
সৈয়দ শামসুল হক
সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬) বাংলাদেশের সাহিত্যের এক অকালপ্রয়াত বরপুত্র। সৃষ্টিশীল মানুষেরা, সৃষ্টিক্ষম থাকতেই যদি পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে বিদায় নেন মহাকালের টানে; তাঁর চলে যাওয়া সব সময়ই অপ্রত্যাশিত। গড় আয়ুর বিবেচনায় যত দীর্ঘ জীবনই তিনি লাভ করুন না কেন, তাঁর প্রয়াণ অকালই হয়।
আমার এক শিক্ষক বলতেন, সৈয়দ হক হচ্ছেন- বাংলাদেশের একমাত্র পরিপূর্ণ আধুনিক লেখক, যার সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি, পোশাক-পরিচ্ছদ, কথা বলার ধরন, শব্দচয়ন, জীবনযাপন বিশ্বমানের আধুনিক লেখকদের মতোই, যিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, লেখালেখি কোনো খণ্ডকালীন বিষয় নয়। অন্যান্য কাজের অবসরে আবেগের তোড়ে ভেসে গিয়ে রচিত সাহিত্যকর্মকে তিনি বলতেন, খণ্ডকালীন কাজ। তিনি নিজে এ দেশে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন লেখকদের জন্য এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত- লেখালেখি জীবনভর সাধনার বিষয়। দৈনন্দিন কাজ সেরে একজন চাকরিজীবী যেমন সকাল সকাল নিজের অফিসের জন্য প্রস্তুতি নেন, সৈয়দ হকও তেমনি প্রস্তুতি নিয়ে সকালে লেখার টেবিলে গিয়ে দিন শুরু করতেন, নিয়ম করে।
বাঙালি, বাংলা ভাষা, বাংলা ভাষার প্রবীণ লেখক, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাস ও আত্মনিবেদন ছিল অকৃত্রিম। তাঁর গোটা সাহিত্যকর্মে বাংলা ও বাঙালিত্বের গভীরতা প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর পক্ষেই বলা সম্ভব হয়েছে, ‘আমারও সংসার হবে/শিল্পের সংসার। চন্দ্রবতী হবে বোন।’ এক সাক্ষাৎকারে তিনি আমাদের বলেছিলেন, ‘কবিতার উপাদান নিতে আমি ইউরোপের কাছে যাইনি।’ এর আগে আরও এক সাক্ষাৎকারে আমাদের দেশের সাহিত্যকদের বিদেশি সাহিত্য-নির্ভরতা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন- ‘আমাদের কজন লেখক গোটা বঙ্কিম পড়েছেন, গোটা মাইকেল পড়েছেন, গোটা রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন?’
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা এই লেখকের সঙ্গে আমার পরিচয় একাডেমিক কাজে-গবেষণাসূত্রে। ২০০৬ সালে এমএ-তে থিসিস করার সুযোগ পেয়েছিলাম। একাডেমিক কমিটি কর্তৃক নির্ধারিত বিষয় ছিল ‘সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায় প্রেম ও নিসর্গ।’ তখন সৈয়দ হকের সব কবিতার বই রাজশাহীতে পাওয়া যায় না। অনেক খুঁজে নিউমার্কেটের বইপত্র থেকে সংগ্রহ করেছিলাম তাঁর কবিতাসংগ্রহ দুই খণ্ড এবং হৃৎকলমের টানে দুই খণ্ড, মার্জিনে মন্তব্য, কথা সামান্যই ইত্যাদি। কবিতা পড়ার আগে তাঁর গদ্যের বইগুলো পড়েছিলাম। সৈয়দ হকের কবিসত্তা ও চিন্তার জগৎ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে তা সহায়তা করেছিল। জানতে পারি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের শিক্ষক মোস্তফা তারিকুল আহসান সৈয়দ হকের জীবন ও সাহিত্য কর্মের ওপর গবেষণা করে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন। সেই অভিসন্দর্ভটি দেখার সৌভাগ্য হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে। গবেষক ও অধ্যাপক মোস্তফা তারিকুল আহসান কেবল রচনাসমগ্র ও শ্রেষ্ঠ কবিতাকে আকর গ্রন্থ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আমার ইচ্ছা প্রতিটি কাব্যগ্রন্থের সঙ্গে আলাদাভাবে পরিচিত হওয়া। রাজশাহীতে সেই সুযোগ নেই। ঢাকায় আমাকে যেতেই হবে সৈয়দ হকের বইয়ের খোঁজে। তাই মিশন শুরু, গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার ও বাংলা একাডেমি গ্রন্থাগারে। এই দুই লাইব্রেরির সহায়তায় শেষ পর্যন্ত কবিতা সংগ্রহ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুলোর মধ্য থেকে কোন কবিতা থেকে কোন কবিতা পর্যন্ত কোন কাব্যের, তা বিভাজন করতে সমর্থ হই। এরপর কবির সঙ্গে দেখা করার প্রবল আগ্রহ তৈরি হলো; সৈয়দ হকের মোবাইলে যোগাযোগ হলো। ঢাকার পথ-ঘাট চেনা নেই। সুতরাং এক ঢাকাবাসী বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে সৈয়দ হকের গুলশানের মঞ্জুবাড়িতে পৌঁছলাম।
দেখা হতেই বললেন, বাইরে একটা মিটিং আছে। যা বলবে দ্রুত বলো। বেশি সময় হাতে নেই। অনুমতি নিয়ে রেকর্ডারে চাপ দিয়ে শুরু করলাম কথা। তাঁর বসার ঘরে বসার কিছুক্ষণ পরই তিনি এলেন। এর কিছুক্ষণ পর এলো রসগোল্লা, খই, পায়েস, চা!
আমি সাক্ষাৎকার নেওয়ার সব প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলাম, সেটা গোপন করে এ-কথা, সে-কথায় ১ ঘণ্টা ৩৮ মিনিটের এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিই সেদিন। আমার মতো এক সাহিত্যের ছাত্রকে, সাহিত্যের ‘স’ কবিতার ‘ক’ বুঝি না যখন আমি, তার সঙ্গে এত দীর্ঘ সময় কথা বললেন- কোনো বিরক্তি ছাড়া! কোনো প্রশ্নই এড়িয়ে গেলেন না। বরং জবাব দিলেন যথাযথ। সেদিনই জানতে পারলাম, সৈয়দ শামসুল হকের প্রেমের কবিতা নামে যে গ্রন্থটি তখন বাজারে, সেটা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। কোন প্রকাশক বের করেছে, তাও তিনি জানেন না। বিখ্যাত লেখকদের অনুমতি ছাড়াও যে তাঁদের পূর্বপ্রকাশিত লেখা প্রকাশকেরা প্রকাশ করে থাকেন, সেটিও জানা ছিল না আমার।
২০০৬ সালে তাঁর সঙ্গে গড়ে ওঠা সেই সম্পর্ক ২০১৬ সালে তাঁর মহাকালের ঠিকানায় প্রস্থানের আগপর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ২০০৮ সালে ঢাকায় স্থায়ী হওয়ার পর আমি প্রতি বছর ২৭ ডিসেম্বর সকালে, তাঁর জন্মদিনে ফোন করেছি। রিসিভ করেই বলতেন, সাদী, বলো। শুভ জন্মদিন বলতেই, কখন আসবে? আমিও শাহবাগ থেকে একটা ফুলের তোড়া নিয়ে চলে যেতাম তাঁর বাড়িতে। খুব স্নিগ্ধতায় ভরা থাকত তাঁর মুখাবয়ব। দলে দলে আসছেন কবির ভক্তরা-অনুরাগীরা। তিনি গ্রহণ করছেন, ফুলের তোড়া। কখনো কখনো সুবাস নেওয়ার চেষ্টা করছেন শিশুর মতো। তবে তাঁকে কখনো কোনো বিষয়ে উচ্ছ্বসিত হতে আমি দেখিনি। ২০১১ সালে আমার থিসিসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। তাঁর হাতে তুলে দিই। হাতে নিয়ে শুধু বললেন, বাহ। ব্যস, এতটুকুই। এ নিয়ে তিনি আর কোনো কথা বলেননি। তবে আনন্দিত যে হয়েছিলেন, তা স্পষ্ট বুঝি, যখন তাঁকে বলি, আমার বইটি হাতে একটা ছবি তুলতে চাই। আমার একটা স্মৃতি হয়ে থাকুক। সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটা শিশুসুলভ ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে বইটি নিয়ে পড়ার মতো করে ধরলেন। তাঁর মহাপ্রস্থানের পর ছেলে দ্বিতীয় সৈয়দ হকের কাছে জেনেছি, তিনি তাঁর মুঠোফোনে আমার মুঠোফোন নম্বর সেভ করে রেখেছিলেন, ‘মাই পোয়েমস ক্রিটিক’ হিসেবে।
২০১৬ সালে তিনি অসুস্থ জেনে খুবই বেদনাহত হয়েছিলাম। লন্ডনে চলে গিয়েছেন চিকিৎসার জন্য। ক্যান্সার। ভাবলাম আমার আশঙ্কা যেন সত্যি না হয়। বন্ধু গোলাম রব্বানীকে বললাম, বয়স তো আশি। তাই ভয় লাগছে। সে বলল, কী করা যায়? বললাম, একটা এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার নিতে হবে। আমি প্রশ্ন দেব তোমাকে। তুমি রেকর্ড করবে। সে যেহেতু বিচক্ষণ, তাই আমাকে না জানিয়ে আমার ধারণার চেয়ে ভালো একটা কিছু কাজ করে ফেলল। সৈয়দ হক আর তাঁর লেখকজীবনের উঠতিকালের বন্ধু আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে সে পাশাপাশি বসিয়ে দেয়। আলাপ তাঁরাই করেছেন। সে কেবল রেকর্ড করেছে। দীর্ঘ সেই সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ নিয়ে সে তৈরি করে ফেলে বন্ধুত্ব ও জীবন নামে আলাপচারিতা-নির্ভর একটি তথ্যচিত্র। তথ্যচিত্রের সেই আলাপচারিতা আমার গ্রন্থনায় ২৪ জুন প্রথম আলোর সাহিত্যপাতায় প্রকাশিত হয়। তথ্যচিত্রটি প্রকাশিত হয় কয়েকটি গণমাধ্যমে।
সৈয়দ হক যখন চিকিৎসকদের শেষ চিকিৎসার আশ্বাসহীনতায় দেশে পৌঁছেন, আমি তাঁর হীনস্বাস্থ্যের কথা জেনে আর তাঁর কাছে যাওয়ার সাহস করিনি। মনে মনে প্রার্থনা করেছি, সব শঙ্কাকে ছাপিয়ে যেন তিনি টিকে থাকেন সক্রিয় সৃষ্টিমুখরতায়। তিনি সেদিন কথোপকথন শেষ করেছিলেন তাঁর আমার পরিচয় কবিতা আবৃত্তি করতে করতে, ‘পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের-/ কখনোই ভয় করিনাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের। /...এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান?/ যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;/ তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-/ চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।’ একপর্যায়ে গাফ্ফার চৌধুরী সৈয়দ হককে বললেন, বন্ধু, এটা শেষ দেখাও হতে পারে; কিন্তু তিনি কিছুতেই এটা মানতে পারছিলেন না। তাঁর কণ্ঠে ছিল বেঁচে থাকার প্রবল বিশ্বাস। মৃত্যুর ছোবলকে সেদিন অস্বীকার করে তিনি বলছিলেন, ‘নাহ, নাহ! অবশ্যই দেখা হবে! মৃত্যুর কথা এত বলতে নেই।’ অথচ আমাদের সকল আশার হন্তারক হয়ে মৃত্যু কেড়ে নিয়ে গেল শেষবার শ্বাস নেওয়ার আগপর্যন্ত অবিচল ও সক্রিয় এক করোটির অধিকর্তাকে-বাংলা সাহিত্যের এক অমর স্রষ্টাকে।
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মস্তিষ্ককে কর্মক্ষম রেখে দিয়ে গেলেন কবিতার নতুন মণিমানিক্য। তাঁর পক্ষেই বলা সম্ভব, ‘আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে!/আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।/আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে/আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।’