কিংবদন্তির ক্র্যাক প্লাটুন মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা দল

অলকানন্দা রায়
প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৬:৪৭

১৯৭১ স্বাধীনচেতা বাঙালির রক্তে নেচে উঠেছিল স্বাধিকারের আগুন। বেজে উঠেছিল যুদ্ধের দামামা। আক্রান্ত হয়ে নিরস্ত্র জাতি খুঁজে নিয়েছিল যুদ্ধের আক্রমণ কৌশল। গড়ে ওঠে দুর্ধর্ষ সব বাহিনী। তেমনি যুদ্ধকালীন পাকিস্তানি দোসরদের এক ত্রাস বাহিনী ক্র্যাক প্লাটুন।
পাকিস্তানি শত্রু জর্জরিত মাতৃভূমি ও জনগণের স্বাধীনতা রক্ষায় ঢাকা শহরে অতর্কিতে আক্রমণ পরিচালনা করার লক্ষ্যে একদল কিশোর-তরুণ মুক্তিযোদ্ধা গড়ে তোলেন এই বাহিনী। এই দলটির গড়ে ওঠায় প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন বীরউত্তম খালেদ মোশাররফ, বীরউত্তম এটিএম হায়দার। তাদের নেতৃত্বে ২নং সেক্টরের অধীনে ভারতের মেলাঘরে প্রশিক্ষণ নিয়ে ‘হিট অ্যান্ড রান’ এই মন্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন শহরের কেন্দ্রগুলো দখল করে রাখা শত্রুদের ওপর। অসীম সাহস আর বিক্রমে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি শত্রুদের আস্ফালন। ঢাকায় পাকিস্তানিসেনাদের ওপর নিত্য নতুন কৌশলে বার বার আঘাত হেনে তাদের ভিত নড়বড়ে করে দেয়। সারা বিশ্বকে জানান দিতে সক্ষম হয়েছিল পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র। তারা তাদের প্রতিটি হিট অ্যান্ড রান আঘাতে বুঝিয়ে দিত বাঙালিরা দমবার পাত্র নয়। তারা এ লড়াই চালিয়ে যাবে এবং জয়ী হবেই।
সেই অদম্য তরুণ-কিশোররাই ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরাই বা গেরিলা ‘বিচ্ছু বাহিনী’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন, তৎকালীন ঢাকাবাসীরা তাদের সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে এই নাম দিয়েছিলেন।
১৯৭১ সালের জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে ক্র্যাক প্লাটুন ছিল পাকিস্তান আর্মির কাছে অপ্রতিরোধ্য এক ত্রাসের নাম! যারা অতর্কিতে আক্রমণ করে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল শত্রুসেনাদের মনোবল। অনেক সাহসী তরুণ সদস্যদের নিয়েই গঠিত হয়েছিল ক্র্যাক প্লাটুন। তবে প্রাথমিকভাবে গঠিত দলের ১৭ জন সদস্য ঢাকায় অপারেশনের জন্য আসেন। ক্রমান্বয়ে ক্র্যাক প্লাটুন দলের সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। এই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন শহীদ শফি ইমাম রুমী, শহীদ মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ, শহীদ বদিউল আলম বদি, শহীদ আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল, শহীদ মোহাম্মদ আবু বকর, শহীদ আলতাফ মাহমুদ, আহমেদ মুনীর ভাষণ, আজম খান, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, লিনু বিল্লাহ এবং আরও অনেকেই।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঢাকায় এই ক্র্যাক প্লাটুন বাহিনী ছোট বড় মোট ৮২টি দুঃসাহসিক গেরিলা অভিযান পরিচালনা করেছিল। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- অপারেশন হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল, অপারেশন এলিফ্যান্ট রোড পাওয়ার স্টেশন, অপারেশন যাত্রাবাড়ী পাওয়ার স্টেশন, অপারেশন ফার্মগেট চেক পয়েন্ট, অ্যাটাক অন দ্য মুভ, ডেস্টিনেশন আননোন প্রভৃতি। এসব গেরিলা অপারেশনের মাধ্যমে ক্র্যাক প্লাটুন বাহিনী পাকিস্তানিসেনা এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের মধ্যে চরম আতংক ও ভীতির সঞ্চার করতে পেরেছিল। তারাই রচনা করেছিল মুক্তিযুদ্ধের নতুন আর এক ইতিহাস গেরিলা যুদ্ধ।
এই অসীম সাহসী বাহিনীর হামলাগুলোর মাধ্যমেই বিশ্ববাসীর দুয়ারে পৌঁছে যায়, এই দেশে একটি স্বাধিকার আন্দোলন তথা অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ চলছে। বিশ্ববাসী আসল সত্যটা জেনে যায় এবং পাকিস্তানিরা চাপের মুখে পড়তে শুরু করে। একে একে বানচাল হতে থাকে পাকিস্তানি সরকারের কূট কৌশল।
এরপর ক্র্যাক প্লাটুন বাহিনীর অতর্কিত হামলায় দিশেহারা হয়ে পাক আর্মি এদের ধরতে পুরো ঢাকা শহর চষে বেড়ায়। এমনকি তারা এদের ধরে দেওয়ার জন্য দুই হাজার টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করে। ১১ আগস্টের হামলার পর পাকিস্তানি বাহিনীর চিরুনি অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে এবং এদেশীয় কিছু কুখ্যাত রাজাকার, আলবদর দোসরদের সহযোগিতায় ধরা পড়ে যায় বিচ্ছু বাহিনীর সদস্যরা! ১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট। রেইড চালিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রায় ১৫ জন গেরিলা যোদ্ধাকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের ধরে টর্চার সেলে নিয়ে নির্মমভাবে অবর্ণনীয় অত্যাচার চালায়।
নিষ্ঠুর টর্চারের মুখোমুখি হয়েও তারা একজনও মুখ খোলেননি এবং নতি স্বীকার করেননি শত্রুপক্ষের কাছে। পরবর্তী সময়ে এই সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে নয়জনের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি! আমাদের স্বাধীনতার আস্বাদ পাইয়ে দিতে গিয়ে, তারা অকাতরে জীবন উৎসর্গ করেছেন।