(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
জীবনানন্দের উপন্যাস : আত্মজৈবনিক উপাদান ও তার সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক বহিঃপ্রকাশ

আসমা চৌধুরী
প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৩:১৬
-621484e047358-621c76c216d33.jpg)
জীবনানন্দ দাশ
দুই বিশ্বযুদ্ধ, কল্লোল যুগ, মার্ক্সীয় যুদ্ধস্পৃষ্ট পরিবেশে থেকেও জীবনানন্দ কল্লোল বা মার্ক্সীয় ইশারা কোনোটিতেই পুরোপুরি অবগাহন করেননি। তিনি ইতিহাসজ্ঞানের আলোকে জীবন, জগৎ, সমাজ, সময় ও সভ্যতাকে গভীর কৌতূহলের সঙ্গে অবলোকন করেছেন। তিনি দেখেছেন মানবসভ্যতা ব্যক্তিভিত্তিক, ব্যক্তিই তৈরি করে সভ্যতার নিবিড় পটভূমি।
জীবনানন্দের ব্যক্তিগত জীবন উপন্যাসের কাহিনী, চরিত্রে প্রচণ্ডভাবে উপস্থিত কারণ তিনি দেখেছেন বিশ্বযুদ্ধ, যুদ্ধের পরিণাম, অর্থনৈতিক মন্দা, মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। তিনি দেখিয়েছেন একজন শিক্ষিত বেকার যুবকের জীবন কীভাবে ব্যর্থ হয়ে যায়। একইরকম জীবন বারবার এসেছে তাঁর উপন্যাসে, একইরকম জীবনবোধ ব্যক্তও করতে চেয়েছেন। কারণ যা দেখেছেন, আক্রান্ত হয়েছেন, সেই বাস্তবের ঘা থেকে মুক্ত হতে পারছিলেন না কোনো মতে।
আমরা জানি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য হলো- প্রথমত, নায়করূপী লেখকের ঘটনাবলিকে ব্যক্তি জীবনের ঘটনা প্রভাবিত করে। দ্বিতীয়ত, লেখকের অন্তর পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়; যা তিনি আড়াল করে রাখতে চান। তৃতীয়ত, স্মৃতির ভূমিকা এ জাতীয় উপন্যাসে বলিষ্ঠ ভূমিকা পেয়ে থাকে। চতুর্থত, আন্তরিক দ্বিধা এসব রচনাকে সীমাবদ্ধ করে রেখে দেয়। নিজস্ব অভিজ্ঞতা বলেই তা জীবনের বিপুল ব্যঞ্জনাকে ধারণ করতে পারে না। পঞ্চমত, আবেগের নিজস্ব উষ্ণতায় সেন্টিমেন্ট আর ইমোশনের আধিক্যে কোথাও কোথাও কাজের রোমান্টিকতা আর উচ্ছ্বাসকে ধারণ করে। ষষ্ঠত, মানুষের জীবন পরিপূর্ণ নয়। নাটকীয়তা থাকলেও তা নাটকের পঞ্চাঙ্কের মতো সুসংবদ্ধ থাকে না। একইভাবে আত্মজীবনীমূলক রচনাও যেহেতু নিজের জীবনের আলেখ্য সেহেতু নায়ক চরিত্রের বিকাশ থাকলেও তা পরিণতির দিকে এগিয়ে যায় না। তাই মূল চরিত্রটি flat হয়ে পড়ে- উপন্যাসের গঠনে শৈথিল্য দেখা দেয়। বলা বাহুল্য, জীবনানন্দের উপন্যাসগুলো আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের সব বৈশিষ্ট্যই কম-বেশি ধারণ করে আছে। [রোখসানা চৌধুরী, জীবনানন্দ দাশের উপন্যাস বিষয়বস্তু ও প্রকরণ, পৃ ১৫৩-১৫৪]
১৯৩০ থেকে ১৯৩৫ পর্যন্ত জীবনানন্দ দাশ নানাভাবে কর্মহীনতার বিড়ম্বনায় বিব্রত, হতাশ, বিক্ষুব্ধ, অপমান হত, আত্মধিক্কার পীড়িত এবং কখনো কখনো কিছুটা পরশ্রীকাতর এবং ঈর্ষান্বিতও ছিলেন। নানাভাবে চেষ্টা করেছেন এর থেকে মুক্তি লাভের, এমনকি খবরের কাগজ ফেরি করে বিক্রি করলে কেমন হয় তাও ভেবেছেন। ভেবেছেন ছাতার ডাঁট তৈরি হয় যে মোটা বেতে তা আমদানির ব্যবসায় যুক্ত হবেন কি-না। এইরকম এক পরিস্থিতিতে উপন্যাসগুলো অনেকটাই আত্মজৈবনিক হয়ে পড়েছে অথবা বলা যায় সচেতন ভাবেই এসছে যুদ্ধ, ক্ষুধা, মানবিক বিপর্যয় সংবলিত জীবনানন্দের একান্ত অনুভবের জীবন।
প্রথম পর্বের উপন্যাসগুলোতে জীবনানন্দ ছোট পরিসরে কাজ করেছেন। দ্বিতীয় পর্বে চলে গেছেন দীর্ঘ পরিসরে। প্রথম পর্বের নায়কেরা হতাশ, ব্যর্থ, অপ্রতিষ্ঠিত, অচরিতার্থ; প্রায় সবাই চাকরির খোঁজে গ্রাম থেকে শহরে আসে এবং কলকাতার মেসের অন্ধকার, আশা-ভরসাহীন জীবনযাপন করে। চাকরির সমস্ত সম্ভাবনা লুপ্ত হয়ে গেলে গ্রামে ফিরে যায়। নায়কদের বয়স ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ, বিবাহিত, সাধারণত একটি সন্তানের জনক, পিতার আশ্রয়ে বাস করে। নায়কের বাবা স্কুল শিক্ষক, দরদী, উপনিষদচালিত, গ্রন্থ প্রেমিক। নায়ক এম এ পাশ, লেখক। কারুস্বভাবী হওয়ায় সংসার জীবনে অদক্ষ।
কারুবাসনা উপন্যাসে এম এ পাস শিক্ষিত নায়ক চাকরির খোঁজে কলকাতা গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে। বাবা স্কুল শিক্ষক। নায়ক বাবা কিংবা বউয়ের সঙ্গে খাপছাড়া কথাবার্তা বলে সময় কাটান। নায়ক হেম ভাবে, জীবনের হাসি-আনন্দকে আমরা কেউই অপছন্দ করি না; কিন্তু পরস্পর এতো কাছে থেকেও সে জিনিস আয়ত্ত করবার অধিকার আমাদের নেই। অনেক রাত বসে খবরের কাগজটা চিবিয়ে শেষ করি, তারপর আবার চিবোই, তারপর আবার চিবোই। বাবা থেকে থেকে উপনিষদের শ্লোক আওড়ান, ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে থাকেন- কল্যাণী তেঁতুলের ঝোল খেয়ে সন্ধ্যা রাতেই বাতি নিভিয়ে জীবনের ক্ষমাহীন জীবনস্রোতের কথা ভাবতে থাকে।
কারুবাসনা উপন্যাসে এই যে জীবন এই জীবন তখনকার সামাজিক প্রেক্ষাপটে সহজলভ্য এবং তাঁর মনস্তাত্ত্বিক বহিঃপ্রকাশেও রয়েছে নানা ঘাত-প্রতিঘাত। হেম, স্ত্রী কল্যাণী, স্কুল শিক্ষক বাবা এই তিনজনের সংসারে আসে হেমের দাম্ভিক অবস্থাপন্ন মেঝকাকা। হেমের স্ত্রীর চাহিদা সামান্য অথচ সেটুকুও পাওয়া সম্ভবপর নয় দেখে সে বুঝতে পেরেছে জীবন কত কঠিন ও জটিল। মেঝ কাকা তাদের বাড়িতে এসে সেই জটিল স্রোতে আরো বিক্ষিপ্ত বিশৃংখলা যোগ করেন নানা আয়োজন, উদ্যোগে। এই সাংসারিক জটিলতা, এই মেজো কাকার অনুদার মনোভাব তখনকার সামাজিক প্রেক্ষাপটে অতি স্বাভাবিক। কারুবাসনার নায়ক হেম ঈশ্বর বিশ্বাস করেন না, জীবনানন্দের উপন্যাসের কোনো চরিত্রই ঈশ্বর বিশ্বাসী নন, ব্যক্তিগত জীবনে জীবনানন্দও ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি মানুষের মানবিকতায় বিশ্বাস করতেন।
‘জীবন প্রণালি’ ও উপন্যাসধর্মী বড় গল্প পূর্ণিমায় সেই একই ধরনের সমস্যা, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন। জীবন যে কতটা শীতল ও মনোটোনাস হতে পারে জীবনানন্দ নানা আঙ্গিকে তা দেখানোর চেষ্টা করেছেন। জীবন প্রণালির শচীন এক সময় সাংবাদিক ছিল, বর্তমানে চাকরিহীন। তার বন্ধুদের নানা ব্যবস্থা হয়; কিন্তু তার কোনো ব্যবস্থা হয় না, এমনকি মাস্টারিও মেলে না। ‘পূর্ণিমায়’ আমরা দেখি বিপরীত অবস্থানের ভেতর দিয়ে জীবনানন্দ মানব জীবনের সেই আর্থিক সংকটকেই আরো এক ধাপ পরিষ্কার করে তুলেছেন। পূর্ণিমা এবং চামেলি দুই বোন। চামেলি বড়, পূর্ণিমা ছোট। চামেলি বিবাহিত জীবনে স্বচ্ছল সংসার পেয়েছে আর পূর্ণিমা পেয়েছে অভাব অনটন। তাদের সংকট এতোটাই প্রকট যে সন্তানসম্ভবা পূর্ণিমার স্বামী সন্তোষ ভাবতে বাধ্য হয়, সন্তান প্রসবকালে পূর্ণিমার মৃত্যু হলে এক ধরনের সমাধান হয়ে যায়, স্বামী স্ত্রী দু’জনেই বেঁচে যায়। ‘প্রেতিনীর রূপকথায়’ নায়ক সাহিত্য পাঠে নিমগ্ন এক ব্যক্তি। চাকরিহীন এবং সামাজিক জীবনে ব্যর্থ। নায়ক ইংরেজি সাহিত্যে অভিজ্ঞ, জর্মনও জানেন, টোমাস মানের ‘বাডেন ব্রুক্স’ তাঁর প্রিয় বই। কারণ এই কাহিনিতে আছে একটা অভিজাত বংশ কী করে নষ্ট হয়ে গেল, তারই ইতিহাস। এখানেও নায়কের মনে নানা ভাবনা কাজ করে তার মনে হয়, ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ পাশ না করে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি হলে ভালো হতো। এমনকি জুতো সেলাইয়ের কথাও তার মনে পড়ে। এই নায়ক আমাদের অপরিচিতি নয়, এ যেনো জীবনানন্দেরই আক্ষেপ, তারই মনোবেদনার স্বরূপ।
‘জলপাইহাটি’ উপন্যাসে শিক্ষা ব্যবস্থার নানা তিক্ত অভিজ্ঞতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন জীবনানন্দ। যা অনেকটাই বাস্তব। পরিস্থিতির শিকার হয়ে ব্যক্তিত্বহীন শিক্ষক শুধু খোশামোদেই অভ্যস্ত হয়ে ওঠে না, অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে ও তাকে এড়িয়ে যেতেও শিখে ফেলে। জলপাইহাটি উপন্যাসের নাম লেখকের নিজের দেওয়া নয় তাঁর ভাই অশোকানন্দ জলপাইহাটির নামকরণ করেছেন। জীবনানন্দ শিক্ষাবিষয়ক বেশ ক’টি প্রবন্ধ লিখেছেন, জলপাইহাটি যেনো সেই চিন্তার আর এক বহিঃপ্রকাশ। এই দীর্ঘ উপন্যাসে লেখক বলতে চেয়েছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্র ছাড়া অধ্যাপনার কাজ পাওয়ার পথ ছিল না।
জলপাইহাটি উপন্যাসে নিশীথের প্রফেসর ঘোষ কুলদা প্রসাদ বা জয়নালের কাছে ঘোরাঘুরি সেই সত্যকেই প্রমাণ করে। সৃষ্টির তীরে শিরোনামের কবিতায় কবি গভীর বেদনা বোধে লিখেছেন, ‘মানুষেরই হাতে তবুও মানুষ হয়েছে নাজেহাল/পৃথিবীতে নেই কোন বিশুদ্ধ চাকরি’ (সাতটি তারার তিমির) চাকরি সংক্রান্ত বিষয়ে জীবনানন্দের সব ধরনের লেখায়, চিঠি কিংবা ডায়রিতেও এক ধরনের আতঙ্কিত অবস্থা দেখা যায়। বেকারত্বের কারণে তিনি এক সময় আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলেন। তাঁর উপন্যাসে এইসব ছাড়া গভীর বিষাদে অসংখ্য প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জীবন প্রণালি উপন্যাসে ফাস্টক্লাস না পাওয়ায় শচীনকে তীব্রভাবে ভৎর্সনা করে স্ত্রী অঞ্জলি। জলপাইহাটিতে নিশীথ চাকরি পায় না শুধু ফাস্টক্লাস না পাওয়ার যুক্তিতে। জীবনানন্দ ফাস্টক্লাস পাওয়া শিক্ষকদের পাঠদানের ফাঁকি খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করেছিলেন। তাই নলিনী চক্রবর্তীকে লিখেছিলেন- ‘অধ্যাপনা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সেসবের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপনি যা লিখেছেন ঠিকই। তবে অধ্যাপনা জিনিসটি কোনো দিনই আমার তেমন ভালো লাগেনি। যেসব জিনিষ যাদের কাছে যেরকমভাবে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তাতে আমার বিশেষ আস্থা নেই।’
জীবনপ্রণালি উপন্যাসে ছুটিতে বেড়াতে এসে অধ্যাপক শ্রীবিলাস বলে, ‘একটা এটাচি কেসে করে কয়েকখানা বই আর নোটের খাতা নিয়ে যাই; কোনো ক্লাসে গিয়ে গল্প করি শুধু; কেনো ক্লাসে মান্ধাতার আমলের লেখা নোট ডিকটেট করি; কোনো ক্লাসে বা বই নেড়ে চেড়ে রিডিং পড়ে যাই- কিংবা হুমকি দিয়ে দু’চারটে বক্তৃতা দিয়ে আসি।’
জীবনানন্দ তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন- ‘আমি জানি, আমাদের বাংলাদেশে অন্তত অনেক কলেজের অনেক অধ্যাপকই পড়াশুনা করতে চান না। বাকি অনেকে পড়তে ইচ্ছুক, কিন্তু সুযোগ পান না।’ জীবনানন্দের নায়কেরা বাস্তবের এই উষর ভূমিতে বারবার রক্তাক্ত করে নিজেকে, বারবার পিছিয়ে পড়ে, জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচে। সুতীর্থ উপন্যাসের লেখককেও তাই দেখি লেখা ছেড়ে দিয়েছে অর্থের সংস্থান করতে গিয়ে। ‘এই নিরেট পৃথিবীতে টাকা রোজগার করতে গিয়ে মূর্খ ও বেকুবদের সঙ্গে দিন-রাত গা ঘেঁষাঘেঁষি করে মনের শান্তি সমতা যায় নষ্ট হয়ে; চাকরির থেকে ফিরে এসে হাতে যে সময় থাকে না তা নয়, কিন্তু তখন শরীর অবসন্ন, মন ধাতে নেই। সে মনকে আস্তে আস্তে জাগিয়ে তোলা সম্ভব নয়, কিন্তু সময় লাগে, সহিষ্ণুতা চাই, সুযোগেরও প্রয়োজন।’
সুযোগের প্রয়োজন এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন লেখক নিজেও, তাই তাঁর সব চরিত্রও কোণঠাসা তাদের মনের মতো কাজের জগৎ থেকে। বিপরীত স্রোতে দাঁড় টানতে টানতে অশেষ ক্লান্ত। সেই সঙ্গে যোগ হযেছে দাম্পত্য সংকট। বাস্তবে কবি নিজের বাসাতেও থাকতেন বহিরাগতের মতো। দাম্পত্য সংকটের হিম দহন তাই মাল্যবান উপন্যাসে ডালপালা ছড়িয়েছে। মাল্যবান উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপনকারী মাল্যবান গভীর রাতে অসুস্থ হয়ে বমি করছে, কিন্তু তার স্ত্রী সেখানে নেই। যখন সে এলো সেই আচরণ আরো অমানবিক। মাল্যবানের পোশাক দিয়েই বমি পরিষ্কার করে উৎপলা। স্ত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্ক সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের মতো। উপন্যাসে আছে- ‘মাল্যবান একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে নিচে চলে গেল। অফিস যাওয়া পর্যন্ত স্ত্রীর সঙ্গে একটা কথা বলতে গেল না- অফিস থেকে ফিরে এসেও না; কিন্তু দেখা গেল তাতে কারুরই কিছু এসে যায় না।’
মাল্যবান উপন্যাসে প্রাধান্য বিস্তার করেছে স্বপ্ন। ফ্রয়েড সম্পর্কে অবচেতন মনের কামনার প্রতিফলন হিসেবেই দেখেছেন। মাল্যবান উৎপলার কাছে নির্মমভাবে প্রত্যাখ্যাত হয় দাম্পত্য সম্পর্কের আহ্বানে। বিরাম মুখোপাধ্যায় লিখেছেন- ‘একদিন হঠাৎ আমায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, যদি স্ত্রী আপনার আমন্ত্রণে ঘনিষ্ট হবার প্রস্তাবে সায় না দেয় কি করবেন? কি করা উচিত?’ জীবনানন্দ মাল্যবান উপন্যাসের শেষে কবিতায় উচ্চারণ করেন- ‘কোনোদিন ফুরুবে না শীত, রাত, আমাদের ঘুম? না, না, ফুরবে না।’
এই আকাঙ্ক্ষা মাল্যবানের মতো জীবনানন্দও দেখেন স্বপ্নের ঘোরে। মাল্যবানকে অনেকে আত্মজৈবনিক বলেন; কিন্তু জীবনানন্দ দাশের কোন উপন্যাসটি আত্মজৈবনিক নয়? এমনকি তাঁর উপন্যাসের নায়কদের অনেকেরই চেহারায় ব্যক্তিত্ব সৌন্দর্য দুইই অনুপস্থিত। জীবনানন্দও ছিলেন নিজের চেহারা নিয়ে বিড়ম্বিত। তাঁর দিনলিপিতেও একথা তিনি স্বীকার করে গেছেন। ৯.৫.৩৭ তারিখে দিনলিপিতে লিখেছেন, পুরুষের পৌরুষ বা সৌন্দর্য কিছুই আমার নাই- flat nose short neck and fat ugly appearance – uglity ugly, can’t sing, play, talk – poor voice, poor organising power, not subtle aggressive or cliguish, not adept at flattery. একাধিক উপন্যাসে নায়কের চেহারা নিয়ে কটাক্ষ করে যায় লোকজন স্ত্রী তো বটেই। নায়ক নিজেও সংকুচিত এবং ভাবিত হন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সমাজ। বিংশ শতাব্দীতে পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধ এবং ইউরোপ-এশিয়া-আফ্রিকার ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে মানুষের সব মূল্যবোধ। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কে, একালে, নেমে এসেছে প্রবল অবিশ্বাস আর সংশয়। অর্থনৈতিক সংকট, মূল্যবোধের বিপর্যয়, বিশ্ব আমলাতন্ত্রের দাপট, জীবনের নিরাপত্তাহীনতা মানুষকে ঠেলে দিয়েছে গভীর নৈরাশ্যে, কখনো নৈঃসঙ্গের অতলে। তাই দেখি সাত মাস বেড়িয়ে মেজদারা চলে গেলে মাল্যবান যখন আবার নিচের ঘরে এসে ওঠে তখন সে দেখে, ‘উৎপলার কাছে রোজ একটা লোক আসে- অমরেশ; অনেক রাত পর্যন্ত উৎপলার ঘরে কাটায়।’ আবার জলপাইহাটিতে দেখি, নিশীথের বাউণ্ডুলে, বখে যাওয়া, বিপ্লবী ছেলে হারীত জলপাইহাটিতে ফিরে আসে, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে বিপ্লব সম্ভবপর কিনা, কিংবা তার পদ্ধতি, প্রক্রিয়া পলিসি কী, এই হলো হারীতের ভাবনা।’ কিন্তু হারীত জড়িয়ে পড়ে মেয়ে মানুষের নানা রকম সম্পর্কে, ধীরে ধীরে তার বিপ্লবাত্মক মনোভঙ্গি শিথিল হয়ে একবারে লুপ্ত হয়ে যায়। জীবনানন্দ দাশের উপন্যাসে তখনকার সমাজের যে বৈশিষ্ট্যগুলো উঠে এসেছে তা হচ্ছে- ১. বেকারত্ব, ২. চাকরি চলে যাওয়া, ৩. উপযুক্ত চাকরি না পাওয়া, ৪. চাকরির জন্য তদবির, ৫. দাম্পত্য অবিশ্বাস, ৬. অবৈধ সম্পর্ক, ৭. গ্রাম ও শহরে বিস্তর ব্যবধান, ৮. নীতিহীনতা, ৯. ধর্মের প্রতি অবিশ্বাস, ১০. সমন্বয়ের অভাব, প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাব সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জটিল মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা।
মাল্যবান উপন্যাসের শেষের দিকে আমরা দেখি অমরেশ-উৎপলার সম্পর্ক নিয়ে উৎপলার সঙ্গে মাল্যবানের উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডা চলছে, আবার এইসবের ভেতেরও মাল্যবান লক্ষ্য করে উৎপলার ইচ্ছুক অনুগত শরীর, তারপর দু’জন বিছানায় গিয়ে শোয়।
জীবনানন্দের উপন্যাসের নায়কেরা কেউই আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। হেম-শচীন-নিশীথ-মাল্যবান এরা সবাই জীবনের পথে চতুরতার অভাবে অর্থের বাজারকে জয় করতে পারেনি। এই ব্যর্থতার জন্য সংসারে নানা দ্বন্দ্ব, অশান্তি। এমনকি মায়েরা, বন্ধুরা তাদের অক্ষমতাকে না বোঝার ভান করে। বন্ধুরা চূড়ান্ত অপমান করে ঘর থেকে বের করে দেয়। এখানেই মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের শুরু।
জীবনানন্দের উপন্যাসের অন্তর্জটিল জগৎ বিশেষভাবে উন্মোচিত হয়েছে। নিশীথ এবং পুত্র হারীতের মধ্যে এক অদ্ভুত দ্বৈরথ দ্বন্দ্ব শুরু হয় কখনো রাজনৈতিক মতবাদ কখনো একই নারীর ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। যে সুলেখার সঙ্গে পুত্র হারীতের সুসম্পর্ক, সেই সুলেখা সম্পর্ক নিশীথ মন্তব্য করে ‘আমাকেও তো বিয়ে করতে পারত সুলেখা।’ উপন্যাসে অর্চনা আর হারীতের সম্পর্ক নিয়ে খেলা তৈরি করেছেন লেখক। সুলেখা-জুলেখা দুবোনের প্রতি হারীতের আগ্রহকে ঈর্ষা করে অর্চনা, অথচ সে ভালোবাসে নিশীথকে যা নিয়ে হারীতও ঈর্ষান্বিত। হারীতের মা অসুস্থ সুমনার সামনেই প্রতিশোধ পরায়না অর্চনা তার ছেলে হারীতকে নিয়ে পাশের ঘরের অন্ধকারে হারিয়ে যেতে চায়। ছেলে হারীতও অসুস্থ মায়ের সামনেই বাবার প্রেয়সীকে বারবার ইঙ্গিত দেয় ভাঙা শরীরকে তালি মেরে ঠিক করে দিতে। জীবনানন্দ এক অদ্ভুত ঘোর লাগা ফ্রয়েডীয় মনোবিকলনের জগতের সঙ্গে পাঠককে পরিচিত করিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন। পাঠকও বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় মানুষ তার বিবমিষাময় অনুভূতি নিয়েই সম্পূর্ণ মানুষ। দোলাচল এই মনোবৃত্তি তখনকার সমাজেরই উপকরণ- জীবনানন্দের প্রায় সকল উপন্যাসে নায়কেরা, কর্মবিমুখ স্ত্রী কর্তৃক নিগৃহীত, স্বজন দ্বারা অপমানিত, কর্মক্ষেত্রে অসফল ও ব্যর্থ। একমাত্র ‘সুতীর্থ’ বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করে, সে বেকার বা হীনম্মনা অধ্যাপক নয়। অথচ তার ভেতরেও দেখা যায় দোলাচল মনোবৃত্তি। সে কোম্পানির শ্রমিক ধর্মঘটে অংশ নেয়, মালিকের বিরুদ্ধে তাদের উত্তেজিত করতে থাকে অথচ এইসব আনুষ্ঠানিক বিপ্লবে তার বিশ্বাস নেই। তার ভেতরে রয়েছে মানবিক অনুভূতিশূন্য নির্লিপ্ততা। এই উপন্যাসে সুতীর্থ অবিবাহিত কিন্তু একাধিক নারীর মনোযোগপ্রাপ্ত। বাড়িওয়ালি মনিকা মজুমদার অসুস্থ স্বামী আর কন্যাকে নিয়ে থাকে। মনিকার হৃদয়ে ঈর্ষা সৃষ্টির জন্য সুতীর্থ বলে বেড়ায়, পাশগাঁয়ে তার স্ত্রী পুত্র আছে, স্ত্রী তাকে খুব ভালোবাসে। শুরু হয় মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। কাকতালীয় ভাবে লম্পট বিরূপাক্ষ আর মনিকাকে একই ঘরে ঘনিষ্ঠভাবে বসে থাকতে দেখে সুতীর্থ। মনিকা আরো চতুর, সে তার নিজের মেয়ের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেয় সুতীর্থকে। অবদমিত বাসনায় ক্রুর ফলাফলে সুতীর্থ চায় ধর্মঘটের দাবি আদায়ের জন্য তার বসের কাছে রাতের বেলা মনিকাকে নিয়ে যেতে। যে মনিকা একদিন সুতীর্থের বস মুখার্জিকে কথার চাবুক মেরেছেন, সে-ই আবার সুতীর্থের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে। প্রয়োজন থাকলেও ভাড়াটে সুতীর্থকে ভাড়ার জন্য তাগাদাও দিতে পারে না, এর ভেতরে আছে প্রেম, আসক্তি নয়।
এভাবেই জীবনানন্দ তাঁর উপন্যাসে মনস্তত্ত্বের জটিল জগতে ঘুরে মানুষের মনোজগতকে উন্মোচন করেছেন। আত্মজৈবনিক উপাদান, সামাজিক চাল-চিত্র, মনোজগতের অধরা অধ্যায়, যুদ্ধ পরবর্তী জীবনাচরণ তাঁর লেখায় এনেছে ভিন্ন মাত্রা। আত্মজৈবনিকতা তাঁর উপন্যাসের প্রধান উপাদান বলেই জীবনানন্দ মানুষের জীবন যন্ত্রণাকে উন্মোচন করতে চেয়েছেন আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে।
(সমাপ্ত)