Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

লেখকের দস্তয়েভস্কি

Icon

রুমা মোদক

প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২১, ১৭:১৭

লেখকের  দস্তয়েভস্কি

ফাইল ছবি

দস্তয়েভস্কিকে আমি তিনটি কারণে লেখকদের জন্য অবশ্যপাঠ্য মনে করি; কিন্তু আমি নিজে যখন দস্তয়েভস্কি পাঠে প্রবৃত্ত হই, তখন এই তিনটি কারণ আমার কাছে অনাবিস্কৃত ছিল কিংবা বলা ভালো কোনো কারণ অনুসন্ধানে দস্তয়েভস্কি পাঠে প্রবৃত্ত হইনি। দস্তয়েভস্কি, মানে দ্য ব্রাদার কারমাজোভ, দ্য ইডিয়ট, দ্য গাম্বলার ইত্যাদি; কিন্তু আমার ধারণামতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যা হয়, আমি ব্যতিক্রম নই। 

আমার দস্তয়েভস্কি পাঠ 'ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট' দিয়ে। এবং সে পাঠ, পাঠে কিংবা চর্চায় কেবলই দস্তয়েভস্কি আবশ্যিক জেনে পাঠ। পড়ার ধারাবাহিক যাত্রায় যুক্ত হয়েছে পরবর্তী দস্তয়েভস্কির এসিরু চ গ্রন্থগুলি।

অতঃপর দস্তয়েভস্কিকে যে তিনটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করি, তার প্রথমটি দস্তয়েভস্কির ব্যক্তি জীবন। বেড়ে ওঠার পারিবারিক আবহ এবং রাশিয়ার তৎকালীন  রাজনৈতিক পরিবেশ। যা একজন দস্তয়েভস্কির ব্যক্তিমানস সাহিত্যকর্মে বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছে। মূলত কোনো লেখকই তার ব্যক্তিসত্তাকে অতিক্রম করে নয়। স্বদেশ সমকালও তার জন্য প্রভূত গুরুত্ববহ; কিন্তু একই পারিবারিক ও রাষ্ট্রিক পরিপ্রেক্ষিত সবাইকে দস্তয়েভস্কির মতো লেখক হয়ে উঠতে কার্যকর ভূমিকা রাখে না। দস্তয়েভস্কির লেখক দৃষ্টি তার সহজাত কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির প্রথাগত আর্কিটাইপ ভেঙে দেয়া ব্যতিক্রম। কখনো পাঠকের জন্য বিস্ময়ের, কখনও বিব্রতকর। 

দ্বিতীয়ত তার পর্যবেক্ষণ অন্তর্গত মানুষ নিয়ে, উপর থেকে যে কেতাদুরস্ত ভদ্রলোকটি আমাদের সাধারণে দৃষ্টিগোচর হয়, তিনি তাকে খুঁড়েন ভেতর থেকে। খুঁড়ে আনেন  সকল মঙ্গল নিয়ে মানুষের দেবত্ব আর অন্ধকার নিয়ে মানুষের অসহায়ত্ব। নির্লিপ্ততায় একইসাথে তিনি উন্মোচন করেন মানুষের ক্ষুদ্রতা সংকীর্ণতা, মহত্ত্ব। তার সৃষ্ট  চরিত্রগুলো তাই যেমন প্রথাবদ্ধ সমাজের তৈরি তেমনই নৈতিকতার বোধে আত্মদণ্ডিত। একরৈখিক চরিত্র নির্মাণ তার নয়। মানুষককে ছিঁড়ে খুঁড়ে তিনি এমন কিছু মানুষের মুখোমুখি করেন আমাদের, কৃতকর্ম এবং আত্মদহন নিয়ে যে মানুষ পাঠককেই দাঁড় করিয়ে দেয় নিজের মুখোমুখি। আত্মদহনের আয়নায় যে নিজেকেই আবিষ্কার করে এবং তার অস্তিত্বের ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে দেয়।  

 তার নির্মিত চরিত্র রাস্কোলনিকভ অর্থাভাবে যার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বন্ধ থাকে, কলাম লিখে বা টিউশনি করে যার শুধু অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম, তার মা এবং বোনের জীবন যাপনের অসহায়ত্ব  সবকিছু মিলে এক জটিল ও অনতক্রম্য পরিস্থিতি ও চারিত্রিক স্খলন, যা তাকে হত্যার মতো একটি কাজে প্ররোচিত করে। শেষ পর্যন্ত তার দায় স্বীকার এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্ন পাঠকের কাছে পৌঁছে যায়, শেষ পর্যন্ত মানুষের পাপমুক্তি কী কেবল আত্মদহনে? কিংবা আত্মদহনহীন শাস্তি কী ব্যক্তিমানস কিংবা সমাজ মানসের জন্য কার্যকরী কোনো পন্থা?

আর তৃতীয়ত ব্যক্তির সুকুমারবৃত্তি জাত কর্ম আর কুপ্রবৃত্তিজাত কর্ম উভয়ের দ্বন্দ্বে শেষঅবধি তিনি সুন্দর জীবনেরই জয় ঘোষণা করতে চান। একজন যথার্থ লেখকের দায়ে অসহায় আত্মদণ্ডিত মানুষগুলোকে তিনি তার কাঙ্ক্ষার মতো অসীম সম্ভাবনার ইংগিতে স্থাপন করেন।

প্রথমত দস্তয়েভস্কির জন্ম ও বেড়ে ওঠা বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ায়। জার শাসনামলে। তারচেয়েও বড় কথা বড় বদমেজাজি বাবা আর নরম সরম দয়ালু মায়ের সংসারে বড় হয়ে ওঠার পরিবেশ তাকে জলমাটি দিয়েছিলো বড় হয়ে ওঠার, চিন্তা ও চেতনার জগত তৈরির। পরবর্তীতে কমিউনিস্ট রাজনীতিতে জড়িয়ে। পড়া, জার শাসক কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তি ও ক্ষমা পেয়ে নির্বাসনে যাওয়া এ সবই একজন ফিওদর দস্তয়েভস্কিকে অবচেতনে প্রস্তুত করেছে রাস্কোলনিকভ নামে চরিত্রটি তৈরিতে। একজন ব্যক্তি মানুষ তার ব্যক্তি চরিত্রের নীতি , নৈতিকতা, স্খলন ও গোপন সহ যা কিছু তার দায় পরিবারের যতোটা, ততোধিক এই সমাজের, যেখান থেকে কোনো পাপ কিংবা পবিত্র বোধ জন্ম নেয়। অপরাধ করতে প্ররোচিত করে এবং প্ররোচিত করে অপরাধ স্বীকারেও।

এই অপরাধ এবং দায় স্বীকারের মধ্যবর্তী প্রশ্নটি উত্থাপিত হয় দ্বিতীয় পর্যায়ে। মানুষ এক গতিশীল চলমান সত্ত্বা। পরিবেশ পরিস্থিতি ও সময়ের সাথে তার ধ্যান ধারণা বিশ্বাস বদলে যাওয়া, আত্মোপলব্ধি, আত্মদহন সবই প্রবহমান নদীর মতো স্রোতময়। দস্তয়েভস্কি যেভাবে যাপন করেছেন নিজের জীবন, মদ কিংবা জুয়া থেকে নির্বাসিত জীবন সব অভিজ্ঞতাই তার লেখার অন্তঃসলিলা শক্তি হয়ে সংযুক্ত হয়েছে। মহাকালের স্রোতে জন্ম নেয়া মানুষ, তার জীবদ্দশায় আবর্তনশীল 

সামাজিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে মানুষ কোন স্থির, অপরিবর্তনীয় ধ্রুবক নয়। তাকে নিষ্পাপ দেবত্ব আরোপ কিংবা পঙ্কিল কলুষতা আরোপ উভয়ই একতরফা এবং অবাস্তব। " আমিই খুন করেছি ওই সুদখোর বুড়ি আর তার বোনকে" রাস্কোলনিকভ এর স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে কি ব্যক্তি অপরাধের দায়মুক্তি ঘটে? যে হত্যা জনিত পাপবোধ তাকে পীড়িত করে তা কী তার একারই পাপ?  কেন সে পাপে প্ররোচিত হয়? তার দারিদ্র্য পীড়িত জীবন, জীবনে টিকে থাকার মানবেতর লড়াই, যা এই অসম সমাজ তার উপর চাপিয়ে দিয়েছে তার দায় কেন একা রাস্কোলনিকভের হবে? সমাজ এবং রাষ্ট্রিক পরিস্থিতি কি ব্যক্তি আচরণকে প্রভাবিত করে না? 

তৃতীয়ত পুলিশের কাছে আত্মসপর্ণের আগে প্রেমিকা সোনিয়ার কাছে তার দেয়া স্বীকারোক্তি।

এর মাধ্যমে লেখক এক নতুন বার্তা রেখে যেতে যান ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট এর পাঠকদের কাছে। তা এই যে সোনিয়াই হয়ে উঠেছিল শাস্তির উর্ধ্বে তার প্রেমময় নতুন জন্মের বার্তা। হত্যা নয় খুন নয় লোভ নয় বরং মানবিক প্রেমেই মানুষ নবজন্ম লাভ করে। যে জন্ম মহত্ত্বের সন্ধানে সদা অগ্রসরমান।

এই যে নিজের যাপিত জীবনাভিজ্ঞতা, লব্ধ মূল্যায়ন আর সাহিত্যে তার অকপট প্রকাশ, মূলত এই তিন মূল্যায়নের নিরিখে আমি লেখক হয়ে উঠা পাঠকের জন্য দস্তয়েভস্কিকে অপরিহার্য মনে করি। 

 লেখক : প্রাবন্ধিক, নাট্যকার ও কথাসাহিত্যিক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫