
দস্তয়েভস্কির ছবি অবলম্বনে গ্রাফিক্স
আমার প্রিয় রাশান লেখক দস্তয়েভস্কি। তার সেরা বইগুলো কেবল মানুষের আত্মার গভীর পরীক্ষাই নয়, বরং কদর্য, হিংসাত্মক, বিদ্রূপাত্মক, জ্বালাময়ী আর মাঝে মাঝে খুব মজার। সম্প্রতি আমি হেনরি ট্রয়েট-এর ‘ফায়ারব্র্যান্ড’র প্রসঙ্গ তুলি। এটি আসলে দস্তয়েভস্কির জীবনের একটা পুরনো দিনের উপন্যাসীয় বিবরণ।
বইটি পড়া মানে দুর্দান্ত ব্যাপারই বটে। এটি পাঠ করে আহ্বলাদিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই; সাথে সাথে আমার চাওয়া—তাকগুলোতে থাকা কিছু দস্তয়েভস্কি বিষয়ক ভারী বই সরিয়ে ফেলার। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচিত চিঠি ও কনস্ট্যান্টিন মোচুলস্কির সমালোচনামূলক জীবনী; যা কিনা বড্ড নিরস। (পরবর্তীতে আমি জোসেফ ফ্রাঙ্কের পাঁচ-খণ্ডের মহাকাব্য সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিই)।
হতে পারে এটা বেশ আকর্ষণীয় পর্যবেক্ষণ। আমাদের ভাবায়—একই উৎস-উপকরণে প্রস্তুত বিভিন্ন খণ্ড ও নিরস সমালোচনামূলক কাজগুলো। আমার মনে পড়ে দস্তয়েভস্কির নাটুকে জীবনের গল্প: পিতার হত্যাকাণ্ড, তার কৌতুকময় মৃত্যুদণ্ড ও নির্বাসন। জুয়ার প্রতি উন্মাদনা ও সেন্ট পিটার্সবার্গের সাহিত্যপটে বিপর্যয়কর আত্মপ্রকাশ নজরে আসে।
যারা জানে না গল্পটি তাদের বলি। দস্তয়েভস্কির প্রথম উপন্যাস ‘পুওর ফোক’ প্রকাশের আগে ভিসারিয়ন বেলিনস্কি নামে একজন কিংবদন্তিতুল্য সমালোচকের কাছে পাঠানো হয়েছিল। ওই ব্যাক্তি অনতিবিলম্বে ঘোষণা করেন-দস্তয়েভস্কিই গোগোলের উত্তরসূরী। এটা বাজে কথা। ‘পুওর ফোক’ হচ্ছে একটা মর্মস্পর্শী গল্প। একই লেখক যদি ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ ইত্যাদি না লিখতেন তাহলে এটা আবিষ্কারই হতো না।
তবু সহসা চব্বিশ বছর বয়সী ফিউদর দস্তয়েভস্কি সেন্ট পিটার্সবার্গের নতুন সাহিত্যিক প্রতিভা হিসেবে সর্বত্র সমাদৃত হন। যখন তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য ডাবল’ বের হয় তখন তাঁর থেকে নতুন নতুন সাহিত্যিক বন্ধু সটকে পড়েন। সবাই তাকে একঘরে করে ফেলেন। ‘দ্য ডাবল’ নিয়ে বন্ধুরা সুযোগমত প্রতিশোধ নেন। বইটি আবর্জনা বলে নিন্দা করেন। বাজে রসিকতার উপাদান হয়ে ওঠেন দস্তয়েভস্কি ।
আমি এখন পর্যন্ত যা জানি না তা হচ্ছে, তার গৌরব ও ভয়ানক পতন কতটুকুন সময়ের মধ্যে ঘটেছিল? তখনকার লেখকরা আজকের তুলনায় অনেক বেশি দ্রুত লিখেছিলেন। আর মিলান কুন্ডেরা একটি উপন্যাসিকা লিখতে যে রকম সময় নিতেন— তার চার ভাগের একভাগ সময়ের মধ্যে উনিশ শতকের অসম্ভব মোটা বইগুলোর মধ্যে কয়েকটি রচিত হয়েছিল। এটি মাথায় রাখুন, আর একটু আন্দাজ করুন: ফিউদর দস্তয়েভস্কির সমাদর কতক্ষণ স্থায়ীত্ব পেয়েছিল? একবছর? নয় মাস? ছয়? তিন?
সঠিক উত্তর হচ্ছে মাত্র পনেরো দিন। ১৫ জানুয়ারি ১৮৪৬ সালে ‘পুওর ফোক’ প্রকাশিত হয়; আর ‘দ্য ডাবল’ একই পথ ধরে প্রকাশ পায় ৩০ জানুয়ারি। দেখুন খ্যাতির মোহ কতটা!
সে সময়ে এটা যে কোনো ধরনের রেকর্ড । তিনি তের বছর পর দীর্ঘ নির্বাসন থেকে বেরিয়ে আসেন আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস নিয়ে। আর তার নাম ‘হাউস অফ দ্য ডেড’। পূর্বের মতই তিনি প্রত্যাবর্তন করতে চেয়েছিলেন। তবে মোচুলস্কির মতে, দস্তয়েভস্কি তাঁর আত্মবিশ্বাস ফিরে পাননি। এমনকি তিনি যখন বিশ্বসাহিত্যের সেরা কিছু বই লিখেছিলেন—তখনো তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন যে এখনো তার খ্যাতি প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি"।
যাই হোক, এটা আমাকে বিস্মিত করেছিল: ১৮৪৬ সালের জানুয়ারিতে দস্তয়েভস্কির মতো এতটা বিপর্যয়কর পতন কি আর কারো হয়েছে? (কেউ এমন পুনরুত্থান অনুভব করেনি, এটা সুনিশ্চিত)।
আমার মাথায় প্রথম লেখক ছিলেন মার্টিন অ্যামিস। সমালোচকরা তার শুরু দিকের বইগুলো পছন্দ করতেন, কিন্তু তার পরের প্রয়াসে জোরালো লাথি দেওয়া একটি জাতীয় খেলায় পরিণত হয়। তবে আমিসের সেই অবস্থানে পৌঁছতে কয়েক দশক সময় লাগে, আর তিনি প্রবল বিশ্বাস করতেন যে উত্তরোত্তর আরো সমাদৃত হবেন।
অনেক লেখক মারা যাওয়ার পর দ্রুত পতনের শিকার হন। অবশ্যই সমারসেট মম একসময় সর্বব্যাপী ছিলেন; এখন তা নেই। এটা প্রমাণ নিতে সত্তর, আশি এমনকি নব্বইয়ের দশকে আপনি সাপ্তাহিক ভাবে রবিবারের কাগজের পাতায় অ্যান্থনি পাওয়েলের মুখোমুখি হওয়ার উপর নির্ভর করতে পারেন। এই ব্যাক্তির খ্যাতি ক্রমবর্ধমান। কারণ তিনি কিছু কীটের সাথে দেখা করতে যেতেন! তারপরও কিছু লোক তাঁকে নিয়ে যত্ন-আত্তি করতেন। ‘এ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ’র স্থায়ী জনপ্রিয়তা না হলে, আরো একবার ‘পালিত’ অ্যান্থনি সম্পর্কেও একই কথা বলা যেতে পারে।
আসলে আমাদের সমুখে উপস্থিত কসাইয়ের খ্যাতির ক্ষেত্রগুলো জরিপ করে এক মজার অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে।দস্তয়েভস্কি বিষয়ক হাল আমলের একটা ভালো নজির— লন্ডনস্তানি লেখক গৌতম মালকানি।
তার ব্যাপক প্রচার। তার বইয়ের ৩৮০,০০০ পাউন্ড মূল্যে অগ্রিম বিক্রি-বাট্টা। এমন বিক্রির ঘটনা আসলে খুব কমই ঘটেছে। মানুষ তার ওপর প্রশ্রাব শুরু করার আগ পর্যন্ত তিনি কিন্তু দ্বিতীয় বইটি আর লিখতেই পারেননি। ২০০৭ সালের মে মাসের পর থেকে তার ওয়েবসাইট আপডেট করা হয়নি। বেশিরভাগ লোকের মতো আমিও বইটি পড়িনি, তাই মালকানির ভাগ্য ন্যায্য কিনা তা নিয়ে আমি মন্তব্য করতে পারছি না।
তবে তাকে অসম্ভব উচ্চাভিলাসী (ইচ্ছাকৃতভাবে) বলে মনে হচ্ছে। আর একটি বইয়ে বহুসংস্কৃতির লন্ডন সম্পর্কে প্রচুর দোষারোপ করে একটি নতুন ব্রিক লেন অথবা হোয়াইট টিথ সেনসেশন তৈরি করার জন্য অমৌলিক প্রকাশনা স্লাভিশলি’র এটি একটি অপচেষ্টামাত্র। এতে তাকে দোষ দেয়া যায় না। তারা আসলে বোকা ছিল।
তবে কি খ্যাতির পতন, নাকি এটা কেবল বুদবুদের শব্দ? নাকি খ্যাতির সূচনা? দস্তয়েভস্কির ক্ষেত্রে যেটি ঘটেছিল: ‘পুওর ফোক’ প্রকাশিত হওয়ার আগেই তাঁর বয়সের সবচেয়ে বিখ্যাত সমালোচক তাকে ‘প্রতিভা’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। তবুও, অন্তত মালকানি এই সত্যে সান্ত্বনা পেতে পারেন যে তাঁর বিশাল অগ্রগতি আর তাঁর কাছ থেকে ফিরে পাওয়া যাবে না। কেউ তাঁকে কঠোর পরিশ্রমে পাঠাবার আগে গুলি করার হুমকি দেবে না-যদিও এটি সেই অভিজ্ঞতা যা দস্তয়েভস্কির খ্যাতি রক্ষা করেছিল। আর অবশ্যই তা দীর্ঘমেয়াদে।
-দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া।
লেখক
মূল লেখক : ১৯৭৪ সালে দানিয়েল কালদার স্কটল্যান্ডের ফিফেতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১০ বছর মস্কোতে বসবাস করেন। বর্তমানে টেক্সাসে থাকেন। তিনি লস্ট কসমোনাট ও স্ট্রেঞ্জ টেলিস্কোপস বইয়ের লেখক।]
ভাষান্তরকারী : কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও প্রাচীন আরবী ভাষা-সাহিত্যের গবেষক।