় কবি। রাজধানী তেহরানের দেয়ালে কিংবা স্কুলের পাঠ্য বইয়ে তথা ইরানি সাহিত্যের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে রুমির অবদান। ফার্সি সাহিত্যের সবচেয়ে সেরা কবি বলে মনে করা হয় রুমিকে। আফগানিস্তানে তিনি পরিচিত মাওলানা জালাল-উদ-দিন বলখি নামে। আর ইরানে পরিচিত ‘মেভলেভি’ নামে। তবে বাইরের বিশ্বের কাছে তিনি রুমি নামেই পরিচিত। অর্থাৎ তিন দেশই রুমিকে তাদের কবি বলে মনে করে। অথচ রুমি’র জন্ম যেখানে সে জায়গাটা পড়েছে বর্তমান আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে। তবে নিজ পরিবার নিয়ে তুরস্কে বাস করছেন তিনি। সেখানেই রচনা করেছেন এবং করছেন তাঁর বহু সেরা সাহিত্য-কর্ম।

দারি (ফার্সি ভাষার আফগান রূপ) ভাষায়। দারি কবিতায় আধুনিকতার সূত্রপাত হয় ষাটের দশকের প্রথমার্ধে, পাশের দেশ ইরানের ফার্সি কবিতার বিবর্তনের প্রভাবে। ইরানে ‘ফ্রি স্টাইল পোয়েট্রি’ বা মুক্ত ঘরানাকে ধ্রুপদি কাব্য প্রকরণের দৃঢ় রীতি ভেঙে ভিন্ন এক ভাবনাপ্রধান কাব্যশৈলী নির্মাণের উদ্যোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যশস্বী ইরানি কবি নিমা ইউশিজ (১৮৯৭-১৯৬০) এই ধারার পথিকৃৎ; কিন্তু আফগানিস্তান বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়েছিল।

সেই পরিবর্তনের হাওয়া সাহিত্য সংস্কৃতিকে প্রবলভাবে ধাক্কা দিয়েছিল। ফলে নতুন ধারার শিল্প-সাহিত্যের স্ফুরণ ঘটেছিল। অন্যদিকে আফগানিস্তানের ক্ল্যাসিক্যাল সাহিত্যের ব্যাপ্তী ছিল প্রধানত গদ্য এবং প্রচলিত উপকথা, রূপকথা কিংবা পুরাণ কাহিনি বা গল্পে। তবে ক্লাসিক্যাল দারি সাহিত্য থেকে আধুনিক আফগান সাহিত্যের বিস্তর ফারাক রয়েছে। পুস্তকে ক্ল্যাসিক্যাল কবিদের তুলনায় দারি-পার্শিয়ান ভাষার জাতীয়তাবাদী কবি খলিলুল্লাহ্ খলিলির (১৯০৭-৮৭) লেখা অধিক সংখ্যক অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর তালেবান আমলে গান কবিতা নিষিদ্ধ থাকলেও সম্প্রতি একটি ওয়েবসাইট চালু করেছে, যেখানে কবিতাকে গানের মতো করে গাওয়া হচ্ছে। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে শিল্প সাহিত্যের কী হতে পারে তা অননুমেয়।

যদিও ২০০১ সালের কথা এখনো ভোলেনি অনেকেই। তালেবান শাসনের একেবারে শেষ বছরেই ঐতিহাসিক বামিয়ান বুদ্ধমূর্তির ধ্বংসসাধন করেছিল। ধ্বংসযজ্ঞ চলেছিল দেশের একাধিক মিউজিয়ামেও। তবে এর মধ্যে গত বছর শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছিল আফগানিস্তানের চরমপন্থী সংগঠনের। মার্কিন প্রতœতাত্ত্বিক সংস্থা এবং আফগানিস্তানের আর্কিওলজিক্যাল ইনস্টিটিউটের যৌথ উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত ‘ভুল’ বুঝতে পেরেছিল তালেবানরা। অনুশোচনার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তালেবান মুখপাত্রের বক্তব্যে। এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যবর্তী অঞ্চলে, তাই একধরনের দ্বন্দ্ব রয়েছে দেশটির শিল্প-সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে। ফলত ‘‘আফগানদের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তারা প্রতিশোধপরায়ণ। তাই বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় ফুটে উঠেছে প্রতিহিংসা, জিঘাংসা। পশতুন কবি এবং লেখক ঘানী খান ‘প্রতিহিংসা’ লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘অবশ্যই একদিন দুটি মিলিত হবে। প্রতিহিংসা এবং মৃত্যু, মৃত্যু এবং প্রতিহিংসা, সব সময় এবং চিরদিন ।’’ (ফজল হাসান)

আফগান জনপ্রিয় কবি নাসরুল্লাহ পারতৌ নাদেরি। তার জন্ম ১৯৫২ সালে আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় বাদাখশান প্রদেশের জেরশাহ বাবা গ্রামে। কমিউনিস্ট আফগান শাসনের বিরোধিতার কারণে অনেক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীর মতো তাকেও কারাগারে যেতে হয়েছে। পুল-ই-চারখি কারাগারে ঠাঁই হয় তার। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত ছিলেন কারাগারে। এরপর ১৯৯৭ সালে পালিয়ে পাকিস্তানে চলে যান। তিনি আফগান কবিতায় ঐতিহ্য, আধুনিকতা ও সমসাময়িক পরিস্থিতির মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। বাংলা ভাষায় তার একাধিক কবিতাও অনূদিত হয়েছে।

একাদশ শতাব্দীতে আফগান সুলতান মাহমুদের সভাপ-িত আল-বিরুনি ভারতবর্ষের সংক্ষিপ্ত বিশ্বকোষ লিখেছিলেন। এরপূর্বে ভারতের কোনো লিখিত ইতিহাস ছিল না। সম্রাট বাবরের আত্মজীবনী থেকে আফগানিস্তানের এক চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়। তার সময়কার কান্দাহার, গজনী বা কাবুলের সঙ্গে লেখকের সময়কালের তেমন কোনো তফাৎ নেই বলে লেখক উল্লেখ করেছেন। বাবরের আত্মজীবনী থেকে তার ভেতরকার সাধারণ মানুষের সত্তাটিকে আলাদা করে দেখা যায়। 

অন্যদিকে আফগানিস্তান কাবুলকে বাংলার সাহিত্য পাঠকের কাছে শত বছর আগে তুলে আনেন সৈয়দ মুজতবা আলী। তিনি ১৯২১ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন। বিশ্বভারতীর প্রথমদিকের ছাত্র মুজতবা আলী বিভিন্ন ভাষা নিয়ে পড়ালেখা এখানে থেকেই শুরু করেন। শান্তিনিকেতনে পড়ালেখার পর আফগানিস্তান সরকারের অনুরোধে ‘কাবুল কৃষি কলেজে’ ফারসি ও ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এই আফগানিস্তান অভিজ্ঞতা নিয়েই তার বিখ্যাত ভ্রমণকাহিনী ‘দেশে বিদেশে’ বইটি।

বহুল পঠিত ‘দেশে বিদেশে’ বইটি মূলত তার আফগানিস্তানের জীবনযাপন এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা। এটা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক কোনো ভ্রমণকাহিনী। পেশওয়ার থেকে লেখকের যাত্রা শুরু হয় আফগানিস্তানের দিকে। এই দেশের অস্থিতিশীল অবস্থা নিয়ে লেখক বেশ শঙ্কিত ছিলেন। পেশওয়ার পৌঁছে আফগান যাত্রীদের আবার নতুন করে স্ট্যাম্প করে নিতে হয়। এই স্ট্যাম্পের মেয়াদও মাত্র তিন দিন। এই ব্যবস্থার কারণ হচ্ছে খাইবারপাসের আশেপাশে যে কোনো সময় দাঙ্গা লেগে যেত।

বইটির অন্যতম চরিত্র আবদুর রহমান। তিনি লেখকের ভৃত্য এবং অন্যতম প্রধান চরিত্র। পুরো কাহিনিজুড়ে হাস্যরসাত্মক ও বিচক্ষণতা মিশ্রিত ঘটনার জন্ম দিলেও শেষ পর্যায়ে লেখকের সঙ্গে বিদায়ের মুহূর্তে মর্মান্তিক এবং করুণ পরিণতি হয়। তারপর মুঈন-উস-সুলতান- আফগানিস্তানের যুবরাজ ইনায়েতুল্লাহ। ১৯২৯ সালের জানুয়ারিতে মাত্র তিন দিনের জন্য আফগানিস্তানের বাদশাহ ছিলেন। সেই সঙ্গে বাচ্চায়ে সাকো- ডাকাত, যার আক্রমণে আফগানিস্তানে আমানুল্লাহর পতন ঘটেছিল। এইভাবে নানান চরিত্রের মাধ্যমে তাদের জীবন যাপন জানা যায়। সঙ্গে উঠে আসে আফগান শিল্প এবং শিল্পিত সমাজ।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫