Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

জসীম উদ্দীন কেন গ্রাম বাংলার কবি?

Icon

চঞ্চল নাঈম

প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২২, ১৫:২৭

জসীম উদ্দীন কেন গ্রাম বাংলার কবি?

জসীম উদ্দীন। ছবি: সংগৃহীত

সাংস্কৃতিক ঘেরাটোপের মধ্যে কবির চেতনা উপভোগ করলেও, কবি পরিপার্শ্বিক সামাজিক-রাজনৈতিক উপাদান-উপকরণ নিয়ে বেড়ে ওঠে। ফলে কবিতা বা সাহিত্য-জগতের সঙ্গে ধীরে-ধীরে কবির নিবিড় বন্ধুত্ব ঘটে। ঠিক তেমনি জসীম উদ্দীনের কবিতায় পল্লীজীবনের নানা রূপ-ঘটনা চিত্র সহজসরলভাবে উঠে আসে। তাই বাংলা কবিতার বিকাশের ধারায় জসীম উদ্দীন এখনো একটি উজ্জ্বল নাম।

রবীন্দ্রযুগের কবি হয়েও রবীন্দ্র প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থেকে পল্লীজীবন ও গ্রামীণ প্রকৃতিকে অবলম্বন করে নিজের কাব্যভুবন স্বকীয়তায় বিকশিত করেন; কিন্তু তাঁর বেড়ে ওঠার সময়ে রবীন্দ্রযুগের বলয় ভেঙে নিজস্ব কবিতা-চিন্তায় আরও দু’জন কবি বেড়ে ওঠেন, নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশ। যদিও নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশের থেকে কয়েক মাসের ছোট। তবুও নজরুল ইসলামের কবিতার বিকাশ ঘটেছিল, জীবনানন্দ দাশের আগে। আবার নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশের প্রায় বছর চারেক ছোট ছিলেন জসীম উদ্দীন; কিন্তু তাঁর বেড়ে ওঠা এই দুই কবির সমসাময়িক সময়ে। নতুন ভাবে গ্রামীণ জীবনের পটভূমির আঙ্গিকে। 

জসীম উদ্দীন (১ জানুয়ারি ১৯০৩-১৪ মার্চ ১৯৭৬) একজন গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি কবি। জসীম উদ্দীন আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধারণ করা কবি। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ ও ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ বাংলা ভাষার গীতিময় কবিতার অন্যতম উদাহরণ। তাঁর লেখা অসংখ্য পল্লীগীতি এখনো গ্রাম বাংলার মানুষের মুখে মুখে। মনে আসে- ‘আমার হার কালা করলাম রে’ ও ‘আমায় ভাসাইলি রে’ ইত্যাদি। ১৯৩১ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত, দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্গে লোক সাহিত্য সংগ্রাহক হিসেবে জসীম উদ্দীন কাজ করেন। তিনি পূর্ববঙ্গ গীতিকার একজন সংগ্রাহকও। কবি জসীম উদ্দীন ১০ হাজারেরও বেশি লোকসংগীত সংগ্রহ করেছেন, যার কিছু অংশ তাঁর সংগীত সংকলন জারি গান এবং মুর্শিদী গানে স্থান পায়। এ ছাড়াও জসীম উদ্দীন গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য নিয়ে বহু গান রচনা করেছেন।

বাংলার বিখ্যাত লোক সংগীতের গায়ক আব্বাসউদ্দীন, তাঁর সহযোগিতায় কিছু অবিস্মরণীয় লোকগীতি রচনা করে সাধারণ মানুষের দৃষ্টির সীমানায় এনেছিলেন, বিশেষত ভাটিয়ালী ধারার গানগুলোকে প্রাধান্য দিয়েছেন। জসীম উদ্দীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যয়ন শেষ করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ বছর শিক্ষকতা করেন। ১৯৪৪ সালে শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকার এবং পরে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬২ সালে অবসরগ্রহণ করেন। জসীমউদ্দীন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার একজন দৃঢ় সমর্থক ছিলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম প্রবাদ পুরুষ।

কাব্যজগতে জসীম উদ্দীন বেড়ে ওঠার সময়ে রবীন্দ্র-বলয় বড় প্রভাব ফেলেছে। তবে তিনি রবীন্দ্রপ্রেমী ছিলেন। বরং তিনি রবীন্দ্র-বলয় আবহে থেকে একটু ভিন্ন ধারার কবিতা চর্চা করেছেন। তিনি নানা কারণে বাংলা ভাষাভাষী ও সাহিত্যিক সমাজের লোভনীয়, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ১৯৭৪ সালে প্রত্যাখ্যান করেন। 

তবে প্রশ্ন আসতে পারে, জসীম উদ্দীন তাঁর পূর্ববর্তীকালের অগ্রজ কবিদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন কিনা? বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কাব্যচিন্তার প্রকাশভঙ্গিতে, তবে জসীম উদ্দীনের কাব্যশৈলী পল্লীজীবনের নানা রূপচিত্র, যা তাঁর কবিতার সম্পদ। অথচ জসীম উদ্দীনের কবিতা সত্যিকারের বাঙালি জাতির গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, উপরন্তু কৃষক, তাঁতি, কামার, কুমোর, মাঝিদের জীবনযাত্রা আবহে রচিত ও সাধারণ মানুষের মনোজগতের অনুগামী। যদিও তিনি অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা না হলেও এবং সমসাময়িক কবিদের থেকে ভিন্ন। তিনি ত্রিশ-উত্তর ইউরোপ দ্বারা প্রভাবিত আধুনিক বাঙালি কবিগণের রোমান্টিক কাব্যবন্দনা গ্রহণ না করে, বরং বাঙালিজাতির নিজস্ব ঐতিহ্যকে কবিতার প্রধান বিষয়-উপকরণ করেছেন। ক্রমাগত শহুরে সভ্যতার বিকাশমান দৃশ্যপট দেখেও নিজ চেতনায় গ্রামবাংলার চিরায়ত রূপটি তাঁর কবিতায় আনয়ন করার চেষ্টা করেছেন; কিন্তু গ্রামীণ জীবনের প্রেম-ভালোবাসা, সংগ্রাম ও স্বপ্নযাত্রা কবিতায় বারংবার তুলে এনেছেন।

তবে এটা সত্য যে জসীম উদ্দীন সমসাময়িক কবিদের কাব্যচেতনা গ্রহণ করেনি, বরং সমকালীন কবিদের কাব্যভাষায় প্রলুব্ধ না হয়ে নিজ চেতনায় পথ হেঁটেছেন। আর ক্রমাগত কাব্যভাষার পরিবর্তিত রূপ কিছুটা বর্জন করেছেন। তবে সচেতনভাবেই ইংরেজি সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত কবি-সাহিত্যিকগণকে তাঁর সমগ্র-কাব্য জীবনচেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছেন। হতে পারে এটিও তার একান্ত শিক্ষা ও জীবনচেতনার প্রকাশভঙ্গি।

তাইতো ত্রিশ-উত্তর কবিদের সম্পর্কে জসীম উদ্দীন সহজেই বলেছিলেন- ‘আজকাল একদল অতি আধুনিক কবিদের উদয় হয়েছে। এরা বলে সেই মান্ধাতা আমলের চাঁদ জোছনা ও মৃগ নয়নের উপমা আর চলে না। নতুন করে উপমা অলঙ্কার গড়ে নিতে হবে। গদ্যকে এরা কবিতার মতো করে সাজায়। তাতে মিল আর ছন্দের আরোপ বাহুল্যমাত্র। এলিয়ট আর এজরা পাউন্ডের মতো করে তারা লিখতে চায়। বলুন তো একজনের মতো করে লিখলে তা কবিতা হবে কেন?’ তাঁর এই বক্তব্যের সঙ্গে অনেক পাঠক ভাবনে তবে একমত হওয়া যায় না; কিন্তু তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট, নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোজগতকে সর্বদাই প্রধান্য দিয়েছেন। স্বসমাজের জাগরণের আঙ্গিক তুলে ধরেছেন।

এ ছাড়া তাঁর কবিতার উপাদান লোকজ হলেও বুনন-চিন্তা অনেকটাই ভিন্ন ধারার। পরম্পরাকে স্বীকার করে বারংবার ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ গ্রন্থে পথ খুঁজেছেন ঠিক এই ভাবে-‘কাঁচা ধানের পাতার মতো কচি-মুখের মায়া/তার সঙ্গে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণের ছায়া।’ 

জসীম উদ্দীন সহজ-সরল নিয়মে বাংলার মানুষের মননের ভাষা বুঝতে পেরেছিলেন। আর তিনি সাধারণ মানুষের হৃদয়ের কথা লিখে উপভোগ করেছেন মনের উষ্ণতা। আবহমান বাংলার নিবিড় পল্লীর অন্তঃসুর ও মায়ার আবেশ কবির সংবেদনশীল অনুভব নিরন্তর উঠে আসে। তিনি গ্রামীণ জনজীবনের সবচেয়ে নিকট স্বজন, পল্লী-মানুষের সুখ-দুঃখের সামগ্রিক চৈতন্য বিবেচনায় অনুভবভাগী। তাঁর সুপরিচিত দুটি কাব্য ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ ও ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’, পরিবর্তনমান কালের ভাষা চেতনাকে ধারণ না করে বরং গ্রাম-বাংলার জনজীবনের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে কাহিনীকাব্যে রূপ দেন। উপরন্তু বাংলা-ভাষা সাহিত্যে কাহিনীনির্ভর কাব্যের দীর্ঘ এক ঐতিহ্য আছে। মধ্যযুগের কাব্যে চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, মঙ্গলকাব্যের দীর্ঘায়িত ধারা, এমনকি সুফি সাহিত্য সবই কাহিনীকাব্যের অন্তর্ভুক্ত এবং সেইসঙ্গে কাহিনীর প্রধান অনুষঙ্গ- প্রেম-বিরহ।

আধুনিক কাব্যে-সাহিত্যে এই প্রেম বরাবরই মানবিক, আবহমান বাংলার নারীর জন্য চিরায়ত পুরুষের হৃদয়ের হাহাকার। ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ দু’জন গ্রাম্য বালক-বালিকা রূপাই ও সাজুর প্রণয় ও বিরহের চূড়ান্ত পরিণতির বর্ণনা এবং যা সর্বোপরি কাহিনীকাব্য। চিত্রশিল্পী ও লেখক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ বইটির ভূমিকায় লিখেছিলেন- ‘এ লেখার মধ্য দিয়ে বাংলার পল্লীজীবন আমার কাছে চমৎকার একটি মাধুর্যময় ছবির মতো দেখা দিয়েছে।’ গ্রামীণ মানুষের প্রেম-ভালোবাসা ও জীবনযাপন যতটা সহজ-সরল, জসীম উদ্দীনের কবিতার প্রকাশভঙ্গি বাঙালির সহজাত মনোজগতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য; কিন্তু বুদ্ধদেব বসু তাঁর সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ সংকলনে জসীমউদ্দীনের কবিতা সংকলনভুক্ত করেছিলেন। তবে হুমায়ুন আজাদ তাঁর ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ সম্পাদনায় জসীম উদ্দীনের কবিতা গ্রহণ করেননি। বরং তাঁর কবিতা বর্জন করেছেন। হয়তো হুমায়ুন আজাদ আধুনিক কবি হিসেবে জসীম উদ্দীনকে বিবেচনায় রাখেননি; কিন্তু আসলেই কী জসীম উদ্দীন আধুনিক কবি নন? এই প্রশ্ন অনেকেরই মনে জেঁকে বসেছে। এই তর্কের মীমাংসাও এখানে আপাতত সম্ভব না।

বরং ধারণায় আসে, দুই সম্পাদকের দৃষ্টিভঙ্গি দুই রকম ছিল এবং হয়তো তাদের নিজস্ব যুক্তি ছিল জসীমউ দ্দীনের কবিতা প্রসঙ্গে। তবে জসীম উদ্দীনের কবিতার অন্যতম দিক সাবলীল অনাড়ম্বরতা। তাঁর কবিতা পড়তে কোনো ক্লান্তি আসে না। বরং গ্রাম-বাংলার ঐতিহাসিক সৌন্দর্যবোধ সাধারণত আলোড়িত করে। আর তিনি আবহমান বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্য উপস্থাপনের অন্যতম রূপকার।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫