
যে বাড়িতে বিদ্রোহী কবিতাটি লেখা হয়েছিল। ছবি: হামিদ কায়সার
কালজয়ী মানুষের ব্যবহারে কোনো কোনো বাড়ি কিংবা গাড়ি হয়ে যায় ইতিহাস। জানান দেয় নানান অজানা গল্পের। প্রবল আগ্রহ নিয়ে মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে দেখতে যায়। যেমন ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি, কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক গাড়ি। তেমনি কলকাতার সদর স্ট্রিটের ৮নং বাড়ির কাছে ৩/৪ সি, তালতলা লেনের একটি বাড়ি।
এই বাড়িতে থাকতেই জন্ম হয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার। ১০০ বছর আগে অর্থাৎ ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে মাত্র ২২ বছর বয়সী নজরুলের বিখ্যাত ও আলোচিত কবিতাটি। কবিতাটি প্রকাশ হয় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায়। সে হিসাবে ১০০ বছর ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশের। পরবর্তীতে কবিতাটি মাসিক ‘মোসলেম ভারত’, ‘ধূমকেতু’, ‘প্রবাসী’, মাসিক ‘বসুমতী’ ও ‘সাধনা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। পরপর ৬টি পত্রিকায় ‘বিদ্রোহী’র পুনঃপ্রকাশিত হওয়াকে নজিরবিহীন ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন অনেকে।
জানা যায়, কাজী নজরুল ইসলাম নানান স্থানে ঘুরে কুমিল্লা থেকে কলকাতায় এলেন বিদ্রোহী’ রচনার কিছুদিন আগে। তখন কলকাতা ৩/৪-সি তালতলা লেনের নিচের তলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরটিতে থাকতেন মুজফফর আহমদ। তিনি তখন কমিউনিস্ট পার্টির বড় নেতা। তৎকালে এই ঠিকানা বহু বিপ্লবীদের আশ্রয়স্থল হিসেবে চিহ্নিত ছিল। ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’-র প্রাণপুরুষ মুজফফরের রাজনৈতিক সক্রিয়তাও তখন বাড়ছে। সবাই তাকে ‘কাকাবাবু’ বলে ডাকছে।
তালতলার বাড়িটি ছিল মুজফফর আহমদের ভাড়া বাড়ি। আর এটি প্রথমে ভাড়া নিয়েছিলেন কুমিল্লা জেলার নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানির দৌহিত্ররা। ওপরে-নিচে মোট চারটি ঘরের দুটি ঘর থেকে একটি ঘরে থাকতেন মুজফফর। তার একটি অংশে মুজফফর আহমদের সঙ্গে একুশ বছরের নজরুল ইসলামও থাকতেন। এই ঘরেই চলে মনে-প্রাণে বিদ্রোহের সুর ও স্বরের প্লাবন। সুনাম ছড়াচ্ছে নজরুল কবি ও গায়ক হিসেবে কেবল। ধারণা করা হয় বড়দিনের ছুটির সময় শেষ রাতে ঘুম ভেঙে কবিতাটি লিখে ফেললেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বরের শেষে জন্ম বাংলা কবিতার ভিন্নস্বর বিদ্রোহী-
‘বল বীর -
বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি নতশির ঐ শিখর হিমাদ্রির!’
মুজফফর আহমদ তার স্মৃতি কথায় (কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা) লিখেছেন, “তখন নজরুল আর আমি নিচের তলার পূর্ব দিকের, অর্থাৎ বাড়ির নিচের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরটি নিয়ে থাকি। এই ঘরেই কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি লিখেছিল। সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে। রাত্রির কোন সময়ে তা আমি জানিনে। রাত ১০টার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি এমন সময় নজরুল বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটি সে তখন আমায় পড়ে শোনাল।
‘বিদ্রোহী’ কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা। আমার মনে হয়, নজরুল শেষ রাত্রে কবিতাটি লিখেছিল, তা না হলে এত সকালে সে আমায় কবিতা পড়ে শোনাতে পারত না। ....এখন থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে নজরুলের কিংবা আমার ফাউন্টেন পেন ছিল না। দোয়াতে বারে বারে কলম ডোবাতে গিয়ে তার মাথার সঙ্গে তাল রাখতে পারবে না, এই ভেবেই সম্ভবত সে কবিতাটি প্রথমে পেনসিলে লিখেছিল।”
তার পরের ইতিহাস সবার জানা। বহুপঠিত হয়েছে কবিতাটি। বিদ্রোহী কবিতার পঙ্ক্তি ১৩৯। ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি শুক্রবার সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায় প্রথম ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ছাপার ফলে কাগজের চাহিদা বাড়ে। এত হয়েছিল যে, সেই সপ্তাহে ওই কাগজটি দু’বার ছাপাতে হয়েছিল।
অধ্যাপক বেগম আকতার কামাল বলেন, ‘ঔপনিবেশিক ভারতের সেই সময় যখন নজরুল আবির্ভূত হলেন, তখন তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঔপনিবেশিক বিরোধিতা বড় করে তুলছেন। বল বীর, চির উন্নত মম শির, এই বীর তিনি বলছেন সমস্ত বাঙালিকে, যে বীরের মতো তোমরা উঠে দাঁড়াও। ভীরু বাঙালিকে উদ্দীপ্ত করে তুলতে চেয়েছেন, তাদের জাগ্রত করতে অসংখ্য শব্দের ঝংকারে কবিতাটি যেন পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে!’
উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয় কবির সুনাম। এর মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্য নজরুলকে সমালোচনাও হজম করতে হয়েছে। তবু তিনি থেমে থাকেননি। সমানে লিখে চলেছেন গল্প-উপন্যাস-কবিতা-গান ও প্রবন্ধ। দিয়ে গেছেন ‘ব্যথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’, ‘রাক্ষসী’; উপন্যাস বাঁধনহারা, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘কোরবানি’, ‘মোহররম’, ‘আগমনী’, ‘রণভেরী’, ‘আনোয়ার’, ‘কামাল পাশা’র মতো কালজয়ী সৃষ্টি।
সেই ঠিকানা আজও আছে। বসানো হয়েছে সেখানে নজরুল স্মৃতির ফলক। ৩/৪-সি তালতলা লেন, কলকাতা-১৪। কয়েকবার হাতবদল হয়েছে এর মালিকানার। এর সামনের অংশটি অবশিষ্ট থাকলেও পিছনে দিকে যে ঘরটিতে বসে কবি বিদ্রোহী কবিতাটি রচনা করেছিলেন সেটির কিছুটা সংস্কার ও পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। কবিতাটির প্রাসঙ্গিকতা আজও আছে।
অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ লেখেন, পরাধীনতার গ্লানিতে নজরুলচিত্ত দীর্ণ হয়েছে এবং এই গ্লানি থেকে মুক্তির অভিলাষে তিনি হয়েছেন বিদ্রোহী। তবে কেবল দেশের স্বাধীনতা কামনাতেই তার বিদ্রোহী চিত্তের তৃপ্তি ছিল না, তার বিদ্রোহ ছিল একাধারে ভাববাদী ও বস্তুবাদী। তার বিদ্রোহ ছিল পরাধীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার, সকল আইন-কানুনের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ, ইতিহাসনিন্দিত চেঙ্গিসের মতো নিষ্ঠুরের জয়গানে মুখর, ভৃগুর মতো ভগবানের বুকে পদাঘাত-উদ্যত, মানবধর্ম প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় সংকল্প, ধ্বংসের আবাহনে উচ্ছ্বাসিত, সুন্দরের প্রতিষ্ঠায় উদ্বেলিত।
প্রসঙ্গত, জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেছিলেন, গত ১০০ বছরে বহু আন্দোলন-সংগ্রামে বিদ্রোহী কবিতাটি বাঙালিকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। কেবলমাত্র ‘বিদ্রোহী’র জন্য হলেও নজরুল যুগ যুগ স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।