Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ

Icon

জোবায়ের মিলন

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯, ১১:০৩

কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ

বাংলার মাটি ও মানুষের মনের গভীরে এক রক্ত ব্যঞ্জনার নাম মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশ, বাঙালির শিরা-উপশিরায় মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের গাঢ় বীজ। মুক্তিযুদ্ধ বলতেই বাংলার জল-স্থল-আকাশ-বাতাস নড়ে ওঠে, কেঁপে ওঠে, জেগে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধ এক অখন্ড চেতনার প্রতীক হয়ে সে দিন যেমন লিপিবদ্ধ হয়েছিল আজও মুক্তিযুদ্ধ জীবন সংগ্রামের প্রেরণার নিশান হয়ে আছে সগৌরবে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের স্রোত ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে মিশে আছে। বাংলা কবিতায় বাংলাদেশের জন্ম-যুদ্ধের অমর দলিল রক্ষিত আছে নানান ব্যঞ্জনাময় কাব্যিক উক্তির সরল বিন্যাসে। বাংলায় এমন একজন কবি পাওয়া দুষ্কর, যার কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, কথা, ব্যথা, বেদনা, মুক্তি বা বাংলার সংগ্রামের ইতিহাস নেই। 

প্রতিটি পদক্ষেপে রচিত হতে থাকে এক একটি মুক্তিযুদ্ধ। সে মুক্তিযুদ্ধই ’৭১-এ পূর্ণ রূপ লাভ করে। এই দীর্ঘ পরিক্রমায় যা রটনা, যা ঘটনা তার প্রতিটিই বাংলা কবিতায় এসেছে দৃপ্ত পায়ে।

কালের সাক্ষী হিসেবে এর প্রতিটি শব্দই যেন ইতিহাস ‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল/হৃদয়ে লাগিল দোলা/জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা/কে রোধে তাহার বজ্রকন্ঠ বাণী?/গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে/কবি শোনালেন তার অমর কবিতাখানি/এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। (নির্মলেন্দু গুণ-স্বাধীনতা, শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো।) কবিতা সময়ের, কালের।

বাঙালির কালে মুক্তিযুদ্ধ সোনার হরফে লেখা নাম, কপালে সূর্যতিলক। কবিতায় সে মুক্তিযুদ্ধ নানান ভাবে এসেছে, আসবেই। ‘আমাদের বুকের ভেতর যারা/ ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিল সেঁটে/মগজের কোষে কোষে যারা/পুঁতেছিল আমাদেরই আপনজনের লাশ/দগ্ধ, রক্তাপ্লুত/যারা গণহত্যা করেছে/শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেতে ও খামারে/আমি অভিশাপ দিচ্ছি/নেকড়ের চেয়েও অধিক পশু/সেই সব পশুদের/ফায়ারিং স্কোয়াডে ওদের সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে/নিমেষে ঝাঁ ঝাঁ বুলেটের বৃষ্টি ঝরালেই/সব চুকেবুকে যাবে তা আমি মানি না।/হত্যাকে উৎসব ভেবে যারা পার্কে মাঠে/ক্যাম্পাসে বাজারে/বিষাক্ত গ্যাসের মতো মৃত্যুর বীভৎস গন্ধ দিয়েছে ছড়িয়ে/আমি তো তাদের জন্য অমন সহজ মৃত্যু করিনা কামনা...’ (শামসুর রাহমান-অভিশাপ দিচ্ছি)।

এই হলো মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধের বিভিষিকা! এমন জ্বালা, ক্ষত, মৃত্যু, পোড়া বাংলার হাজার-লাখ কবি মনে দাউ দাউ, কবিতায় ভাস্বর। যুদ্ধ-বীভৎসতার পোড়নে পিড়িত কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র কবিতায়ও মুক্তিযুদ্ধের করুন নিধন যজ্ঞের পট উঠে এসেছে- ‘তাঁর চোখ বাঁধা হলো/বুটের প্রথম লাথি রক্তাক্ত করল তার মুখ।/থ্যাতলানো ঠোঁটজোড়া লাল-রক্তে একাকার হলো,/জিভ নাড়তেই দুটো ভাঙা দাঁত ঝরে পড়লো কংক্রিটে।/মা...মাগো... চেঁচিয়ে উঠল সে।/ পাঁচশ’ পঞ্চান্ন মার্কা আধ খাওয়া একটা সিগারেট/প্রথমে স্পর্শ করল তার বুক/পোড়া মাংসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল ঘরের বাতাসে।...’ (কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প)।

শক্তিমান কবি আল মাহমুদের কবিতায় বাঙালির পরাধীনতার দীর্ঘকালীন দুঃসময়ের গ্লানি ফুটে উঠতে দেখি আমরা। তিনি তার ‘দিগিজয়ের ধ্বনি’ কবিতায় লিখেছেন ‘আমাকে বিদীর্ণ করে মাটি ও রক্ত ফুঁড়ে বেরিয়েছে এই নিশান।/...বলো কত দিন ধরে আমরা হাঁটছি, কত কাল কত যুগ?/শিকলের ঝনাৎকার বয়ে নিয়ে আমরা সবগুলো নদী পার হয়ে এসেছি/সবগুলো স্রোতস্বিনী। কিন্তু/পারাপারে তো আমাদের দাসত্ব ঘোচেনি/ আমাদের অন্তরাত্মা না না করছে/কিন্তু দাসত্বের ঝনাৎকারকে আমরা কখনোই চমৎকার বলতে পারি না।’।

মুক্তিযুদ্ধ শুধু যুদ্ধের চলমানতা নয়, যুদ্ধের আগে ও পরের প্রস্তুতি, আশা-আকাক্সক্ষার বীজও মুক্তিয্দ্ধু। মুক্তিচেতনার আরেক কবি, রফিক আজাদের বিখ্যাত কবিতা ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ কবিতায় আমরা দেখি, তিনি লিখছেন ‘...চুনিয়া সর্বদা বলে পৃথিবীর কুরুক্ষেত্রগুলো/সুগন্ধি ফুলের চাষে ভরে তোলা হোক/ চুনিয়ারও অভিমান আছে,/শিশু ও নারীর প্রতি চুনিয়ার পক্ষপাত আছে;/শিশুহত্যা, নারীহত্যা দেখে দেখে সেও/মানবিক সভ্যতার প্রতি খুব বিরূপ হয়েছে/চুনিয়া নৈরাশ্যবাদী নয়, চুনিয়া তো মনেপ্রাণে নিশিদিন আশার পিদ্দিম জ্বেলে রাখে।/চুনিয়াবিশ্বাস করে;/শেষাবধি মানুষেরা হিংসা-দ্বেষ ভুলে/পরস্পর/সৎ প্রতিবেশী হবে।’

কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে শেষ করা যাবে না। খ্যাতনামা কবি আবিদ আজাদ তার একটি মর্মস্পর্শী মুক্তিযুদ্ধের কবিতায় সাহসী উচ্চারণ করেছেন এমন-...এখন যে কবিতাটি লিখব আমি/তার জন্য আমার সন্তানের জন্মের যন্ত্রণা মুখে নিয়ে/আমার প্রিয়তমা নারীর মতো/অপেক্ষা করছে আমার বাংলাদেশ।’

বাংলার জন্মক্ষণের স্মরণক্ষণটি সুখের নয়। মুক্তির যুদ্ধের কালটি আনন্দের নয়; দীর্ঘ নয় মাস যে রক্তক্ষয়ের বেদনার্ত সময় অতিবাহিত করে উদিত হয়েছে রক্তলাল সূর্য, চিরমুক্তির নিশান তা কবির কবিতায় হাজার বছর বললেও শেষ হবে না। শেষ হয়ও নি। যে দেশের, যে জাতির ললাটে মুক্তির জন্য এমন যুদ্ধ, এমন করুন কাহিনি, এমন মরন কামড় গাঁথা; সে জাতি কি পারে কবিতায় রক্ত-রঙে সচিত্র প্রতিবেদন না লিখে থাকতে!

যে মুক্তিযুদ্ধ দু’লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম, ত্রিশলাখ শহীদের রক্ত আর অযুত-নিযুত খতিয়ানের হিসাব সে মুক্তিযুদ্ধ কী করে আড়াল থাকে কবির কবিতায়! যখন এমন নির্যাতন তখন তো কবির কলমে যুদ্ধের দশদিক উঠে আসবেই। কবি তো বাস্তবতারই এক নিখুঁত দলিল লেখক।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫