Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

উৎপলকুমার বসু

শাশ্বত সম্ভাবনার বিন্যাস

Icon

চঞ্চল নাঈম

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২১, ১৫:১৬

শাশ্বত সম্ভাবনার বিন্যাস

উৎপলকুমার বসু

দক্ষিণে হাওয়া বয়। পূর্ব থেকে পশ্চিমে হাওয়ার বাঁক। বাঁকের মধ্যে উৎপলের বাক্যচিন্তা অনায়াসে উপলব্ধির ঘুম অতিক্রম করে। উৎপলকুমার বসু ৩ আগস্ট, ১৯৩৭ সালে কলকাতার ভবানীপুরে জন্মগ্রহণ করেন; কিন্তু অল্প বয়সে তার মা মারা যাওয়ায়, ছেলেবেলার অধিকাংশ সময় কেটেছে কুচবিহারের দিনহাটায়, মাসির কাছে। দিনহাটার রূপকার কমল গুহ মহাশয়কে তিনি শিক্ষক হিসেবে পান। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পর উৎপলকুমার বসু আবার কলকাতায় চলে যান। সেইসঙ্গে ছাত্র থাকার সময় থেকে লেখালেখির আত্মপ্রকাশ ঘটে। 

তবে আলোক সরকার, কালীকৃষ্ণ গুহ, প্রকাশ কর্মকার এবং ভূমেন্দ্র গুহের মতো কবিবন্ধুর সঙ্গে যৌথভাবে তিনি এক সময় সম্পাদনা করেছেন কবিতা ও কবিতাবিষয়ক ভাবনার পত্রিকা ‘দরগারোড’; কিন্তু প্রথম দিকে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর কবি হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ৩ অক্টোবর, ২০১৫ সালে কলকাতায়। হাংরি আন্দোলনের কবিতাচিন্তায় নিজেকে যুক্ত করেন আর পাশাপাশি নিজস্ব চৈতন্যের ধারণায় কবিতা লিখতে থাকেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’(১৯৬১) প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাসমূহ বারংবার হৃৎপানিতে খেলা করে। সমসাময়িক কবিতা থেকে তার কবিতার প্রকাশভঙ্গি কিছুটা ভিন্ন। হাংরি আন্দোলনের জন্য ১৯৬৪ সালে উৎপলকুমার বসুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। সেই কারণেই যোগমায়া দেবী কলেজের অধ্যাপনা থেকে তিনি সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন। আর কবিতা লেখা থেকে সাময়িক বিরতি নিয়েছিলেন বটে; কিন্তু কবিতার জন্য কোন পরিস্থিতিতে আপোষ-রফায় স্বাক্ষর করেননি।

তাইতো, তিনি এক সাক্ষাৎকারে কবিতা বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেন, আকাদেমিয়ার থেকে কবিতা অনেক বেশি অরগ্যানিক। বিশেষত, আমি এবং আরও হাতে গোনা কয়েকজন এই অরগ্যানিক ব্যাপার-স্যাপারগুলোকে ছুঁতে চেয়েছি। একই সাক্ষাৎকারে তিনি প্রেম বা কাম সম্পর্কে দৃষ্টিপাত করেন। মেটাফিজিকসেরও বিরাট গুরুত্ব এইখানে। এখানে বলতে ভারতবর্ষে। এখানকার শিল্পচর্চার মেটাফিজিক্যাল বোধ ইন্দ্রিয় চেতনায় বরাবর খুবই কেন্দ্রে থেকেছে। মেটাফিজিকসের চর্চা ভারতবর্ষীয়রা বারংবার করেছে। স্থাপত্য, ভাষ্কর্য থেকে শুরু করে মহাকাব্যেও।

কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরের প্রাক্তন অধ্যক্ষ শ্যামলবাবুর সঙ্গে কথা হচ্ছিলো। আমি ওনাকে বলছিলাম ভারতীয় মন্দির শিল্পে এত কিছু আছে। কামকলা আছে, শিকার আছে অথচ কৃষি নেই। এগুলোই হচ্ছে ব্যাপার।

যামিনী রায় বলতেন, সারা পৃথিবী দু’ভাগে ভাগ ভারত এবং অ-ভারত। এখানে আমার একটা সংযোজন আছে। ভারতবর্ষীরা কখনোই এটা ভারত ওটা অ-ভারত এসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি। ভারতবর্ষ একটা বিচিত্র দেশ। আমরা নতুন কিছু দেখলে বিস্মৃতি হয়েছি। নতুন কিছু কীভাবে আত্মস্থ করা যাবে, ভেবেছি যেহেতু আমাদের চিন্তা অরগ্যানিক। ইন্দ্রিয়চেতনা আমাদের স্মৃতি-বিস্মৃতির মধ্যে রয়েছে। তাই আমরা আরোহন করতে পারি আর এ জন্যই আমাদের ভাবনা বিস্তর। এই যে এতসব কথাবার্তা তুলে আনলাম। তার কারণ উৎপলকুমার বসুর সমকালীন অভিজ্ঞতা আর চিরন্তন অনুভূতিকে বোঝার জন্য। বুঝতে পারি, বাংলা কবিতায় সহজ-সরল অনন্য রচনাশৈলী তৈরীতে তার ভূমিকা অন্যতম। চিন্তার ভাঙচুর আর কবিতার ভাষা নিয়ে তার নিবিড় ভাঙাগড়ার খেলা- কবিতাকে অন্যরকম স্বাধীনতা দিয়েছে। তাইতো কোনও নির্দিষ্ট প্রজন্মের চাহিদায় আবদ্ধ না হয়ে তার কবিতা ও গদ্যসমূহ, প্রজন্মোত্তর সৃষ্টিশীল মননের রসদ যোগায় সব পাঠকেরই।

তাই চিরকালীন কবিতা প্রেমী আপামর বাঙালিরা তাঁর কবিতার স্বর শুনেছেন- ‘ডুবো নদীর তীরে জলের অধিকারে আঙুল ছোঁয়ার স্পর্ধা পেয়েছে’। এমন সব অনুভূতি সাবলীলভাবে জগৎ-জীবনকে গ্রহণ বর্জনের প্রকাশভঙ্গিতে দেখার ভিন্নতায় আনয়ন করেন। চিরচেনা প্রকরণ ভেঙে উৎপলের কবিতাগুলো নানান অভিজ্ঞতার অবয়বে ভাসে- ‘রূপনগরেতে চলো।/ সে-দেশে ধুলোয় সবার নিভৃত নাম লেখা আছে।/ যে-নামে তোমায় পুরনো বন্ধুরা চেনে এখনি বাতাস/ সেই নাম ডেকে গেল।/ রূপনগরের পাঁচিলে না হয় বসো/ কিছুক্ষণ- দুটি পায়রার পাশাপাশি।’ (প্রান্তর থেকে : চৈত্রে রচিত কবিতা) রূপনগরে কার নাম লেখা আছে? আর কে সেই বাতাস যে নাম ধরে ডেকে গেল? তারই কি উদ্দেশ্য ছিল? এমন বহুরূপ প্রশ্ন রূপনগরের পাঁচিলে বসে। হয়তো কিছুক্ষণ কথা হয়, হৃদয়ের নিভৃতে যেন কাছাকাছি বসে।

উৎপলকুমার বসু এমনই এক কবি, যিনি পাঠকের চেনা জগৎকে পুনরায় উসকে দিতে পারেন স্মৃতির স্পষ্টতায়, চিরন্তন মানবিক সংবেদনশীলতায়। পাঠক নিজস্ব অনুভব খুঁজতে থাকেন কবিতার নানাবিধ পঙক্তিতে- ‘ফিরে এসো লেখার টেবিলে। এইখানে জন্মেছিলে।/ এখানেই শেষ দেখে যেও।/ যারা বোধি নিয়ে কথা বলে, বোধবুদ্ধি নিয়ে/ হাসিঠাট্টা করে, তারা হে কেমন লোক?/ যে-প্রাণ নিভৃত হয় তাকে সখা আমিও দেখছি।/ লেখার টেবিল যেন, পড়ে আছে ভাঙাচোরা সন্ধ্যার বাগানে।’ (সৌরলতা)

কবিতার পঙক্তিসমূহ ইঙ্গিতপূর্ণ। যেন কবিতাকেই ফিরে আসার আহ্বান করেছেন। সচেতনভাবেই বিস্তীর্ণ করেছেন কবিতা-সম্পর্ক। প্রকরণগত কবিতার ধারণা দুর্বোধ্য বা রহস্যময় না করে বলে গেলেন সমসাময়িক নিজের আখ্যান। আর সেইসঙ্গে পাঠকের নিকটে শাশ্বত সম্ভাবনার পথ মেলে ধরেন এবং তাঁর কবিতার স্বপ্ন-পথে ধু ধু বিন্যাসের একাধিক আবহ থাকে- ‘সমস্ত সন্ধ্যা ভরে লুব্ধকের পিছু পিছু দেখা যায় সমুদ্রমন্দির/ টানো তুমি, এখন সন্ধ্যা ভরে অদ্ভুত জোয়ার এল, বসন্তও সমাগত ঐ/ তোমার বিশাল বাড়ি ভেঙে ফেলে লাখো লাখো জানালা উঠেছে/ বসন্তকর্ণিক হাতে কারিগর পুরুষ এনেছি।’  (পুরী সিরিজ)

নিজস্ব ঢঙ আর শব্দের মনোরঞ্জনে কবিতার সমাগত পথে একা একা হেঁটে চলেন। কবিতার শব্দগুলো সচেতনভাবে প্রেমময় বসন্তের কারিগর হয়ে ওঠে। এভাবেই কবিতার প্রতিটি ইঙ্গিত স্পন্দনে চুরমার করে সুহৃদ-আকুতি। আর দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে আসে লাখো লাখো দৃশ্য। প্রতিটি দৃশ্য যেন কবিতার পরম্পরা। তাই দৃশ্যমান সরল লিখনভঙ্গিমায়, উৎপলকুমার বসু অন্যের থেকে পাঠকের নিকট আগ্রহের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন। 

বাংলাদেশের জাতীয় কবিতা উৎসবের আমন্ত্রণে উৎপলকুমার বসু ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় এসেছিলেন। ৩ ফেব্রুয়ারি, জহির হাসান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক জাহিদ হাসান মাহমুদ যৌথভাবে উৎপলকুমার বসুর এক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি নিজের লেখার অনুষঙ্গ নিয়ে বলেন- ‘আমার লেখায় খুব চিন্তা-টিন্তা কিছু নেই। উচ্চচিন্তা কিচ্ছু নেই। আমার হচ্ছে সাধারণ-যাকে বলে স্ট্রিট রিয়ালিটি। সেসব চিন্তাই আমার লেখায় আছে। উচ্চমার্গীয় কোনো চিন্তা আমার লেখায় নেই।’ কিন্তু আমরা তার লেখায় চলমান জীবনের নানাবিধ বিষয়-আশয় দেখি, যা জীবনানন্দ পরবর্তী কবিতাতে এমন সহজভাবে উপস্থাপন কমই আছে। তবে কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে তাঁর কবিতা ও গদ্যসমূহ দিন দিন পাঠকের চলমান মুখরতার সম্ভাবনা।

লেখক : কবি

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫