
‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’-এর লেখক ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কি ছিলেন রুশ সাহিত্যের স্বর্ণযুগের লেখক। যার জীবন কখনও রহস্যময় মনে হবে পাঠকের নিকট-কখনোবা মনে হবে কালিমাযুক্ত, তবুও ফিওদর দস্তয়েভস্কি পৃথিবীর মহান এক শিল্পী- যার কলমে কেবল সোনা ফলেছে। তিনি যা লিখেছেন তা হয়ে উঠেছে সাহিত্যের একেকটি প্রতিনিধিত্বশীল রচনা। দুনিয়াজুড়ে দস্তয়েভস্কির পাঠকের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে বছরের পর বছর। ১৮২১ সালে মস্কো শহরে জন্মান এই মহান লেখক। এ বছর পালিত হচ্ছে তার জন্মের ২০০ শত বছর। ১৭০ ভাষায় ভাষান্তরিত হয়েছে তার রচনা।
দস্তয়েভস্কির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার লেখা চিঠি-পত্রের সঙ্কলন থেকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ চিঠি ভাষান্তর করেছেন লেখক ও অনুবাদক : সুদেষ্ণা ঘোষ
ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কির জন্ম হয়েছিল ১৮২১ সালে মস্কোর মারিনস্কায়া দাতব্য হাসপাতালে। তাঁর বাবা মিখাইল আন্দ্রেয়ভিচ দস্তয়েভস্কি ছিলেন সেই হাসপাতালেরই একজন স্টাফ ডাক্তার। বাবা ডাক্তার হলেও তাদের বংশগত পেশা ছিল পৌরহিত্য; কিন্তু ইতিহাস বলে তাঁদের পূর্বপুরুষেরা ছিল দস্যু। তাদের আদি বসতি ছিল পশ্চিম রাশিয়ার পিনস্ক মারশেস দস্তয়েভা নামক ছোট্ট একটা গ্রামে। তারা সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে নিজেদের গ্রাম ছেড়ে ইয়ুক্রেনে বসতি স্হাপন করেছিল এবং বেছে নিয়েছিল পৌরোহিত্য পেশা। স্হানীয় দস্তয়েভা থেকে আসার দরুণ স্হানীয় লোকেরা তাদের দস্তয়েভস্কি বলে ডাকত। বংশ পরম্পরায় পৌরহিত্য পেশাকে উপেক্ষা করে ডাক্তার হবার নেশায় ফিওদরের বাবা পরিবারের সঙ্গে মনোমালিন্য করে পড়াশুনার জন্য চলে আসেন মস্কোতে। মা মারিয়া নেচায়েভা ছিলেন একজন শিল্পরুচিসম্পন্ন নারী। স্বামীকে লেখা তার পত্রে গ্রামীণ সারল্যের সঙ্গে মিশে থাকত কবিতার রমণীয়তা। আর বাবার ছিল দেশাত্মবোধক সাহিত্য চর্চার অভ্যেস। ফিওদর এবং তার ভাইদের মধ্যে সাহিত্যের প্রতি এই অনুরাগ সঞ্চারিত হয়েছিল তার মা-বাবার হাত ধরেই। দস্তয়েভস্কিদের দিন কেটেছে হাসপাতালের ছোট্ট কোয়ার্টারে। সেই কোয়ার্টারে অন্ধকার লম্বা বারান্দা একটা রান্নাঘর আরেকটা খাবার ঘরে বিজাভজ টেনে ভৃত্যসহ থাকত চৌদ্দজন। সেখানে না ছিল কোনও জানালা, না ছিল ভেন্টিলেটর। যদিও খাবার ঘরটা ছিল তুলনামূলক একটু বড়। উঠোন আর রাস্তার দিকের ঘরে সব মিলিয়ে ছিল পাঁচটা জানালা। সেই ঘরে পার্টিশান দিয়ে থাকতেন ডাক্তার এবং তার স্ত্রী। অন্য খুপরিতে চলত ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা। একদিকে ছিল ঘিঞ্জি পরিবেশ, আর অন্যদিকে বাবার মেজাজ। পান থেকে চূণ খসলেই শুরু হয়ে যেত বকাঝকা। ক্রমেই পরিবারের পক্ষে তা অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। দেশের সেবা করে, মানুষের কল্যাণ করে যোগ্য সম্মান না পাওয়া, উপযুক্ত টাকা রোজগারের থেকে বিরত থাকা এবং নিজের জীবনের অসম্পূর্ণতা- সব মিলিয়ে তাঁর মন খিটখিটে হয়ে উঠেছিল। ফিওদরের জন্মের পর থেকেই মায়ের শরীর ভাঙতে থাকে। এইজন্য ফিওদরের জন্মের পরের সন্তানগুলো মাতৃদুগ্ধ পেত না। অন্য গ্রাম থেকে দুধ-মা আনা হতো।
১৮৩৫ সালে যখন মারিয়া নেচায়েভা যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হলেন তখন গর্ভে ছিল ফিওদরের ছোটবোন আলেকসান্দ্রা। ১৮৩৬ সালের হেমন্তে দস্তয়েভস্কির মা যক্ষা রোগে শয্যাশায়ী হলেন। সেই সময়ে ডাক্তার তার রোজগার নিয়ে ব্যস্ত। আর ফিওদর এবং দাদা মিখাইল তখন বোর্ডিং-এ। কেবলমাত্র আন্দ্রেই তখন মায়ের সেবা করত। ১৮৩৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারীতে মা চিরকালের মতো পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। মায়ের মৃত্যুর কিছুকাল আগেই পুশকিনকে হত্যার সংবাদ ফিওদরের মনকে গভীরভাবে শোকাহত করেছিল। পুশকিনের সঙ্গে দ্যাখা করার প্রবল ইচ্ছেটা তার চিরকালের মতো অপূর্ণই থেকে গেল। মাত্র ষোলো বছর বয়সে ফিওদরের জীবনে আগত পরপর এই দু’টো ঢেউ কৈশোর জীবনকে ঢেকে দিয়েছিল মৃত্যু শোকের গভীর মায়াজালে। তারপর একই সালে তিনি বাবার হাত ধরে আসেন পিটার্সবার্গে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি বাবার বিরুদ্ধে যেতে পারলেন না। ভর্তি হলেন আর্মি ইঞ্জিয়ারিং কলেজে। দুঃখে-কষ্টে নিজে ভেতরে ভেতরে ভুগতে লাগলেন। জ্বর-সর্দি হয়ে উঠল তার নিত্যসঙ্গী। বাবার কথা মতো অন্য শহরে গিয়েও তার বিশেষ শারীরিক পরিবর্তন হলো না। আজীবন গলার স্বর তার ভাঙাই থেকে গেলো। কবিতা লেখা ছেড়ে তাকে অঙ্কে মনোনিবেশ করতে হবে ভেবে ফিওদরের মনটা ক্ষণেই ম্লান হয়ে গেলো। যাত্রাপথেই ফিওদর তৈরি করে ফেলল উপন্যাসের খসড়া আর তার দাদা মিখাইল লিখল তিন-চারটে কবিতা। নতুন শহরে এসে ডাক্তার তার ছেলেকে নিয়ে উঠলেন সরাইখানায়। আর সেখানেই তার সঙ্গে আলাপ হল তেইশ বছরের তরুণ কবি ইভান শিদলফস্কির সঙ্গে। সেই সময়ে রোমান্টিক কবি হিসাবে সাহিত্যকর্মে শিদলফস্কির খ্যাতি ছিল চূড়ান্ত শিখরে। পরবর্তীকালে ইভানের জীবন দর্শন এবং সাহিত্যভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়ে ফিওদর বারবার ছুটে যেতেন তার কাছে। সরাইখানা থেকে বেরিয়ে ডাক্তার দুই ছেলেকে রাখলেন কোরোনাদ কোসতো মারোভ-এর স্কুল বোর্ডিং-এ। তারপর প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হলেন আর্মি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। মিখাইল শারীরিক যোগ্যতায় বাতিল হয়ে পড়াশুনার জন্য চলে গেলেন রেভাল শহরের ইঞ্জিনিয়ারিং একাডেমিতে। ক্রমেই অঙ্ক, জ্যামিতি, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন সবকিছুর প্রতি ফিওদরের বিতৃষ্ণা জন্মালো। আরেকদিকে ততদিনে তিনি মজেছেন সাহিত্যে। কাব্যচর্চা, নাটক, উপন্যাসেই তিনি মুক্তি পেতে লাগলেন। অন্ধকার বাতাস রুদ্ধ ঘরে তিনি চর্বিবাতি জ্বেলে লেখালিখি করে, কখনো পড়াশুনা আবার কখনোবা পায়চারি করে রাতের পর রাত কাটিয়ে দিতেন। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের জীবন তাঁর পক্ষে দুঃসহ হয়ে উঠেছিল। ফিওদরের কন্ঠস্বর, চেহারা নিয়ে কলেজের সহপাঠিরা ব্যঙ্গ করত। তবুও তিনি দমে থাকেননি। তিনি জ্ঞানের বিস্তীর্ণ সমুদ্র সাঁতার কেটে চলেছেন তো চলেছেন। জীবন যন্ত্রণায় ভেতর ভেতর পুড়ে ছারখার হলেও তিনি তার জ্ঞান নিয়ে অহংকার বোধ করতেন। তিনি বুঝেছিলেন-হয় তাকে এদের মতো অমানুষ হতে হবে, না হলে কলেজ জীবন থেকে মুক্তি নিয়ে মানুষের মতো মানুষ হতে হবে।
বাবাকে লেখা চিঠি...
আসলেই যে দস্তয়েভস্কি অর্থাভাবে ভুগছিলেন তা নয়। শৈশব থেকে বাবা তার হাতে কখনও টাকাপয়সা দেননি। পিটার্সবার্গে আসার পর টাকা হাতে পেয়ে তিনি অত্যন্ত অমিতব্যয়ী হয়ে উঠলেন। জীবনপথে চলার জন্য যতটুকু প্রয়োজন তারচেয়ে অধিক খরচ করতেন। যখন তখন তিনি মানুষকে টাকা ধার দিতেন। টাকা আদায়ের জন্য তার কোনওরকম তাগাদা ছিল না। দিন শেষে যতটুকু জমাতে পারতেন তা দিয়ে বই কিনতেন। ফলে মাস শেষে তিনি বড়োই অর্থসঙ্কটে পড়তেন। তখন চা কেনার পয়সাটুকুও তাঁর কাছে থাকত না। তখন যেন বাবার প্রতি পুরোনো অভিমান এবং রাগের আগুন পুরনায় জ্বলে উঠত। মনে একরাশ রাগ, ঘৃণা নিয়ে নিয়ে বিনয়ের সুরেই তখন লিখলেন-
বাবাকে লেখা চিঠি...
মে ১০, ১৮৩৮
প্রিয়বাবা,
যখনই তোমার ছেলে তোমার কাছে বিশেষ সুবিধার দাবি রাখে কেবলমাত্র তখনই সে তোমার খোঁজ-খবর নেয়-এমনটা কি তুমি সত্যিই মনে করো? এটা যে আত্মকেন্দ্রিকতা নয়, এমন কি উচ্চাকাঙ্ক্ষাও নয়, তার একমাত্র সাক্ষী ঈশ্বর। আমি কি কখনো কোনো কিছুর থেকে তোমাকে বঞ্চিত করার ইচ্ছা পোষণ করেছি? যখন এসব কথা নিজের রক্ত মাংসের কাছে জানতে চাই, তখনই এই তিক্ত অনুভূতি আমার মনকে গভীরভাবে ভারাক্রান্ত করে তোলে। আমার নিজস্ব বুদ্ধি ও হাত আছে। ছিলাম মুক্ত এবং স্বাধীন। আমার কখনো উচিত হয়নি এক কোপেকের মতো তোমার কাছে এত কিছু চাওয়াটা। আমার বরংউচিত ছিল ভয়ংকর দারিদ্রতার মায়াজালে নিজেকে অভ্যস্ত করে নেওয়া। এই যে মৃত্যুর বিছানায় শুয়ে চিঠি লিখে তোমার কাছে আমি সাহায্য চাইছি, তার জন্য আমার লজ্জিত হওয়া উচিত। এই অবস্থায় আমি শুধু ভবিষ্যতের জন্য প্রতিশ্রুতি আর সান্ত্বনাটুকু দিতে পারি। যদিও এই দিন খুব বেশি দূরে নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই বাস্তবতাকে উপলব্ধি করবে।
প্রিয়বাবা, বিষয়টিকে বাস্তবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে চিন্তা করার জন্য বর্তমানে আমি তোমার কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি- আমি সেবা প্রদান করছি। আমি বাধ্য, তা আমার ইচ্ছানুযায়ী হোক বা ইচ্ছের বিরুদ্ধেই হোক। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছি। কেন আমি ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠা করব? দৃঢ় তিক্ত অনুভূতি প্রায়ঃশই ব্যতিক্রমী আচরণের উন্মেষ ঘটায়। প্রিয়বাবা, তুমি সহজেই এটা বুঝতে পারবে। এটা উপলব্ধি করার জন্য তুমি অনেক রকম লোকজনের সঙ্গেই সময় কাটিয়েছ। সুতরাং এই বিষয়গুলো একটু বিবেচনা করো-শিবির জীবনে, সেনাবাহিনীর শিক্ষায়তনে প্রয়োজন হয় কম পক্ষে চল্লিশ রুবল। (আমি আমার বাবাকে উদ্দেশ্য করেই এই কথাগুলো লিখছি।) এই যোগ ফলের মধ্যে কিন্তু প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি অর্থাৎ চা, চিনি, প্রভৃতির মূল্যের অন্তর্ভুক্তিকরণ নেই। যা হোক, এই সব বস্তু আমারও প্রয়োজন-অবশ্যই আয়েশের জন্য না, বরং অত্যাবশ্যকীয়। কুয়াশায় বা বৃষ্টিতে যখন কাউকে মহাশূন্যের নিচে তাঁবুটা নিয়ে শুতে হয়, এই আবহাওয়ায় যখন কেউ ক্লান্ত হয়ে কিংবা অনুশীলনের ফলে শীতল হয়ে ফিরে আসে-তখন চায়ের অভাবে যে কেউ সহজেই অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। যেমন আগের বছরগুলো থেকে এযাবতকাল পর্যন্ত আমি বহুবার এই রকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি; কিন্তু আমি তোমার সমস্যার কথা বিবেচনা করতে চাই। ফলে আমি চা ত্যাগ করব। কেবলমাত্র নগ্নতা রক্ষার জন্য প্রয়োজনটুকুই আমি তোমার কাছে চাইছি- দু’জোড়া সাধারণ বুট জুতার জন্য মাত্র ষোলো রুবল। আবার : বই, জুতা-মোজা, লেখার সরঞ্জাম, কাগজ, প্রভৃতি আমার কিছু প্রয়োজনীয় বস্তু রাখতে হবে। সেই জন্য আমার একটা বাক্সের প্রয়োজন। শিবিরে তাঁবু ছাড়া তেমন কোনো ছাউনি নেই। আমাদের বিছানাগুলো গুচ্ছ গুচ্ছ ঘাস দিয়ে তৈরি, যা পাতা দিয়ে ঢাকা। এখন তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি, বাক্স ছাড়া কোথায় আমার জিনিসপত্র রাখব? কোষাগার ন্যূনতম পরোয়া করে না- আমার একটা থাকুক আর নাইবা থাকুক। খুব তাড়াতাড়ি আমার পরীক্ষা শেষ হবে। তখন আর বইয়ের প্রয়োজন হবে না। মনে হয় উর্দিটাকে সামলে রাখতে হবে। যদিও বুট জুতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা আমার উচিত হবে না; কিন্তু বই ছাড়া আমি কীভাবে পরীক্ষায় পাস করব? আর আমাদের যেসব বুট জুতা সরবরাহ করা হয়, সেগুলো এতটাই খারাপ যে দেখা যায়, তিন জোড়া জুতার আয়ুষ্কাল এক থেকে ছয় মাস। এমনকি শহরের জুতাগুলোরও একই অবস্থা।
(আবার ক্রেতাদের বিপদকালীন সময়ে ক্রয়ের ক্ষেত্রে অধিক মূল্যের তালিকা প্রদর্শন করানো হয়।)
তোমার সর্বশেষ প্রেরিত অর্থ থেকে আমি পনেরো রুবল সংরক্ষণ করেছি। বর্তমানে আমার আরও পঁচিশ কোপেকের প্রয়োজন পড়েছে। জুনের শুরুতেই আমরা শিবির ছাড়ব। ছেলের এই বিপদকালীন সময়ে যদি পাশে দাঁড়াতে চাও, তবে তাকে ১ জুনের মধ্যে এই পরিমাণ টাকা পাঠিও। আমার আবেদনে সম্মতি জানানোর জন্য জোর করার দুঃসাহস দেখাচ্ছি না : আমি বারবার বলছি না; কিন্তু তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা চিরকালই থাকবে সমুদ্রতুল্য।
ভাই মিখাইলকে লেখা চিঠি...
আসলে নিজের মিথ্যাচার স্বীকার করে দস্তয়েভস্কি ১৮৭৩ সালের “নাগরিক” পত্রিকার এক প্রবন্ধে লিখেছেন, দুনিয়ার সব মানুষ, রাশিয়ার মানুষসুদ্ধ সবাই মিথ্যাবাদী, আমিও এর থেকে বাদ যাই না। আর এই মিথ্যাচারের কারণ শ্রোতাদের তৃপ্তি দেওয়া, তাদের মনে এক প্রিয়বোধের সৃষ্টি করে সুখী করা। আসলেই বাবাকে মিথ্যা বলার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল টাকা আদায় করা। তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তেই কোনও মতেই আগ্রহী নন, তা বুঝেও তিনি জানান পয়সার অভাবে তার মনে পড়াশুনা ত্যাগের আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাবার প্রতি অসন্তোষের যথেষ্ট কারণ ছিল বটে। দস্তয়েভস্কি ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছেন তার মা’কে কিভাবে চিরকাল লাঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে; কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি আত্ম-উপলব্ধি করেছেন তার বাবার এইরকম অবস্থার জন্য দায়ী সমাজ, কিছু না পাওয়ার ক্ষোভ-যা প্রায়ই স্ফুলিঙ্গের মতো ঝরে পড়ে। আর এই আগুনেই পুড়েছে সমস্ত পরিবার। না পাওয়ার ক্ষোভ যে কি বিভৎস মূর্তি ধারণ করে তা ফিওদর নিজের জীবন থেকে বুঝেছেন। এসব ভাবলে তাই তার মনে বাবার জন্য করুণার জন্ম নিত। সেই জন্য তিনি তার ভাইকে চিঠিতে লিখেছিলেন-
ভাই মিখাইলকে লেখা চিঠি...
পিটারবার্গ,
অক্টোবর ৩১, ১৮৩৮
প্রিয় ভাই, কতদিন পর তোমাকে চিঠি লিখলাম! ঐ জঘন্য পরীক্ষাটা তোমাকে এবং বাবাকে চিঠি লেখার এবং *আই. এন. শিদলভস্কিকে খোঁজার থেকে আমাকে এতদিন বিরত রেখেছিল। আর শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াল? আমি পরক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলাম না। আরেকটা গোটাবছর এই দুর্বিপাকে থাকাটা কী ভয়ঙ্কর! না, এটা আমার উচিৎ হয়নি। আমি কি তাড়াতাড়ি বুঝতে পারিনি যে আমি পুরোদস্তুর সংকুচিত হচ্ছি। ব্যর্থতা আমাকে খুব বেশি আতঙ্কিত করতে পারেনি। কেবলমাত্র আমাদের বৃদ্ধ বাবার অশ্রুবিন্দু আমার হৃদয়ে ছ্যাঁকা দিয়েছে। এতদিন পর্যন্ত আমি বুঝতে পারিনি আহত অহমিকার বেদনা। যদি এইরকম একটা অনুভূতি আমাকে আঁকড়ে ধরত তবে আমিই আমার ওপর লজ্জিত হতাম; কিন্তু এখন কি জানো-পুরো পৃথিবীটাকে এক নিমেষে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে। পরীক্ষার আগে আমি প্রচুর সময় নষ্ট করেছি। অসুস্থও ছিলাম বটে, আর পাশাপাশি ছিল চরম দুরাবস্থা; কিন্তু সবটাই সহ্য করেছি। সহজভাবে বলতে গেলে আমি ব্যর্থ হয়েছি…এটা বীজগণিতের অধ্যাপকের রায়, যাঁর কাছে কোনো-না-কোনোভাবে ঔদ্ধত ছিলাম কোর্স চলাকালীন বছরটায়। আজ এসব মনে করানোর জন্য ঐ অধমটাই যথেষ্ট, বড়াইপূর্ণ ভাবে আমার ব্যর্থতার কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন। আমি পেয়েছিলাম দশে নয় এবং একের অর্ধেক। যা হোক…কিন্তু আমি বুঝতে পারি, আমাকে ভুগতে হবে, আমি ভুগবো…
আমি এই বিষয়ের ওপর আর পৃষ্ঠা নষ্ট করব না, কারণ আমি তোমার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাই না বললেই চলে।
বন্ধু, তুমি কবির মতোই দার্শনিক মনোবৃত্তি পোষণ করো। আত্মা চিরকাল মহিমান্বয়ন অবস্থায় থাকে না, আর সেই কারণেই তোমার দার্শনিকতত্ত্ব সত্য না। একটু-আধটু নয়, বরং পুরোপুরি অসত্য।
বেশি জানবার জন্য তাকে অনুভব করতে হবে যে সে কম জানে, এবং উল্টোটাও। তোমার বিবেচনা কাণ্ডজ্ঞানহীন-এটা হৃদয়ের জন্য প্রবল উত্তেজনাপূর্ণ। শব্দের মাধ্যমে তুমি ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছ? প্রকৃতি, আত্মা, ভালোবাসা এবং ঈশ্বর। কেউ উপলব্ধি করে হৃদয়ের মাধ্যমে এবং যুক্তিকে গুরুত্ব দেয় না। আমরা যদি অশরীরি হতাম, আমরা চিন্তার জগতে বসবাস করতে পারতাম। যেখানে আমাদের মন ভেসে বেড়ায় সমাধান খোঁজার উদ্দেশ্যে; কিন্তু আমাদের জন্ম যেহেতু পৃথিবীতে, তাই আমরা শুধুমাত্র ভাবনাকে অনুমান করতে পারি- একবারে সবদিক থেকে তা উপলব্ধি করা যায় না। আত্মার অধিকতর অন্তর্নিহিত কেন্দ্রে সাময়িক ঘোরের মধ্য দিয়ে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাভাবনার পথপ্রদর্শককে বলা হয় যুক্তি। এখন, যুক্তি হলো অকাল্পনিক ধারণাশক্তি, যখন আত্মা অথবা আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনায় বিরাজমান থাকে- তখন তারা হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে ফিসফিস করে। চিন্তাভবনার জন্ম আত্মার মধ্যেই। যুক্তি হলো অস্ত্র, একটা যন্ত্র যা নিয়ন্ত্রিত হয় আধ্যাত্মিক আগুনের মাধ্যমে। যখন মানুষের যুক্তির পরিব্যাপ্তী ঘটে জ্ঞানের রাজ্যে, তখন তা অনুভূতি এবং পাশাপাশি হৃদয়কে ছাপিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করে; কিন্তু যখন আমাদের লক্ষ্য হয় ভালোবাসাকে উপলব্ধি করা অথবা প্রকৃতিকে, তখন আমরা দুর্বারভাবে অগ্রসর হই হৃদয়ের আশ্রয়স্থলের দিকে। আমি তোমাকে ক্রদ্ধ করতে চাইছি না; কিন্তু আমি তোমাকে বলতে চাই- কবিতা অথবা দর্শনশাস্ত্রে আমি তোমার দার্শনিকতত্ত্ব প্রতীয়মান করব না। দর্শনশাস্ত্র নিছকই একটা সমীকরণ হতে পারে না, যেখানে প্রকৃতি এক অজানা রাশি হিসাবে বিবেচিত! একজন কবিকে দ্যাখো,উদ্দীপনার মুহুর্তে, অনুসরণ করে ঈশ্বরকে এবং দার্শনিকের কাজ করে। অতএব ছন্দময় প্রেরণা কোনও অংশে দার্শনিকের অনুপ্রেরনার তুলনায় কম নয়। কাজেই দর্শনশাস্ত্র কবিতা ছাড়া কিছুই না, বরং উচ্চমাত্রার কবিতা। তুমি যুক্তি দিচ্ছ আমাদের সমসাময়িক দর্শনভাবনার নিরিখে-এটা খুবই অদ্ভুত। কত কী আশ্চর্য পদ্ধতির সৃষ্টি হয়েছে বুদ্ধিশালী এবং প্রদীপ্তদের মগজে! এই বিচিত্র ভিড়ের থেকে সঠিক ফলাফল পাওয়ার জন্য কেউ একজনকে অধীনস্থ করতে হবে তাদের সবাইকে গাণিতিক সূত্রে। আর তারাই হলো আমাদের সমসাময়িক দর্শনের “নিয়মরাশি”। আমি যথেষ্ট বকবক করলাম। আমি যদি ভেবে নিই তমি কখনওই থুলথুলে হবে না, আমার মনে হয় এটা আমার আপত্তি কম থুলথুলে নয়। তাই এসব নিয়ে আমি তোমাকে আর বিরক্ত করতে চাই না।
ভাই, আশা ছাড়া বেঁচে থাকা খুবই কষ্টকর। ভবিষ্যতের কথা ভাবলেই আমি কেঁপে উঠি। আমি নিজেকে স্থানান্তরিত করেছি ঠাণ্ডা সুমেরীয় জলবায়ু অঞ্চলে। সেখানে সূর্যের আলোও পৌঁছায় না। দীর্ঘদিন ধরে অনুপ্রেরণার একক প্রকাশও আমি পাইনি। এইজন্য আমি সেইরকমই অনুভব করি যেমনটা চিলনের কয়েদি তার ভাইয়ের মৃত্যুর পর অনুভব করেছিল। কবিতার নন্দনকাননের পাখিটি আমাকে পুনরায় কখনও দেখা দেবে না-আমার বরফাবৃত আত্মাকে আর কখনও উষ্ণ করবেনা। তুমি বলো আমি নাকি সংরক্ষণশীল; কিন্তু আমার প্রাক্তন স্বপ্নগুলো দীর্ঘকাল আগেই আমাকে ত্যাগ করেছে এবং স্পেনের মূরজাতির ঐসব উজ্জ্বল অলঙ্কার আমি একদা পরতেই পারতাম; কিন্তু সব ঔজ্জ্বলতা অদৃশ্য হয়েছে। চিন্তারা আমার আত্মাকে উত্তেজিত করে তুলত এবং হৃদয় হারিয়েছে তার ঔজ্জ্বলতা এবং আকুলতা না হলে আমার হৃদয় হয়েছে অসাড় না হয়…এই বাক্যটা বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে ভয় পাচ্ছি। অতীতের সব কিছুই ছিল এক একটা স্বপ্ন, একটা উজ্জ্বল সোনালী স্বপ্ন- একথা স্বীকার করতে আমি নারাজ।
ভাই, আমি তোমার কবিতা পড়েছি। তোমার কবিতা অশ্রুরূপে আমার আত্মাকে বিগলিত করতে বাধ্য করেছে এবং স্মৃতির সম্মোহনে কিছু সময়ের জন্য আমি নিশ্চল ছিলাম। তুমি বলেছিলে তুমি নাকি নাটক বিষয়ক একটা পরিকল্পনা করেছ। এটা শুনে আমি খুব আনন্দিত হয়েছি। তবে নাটকটা তুমি এবারে লিখেই ফেলো। তুমি যদি দিব্যধামে আয়োজিত ভোজোৎসবের অন্তিম রুটির টুকরোগুলো না-ই পাও, তবে তুমি এই জীবনে কী রেখে যাবে? শেষ কিছু সপ্তাহ ধরে আমি ইভান নিকোলায়েভিচের (শিদলভস্কি) খোঁজ নিতে পারিনি, তার জন্যে আমি দুঃখিত। আমি অসুস্থ ছিলাম। এখন শোনো-আমার মনে হয় কবির প্রেরণাই তাদের সাফল্যকে বর্ধিত করে। বায়রন ছিলেন একজন আত্মশ্লাঘী ব্যক্তি। তার খ্যাতির প্রতি আকাঙ্ক্ষা ছিল নগণ্য; কিন্তু মনে করা হয়, একজনের অনুপ্রেরণায় এমন একটা দিন আসবে যেদিন ধূলোর থেকে পৌঁছাবে স্বর্গের উচ্চশিখরে কিছু উজ্জ্বল প্রতিভা, সুন্দর মন বিশিষ্ট মানুষ; যার স্তবক পড়ে কেউ কেঁদে ফেলেছে, কারও অনুপ্রেরণায় সেইসব ভাবনারা তেমনই পবিত্র যেমনটা হয় স্বর্গীয় আচার এবং তাদের ছাপিয়ে প্রতিধ্বনি স্বরূপ আগামী প্রজন্ম অশ্রুসিক্ত হবে। এই চিন্তায় আমি বিশ্বস্ত, যা বহু কবির মধ্যেই পরিলক্ষিত হয় সর্বোচ্চ সৃজনশীলতার ফলে সৃষ্ট আনন্দের মুহূর্তে; কিন্তু ভিড়ের মধ্যে চিৎকার করা নিরর্থক। পুশকিনের এই বাক্যগুলো আমার জীবনের সঙ্গে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত, যেখানে তিনি বর্ণনা করেছেন জনতা এবং লেখককে : “অগ্রাহ্য করো নির্বোধদের,অশ্রদ্ধা করছে তোমার কাজ, চেঁচাচ্ছে, থুতু ফেলে পবিত্র ঘরে যেখানে পুড়ছে তোমার মহত্মের আগুন থাকতে দাও তাদের শিশুসুলভ অহং নিয়ে, তোমাকে তেপায়া তৈরি করবে একটা-কম্পন..।” চমৎকার, তাই না? বিদায়।
তোমার বন্ধু এবং ভাই,
এফ. দস্তয়েভস্কি
যাই হোক, আমাকে বলতে পারো সাতেওব্রিয়ান্দের রচিত “খ্রীষ্টধর্মের সহজাত সৃজনী ক্ষমতা”-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা কী?
ওতেতচেস্তেভ্-তে (পিতৃভূমি) সম্প্রতি আমি ভিক্টর হুগোর ওপর নিসার্দের সমালোচনা পড়েছি। ফরাসী ব্যক্তিটি কতটুকু-বা প্রশংসা করেছেন! তার নাটকসমূহ এবং উপন্যাসগুলিকে নিসার্দ কতটাই-না নিম্নমূল্য দিয়েছেন! এটা বড়োই অশোভনীয়। আর নিসার্দ (ভেবেছিলাম খুব বুদ্ধিমান) বড়োই অবিবেচকের মতো কথা বলেছেন। আচ্ছা, আমাকে তোমার নাটকের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলো;আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে এটা ভারী চমৎকার হয়েছে।
বৃদ্ধ বাবার কথা ভাবলেই আমার মনে করুণার জন্ম নেয়। তিনি একজন অবিস্মরণীয় চরিত্র। তিনি জীবনে কত জটিলতার সম্মুখীন হয়েছেন! আমি তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কিছুই করতে পারছি না-এই বিষয়টা আমাকে বড়ো কষ্ট দেয়; কিন্তু তুমি কি জানো, বাবা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব। পঞ্চাশ বছর এ পৃথিবীতে জীবনযাপন করেও পৃথিবীটাকে পুরোপুরি চিনলেন না। ত্রিশ বছর আগে মানুষ সম্বন্ধে তার যে ধারণা ছিল, এখনও তিনি সেই ধারণাকেই মনের গভীরতায় পোষন করে রেখেছেন। নিরীতার কি শাস্তি! জগৎ তাকে হতাশ করেছে এবং আমি মনে করি এটাই আমাদের সকলের নিয়তি।
বিদায়।
*আই. এন. নিকোলে স্কিডলোভস্কি, তহবিল আধিকারিক, লিখেছিলেন উচ্চগতি সম্পন্ন ভাবমূল কবিতা। পরবর্তীকালে তিনি নেশার কবলে পড়ে নিজেকে ধ্বংস করলেন।
কারাগার থেকে ভাই মিখায়েলকে লেখা চিঠি
এরপর ধীরেধীরে তার সাহিত্যকর্মের উত্থান শুরু হলো। তিনি রচনা করলেন ‘বেদ নিয়ে লিয়ুদি’ (অভাজন) উপন্যাস। এই উপন্যাসের নায়ক একজন সাতচল্লিশ বছরের এক সাধারণ মানুষ, দরিদ্র কেরানী। রূপে সুদর্শনা না, এমনকি বলিষ্ঠও না। মাথায় চুল নেই, ক্ষীণ দৃষ্টি সম্পন্ন, একটুতেই ঠাণ্ডা লেগে যায়। এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু অন্যান্য বিষয়বস্তুর থেকে সম্পুর্ণ ভিন্নধর্মী। সেই সময়ে তার পরিচয় হয় বড় বড় সাহিত্যিক, কবিদের সঙ্গে-গ্রিগরোভিচ, নেক্রাসফ্, রুশ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক এবং বিখ্যাত সমালোচক বেলিনস্কির সঙ্গে। সেই সময়ে ‘বেদনিয়ে লিয়ুদি’-এর পাণ্ডুলিপি বেলিনস্কির কাছ থেকে ভুয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছিল। ১৮৪৬ সালের জানুয়ারিতে বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর দস্তয়েভস্কির নাম শুধুমাত্র সাহিত্য জগতেই সীমাবদ্ধ থাকল না, জাদুমন্ত্রের মতো নিমেষেই ছড়িয়ে পড়ল রাশিয়ার ঘরে ঘরে-বৈঠকখানা থেকে অন্তঃপুরে। ফিওদর তখন খ্যাতির চূড়ায়। ক্রমেই বন্ধু-বান্ধবের পরিসরও বড় হতে লাগল। আলাপ হলো তুর্গেনয়েফ, ইভাব পানায়েফ্, প্রিন্স ওদায়েভস্কির সঙ্গে। এরপর লিখলেন ‘দভোইনিক’(প্রতিরূপ); কিন্তু তা পাঠক মহলে সেইভাবে সাড়া ফেলতে ব্যর্থ হল বরং স্বীকৃতি পেল নিম্নমানের বই হিসাবে। এছাড়াও সেসময়ে সাময়িকীতে প্রকাশিত বইগুলোর ভাগ্যেও জুটল নিন্দা। এছাড়াও ‘খোজিয়াইকা’(বাড়িওলি) বইটির সমালোচনারূপে বেলিনস্কি এতোটাই গালাগাল করলেন যে দস্তয়েভস্কির নিজের লেখার প্রতিই বিতৃষ্ণা জন্মালো। তিনি কখনও গাদাগুচ্ছের লিখতে চাননি; কিন্তু অভাবের তাড়নায় তার কলম চলতেই থাকল। একদিকে তিনি ঋণ, দারিদ্রতার মায়জলে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছিলেন ফলে স্বচ্ছল জীবনযাপন করার আশায় হয়ে উঠলেন ‘জুয়ারী’। সেই সঙ্গে সাহিত্য জগতে লবিবাজি, প্রেমে ব্যর্থতা, যৌনবিকৃতি, স্নায়বিক রোগ সবকিছুই তাকে একটু একটু করে ধ্বংস করে দিচ্ছিল। তিনি তলিয়ে গেলেন অন্ধকারের জগতে। সমাজ বহির্ভূত কাজ করলেও প্রবল একটা অনুশোচনাবোধ তাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়াত। আত্মতুষ্টির জন্য চিঠিতে ভাইকে লিখলেন তার অকপট স্বীকারোক্তি। ‘অপমান ও লাঞ্চিত’ বইতে তার বিভীষিকাময় দিনের কথা সুস্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। টাকা ধার নেওয়ার জন্য ক্রাইয়েফ্স্কির কাগজে লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন তিনি ক্রাইয়েফ্স্কির দাসে পরিণত হয়েছেন। তবুও তিনি হাল ছাড়েন নি। তিনি এ অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াবেনই-এ বিষয়ে তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। পরবর্তীকালে ‘বেলিয়ে নোচি’(শুক্লারাত) আর ‘নেতোচকা নেজভানোভা’ তার হারানো সম্মান কিছুটা ফিরয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল। সেই সময়ে তিনি ছিলেন সেন্ট পিটার অ্যাণ্ড পল দূর্গে নির্বাসনে।
সেই সময় সমগ্র রাশিয়া জ্বলছে ভূমি-দাস প্রথা এবং জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন। মানুষ নৈতিক অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য দলে দলে যোগ দিচ্ছে বিপ্লবী দলে আর আটক হচ্ছে সেন্ট পল দূর্গে। এদিকে ফরাসী বিপ্লবের সাফল্যতা নির্যাতিত মানুষদের করে তুলেছিল সরব। আরও সেই সময়ে ফিওদরের আলাপ হলো পেত্রাশেভস্কির সঙ্গে। আর এই আলাপই ফিওদরকে অন্ধকারের কূপ থেকে তুলে এনে দিল আলোর পথের সন্ধান। তার যেন প্রতিটি রোমকূপে সঞ্চার হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্পৃহা। নেমে পড়লেন রাস্তায়। চলল জারতন্ত্র, সেন্সরসশিপ উচ্ছেদের বিরুদ্ধে সভা সমিতি। জার সতর্ক হলেন। রাজত্ব কায়েম রাখার জন্য মোতায়েন করলেন গুপ্তচর। এমনই একটা দিনে এক সভায় পড়লেন জার সরকারের বিরুদ্ধে গোগোলকে লেখা বেলিনস্কির নিষিদ্ধ চিঠি। তারা ঠিক করলেন সেই চিঠি তারা যুবসমাজের মধ্যে বিলি করে স্বাধীনতা আন্দোলনের শরিক হবার জন্য সারা দেশকে আহ্বান জানাবেন; কিন্তু সভা শেষে ১৮৪৯ সালের ২৩-এ এপ্রিল রাত তিনটের সময় দস্তয়েভস্কি যখন গভীর ঘুমে অচেতন, তখন সেনাবাহিনী তার বাড়িতে চড়াও হয়ে- তাকে গ্রেপ্তার করে এবং তার বইপত্র, পাণ্ডুলিপি সব সঙ্গে নিয়ে যায়। সেই রাতেই গ্রেপ্তার করা হয় পেত্রাশেভস্কির শুক্র-বাসরের আরও বাইশজনকে। জেলে থাকাকালীন সময়ে প্রথম তিন-চার মাস ফিওদরকে কোনও বই, খাতা কিছুই দেওয়া হলো না। শুধুমাত্র দেওয়া হলো চিঠি লেখার অনুমতি। ফলে তিনি লিখলেন ভাইকে চিঠি-
কারাগার থেকে ভাই মিখায়েলকে লেখা চিঠি
কারাগার থেকে
২২ ডিসেম্বর, ১৮৪৯ খ্রি.
আজ ২২ ডিসেম্বর, আমাদের নিয়ে আসা হয়েছে সেমিওনোভস্কি স্কোয়ারে। সেখানে আমাদের উদ্দেশে মৃত্যুদণ্ড পাঠ করা হয়েছে। আমাদের ক্রুশচিহ্ন দেওয়া হয়েছে চুম্বনের জন্য। আমাদের মাথার ওপরে ক্ষুর চালানো হয়েছে এবং শোকপূর্ণ পোশাক (সাদাশার্ট) তৈরি করা হয়েছে। তারপর আমাদের মধ্যে তিনজনকে দাঁড় করানো হলো খুঁটি দ্বারা নির্মিত বেড়ার সামনে মৃত্যুদণ্ড সম্পাদনের জন্য। আমি লাইনের ৬ নম্বরে ছিলাম। আমাদের ডাকা হচ্ছিল তিনটি দলে। ফলে আমি ছিলাম দ্বিতীয় দলে এবং বাঁচার জন্য এক মিনিটও সময় অবশিষ্ট ছিল না। আমার ভাই, তোমার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিল। আর একেবারে শেষ মুহূর্তে আমার চিন্তায় কেবলমাত্র তুমিই যাতায়াত করছিলে। তখনই প্রথম বারের মতো বুঝতে পারলাম আমি আমার প্রাণের ভাইকে কতটা ভালোবাসি! তখন কেবলমাত্র সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্লেচচেয়েভ এবং দুরভকে আলিঙ্গন করে তাদের বিদায় জানানোর সময়টুকুই আমার হাতে অবশিষ্ট ছিল। অবশেষে দেওয়া হলো সৈন্যবাহিনীকে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ। যাদের বেড়ার সঙ্গে বাঁধা হয়েছিল, তাদের ফেরত আনা হলো। আমাদের শোনানো হলো-তার সার্বভৌম মহত্ব আমাদের জীবন মঞ্জুর করেছে। তারপর সর্বশেষ বাক্য আবৃত্তি করা হলো। একা পাল্মকে পুরোপুরি ক্ষমা করে একই পদে তাকে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
এফ দস্তয়েভস্কি
পরবর্তীকালে আকুতি-মিনতির পর তাকে লেখা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তিনি চিঠিতে লিখলেন -কারাদণ্ডে যদি তাকে লেখার সুযোগ দেওয়া হয়, তবে তিনি সেখানে পনেরো বিশ বছর নির্দ্বিধায় কাটিয়ে দিতে পারবেন। কারাজীবন তার কাছে বিষণ্ণতার কারণ হলেও পাশাপাশি এ জীবনকে তিনি পুনঃর্জীবন নামে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ এই জীবন তাকে পাশবিক যৌন কামনা থেকে মুক্তি দিয়েছে।
ফিওদর দস্তয়েভস্কির জীবন ছিল দ্বি-সত্তা বিশিষ্ট। কখনো যুক্তিবাদী আবার কখনো ঈশ্বরবাদী, কখনো পাপ -তো কখনো অনুশোচনা, কখনো অসামাজিক আবার কখনোবা দেশপ্রেমী-এই দুই সত্তার টানাপোড়নে বারবার তিনি নিজেকে চূর্ণবিচূর্ণ করেছন। আর ঠিক ততবারই নিজেকে আবিষ্কার করেছেন নতুন রূপে। তাই রাশিয়ায় পুশকিনের মূর্তির আবরণ উন্মোচনের সময় সমস্ত জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি, শিল্পীরা ফিওদরকে “প্রফেট” নামে সম্বোধন করলেও ফিওদরের মৃত্যুর পর তার সমকালীন লেখক তুর্গেনিয়েভ তাকে “দ্য সাদ্” নামে আখ্যায়িত করেছেন। প্রবল ঈর্ষায় তাকে কালিমালিপ্ত করার উদ্দেশ্যেই মূলত এই নামটি তিনি ব্যবহার করেছেন। তার দীপ্তিমাণ প্রতিভা শুধুমাত্র সাহিত্যজগতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এই মনীষীর কথা জেনেছে সমগ্র রাশিয়া, দেশ থেকে দেশান্তর। নতশীর রাশিয়া তাকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছে। তাদের ভাষায়- “পুশকিন যদি রাশিয়ার ঈশ্বর হন, তবে দস্তয়েভস্কি পরম-পুরুষ”।