
প্রতীকী ছবি
জমিজমার জন্য আপন চাচাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে রমজান। তার ফাঁসির রায় কার্যকর হচ্ছে আজ ভোর সোয়া চারটায়। বসের সঙ্গে জেলখানায় গেলাম। আমি আর শাহাদত। শাহাদত চাকরিতে নতুন। মাস চারেক হলো জয়েন করেছে। আমার বছর চারেক। নাটক, সিনেমা ছাড়া, কোনোদিন আমি ফাঁসি কার্যকর হতে দেখি নাই। শাহাদতও না। এক্ষেত্রে আমরা দু’জনই একেবারে নতুন। আজই প্রথম সরাসরি ফাঁসি কার্যকর প্রত্যক্ষ করব।
আকাশ ভালো না। টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। সহকারী জেলার আবদুস সোবহান সাহেব আমাদের নিয়ে গেলেন ফাঁসির মঞ্চের দিকে। ঠিকঠাক আছে কিনা, তা দেখাতে। মঞ্চের আয়োজন দেখেই শাহাদত ঢলে পড়ে গেল নিচে। জ্ঞান হারালো। কিছুক্ষণ চোখেমুখে পানি দেওয়ার পর জ্ঞান ফিরে এলো তার। বস বলল, ওকে সরাও এখান থেকে। ওর হার্ট দুর্বল। ও সহ্য করতে পারবে না।
শাহাদতকে বাসায় পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা হলো। আমি বসের সঙ্গে। কোনো সমস্যা হচ্ছে না আমার। বসেরও না। দু’জন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। মঞ্চ দেখছি। দেখাও শেষ। স্যার বললেন, সব ঠিক আছে। এবার রমজানের কাছে যাব।
সোবহান সাহেব বললেন, চলেন স্যার। ওই দিকেই আছে।
কনডেম সেলের দিকে এগিয়ে গেলাম। ফাঁসির আসামি রমজানকে দেখার জন্য। ভয়ংকর নিষ্ঠুর লোক। তা না হলে এমন কাজ করে কীভাবে? খুব দুর্ধর্ষ মনে হয়েছিল রমজানকে; কিন্তু কাছে গিয়ে দেখি ছোটখাটো একজন মানুষ। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কোটরাগত চোখ। বুকের হাড়হাড্ডি জেগে। গায়ের রঙ কালো। একটা থাপ্পড় দিলেই মনে হয় পড়ে যাবে সে। এই মানুষ কীভাবে আপন চাচাকে খুন করে ফেলল! বিশ্বাস হচ্ছে না। আবার ভাবলাম, চাচা তো চাচা। সম্পত্তির জন্য কতজনে আপন ভাই-বোন, মা-বাবাকে খুন করে ফেলে! কিন্তু রমজানকে কি সেই রকম কিছু মনে হয়? ভালো করে তাকিয়ে আছি তার দিকে। ফ্লোরে চুপচাপ বসে আছে সে। চোখ-মুখ বিষণ্ণ। আমাদের দিকে একবার তাকিয়ে, নামিয়ে নিলো চোখ। নিচের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে দোয়া-দরুদ পড়ছে সে। স্যার বললেন, তোমার নাম রমজান?
হ।
তার কণ্ঠ অস্পষ্ট। ভেজা ভেজা। করুণ।
কী খেতে ইচ্ছে করে তোমার?
কোনো কিছু খাইতে মন চায় না।
ভালো করে ভেবে বলো।
না স্যার থাউক, খাওয়ার দরকার নাই। খাইয়া আর কী অইবো!
না, তবুও বলো। কী খেতে মন চায় তোমার?
স্যার, জীবনে কত কিছুই তো খাইতে মন চাইছে, খাইতে পাই নাই।
এ মুহূর্তে কী খাইতে ইচ্ছা করে বলো।
বড় রুই মাছ দিয়া ভাত খাইতে ইচ্ছা করে। এই সব মাছ শুধু বাজারে দেইখাই গেছি। কুনোদিন কিনতে পারি নাই। খাইতেও পারি নাই।
ঠিক আছে। আজ খাবে।
রুই মাছের তরকারি আর ভাত আনার জন্য একজনকে পাঠালেন সোবহান। আমাদের নিয়ে গেলেন জেলারের রুমে। জেলার সাহেব রুমে নাই। সোবহান বললেন- বসেন স্যার। স্যার হয়তো এদিকেই কোথাও আছেন। চলে আসবেন এক্ষুণি। স্যার বললেন- তাহলে রমজানের ওদিকেই যাই।
আবার হাঁটতে হাঁটতে সেই কনডেম সেলে। দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই ভাত-তরকারি এসে গেল। লোকটি সোবহান সাহেবের কানে ফিসফিস করে কী যেন বলল। সোবহান সাহেব ফিসফিস করে বসকে বললেন- স্যার, এই মুহূর্তে আশপাশে কোথাও রুই মাছ পাওয়া যায় নাই। কাতল মাছের ব্যবস্থা হয়েছে।
বস বললেন- এত রাতে আর কী-ই বা করা যায়!
সোবহান সাহেব বললেন- কাতল যে পেয়েছে, এটাই ওর ভাগ্য।
আমি মনে মনে বললাম- হায় রে ভাগ্য! মরার সময়েও কী সুন্দর প্রতারণা। অনতিদূরে দাঁড়িয়ে, চুপ করে রমজানের ভাত খাওয়া দেখছি। কাতল মাছকে রুইমাছ ভেবে বেশ আয়েশ করেই ভাত খাচ্ছে সে। খেতে খেতে বামহাতের তালু দিয়ে কয়েকবার চোখ মুছল। তারপর খুব স্বাভাবিকভাবেই খাওয়া শেষ করল। তবে সব ভাত আর মাছ সে খেতে পারল না। হয়তো মৃত্যু চিন্তায় গলা দিয়ে ভাত নিচে নামছে না তার। অর্ধেকের কিছু কম ভাত-তরকারি রয়েই গেল প্লেটে। খাওয়া শেষে হাতমুখ ধুয়ে বলল- আলহামদু লিল্লাহ। খোদা তোমার দরবারে অনেক অনেক শুকুর।
কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলো সে। তারপর জিজ্ঞেস করল- স্যার কয়টা বাজে?
আমি মোবাইলে সময় দেখলাম- রাত চারটা।
তাইলে তো আর বেশি সময় নাই। মাত্র পনের মিনিট আছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়া কুনোদিনই পারলাম না স্যার। পাগলা ঘোড়ার লাহান সময় খালি আগে আগে ছুইট্টা যায়। কিছুতেই তারে আটকায়া রাহা যায় না।
আমি চুপ করে আছি। স্যারও। রমজান বলল- সব ব্যবস্থাই তো হইয়া গেছে স্যার, না?
হ্যাঁ।
কোথায়?
ঘরের মধ্যে।
ঘরের মইদ্যে ক্যান স্যার? ফাঁসি না বাইরে অয়?
সোবহান সাহেব বললেন, হ্যাঁ, বাইরেই হয়, তবে আজ আকাশ মেঘলা। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। তাই ঘরেই ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রমজান জোরে একবার নিঃশ্বাস ফেলল। কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল- স্যার, রমজানের চাঁদ কবে উঠবে?
আগামীকাল।
অহ্!
আরেকবার নিঃশ্বাস ফেলল সে। ভাবলাম, একথা কেন জিজ্ঞেস করল রমজান? রমজানের চাঁদ উঠলে ফাঁসির কার্যক্রম বন্ধ থাকে- একথা কি সে জানে? আগামীকাল রমজানের চাঁদ উঠবে আকাশে। আজ সোয়া চারটায় তার ফাঁসি কার্যকর হবে। যদি গত সন্ধ্যায় চাঁদ উঠতো, তাহলে আরেকটি মাস বেঁচে থাকার সময় পেতো রমজান। এখন সেই সুযোগ তার হাতছাড়া। স্যার তাকে জিজ্ঞেস করলেন- হঠাৎ চাঁদের কথা কেন, রমজান?
স্যার, ক্ষেতের কামকাইজ কইরা খাইতাম। সব সময় খোলামেলা জায়গার মইদ্যে বাইড়া উঠছি। পেট ভইরা হয়তো ভাত খাইবার পারি নাই। কিন্তু বুক ভইরা বাতাস নিবার পারছি স্যার। কতদিন এই ঘরের মধ্যে আটকা পইড়া আছি। বাইরের কিছুই দেখতে পাই না। কতদিন খোলা আকাশ দেখি না। চাঁদ দেখি না। তারা দেখি না। গাছপালা দেখি না। ফসলের ক্ষেত দেখি না। গিরামের মানুষ দেখি না। দম খালি বন্ধ অইয়া আহে। তাই ভাবছিলাম- বাইরে যদি ফাঁসি অয়, তাইলে জীবনে শেষবারের লাহান অন্তত একটুখানি খোলা আকাশ দেখতে পারব। চাঁদ দেখতে পারব। চাঁদ না থাকলে তারা। আর পরাণ ভইরা শ্বাস নিবার পারব।
রমজানের কথা শুনে বসের চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। তিনি বোধ হয় আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। আমাকে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বললেন- নাফিস, জাস্ট পারফরম ইউর জব।
চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন তিনি। আমি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। আমার চোখ ভিজে উঠছে না। একফোঁটা পানি নাই। একটুও কান্না আসছে না। তবে কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। ভাবলাম- ফাঁসির আয়োজন দেখে আমি যদি আমার অধস্তন কর্মকর্তার মতো ফিট হয়ে পড়ে যেতে পারতাম, তাহলে ভালো হতো। কিন্তু মনে হচ্ছে আমি খুব স্বাভাবিকই আছি। রমজানের জন্য কোনো দুঃখবোধ হচ্ছে না। আমার হাত-পা, চোখ-কান, অস্থি-মজ্জা সবকিছু কত সচল! খুব স্বাভাবিক কণ্ঠেই রমজানকে জিজ্ঞেস করলাম- দুনিয়ার এই বিচারই শেষ বিচার নয়, রমজান। মরার পরেও বিচার আছে। সত্যি করে বলো তো, তুমি দোষী না নির্দোষ?
স্যার, এই মুহূর্তে, আমার বিশ্বাস কেউ মিছা কথা কয় না। আমি কোটে কইছি, অহনো কই- চাচাকে আমি রাগের মাথায় লাঠি দিয়া বাড়ি দিছিলাম- এ কথা ঠিক। তখন ভাবি নাই যে হে মইরা যাইবো। তবে প্রথমে হে-ই আমারে লাঠি দিয়া বাড়ি মারছিল, আমি মরি নাই। চাচা মইরা গেল। তবে একথা ঠিক তার ওপর আমার খুব রাগ আছিল। ছোটবেলায় বাবা মইরা যাওয়ার পর হে আমাগো ওপরে অনেক অত্যাচার নির্যাতন করছে। জমিজমা সব কাইড়া নিছে। ভিটা থেইকাও তাড়ায়া দিবার আয়োজন করছিল। এই নিয়াই ঝগড়া। তারপর ...
তোমার উকিল ছিল না?
ছিল, তয় না থাহনেরই লাহান। লোকটা আস্ত একটা চামার। পয়সা ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না। মায় তারে পয়সাপাতি তেমন দিবার পারে নাই। উকিল সাবও আমারে নিয়া তেমন ভাবছে বইলা মনে অয় না। শেষের দিকে হে নাকি কোটে আইতেই চাইতো না। মায় তারে হাতেপায়ে ধইরা কান্নাকাটি কইরা নিয়া আইতো।
বিয়া করেছিলে? ছেলেমেয়ে আছে?
আছে। ফাঁসির রায় অওনের পর বউডা আবার বিয়া বইছে। একটা মায়া আছে স্যার। তহন অনেক ছোট ছিল। অহন ৭ বছরে পা দিছে। এই তো আইজ সকালে মায় নিয়া আইছিল। আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল কইরা চাইয়া রইল। তারে দেইখা আমি চোখের পানি ধইরা রাখতে পারি নাই। এই মুহূর্তে মায়াডার মুখ কেন যানি বারবার ভাইসা উঠছে চোখের সামনে।
হু হু করে উঠল রমজান। আবার মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিলো। তারপর সে বলল- স্যার আমার একটা বোন আছে। আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। অবশ্য অনেক দূরে থাকে। আমার মাকে কইবেন তারে যানি আমার ফাঁসির কথা না কয়। তাইলে হে সহ্য করতে পারব না। গলায় ফাঁসিও দিয়া হালাইতে পারে। আর একটা কথা, স্যার, আমার লাশটা নিবার জন্য মায় আইব। রোগে-শোকে, অভাবে ম্যালা বয়স অইছে তার। লেহাপড়া জানে না। জেলের এই বিষয়-আশয় হে কিছুই বুঝে না। হে আসার সঙ্গে সঙ্গেই যানি আমার লাশটা নিবার পারে, তাকে যানি কিছুই করতে না-অয় হেই ব্যবস্থাডা করতে অইব স্যার।
ঠিক আছে করব।
স্যার আপনার অনেক দয়া। আল্লাহপাক আপনারে আরো বড়ো করুক, দোয়া করি।
চোখ মুছল সে। দু’জন জল্লাদ চলে এলো। ভয়ে রমজানের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগল সে। জল্লাদরা দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেলল তাকে। রমজান বাধা দিল না। বরং তাদের সঙ্গে হেঁটে চলল ফাঁসির মঞ্চের দিকে। জোরে জোরে কলেমা পাঠ করছে সে। তার মাথায় যমটুপি। জল্লাদরা তাকে মঞ্চে দাঁড় করিয়ে ফাঁসির রশিটা, নির্বিঘ্নে পরিয়ে দিলো গলায়। তখনো জোরে জোরে কলেমা পাঠ করছে রমজান। তারপর আমি তার দিকে আর তাকাতে পারিনি। নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
রমজানের লাশ, তার মায়ের কাছে হস্তান্তর করার সহজ ব্যবস্থা করে চলে এসেছি বাসায়। বাসা থেকে অফিসে। আবার অফিস থেকে বাসায়। কাজকর্ম করি। কিন্তু সব সময়ই মনমরা ভাব। কিছুতেই তা দূর হয় না। দুপুরে রুই মাছ দিয়ে ভাত খেতে বসেছি। চোখের সামনে ভেসে উঠল রমজানের মুখ। আর খেতে ইচ্ছে হলো না। রাতেও তাই। খাবার প্লেট নিয়ে বসলেই রমজানের কথা মনে পড়ে। খেতে পারি না।
অফিসের কাজকর্ম করে, নানারকম মানুষের সঙ্গে কথা বলে সময় কেটে যায়। কিন্তু তার পরে আর সময় কাটতে চায় না। মনে হয় সময়টা পাথরের মতো ধমকে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। রাতে ঘুম আসে না চোখে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে রমজান। মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়িমোচ। উস্কোখুস্কো চুল। কোটরাগত চোখ। বুকের হাড়হাড্ডি জেগে। আমি রমজানকে চোখের সামনে থেকে সরাতে চেষ্টা করি। মন থেকে মুছে ফেলতে চেষ্টা করি; কিন্তু পারি না। বারান্দায় গিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকাই। কদিন ধরে খুব জোছনা। এক টুকরো মেঘ নাই আকাশে। যেদিকে তাকাই, খালি ফকফকা জোছনা। ঝিরিঝিরি বাতাস এসে মাথার চুল উড়িয়ে দেয়। বুক ভরে শ্বাস নিই। রমজানের কথা মনে পড়ে- ‘কতদিন খোলা আকাশ দেখি না। চাঁদ দেখি না। তারা দেখি না। দম খালি বন্ধ অইয়া আহে’। চোখ ভিজে ওঠে আমার। মনে হয় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আরো বাতাস প্রয়োজন আমার। আরো বাতাস। পৃথিবীর সবটুকু বাতাস যদি এই বুকের ভেতর ভরে নিতে পারতাম, তাহলে বোধ হয় শান্তি পেতাম।
ইদানীং কারও সঙ্গেই কথা বলতে ইচ্ছে করে না। দিন দিন কেমন যেন বদলে যাচ্ছি আমি। কোনো কিছুই ভালো লাগে না। ওপরে খোলা আকাশ। সন্ধ্যা থেকে জানালায় ঝুলে থাকে গোলগাল চাঁদ। চারপাশে কত খোলামেলা জায়গা। কত চেনাজানা মানুষ। গাছপালা। পাখপাখালি। সবকিছুই ভীষণ অসহ্য লাগে। বারবার মনে হয়- কেউ নাই আমার। ভীষণ নিঃসঙ্গ আমি। ভেতরে শুধুই অস্থিরতা। অশান্তি। যেদিকেই তাকাই ভেসে ওঠে রমজান। রমজানের সেই বিষণ্ণ মুখ।