
প্রতীকী ছবি
একটা সবজির পিকআপে করে ঢাকা ফিরছে কিছু মানুষ। গার্মেন্টস খুলে দিয়েছে আগামীকাল থেকে। ঈদের ছুটিতে গ্রামেগঞ্জে বাড়িতে ঈদ করতে যাওয়া মানুষগুলো যে যেভাবে পারছে পাগলের মতো রাজধানীমুখো হচ্ছে। চাকরি বাঁচাতে হবে, চাকরি বাঁচলে রোজগার থাকবে পেট বাঁচবে, পেট বাঁচলে জীবন।
সবজিগুলোর স্তূপের ফাঁকে গাদাগাদি করে বসে আছে আট দশজন। বাদশাহ মিয়াও মুখে একটা মলিন কাপড়ের মাস্ক পরে, বুকের কাছে একটা ছোট লাল রঙের সস্তা ট্রাভেল ব্যাগ আঁকড়ে জবুথবু হয়ে বসে আছে। চোখের নিচে নির্ঘুম রাতের কালো ছাপ। ছিপছিপে দীর্ঘকায় শরীরটাকে ভাঁজ করে পালং শাকের স্তূপের মধ্যে বসে চোখ বন্ধ করে কী যেন ভাবছে এলোপাতাড়ি। রাস্তাঘাটের কোনো কোলাহলই তাকে স্পর্শ করছে না। কোনো গন্ধও সে পাচ্ছে না এই ঘিঞ্জি স্তূপ করে রাখা সবজির।
গত কদিন ধরে তার গা কাঁপানো জ্বর। মুখে কোনো স্বাদ নেই। বিড়ি ফুঁকলেও কোনো গন্ধ পাচ্ছে না সে বিড়ির তামাকের। বাড়িতে কাউকে টের পেতে দেয়নি সে। ঈদের পর পরই যেদিন সন্ধ্যায় গা কাঁপানো জ্বর এলো, তখনই বাদশাহ মিয়ার মনে কু ডাক দিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে চুপিসারে একটা প্যারাসিটামল খেয়ে বালিশ নিয়ে অন্য রুমের বিছানায় শুয়ে পড়েছিল।
বাদশাহ মিয়ার মনের খচখচানি সেই রাত থেকেই শুরু হয়েছিল যখন গা কাঁপানো জ্বরের সঙ্গে, গা গতরের জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথায় রাতভর কোকাচ্ছিল।
পরীর মা সেই দিন রাতে খাওয়ার সময় ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেছিল,
কি হইছে পরীর আব্বা? খাইতাছুইন না যে? শরীর খারাপ করছেনি আফনের? মুখখান অমন কালা লাগতাছে ক্যান? আলাদা শুইবেন ক্যান?
বিস্বাদ ভাতের নলা মুখে তুলতে তুলতে অসহায় হাসি ঠোঁটে চেপে বাদশা মিয়া উত্তর দিয়েছিল,
- আরে এক বিছানায় তিনজনার ঘুমাইতে কষ্ট অয়। গরম লাগে। ওই রুমটায় রাইতের বেলা ঠান্ডা বাতাস আহে, ওইহানে শুই। তোমরা মা-মাইয়া আরাম কইরা এইহানে শোও।
পরী কাঁদো কাঁদো আহ্লাদে বলছিল,
-আব্বা, আমি তোমার লগে ঘুমামু, না অইলে আইজ রাতে তো পরীর গল্প শুনতে পারতাম না।
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে অসুস্থ বাদশাহ মিয়া মিথ্যা বলেছিল সেদিন,
- না রে, আম্মাজান। তুই তোর মায়ের লগেই শোও। আইজ আমার একটু মাথাব্যথা করতাছে যে। পরীর গল্প, তারার গল্প আরেকদিন হুনামু নে, ঠিক আছে আম্মাজান?
পরীর মা মেয়েকে মুখে তুলে খাওয়াচ্ছিল। বাবার মাথাব্যথা শুনেই মুখে ভাত নিয়ে বাবার পাশে উঠে এসে মাথা টিপতে শুরু করে দিয়েছিল পাঁচ বছরের ফুটফুটে পরীর মতো মেয়েটা। অব্যক্ত সুখের আনন্দে সেদিন চোখে জল চলে এসেছিল বাদশাহ মিয়ার।
পিকআপটা একটা ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল। ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। হাল্কা একটা ঝিমুনি চলে এসেছিল বাদশাহ মিয়ার। সেই ঝিমুনিটা কেটে গেল। রাস্তায় পুলিশ চেকপোস্টে গাড়ি থামিয়েছে। পুলিশের উচ্চবাচ্য শুনতে পাচ্ছে সে। এ নিয়ে মাথা ব্যথা নেই তার। ঢাকা শহরে কোনোমতে পৌঁছুতে পারলে সে বাঁচে। পেটের দায়ে এমন লক্ষ লক্ষ শ্রমিক পঙ্গপালের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসছে রাজধানী উদ্দেশ্য করে।
মাথাটা নিচু করে পালং শাকের স্তূপের মধ্যে আরেকটু ঘন হয়ে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করল সে। পালং শাকের কোনো গন্ধই সে পাচ্ছে না। ভাবতে অবাক লাগে তার। ঘ্রাণহীন এই দুনিয়া আজব লাগে তার কাছে! সে অনুভব করে, ঘ্রাণ ছাড়া যে কোনো জিনিসের অস্তিত্ব অসাড়, অনুভূতিহীন লাগে।
পুলিশের চড়া গলা আর শোনা যাচ্ছে না। পুলিশের সঙ্গে গাড়ির চালকের হয়ত কোনো ফয়সালা হলো। পুলিশ কোনো ধরনের চেক না করে গাড়ি ছেড়ে দিল। বাদশাহ মিয়া মনে মনে হাসে, চকচকে টাকা নোটের কাছে দুনিয়া অর্থহীন। টাকায় সব কেনা যায়, মাইনষ্যের মাথাও।
ঝাঁকুনি দিয়ে স্টার্ট হলো ইঞ্জিন। দুলুনি খেতে খেতে আবার যাত্রা শুরু হলো তিলোত্তমা নগরীর লাল নীল বাতির শহরের পথে। একটা গান মনের মধ্যে গুণগুণ করে ওঠে তার, ঢাকা শহর আইস্যা আমার আশা পুরাইছে। আশা তো পূর্ণ হয়নি, বরং আশা ফুরাচ্ছে দিন দিন। মাস্কের ভিতর একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাদশাহ মিয়া।
টাঙ্গাইল থেকে কয়েকজন মিলে ভাড়া ঠিক করে সবজির পিকআপে করে রওনা দিয়েছে তারা। আগামীকাল থেকে সকল গার্মেন্টস খুলে দিচ্ছে বলে হুট করে জানিয়েছে গার্মেন্টস মালিকরা। একই গার্মেন্টসে কাজ করে তারা। যে কোনো উপায়েই যেহেতু ঢাকায় ফিরতেই হবে, তাই অবশেষে এই ব্যবস্থা। বাদশাহ মিয়াও তাদের সঙ্গে রওনা দিয়েছে। শরীরে জ্বর জ্বর ভাব এখনো আছে। কাউকে জানায়নি জ্বরের কথা। যদি সঙ্গে না নেয় এই ভয়ে! মাস্কটা জোরে চেপে তীব্র গতিতে আসা খুশখশে কাশিটা সংবরণ করল সে। করোনা টেস্টও করায়নি সে, কীভাবে করাবে? টেস্টে তো টাকা লাগবে। টানাটানির সংসারে শুধু শুধু করোনা টেস্ট করিয়ে টাকাটা জলে ফেলতে চায়নি; কিন্তু সব উপসর্গ জানান দিচ্ছে করোনার সম্ভাব্যতা। বাদশাহ মিয়া মনে মনে ভাবে, গরিবের আবার করোনা কি? অভাবই তো এখন সবচেয়ে বড় ভাইরাস তাদের জীবনে।
মনে হয় জ্বর বাড়ছে। নিঃশ্বাসটা গরম হয়ে উঠছে মাস্কের ভিতর। বাদশাহ মিয়া আবার গাড়ির দুলুনির তালে তালে ঘোরের ভিতর চলে গেল। গেল ঈদে মেয়েটার জন্য কিছু কিনে দিতে পারে নি। মেয়েটা হয়ত বড় আশা করে ছিল যে তার বাবা পরীর মতো লাগবে দেখতে এমন একটা সুন্দর ঝলমলে ফ্রক কিনে দিবে আর সেই ফ্রক পড়ে বাবার হাত ধরে গ্রামের রাস্তায় নাচতে নাচতে ঘুরে বেড়াবে। বাদশাহ মিয়া পারেনি। করোনা এসে গত বছর থেকে সব ওলট-পালট করে দিয়েছে জীবনের হিসাব-নিকাশ। সংসারে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। গার্মেন্টসে বেতনের টাকাটাও ঠিকঠাক মতো পায় না আজকাল। বেতন আটকে আছে শ্রমিকদের। ব্যাংকে কিছু জমানো টাকা ছিল সেটাও ভাঙিয়ে খেয়ে ফেলেছে লকডাউনের এই নিষ্ঠুর খেলায়। এখন ভরসা শুধু এই চাকরিটাই। করোনায় গার্মেন্টস শিল্পেও ধস নেমেছে। আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় অনেক কর্মীও ছাঁটাই হয়েছে। বাদশা মিয়াও ভয়ে ভয়ে ছিল কখন জানি চাকরিটা চলে যায়। দুই পয়সার চাকরি, এটা চলে গেলে তো না খেয়ে দিন পার করতে হবে তাদের।
জন্মের সময় ফুটফুটে দেখতে হয়েছিল দেখেই বাবা বড় শখ করে ছেলের নাম রেখেছিলেন বাদশাহ মিয়া। হয়ত তার বাবা ভেবেছিল বাদশাহ নাম রাখলে বাদশাহের মত ধনাঢ্য জীবন হবে তার ছেলেটার। নামটা শুধু নামেই রইল একটা কৌতুক হয়ে, জীবন নাটকের কাজে কর্মে বাদশাহ গিরি দেখাতে পারল না। হাইস্কুলটা তাও কোনোমতে পার করতে পেরেছিল বলেই গার্মেন্টসে একটা কাজ পেয়েছে। নয়তো এমন নিস্তরঙ্গ আশাহীন জীবন যাপন দেখলে নামের সঙ্গে মিল খুঁজে পাবে না কেউই, স্বয়ং বিধাতাও। যেটুকু সঞ্চয় নিয়ে ঈদ করতে বাড়ি গিয়েছিল এবার, সেই শেষ সম্বলটুকু ও ঢাকা ফেরার গাড়ি ভাড়া গুনতে হলো তার। শূন্য পকেটে ফিরছে রাজধানী। করোনা উপসর্গ নিয়েও কাউকে না জানিয়ে শুধু পেটের দায়ে ঢাকার পথে রওনা দিচ্ছে সে। এমনিতেই তার গরিবি হাল, তার ওপর ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’। গত মাসে যখন বৃদ্ধ বাপটা করোনায় মারা গেল, শেষমূহূর্তে বাপের চিকিৎসার জন্য এত অভাব অনটনের মধ্যেও টাকা পাঠিয়েছিল সে। বাপটা কে বাঁচাতে পারেনি। শুধু বাপের কবরের সামনে গিয়ে মাফ চেয়ে অনেক কেঁদেছিল সে।
মাস্ক মুখেও বাদশাহ মিয়া টের পায় মাস্কটা চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে। সবার অগোচরে চোখটা মুছে সে।
মেয়েটার জন্য বুকটা পুড়ে যায় বাদশাহ মিয়ার। এবার ঈদে দুপুরবেলা আয়েশ করে যখন মাংস-পোলাও খেতে বসেছে সবাই, তখন আহ্লাদ করে মেয়েটা বলে ওঠে,
-আব্বা জানো? সালমারে তার আব্বা কী সুন্দর একখান টকটকা লাল ফ্রক কিইন্যা দিছে।
বাদশাহ মিয়ার গলা দিয়ে পোলাও-মাংস নামতে চায় না। একটা কষ্টের দলা পাকতে শুরু করে গলার ভিতর। কাউকে কিছু বলতে পারে না। শুধু সেদিন রাতে ঘুমানোর আগে পাশে শুয়ে পরীর দুই গাল টিপে আদর করে বলেছিল,
-আমার পরীর লাইগ্যা চাঁন্দের লাহান ধবধবা সাদা পরীর মতো দেখতে লাগব এমুন একখান ফ্রক আনমু এইবার, ঠিক আছে আম্মাজান?
পরী খুশিতে ঝলমল করে উঠেছিল-সত্য আব্বা?
বাদশাহ মিয়া কপালে চুমুখেয়ে বলেছিল,
-হ, আম্মাজান। সত্যই আনমু।
‘কাওরান বাজার আইয়া পড়ছি, নামেন সবাই’- পিকআপের হেলপারের কর্কশ কণ্ঠে বাদশাহ মিয়ার মিষ্টি ভাবনার রেশ কাটে। ঢাকায় এসে পড়েছে। এখন গন্তব্যপথে যাত্রা। কাল থেকে যুদ্ধ শুরু। বেঁচে থাকার লড়াই-টিকে থাকার লড়াই। ব্যাগটা নিয়ে গাড়ি থেকে নামতেই যেন মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল তার। জ্বরে শরীরটা বেশ কাবু হয়েছে। খুব দুর্বল লাগছে। বিস্বাদ ঘ্রাণহীন আশপাশটা অসহ্য লাগছে তার।
চাইনিজ ব্র্যান্ডের ছোট্ট বাটন ফোনের রিংটোনটা বিরক্ত করল তাকে। বাম পকেট থেকে ফোনটা বের করে কল রিসিভ করল, -হ্যালো?
-ও পরীর বাপ, আফনে কই? পৌঁছাইছুইন? আমার পরী সকাল থাইক্যা ক্যামন জানি করতাছে। গায়ে ম্যালা জ্বর। বমি করতাছে খালি। আমার ক্যামন যেন ভয় করতাছে। করোনা অইল নাকি? ও পরীর বাপ, আফনে কই? আফনে আইয়া পড়ুইন, ক্যামনে কি করুম আমি একলা? ও পরীর বাপ, কথা কইতাছুইন না ক্যান, শুনতাছুইন? হ্যালোও পরীর বাপ...
বাদশাহ মিয়া আস্তে করে ফোনটা কান থেকে নামিয়ে রাখে। তার মাথা কাজ করছে না। মনে হচ্ছে তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। মেয়েটার অনেক জ্বর। চোখের সামনে মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছে সে, ধবধবা সাদা একটা ফ্রক পড়ে তার দিকে দৌড়ে আসছে।
সবকিছু অসাড় হয়ে আসছে তার। ফিরে যাওয়ার কোনো শক্তি নেই তার, কোনো উপায় নেই তার। মাথার ভিতর কোনো হিসাব-নিকাশ কাজ করছে না। মন ছুটে পালাতে চাইছে মেয়ের কাছে; কিন্তু এ মূহূর্তে এমন অসুস্থ শরীর নিয়ে আবার ফিরে যাওয়ার জোর নেই, পকেটে কানা কড়িও নেই। অসহায়ত্বের চরম সীমানায় পতিত একজন পিতা এখন বাদশাহ মিয়া। তার দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রুবন্যা বইতে শুরু করেছে। নিষ্ঠুর এ শহরের কোলাহলে সেই অশ্রু ঢেউয়েরও কোনো মূল্য নেই।
বাদশাহ মিয়া দুনিয়ার অসহায় পিতাদের একজন হয়ে কপর্দকহীন শূন্য হৃদয়ে রাজধানীর বুকে হেঁটে চলেছে ডানাভাঙা স্বপ্নগুলো নিয়ে...।