মঙ্গোলিয়ান কবি হাদা সেন্দোর কবিতা
চাঁদের আলোয় যাযাবর গান

অনন্ত উজ্জ্বল
প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:১২

হাদা সেন্দো
মঙ্গোলিয়ায় হাদা সেন্দোকে একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী কবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। হাদা সেন্দোর প্রথম জীবনের কবিতাগুলো মঙ্গোলিয়ান মহাকাব্য দ্বারা প্রভাবিত ছিল। সেই কবিতাগুলো অনেকটা প্রভাবিত ছিল রাশিয়ার চিত্রকল্পবাদ এবং একবিংশ শতাব্দীর ইটালিয়ান হারমেটিক কবিতা দ্বারা। তরুণ বয়সে হাদা সেন্দো প্রচুর পরিমাণে মঙ্গোলিয়ান সাহিত্য পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। অবশ্যই এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মঙ্গোলিয়ান ধ্রুপদি সাহিত্য, মহাকাব্য এবং জাঙ্গারের মতো কাব্যিক মহাকাব্য। এই বয়সে তিনি নিবিড়ভাবে পাঠ করেন মঙ্গোলিয়ান লোকগান এবং আধুনিকতাবাদী কবিতা।
হাদা সেন্দো মঙ্গোলিয়ান কবি এবং অনুবাদক। তিনি ১৯৬১ সালের ২৪ অক্টোবর মঙ্গোলিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে এই অঞ্চলটি ইনার মঙ্গোলিয়া নামে পরিচিত। সেন্দো শিশুকাল কাটিয়েছেন ইনার মঙ্গোলিয়া অঞ্চলের সিলিগোল শহরে। হাদা সেন্দোর বাবা ছিলেন স্থানীয় নাট্যদলের প্রধান আর মা ছিলেন এই নাট্যদলের অভিনেত্রী। হাদা সেন্দো যখন অনেক ছোট ছিলেন তখন তার বাবা পরিবারের সবাইকে নিয়ে দক্ষিণ মঙ্গোলিয়ার দালানহার পর্বতমালার কাছাকাছি চলে আসেন। এখানেই সেন্দোর বাল্যকাল অতিবাহিত হয়েছে। দালানহার পর্বতমালার নিকটে স্থানীয় বিদ্যালয়ে পুরাতন মঙ্গোলিয়ান ও চাইনিজ ভাষায় লেখাপড়া করেন তিনি। স্কুলের লেখাপড়া সেন্দোকে বেশি দিন মুগ্ধ করে রাখতে পারেনি বরং স্কুল অল্পদিনেই তাকে ক্লান্ত করে তুলেছিল। এ জন্য কিছুদিন পরে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে হাদা সেন্দো স্কুল ছেড়ে স্তেপ তৃণভূমি অঞ্চলে চলে আসেন। সেন্দো ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলে যাযাবর জীবনযাপন করেন। ১৯৮৪ সালের শেষের দিকে সেন্দোর বাবা তাকে আর্ট ইনস্টিটিউটে চাকরি নেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বাবার পরামর্শে আর্ট ইনস্টিটিউটের চাকরিতে যোগদান করেন। চাকরিতে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পরেই সেন্দো আর্ট ইনস্টিটিউটের সম্পাদকীয় সহকারী পদে কাজ করার সুযোগ পান।
মঙ্গোলিয়ায় হাদা সেন্দোকে একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী কবি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। হাদা সেন্দোর প্রথম জীবনের কবিতাগুলো মঙ্গোলিয়ান মহাকাব্য দ্বারা প্রভাবিত ছিল। সেই কবিতাগুলো অনেকটা প্রভাবিত ছিল রাশিয়ার চিত্রকল্পবাদ কবিতা এবং একবিংশ শতাব্দীর ইটালিয়ান হারমেটিক কবিতা দ্বারা।
তরুণ বয়সে হাদা সেন্দো প্রচুর পরিমাণে মঙ্গোলিয়ান সাহিত্য পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। অবশ্যই এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মঙ্গোলিয়ান ধ্রুপদি সাহিত্য, মহাকাব্য এবং জাঙ্গারের মতো কাব্যিক মহাকাব্য। এই বয়সে তিনি নিবিড়ভাবে পাঠ করেন মঙ্গোলিয়ান লোকগান এবং আধুনিকতাবাদী কবিতা (Shuleg)। ১৯৮৯ সালে হাদা সেন্দো প্রকাশ করেন তার প্রথম কাব্য সংকলন ‘চাঁদের আলোয় যাযাবর গান’ (The Nomadic Songs and Moonlight). হাদা ১৯৯১ সালে সিলিগোল শহর ছেড়ে চলে আসেন মঙ্গোলিয়ার উত্তরাঞ্চলে রাজধানী উলানবাটোর শহরে। তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত তিনি মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটোর শহরে বাস করছেন। উলানবাটোর শহরে সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান এবং মঙ্গোলিয়ান লোকসাহিত্য নিয়ে গবেষণা করেন। এই গবেষণার মধ্যে অর্ন্তভুক্ত রয়েছে মঙ্গোলিয়ার লোকগান এবং ঐতিহ্য।
হাদা সেন্দো ১৯৯৬ সালে ‘সাইরিলিক নতুন মঙ্গোলিয়ান’ (Cyrillic new Mongolian) ভাষায় লেখা তার প্রথম কাব্য সংকলন প্রকাশ করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে মঙ্গোলিয়ান রাইটারস্ ইউনিয়নে যোগ দেন। হাদা সেন্দো তার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে The World’s Mongolians (a Mongolian-English bilingual edition) নামে একটি কালচারাল ম্যাগাজিন মঙ্গোলিয়া থেকে নিয়মিত প্রকাশ করেন। এই বছরের গ্রীষ্মকালে, সেন্দো এবং তার ঘনিষ্ট বন্ধু মঙ্গোলিয়ান কবি এস.টি. সেরেন্দরর্জ (S. T Serendorj) মিলে উলানবাটোর শহরে প্রথম বারের মতো এশিয়ান কবিতা উৎসব আয়োজন করেন। ১৯৯৯ সালে হাদা সেন্দো এথেন্সের সিটি হল প্রাইজ এবং সেকেন্ড অলিম্পিক কালচারাল প্রাইজ অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি মঙ্গোলিয়ান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
কবিতার পথে : অল্প বয়স থেকে কবিতা লেখা শুরু হলেও মূলত মাঝ বয়সে এসে হাদা সেন্দো কবিতা লিখেছেন পরিমাণে অনেক বেশি। এই বয়সে লেখা কবিতাগুলোর সঙ্গে বিগত সময়ের বিশেষ করে তরুণ বয়সের লেখা কবিতাগুলোর মধ্যে অনেক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
২০১১ সালে ২৪ সেপ্টেম্বর হাদা সন্দো World Poetry Movemen:-এ যোগ দেন। তিনি World Poetry Movemen:-এর প্রথম দিকের অন্যতম সদস্য হিসেবে পরিচিত। ২০১২ সালে হাদা সেন্দো যুক্তরাজ্যের সর্বকালের সব থেকে বড় কবিতা উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রিত হন। সেখানে তিনি সাউথব্যাঙ্ক সেন্ট্রাল কবিতা প্রাঙ্গণে কবিতা পাঠ করেন। উৎসবের অংশ হিসেবে কবিতা পাঠের পর সেন্দোর কবিতা নিয়ে আলোচনা হয়। এই উৎসবে হাদা সেন্দোর কবিতা সমগ্র বইটি প্রদর্শিত হয় রয়েল ফেস্টিভ্যাল হল ও কুইন এলিজাবেথ হলে। কবিতাবৃষ্টির জন্য হাদা সেন্দোর একটি কবিতা বুকমার্কে ছাপা হয় এবং কবিতা ছাপা বুকমার্কর্টি হেলিকপ্টার থেকে লন্ডন শহরের ওপরে ফেলা হয়। তার কবিতা ব্লোডেক্সের বিশ্ব কবিতা সংগ্রহ সমগ্রে ছাপা হয়েছে। বিশ্বের ৬০ জন স্বনামধন্য কবির শ্রেষ্ঠ কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে এই সমগ্রটি। হাদা সেন্দোর কবিতা ইতিমধ্যে পৃথিবীর ৪০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি বর্তমানে মঙ্গোলিয়ার সব থেকে জনপ্রিয় কবি। হাদা সেন্দো বিগত কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক সাহিত্যের ত্রৈমাসিক পত্রিকার পরামর্শক সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কবি রিচার্ড বেরেনগ্রারটেন হাদা সেন্দোর কবিতা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমি তার কবিতা মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কবিতা। আমি তার কবিতার শ্বাস-প্রশ্বাসের দর্শন আবিষ্কার করতে পেরে খুবই আনন্দিত।’ তিনি আরো বলেন, ‘বিষয় হিসাবে বাতাস (বায়ু, নিঃশ্বাস, আত্মা) খুবই গভীর একটা বিষয়। ‘পৃথিবীতে ফিরে এসো’ (Come Back to Earth) এবং ‘বায়ু’ (The Wind) কবিতাটি মঙ্গোলিয়ার বিশাল অঞ্চল সম্পর্কে আমার ধারণা পরিস্কার করেছে। এই কবিতাগুলোকে আমি ‘সার্বজনীন কবিতা’ হিসেবে বিবেচনা করি। পাশাপাশি কবি হাদা সেন্দো একজন ‘সার্বজনীন কবি’ এটা আমার বিশ্বাস। কবিতাগুলো পড়ে আমি দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়েছি মঙ্গোলিয়ানদের হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতির জন্য। তার কবিতা আমাকে কিছু সিনেমার কথা মনে করিয়ে দেয়। তারমধ্যে ‘হলুদ কুকুরের গুহা’ এবং ‘কান্নাকাটি করা উটের গল্প’ (The Cave of The Yellow Dog and Story of the Weeping Camel). এই সিনেমা দুটিতে রয়েছে মঙ্গোলিয়ান যাযাবর জীবনের বিশাল সংস্কৃতির বর্ণাঢ্য চিত্র ও তথ্য।
জার্মান লেখক রাইনার ওয়েডলার বলেছেন- ‘মঙ্গোলিয়ান কবি হাদা সেন্দো কবিতা সাহিত্যে অল্প পরিচিত ভূগোলকে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে উপস্থাপন করেছেন।’
জার্মানের একজন শিল্প সমালোচক আনড্রেস ইউল্যান্ড বলেছেন- ‘‘হাদা সেন্দোর কবিতা, প্রতিনিধিত্ব করে তার জীবন, প্রকৃতি, বিশাল মরু-পাহাড়ি অঞ্চল, সবুজ তৃণভূমি অঞ্চল ও মঙ্গোলিয়ার মনোরম বাতাস। আমি সেই প্রকৃতি এবং বাতাসের ছন্দ শোনার চেষ্টা করি হাদা সেন্দোর কবিতার মধ্যে। আমি প্রতিটি লাইনের কাব্যিক গুরুত্ব বিবেচনা করে পাঠ করি। কবিতার লাইনগুলো পাঠ করতে করতে আমার মনে হয় এই কবিতাগুলো ‘কোনো মৃত্যু থেকে পালিয়ে আসা কবিতা’ অথবা ‘অনেক বেশি আনন্দিত হয়ে মৃত্যুর জন্য উন্মুখ কবিতা। যে ভাবেই বলি না কেন, এগুলোর সবই হাদা সেন্দোর কবিতায় বার বার জন্মকেই ইঙ্গিত করে।” তিনি আরো বলেন, সেন্দোর কবিতা আমার হৃদয়কে স্পর্শ করে এবং জাগ্রত করে শক্তিশালী চিন্তুা, গভীর আবেগ ও ভাবাবেগপূর্ণ চিত্রকল্প। আমি হাদা সেন্দোকে সংবেদনশীল এবং বাস্তবাদী কবি হিসেবে বিশেষভাবে বিবেচনা করি।”
হাদা সেন্দো অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক পোয়েট্রি ফেস্টিভ্যাল ইন মেডেলিনে এবং টোকিও পোয়েট্রি ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণ করেন। ২০১২ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সব থেকে বড় কবিতা উৎসব পোয়েট্রি পার্নাসাস-(poetry festival Poetry Parnassus)-এ অংশগ্রহণ করেন।
২০১৬ সালে ‘ঘাসেদের মিস্টি হাসি’ নামের হাদা সেন্দোর একটি কবিতা সংগ্রহ প্রকাশিত হয় ইরান থেকে। এই কবিতা সংগ্রহটি ইরানের পাঠক সমালোচকদের মনযোগ আকর্ষণ করে। তেহরান আন্তর্জাতিক বই মেলায় এই সংকলনটি বিশেষভাবে আলোচিত হয়। হাদা সেন্দোর কবিতা সংকলন, ‘আমি মরে গেলে স্বপ্ন দেখব’ (Wenn ich sterbe, werde ich träumen, Bilingual Mongolian-German), প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালের ফ্রাঙ্কফুট বই মেলা উপলক্ষে।
ভাষান্তর : অনন্ত উজ্জ্বল