Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

চণ্ডাল-বয়ানে শূন্যতা ক্ষুধা ও উদ্বাস্তু পর্যটন

Icon

স্বপন রুদ্র

প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২২, ১৪:৫৯

চণ্ডাল-বয়ানে শূন্যতা ক্ষুধা ও উদ্বাস্তু পর্যটন

ছবি: সংগৃহীত

লেখোয়াড় একজনই, তিনি মনোরঞ্জন ব্যাপারী। তবে বিশ্বে মনোরঞ্জন ব্যাপারী একজন নয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বে অসংখ্য মনোরঞ্জনের জন্ম হয়েছে। হারিয়ে যাওয়া তাদের জীবন। কেউ তাঁদের ঠিকানা খুঁজে পায় না। যে জীবন জন্ম-উদ্বাস্তু, নিরর্থক। বৈশ্বিক বর্বরতা, ঐতিহাসিক হিংসা, বিভাজনই এমন নিরর্থকতার জন্য দায়ী। সভ্যতা ও রাষ্ট্র নামীয় অস্তিত্বের কারণে আমরা এই সভ্যতা ও রাষ্ট্রিক দায়কে চিহ্নিত করি। ফলে, সামষ্টিক সভ্যতার ওপর কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী জোরজবরদস্তি চালাতে পারে না- এ তো গেল নিয়মের কথা; কিন্তু জবরদস্তি থেকেই জন্ম নেয় হিংসা ও সংঘাতের। অসংখ্য মনোরঞ্জন হিংসার বোঝা মাথায় নিয়ে, নির্যাতনের কষাঘাতে, শোষণের চাপে পৃথিবী থেকে চলে গেছেন। কেউ কিছু বলতে পারেননি। কারণ, বঞ্চিতরা বলা বা লেখার মতো সুযোগ পায়নি। না বলে, কষ্ট বুকে চেপে, অসহায়ত্বে, কেঁদে কেঁদে তারা বিদায় নিয়েছেন। ভাসতে ভাসতে, যুদ্ধ করতে করতে ঘটনাচক্রে মনোরঞ্জন শত মানুষের হাহাকার, দলন পীড়নের কিছু কথা বলার চেষ্টা করছেন। তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে দলিত মানুষের জীবন।

মনোরঞ্জন ব্যাপারী লিখেছেন লাঞ্ছিত জীবনের গল্প ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন গ্রন্থে। এর প্রথম অংশ ২০১২ ও দ্বিতীয় অংশ ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়। এখন এর অখণ্ড সংস্করণ পাওয়া যায়। ১৯৮১ সালে ‘রিকশা চালাই’ শিরোনামে তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় বর্তিকা কাগজে। এর সম্পাদক ছিলেন মনীশ ঘটক ও পরে মহাশ্বেতা দেবী। এ ছাড়াও আরও কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত এবং অনূদিত হয়েছে। তাঁকে নিয়ে এখন চারপাশে কথা হচ্ছে। কেউ কেউ আবার ঈর্ষান্বিত হন। ২০২১ সালে তিনি পশ্চিম বাংলায় বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন। জীবনের সারাংশ হলো- উদ্বাস্তু, হারানো, রিকশাচালক থেকে বিধানসভার সদস্য। এখানে বিধায়ক পরিচয় মুখ্য নয়। তাঁর জীবন ও সাহিত্যের বিষয়ই আমাদের বিবেচ্য। একাডেমি পুরস্কারসহ অর্জন করেছেন কয়েকটি সম্মাননা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা, সেমিনারে ভাষণ দিচ্ছেন এবং সম্মান জানানো হচ্ছে। এ পরিসরে আমাদের অবলম্বন- ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন। 

অন্তবিহীন পথে চলাই জীবন

অন্তহীন ক্ষুধা ও বঞ্চনার পথে ঘুরে ঘুরে মনোরঞ্জন চলেছেন জীবনের খোঁজে। জীবনার্থের সন্ধানে। আজও থেমে নেই এ জীবন। চণ্ডাল জীবনের কৌণিক কথাগুলো কি মনোরঞ্জন বলতে পেরেছেন? পারেননি। না পারার স্বীকারোক্তিও দিয়েছেন। কেন পারেননি- এর কৈফিয়ৎ তাঁর প্রতিবেদনেই রয়েছে। বাস্তবতায় অস্ফুট থেকে যায় কষাটে জীবনের বর্ণনা। এমন অঙ্গার হওয়া ভস্ম জীবন বর্ণনা করা যায় না। আমাদের চারপাশে নিম্নবর্গীয় জীবনের মধ্যে এমন সংবেদনশীল ব্যক্তি খুঁজে পাইনি এখনো। যেখানে সংবেদন মরে যায় অনায়াসে। যা আমাদের সাধারণ ও অভ্যস্ত জীবনের ভাবনার অতীত। প্রচলিত ভাষা দিয়ে যা ধরা যায় না। তারপরও বলার চেষ্টা কম নয়, যা বলেছেন মনোরঞ্জন ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবনসহ বিভিন্ন গ্রন্থে। তাঁর ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন পাঠ করতে করতে মনে হয়- এ কি কোনো মানুষের জীবন আমি পাঠ করছি, না কি অন্য কিছু? এমন তো হয় না। সম্প্রতি ভারতবর্ষের ইতিহাস, দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, শোষণ, নির্যাতন, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ইত্যাদির ওপর গবেষণা ও গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে। 

প্রকৃতার্থে দলিতরা কি মানুষের জীবনযাপন করে? তা আমরা মনে করি না। রাষ্ট্র ও সভ্যতার ঐতিহাসিক চিহ্ন থেকে এখনও শোষকগোষ্ঠী মানুষের জীবন নিয়ে সাপলুডু খেলছে। শাসক-শোষকগোষ্ঠীরা মনে করে ক্ষমতাহীন মানুষের ওপর নিবর্তন করা ঐশ্বরিক দায়িত্ব ও বিনোদনের উৎস। চিরকালই শাসনক্ষমতার ভাগাভাগি হয়েছে; তবে শাসনাধীন কত মানুষ যে দিনে দিনে ক্ষয়ে ক্ষয়ে বিদায় নিচ্ছে, তা কেউ খোঁজ নেয়নি। এটাই ইতিহাসের নির্মম নিয়তি। ইতিহাসের বিবিধ করুণ ঘটনার শিকার কত হাজার হাজার মনোরঞ্জন ব্যাপারী। খেয়াল রাখতে হয়, ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় মানুষ সুখের সন্ধান করতে গিয়ে কষ্টের কাছেই ধরা পড়েছে। যেমন প্রয়োজনে নারী-পুরুষের সম্পর্ক, রাষ্ট্র, উত্তরাধিকার, সম্পদ, ইত্যাদি প্রাতিষ্ঠানিক করতে গিয়ে এখন জটিলতায় নিপতিত। নিছক সন্ধিৎসু হওয়ার ফল। ফলত, অবস্থা, পরিস্থিতি, আবহাওয়া, জলবায়ু ও পরিবেশের নিরিখে জীবন বাঁচানো, খাদ্য সন্ধান সবই করতে হয়েছে। এখন শুধু অবয়বের পরিবর্তন ঘটেছে। বাস্তবতার আলোকে ও উৎপাদনসূত্রে নির্যাতিত শ্রেণির ওপর নির্যাতন ক্রিয়াকে নিয়মানুগভাবেও অনুমোদন করা যায় না। বস্তুত, আবিষ্কৃত উপাদান ও উত্তরাধিকার ভাবনা, যুদ্ধবিদ্যার ক্ষমতা, সম্পদের প্রতি আকর্ষণ ইত্যাদি প্ররোচিত করেছে শোষণে। অধিকাংশ মানুষই এমন পরিস্থিতির জটাজালে আক্রমণের শিকার। তেমনই আক্রান্ত একজন মনোরঞ্জন ব্যাপারী। যে আধিপত্য বা দখলের বিবেচনা প্রচলিত; এর বৈশিষ্ট্য বিশ্বব্যাপী একই ধরনের। ভূগোল নিয়ে যে মারামারি, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়গত দ্বন্দ্ব তা সবই বৈশ্বিক দ্বন্দ্বেরই টুকরো আকার। আর গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, শিক্ষা, ভাষাকেন্দ্রিক বিভাজন এবং সংঘাত, হিংসা এই অহঙ্কার সভ্যতাজাত। এই অহঙ্কারে ক্রম-স্ফীত হওয়া অভিশপ্ত সভ্যতা পীড়ন করছে মনোরঞ্জনকে। আগেও করেছে, এখনো করছে। অতএব, মনোরঞ্জন ব্যাপারী আলাদা কিছু বলেননি। আমরা সকলেই সে প্রাগৈতিহাসিক বিবর্তনের অংশী। তিনি একটি সময়ে এসে এ কথাগুলো একটি সূচক ধরে বলেছেন। বলার সে যোগসূত্র তিনি নিজে। ফলে মনোরঞ্জনের বয়ানকে আলাদা রাখতে হয়। যেখানে আমাদের দিনের কাজ শুরু হয় মিথ্যে, ইতরামি, চক্রান্ত, পরনিন্দা, ঠকাঠকি, লাভালাভের হিসেব কষে- এমন যন্ত্রণা, জটিল পরিস্থিতিতে কোনো ব্যক্তি কি শতভাগ সবকিছু থেকে মুক্ত রাখতে পারেন নিজেকে? অসম্ভব। রাজনীতি, সমাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির গলদ এত বেশি, যা থেকে ব্যক্তি মানুষকে বিচ্ছিন্ন রাখা সম্ভব নয়। এ সমাজে বসবাস করে এমন জীবনী লিখে যাচ্ছেন লেখক, গুণীজনরা, যা পড়ে মনে হয়, তারা কোনো উন্নত সমাজের নাগরিক। অথবা এ পৃথিবীর বাইরে কোনো ভিন্নগ্রহে তারা জীবন অতিবাহিত করেছেন। নেতির কোনো ছায়া বা দাগ তাদের স্পর্শ করেনি। এ সমাজ তাদের নির্মাণ করেছে শুধু নক্ষত্র হতে? সমস্ত ভালো ও মঙ্গলময় কাজের সাক্ষী তারা। যেন দেবত্ব নিয়ে ভিন্ন গ্রহ থেকে এ পৃথিবীতে অবতরণ করেছেন, জীবনযাপন করে আবার দেবলোকে ফিরে যাবেন বা গেছেন। ফলত, এমন জীবনী, স্মৃতিকথা পড়ে আনন্দ পাই না। যেগুলোতে জীবন নেই, সমাজ, 

প্রকৃতি ও পরিবেশের কোনো চিহ্ন নেই। আমরা নিছক অভ্যাস বা কোনো প্রয়োজনে কত দেবতার জীবন ও কর্ম পাঠ করছি। কতজনকে রাষ্ট্রিক ও সামাজিক চাহিদাসাপেক্ষে দেবতা বানানো হয়। তারা জীবনে যা করেছেন, তা কিছুই লিখেন না, বলেন না, সামাজিক প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা হারানোর ভয়ে। অবশেষে জীবনের পড়ন্তবেলায় একটা আত্মজীবনী লিখেন। অথবা আগ্রহী কোনো লেখক তার জীবনী লিখেন। আমাদের চারপাশে কত সংগ্রাম, বিভক্তি, তিক্ততা, হিংসা, ক্রোধ, লোভ, লালসা, পিঁপড়া, তেলাপোকার স্পর্শ থাকে। এসবই কি অবাস্তব হয়ে যায়? কত সমর্থন ও বিরোধিতা সবই অস্বীকার করা যায়? আসলে আমরা মুখোশের বিবরণ লিখি। দেবত্ব আরোপ, বা নিজেকে আড়াল করে এ জীবন কেনইবা লেখা দরকার। এক্ষেত্রে লেখক পাঠক উভয়ই মিথ্যে বলার রুচি ও মুখোশের নান্দনিকতা তৈরি করে চলেছেন। আমাদের বইয়ের দুনিয়া এমন সব চালাকির অক্ষরে ভর্তি হয়ে আছে। কাল থেকে কালান্তরে এর প্রবহমানতা লক্ষণীয়। রাষ্ট্র ও সমাজে যে আড়ালক্রিয়ার সংস্কৃতি, এত ওই বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চারই প্রতিফলন। সংগত কারণে এ ধারাবাহিকতার সংক্রমণে পতিত হলে মনোরঞ্জন ব্যাপারীর লেখাও এমন হয়ে যেত সন্দেহ করি। তিনি এসব থেকে দূরে ছিলেন বাস্তবতার কারণে। আত্মপ্রতারণা ও আত্মপরিচয়ের সঙ্গে ভণ্ডামি করেননি। এ ছাড়াও আছে তাঁর দ্রোহ, ক্রোধ, আত্মবিশ্বাস। পরিণামে এ জীবনী অন্যদের মতো হয়নি। 

যে জীবন শুরুতেই মধুবঞ্চিত। জন্মক্ষণে প্রথা অনুযায়ী মুখে মধু দিতে পারেননি তাঁর বাবা। না দিতে পেরে খুবে কেঁদেছেন। নিম্নবর্গীয় মানুষ হওয়ার ফলে তাদের অবস্থান ছিল একেবারে প্রান্তে। বলা হয় তারা অস্পৃশ্য, অচ্ছ্যুত, চণ্ডাল। সমাজ মর্যাদা দেয়নি, কিন্তু শ্রম কেড়ে নিয়েছে বিনামূল্যে। এ অবস্থায় তাদের ভাগ্যের চাকা কখনো পরিবর্তন হয় না। শ্রমের বদৌলতে নির্দিষ্ট মানুষের ঝকঝকে জীবনযাপন। বাকি সব মনোরঞ্জন। জীবনের প্রয়োজনে আসাম, লক্ষে্‌নৗ, এলাহাবাদ, কলকাতায় বিভিন্ন ধরনের কাজ করেছেন। দণ্ডকারণ্য ছেড়ে আবার সেখানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। অনিশ্চিত জীবনের এক পর্যায়ে সাক্ষাৎ হয় নকশাল আন্দোলন ও শ্রমিক নেতা শংকর গুহ নিয়োগীর সঙ্গে। তাঁর জীবন বদলে দিতে সহায়ক হয়েছে শংকর নিয়োগীর সান্নিধ্য। বিধায়ক নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত বাবুর্চির কাজ করেছেন। জীবনসংগ্রাম শুরু হলো যেভাবে। তাঁকে জেনে নিতে গেলে যে উত্তর তিনি দিয়েছেন- ‘দেখতে পাবেন ছাগল গরুর পিছনে পাচনবারি হাতে ছুটে চলা আদুল গায়ে এক রাখাল বালককে। বহু বছর ধরে দেখেছেন ছেলেটাকে। মুখটা তাই আপনার চেনা চেনা। ও-ই আমি। ওই হচ্ছে আমার বাল্যবেলা।... একবার তাকান মোড়ের চা দোকানটার দিকে। রুক্ষ চুল, গায়ে দুর্গন্ধ যুক্ত ময়লা গেঞ্জি, হাতে পায়ে দগদগে হাজা, কিছুক্ষণ আগে মালিকের হাতে মার খেয়ে কেঁদে কেঁদে গ্লাস ধোয়া ওই যে ছেলেটা- এই হচ্ছে আমার কিশোরকাল। এরপর যুবা বয়স। রেলস্টেশনে মোট বওয়া, মাথার ওপর এক পাঁজা ইট নিয়ে বাঁশের ভারা বেয়ে দোতলা তিনতলা ছাদে ওঠা, রিকশা চালানো, রাত জেগে পাহারাদারি, দূরপাল্লার ট্রাকের খালাসি, মেথর- ডোম- এভাবেই কেটেছে আমরা যুবা বয়েস। এর কোনো না কোনো পর্বে পথে ঘাটে হাটে মাঠে কখনো না কখনো আপনি আমাকে দেখে থাকবেন। বলা যায় না হয়তো দেখে থাকবেন সেই উত্তাল সত্তর দশকে পাড়ার গলিতে বোমা পাইপগান নিয়ে ছুটে বেড়াতে। অথবা হাতে হাতকড়া পরিয়ে পুলিশ মারতে মারতে ভ্যানে তুলছে।’ [২০১২, খ. ১ : ১৫] ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবনের বিশাল পরিসরে ব্যক্তিজীবনের বেড়ে ওঠা ও বেঁচে থাকার ঘটনাবলি তিনি বলে গেছেন। সকল সম্পর্কই দ্বিবাচনিক। ফলে জাগতিক জীবনের যথাসম্ভব সবকিছুই তিনি অনায়াসে তুলে এনেছেন এই জীবনের প্রতিবেদনে। এ বয়ান পাঠের পর মনে হয় এটা চারপাশে দেখা চলমান জীবন নয়। প্রতিদিন মরণের ইংগিত, তবু কেন যেন আবার বেঁচে যায় একটি মানুষ। এত দৃঢ়, শক্ত প্রাণের সাক্ষাৎ তাঁর মতো এখনো পাইনি। 

বস্তুত, এ সমাজ, সভ্যতা যুথবদ্ধ হয়ে মেরেছে, মারছে। এখানে এমন জীবনের অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। আবার এই সভ্যতা গর্বের ইতিহাসও লিখে। সমতার ব্যাখ্যা করে। বিশ্বসভ্যতার নামে বিশ্ববর্বরতারই প্রতিবেদন চিত্রিত হয়েছে তাঁর জীবনকথায়। তবে লেখক নিজেও বলেছেন সবকিছু বলা হলো না। যা ভাষা দিয়েও প্রকাশযোগ্য নয়। অনেকক্ষেত্রে উপযুক্ত ভাষা তিনি পাননি। আমরা বলি- যা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়; বিষয়গুলো তেমনই। তাঁর বয়স, বিবেচনাবোধ উপযুক্ত হওয়ার আগেই দেখতে হলো বর্ণহিন্দুদের নির্যাতন, দাঙ্গা আর দেশ ছেড়ে যাবার যন্ত্রণা। দাঙ্গার ভয়ে তখন অসংখ্য মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। মনোরঞ্জন ব্যাপারীর পরিবারও পিরোজপুর থেকে পাড়ি জমান সেখানে। তারপর কখনো রেলস্টেশন, বা কোনো বস্তি আবার শরণার্থী ক্যাম্পে থাকতে হয়েছে। বহুবার ক্যাম্প ও স্থান বদল করতে হয়েছে। শরণার্থী ক্যাম্পে শুরু হয় মানবেতর জীবন। তখন তাঁর তিন বছর বয়স। ভালো খাবার পেতে কোনো ব্যবস্থা ছিল না। যেসব খাবার দেওয়া হতো- এগুলোর প্রতিক্রিয়ায়- ‘বার্ডফ্লু রোগ লাগা মুরগির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ মারা’ গেছে। 

১৯৫৮ সালে দণ্ডকারণ্যে শরণার্থীদের স্থানান্তর করা হয়; কিন্তু সেখানে না চাষাবাদ বা খাবারের কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। খাবারের জন্য ভুখা মিছিল হলে পুলিশ অমানবিক নির্যাতন করেছে। ওই সময় ক্যাম্প থেকে দূরবর্তী এক গ্রামে গরু-ছাগল চরানোর চাকরি করেছেন তিন মাস। এখান থেকে আবার সপরিবারে চলে গেলেন দোলতলা ক্যাম্পে। খাদ্যের সন্ধানে আবার সংগ্রাম, তবুও বাঁচার কোন সংগতি হয় না। এ সূত্রে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার চালচিত্র উপলব্ধি করা যায়, হারিয়ে যাওয়া দলিত মানুষদের সংগ্রাম থেকে। স্থান-কাল নির্বিশেষে শাসকশ্রেণির অভিন্ন শ্রেণিচরিত্র সহজেই বোঝা যায়। তাঁর বাবা তখন ঝুড়ি কোদাল হাতে রাতের অন্ধকার না কাটতেই সাত আট মাইল পায়ে হেঁটে ঘুটিমারি স্টেশন পৌঁছাতেন। সেখান থেকে যেতেন যাদবপুর স্টেশন। আবার দু-তিন মাইল হেঁটে যেতেন বাঘা যতীন মোড়ে। সেখানে ভিখারির মতো দাঁড়াতে হতো কাজের আশায়। কাজ পেলে ওইদিন খাবার হতো, না হলে নেই। আবার টিকেট করার সামর্থ্য না থাকায় গভীর রাতে ক্যাম্পে ফিরতে হতো। কখনও সারাদিন না খেয়ে ‘খালি হাতে ওই একইপথ পাড়ি দিয়ে একইরকম কষ্ট করে অনেক রাতে একবুক হাহাকার নিয়ে ঘরে ফিরে আসতেন। ইচ্ছে থাকলেও বাবা দিনের বেলা ট্রেনে চাপতে পারতেন না।’ একসময় খাবারের অভাবে একমাত্র আয়ক্ষম তাঁর বাবা হয়ে পড়েন অসুস্থ। তিনি কখনো এই বাবাকে পেটভরে ভাত খেতে দেখেননি। ওই সময় তাঁর বড় বোন মঞ্জু না খেয়ে মারা গেলেন। সে সময় তাঁর পরিবারে খাবারও নেই, কাপড়ও নেই। কেমন ছিল সেই সময় ও জীবন। লেখকের ভাষ্যে- ‘আমার জন্মদাতা পিতা চোখের সামনে পেটের ব্যথায় বিনা চিকিৎসায় তিলে তিলে মারা যাচ্ছেন। আমার গর্ভধারিণী মা এক টুকরো বস্ত্রের অভাবে গর্তে ইঁদুরতুল্য জীবনযাপন করছেন। দিনের আলো তার ভাগ্যে নেই। প্রবল শীতের দিনে যে একটু রোদে এসে বসবেন তা আর পারবেন না।... তিনটি ভাইবোন শুকোচ্ছে। কদিন পর মরবে। আমার বুড়ি দিদিমা থলি নিয়ে বাজারে পঁচা আলু পোঁকা বেগুন শুকনো শিম যা চাষিরা ফেলে দিয়ে গেছে তা কুড়িয়ে বেড়ায়। যদি এই পরিত্যক্ত বস্তুর মধ্যে একটু বেঁচে থাকার উপাদান মিলে যায়।’ [২০১২, খ. ১ : ৪৪] 

এসব দেখে একদিন তিনি না বলেই বাড়ি থেকে পালিয়ে অনিশ্চিত পথে নেমে পড়েন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে অন্ধকারে ডুবে যান ঘুটিমারি স্টেশনে। স্টেশনের হৈচৈ, রেলগাড়ির শব্দ, বুনো শেয়ালের ডাকের মাঝে অনাহারের ক্লান্তিতে ঘুম আসে। এর মধ্যে জনৈক ব্যক্তি তাঁকে ডাক দেয়, জানতে চায়- কোথায় যাবে? নিরুত্তর। কী উত্তর আছে তাঁর কাছে, যে ভাতের সন্ধানে নিরুদ্দেশ হয়েছে। ওই ব্যক্তি তাঁকে বলে- ‘আমার বাড়ি যাবি? থাকবি আমার বাড়ি? ভাত খেতে দেব?’ এ উচ্চারণে আদর ছিল। যে আদরে শোষণ, বীভৎস রূপ ঢাকা থাকে এ-বোধ তখনো তাঁর হয়নি। ছিল ভাতের আকাঙ্ক্ষা। কারণ ভাত না খেতে খেতে এর রূপ, রস, গন্ধ ভুলে গেছে অনেকে এবং তিনিও। ওই ব্যক্তি ছিলেন পেশায় ডাক্তার; কিন্তু শ্রেণিচরিত্র, বর্ণহিংসা ত্যাগ করতে পারেনি। এ ডাক্তারের বাড়িতেই তিনি প্রথম বর্ণবাদের সাক্ষাৎ কুৎসিত রূপ প্রত্যক্ষ করেন। তিনি নমঃশুদ্র পরিবারের সন্তান, তা এরা জেনে যায়। ‘ফলে বাড়ির লোক আমাকে এমন ঘৃণিত জীব বলে মনে করে যেন আমি কোনো ছোঁয়াচে রোগের রোগী। ভাত খাবার সময়ে ডাক্তারের গিন্নি একটা কলাই করা তোবড়ানো থালায় যেন ছোঁয়া না লেগে যায় এমনভাবে উঁচু থেকে ছরছর করে ভাত তরকারি দিত। যা উঠানের এক ধারে বসে কাঙালের মতো খেয়ে নিজের থালা নিজে ধুয়ে আনতে হতো। সে থালা ওরা ঘরে ঢোকাত না। গোয়াল ঘরের মধ্যে রাখা থাকত। আমার ঘুমাবার জন্য বরাদ্দ স্থান ছিল গোয়ালের গাদা মারা মুটের বস্তার উপর। গরুর চোনার গন্ধে আর মশার কামড়ে সারা রাত ঘুমাতে পারতাম না। ঘুমাতাম দিনের বেলায় গরু চড়াতে গিয়ে, মাঠের কোন গাছ তলায় গামছা পেতে। সেই ঘুমের কারণেই একদিন পিঠে পড়েছিল কাঁচা কঞ্চির বাড়ি।’ [২০১২, খ. ১ : ৪৭-৪৮] 

অবশেষে এ-গ্রন্থকে আত্মজীবনী বলে মনে হয়নি। মনে হয় দলিত শ্রেণির সংগ্রামগাথা। মূলত, দলিত, পীড়িত মানুষের জীবন এমনই। উপরে উঠে গেলে যে জীবন দেখা যায় না, কেউ ভাবে না। এ প্রকৃতি সবার জন্য সমান-আপ্তবাক্য কথা; কিন্তু যারা প্রকৃতি শাসন, শোষণ ও ধ্বংস করে নিজেদের জীবন একটা বেহিসেবি জায়গায় নিয়ে গেছে, যা পৃথিবীর সবখানেই হয়েছে। আসলে লড়াই প্রকৃতির সম্পদ দখল নিয়ে। পরিবেশ ও পরিবেশকেন্দ্রিক সম্পদ দখল ও লুটপাট করে নিজের ও সমশ্রেণির জীবনকে আয়েশি করে তোলা। দখল, শক্তি ও ক্ষমতার সঙ্গে ভোগ করা। এ প্রকৃতি ভাগাভাগি ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার নেশা ও গবেষণা থেকেই কলাকৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে। এ থেকেই রাষ্ট্র, সমাজ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন। যদি প্রাতিষ্ঠানিক কোনো আয়োজন না হতো, তা হলে আমাদের কিছু বলার ছিল না। দখল ও ক্ষমতা প্রয়োগের প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনে সমাজের একটি অংশকে দলিত রাখার বিধান তৈরি হয়েছে। মূলত প্রকৃতি, পরিবেশ থেকে খাদ্য, সম্পদ আহরণ ও উৎপাদনের কাজ সম্পন্ন করে থাকে ওই দলিত, পীড়িত মানুষেরাই; কিন্তু নির্যাতিত শ্রেণি কখনেই ভোগের শামিল হতে পারেনি। এ ভাগাভাগি, ভোগ, উপভোগ থেকে বঞ্চিত এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সার্বক্ষণিক নিয়োজিত রাখার জন্যই শ্রমজীবী-শোষিতদের জন্য শিকল বানানো হয়েছে। যে শিকল প্রয়োগে আবার জ্ঞান ও বস্তুতান্ত্রিক উভয় পন্থাই রয়েছে। এ বিষয়কে স্থায়ী করতে এত তত্ত্ব ও শক্তিসমাবেশ ঘটেছে যা কল্পনার অতীত। সেই থেকে এ কলাকৌশলের বিকাশ, বিবর্তন ও প্রতিষ্ঠা এবং প্রসারমান সকল সময়। বোঝা যায় যে লড়াই পুরোনো। উদ্বাস্তুজীবন, বর্ণবিভাজন সম্পর্কে এ বইয়ের মধ্যে নানা জায়গায় তিনি বিচিত্র অভিজ্ঞতা উল্লেখ করেছেন। সব মিলিয়ে তাঁর অনুভব, অভিজ্ঞতা ও উপলদ্ধির সারাৎসার হাজির করেছেন। তাঁর এ-লেখায় দলিত হওয়া ও অস্পৃশ্যতার ইতিহাস খানিকটা পাওয়া যায়। যেমন, ‘রিফিউজি! বাংলা ভাষার অভিধানে এর চেয়ে নিকৃষ্ট অপমানজনক শব্দ আর একটাও নেই। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে রিফিউজি আর বাঙাল সমার্থক শব্দ। যা স্থানিক পরিভাষায় একটা গালাগালিও বটে।... আমরা নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দেই, মূর্তি পূজা করি, সেই অপরাধে একদল মুসলমান আমাদের কাফের বিধর্মী শত্রু বলে। আমরা নিম্নবর্গ-নমঃশূদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ বলে, একদল তথাকথিত উচ্চবর্ণ আমাদের অচ্ছ্যুত অস্পৃশ্য চণ্ডাল বলে গাল দেয়। ঘৃণায় থুথু ছেটায়! এখন এদেশে এসে পড়তে হয়েছে- ওদেশে জন্মাবার অপরাধে আর এক গালাগালির সামনে- বাঙাল।’ [২০১২, খ. ১ : ৪৭] অন্যসব মানুষের সঙ্গে তারাও দেশভাগ-জাত উদ্বাস্তু হয়েছেন। ফলে, স্থায়ী কোনো আবাস ছিল না। ক্ষুধা, খাদ্যের তাড়না বা অহেতুক নির্যাতন, নিবর্তনের কারণে স্থানান্তরিত হয়েছেন দণ্ডকারণ্য, জংগল, রেললাইনের বস্তি, বা কোনো নর্দমা, বা খালপারের বস্তিতে। ’৪৭-উত্তর লক্ষ লক্ষ মানুষের এই তো অবস্থা। তবে তাঁর বাবা মা ছিলেন অত্যন্ত সৎ মানুষ। অভাব অনটনে মুখ খোলেননি। অন্যের ক্ষতি করেননি। তাহলে সততা, নিষ্ঠা থাকা সত্ত্বেও এমন বিপর্যস্ত জীবন কেন যাপন করতে হলো- এ প্রশ্ন তাঁর করোটিতে সেই শৈশবেই জন্মেছে। বন জংগলের বিভিন্ন বীজ, গাছের ফল, কচু, লতাপাতা শাপলাফুলের খই ইত্যাদি ছিল খাদ্যের উপকরণ। অভাব অনটনের চাপে সেকালে কোনো জন্মই উৎসবের ছিল না। তাঁদের জন্মও হয়েছে নিরুত্তাপ ও উৎসবহীন পরিবেশে। সব মিলিয়ে তিনি বলেন, ‘লোকে বলে দারিদ্র্য, গরিবি, অভাব, অনটন; কিন্তু এই সব নরম কোমল সাহিত্যের শব্দ দিয়ে আমাদের সেই সময়কার দুরবস্থাকে কোনোভাবেই বর্ণনা করা সম্ভব নয়। শুধু বাংলা কেন, বোধ হয় পৃথিবীর কোনো ভাষার মধ্যে এমন শব্দ নেই যা আমাদের জীবনের সেই দুঃসহ সময়ের চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম।’ [২০১২, খ. ১ : ৪৪]

জীবনের যা কিছু অর্জন তা সবই নিজের দেখা। একটি জীবনের মাঝে বিচিত্র জীবনের পরিচয়। অনেক সত্তায় বিভাজিত জ্বালা, পোড়া, অঙ্গার হওয়া একটি সত্তা। মুটে, মজুর, খালাসি, মদখোর, চোর, ডাকাত, রাজনীতির মাঠে কর্মী, স্বপ্নদেখা বিপ্লবী, কোনটা নয়। একসময় কান্না ভুলে গেছেন। মানুষের মৃত্যু দেখতে দেখতে মরণের ভয় কাজ করত না। বাঁচার জন্য কোনো আশা ছিল না। শুধু জীবনকে বয়ে চলেছেন। যেন এক দেহের ভার বহন করা। এ জীবন মরতে মরতে বেঁচে গেছে। প্রকৃতির খেয়ালে। প্রাণ বাঁচানোর জন্য নয়, ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করা কী যে সংগ্রাম, তা তিনিই জানেন। আসলে তিনি কেন বেঁচেছিলেন, এর কারণ তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। শুধু ছুটে চলেছেন একমুঠো ভাতের জন্য, আর কিছু নয়। এখনো আছেন, এখন কারণ জানেন- কেন বেঁচে আছেন। লিখে যাচ্ছেন অনেককিছু, কথা বলছেন। জীবনার্থ সন্ধানে সাধারণ মানুষের জন্য তাঁর প্রতিদিন লড়াই, সংগ্রাম। অবশেষে জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক এক ধারণায় স্থিত হন। এত অবহেলা ও নিবর্তনের পর তবুও কোথায় যেন জীবনের প্রতি বিশ্বাস ও মায়া তৈরি হয়ে যায়। তিনি বলেন ‘জীবন এক যাত্রা, জীবন এক যুদ্ধ, জীবন এক অভিজ্ঞতার নাম।’ তবে বারবার মানুষের আচরণে বিশ্বাস হারিয়েছেন। যেখানে খাবারের আশায় বিশ্বাস রেখেছেন, পেটের দায়ে কাজের আশায় কারও হয়তো পেছন পেছন গেছেন, কিন্তু কোথাও স্থিত হতে পারেননি, শুধু মানুষের ঠকানোর কারণে। কিশোরবেলায় উদ্দেশ্যহীন গঙ্গা দেখার সময় এক পুলিশ সদস্য তাকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ মেসে। সেখানে রান্না ও প্রাত্যহিক বাজার করা ইত্যাদি কাজের কথা বলা হয়; কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতা হলো,- ‘পশুরা পায়ুকামী অগম্যাগমন ধর্ষণকারী প্রকৃতি বিরুদ্ধ কোনো কাজ করে না। মানুষের সেই অবনমন নীচতা আমি যেন আমার জীবনে অনেক বেশি দেখে ফেলেছিলাম।’ [২০১২, খ. ১ : ৫৬] এসব অভিজ্ঞতা মাঝখানে তাঁকে এক অমানবিক পথে ঠেলে দেয়। ক্রোধে মানুষকে এলোমেলো আঘাত করতেও দ্বিধা করেননি। ‘প্রায় পাগলের মতো ঘুরি। মদ খেয়ে ঘুরি, না খেয়ে ঘুরি।’ সঞ্চিত কত অভিজ্ঞতা জল জঙ্গল ও পাহাড়ে। রিকশাচালক, মজুর থেকে বাবুর্চি ও লেখক। এখন তিনি নিজেকে বলেন- লেখোয়াড়। 

নির্যাতিতের শিক্ষাবিজ্ঞান 

‘জন্ম মুহূর্তের এক অভিশাপ জর্জরিত মানুষ আমি,... এই দেশ, সময়, মানুষ, খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে আমাকে। সবাই ঠকিয়েছে যার যেমন সাধ্য।... গ্রীষ্মের রাগীরোদ আমার শরীরজুড়ে ছোবল মারতে থাকে। দরদর ঘামে গায়ের গেঞ্জি ভিজে ওঠে। ভিজে ওঠে আমার চোখের পাতাও।’ [২০২১, খ. ১ : ১০৯] 

দারিদ্র্য ও ক্ষুধার কারণে তিনি মর্যাদা, শ্রেণিবিভাজনের ব্যাকরণ ভালোভাবে বুঝে নিয়েছেন। নিজে শূদ্র গোত্রভুক্ত এ বিষয়টি আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। বর্ণ-সাম্প্রদায়িক ভারতবর্ষের দারিদ্র্য ও ক্ষুধার রাজনীতি দীর্ঘায়িত করণের সমাজবিজ্ঞান তাঁর লেখা থেকেই অনুধাবন করা যায়। চরম দারিদ্র্য, দেশভাগের বঞ্চনার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হয়নি। মূলত, ক্ষুধার তাড়না, যেখানে-সেখানে মার খেতে খেতে সমাজ ও রাষ্ট্রকে বুঝে নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘জীবন আমাকে কত কিছু যে করিয়ে নিয়েছে তার কোনো হিসেব নেই। ছাগল, গরু চরানো, চায়ের দোকান, হোটেলের থালা গ্লাস ধোয়া, মুটে মজুরি, ট্রামের খালাসি, রাত পাহারার পাহারাদার, শ্মশান ডোম, পায়খানা পরিষ্কার করা জমাদার, রাঁধুনি, রিক্সাওয়ালা থেকে চাকু বোমা হাতে দৌড়ানো, জেলখাটা আসামি আরও কত কী। [২০১৬, খ. ২ : ৮৪] ফলে, চারপাশের পরিবেশই হলো তাঁর শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। রেলস্টেশন, রাস্তা, রেলভ্রমণ, চায়ের দোকান, গরু-ছাগল চরানো, রাজনীতি প্রভৃতি কাজে পুলিশসহ সাধারণের হাতে প্রচুর মার খেয়েছেন। ‘মাথায় তেল, পেটে ভাত, পরনের ত্যানা, পায়ের চপ্পল, ঘরের চালে খড় কিছুই কেন নেই। কেন এত লাঞ্ছনা অপমান অত্যাচার?- আছে নমঃশূদ্র মানুষের কাছে সেই প্রশ্নেরও উত্তর আছে।’ [২০১২, খ. ১ : ১৯]

বস্তুত, তিন উপায়ে তাঁর শিক্ষা অর্জন। ১. ক্ষুধা নিবারণের উপায়ের খোঁজে, ২. কারাগার যাপন, ৩. রাজনৈতিক সংগঠনে। একসময় কলকাতা শহর, বস্তি, যাদবপুরে রক্তপাত, প্রশাসনের উৎপাত, নৃশংসতা দেখে মনে মনে ভেবেছেন যে আর কী হবে। জেলখানাই তাঁর জন্য নিরাপদ জায়গা। যাদবপুর এলাকায় তিনি একসময় ক্রোধ, ক্ষোভে সন্ত্রাসী কাজে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ফলে, অন্যদের মতো তিনিও ছিলেন তাড়া খাওয়া আসামি। ১৯৭৫ সালে তিনি গ্রেফতার হন গুণ্ডামির অভিযোগে। পুলিশের ধারণায়, তিনি দাগি আসামি ও সন্ত্রাসী; কিন্তু কোনো প্রমাণ ছিল না। উত্তাল নকশাল আন্দোলনের ফাঁকে তাঁকে জেলখানায় যেতে হয়। সেখানেও অস্বস্তি। তবে খাবার পেয়েছেন। তাঁর ভাষায়- খাবারের কাছে পৌঁছে যাওয়া। বিশাল খাবারের জায়গা। না খেলে পিটিয়ে খাওয়াবে। তবে তাঁকে মুক্ত করার লোক ছিল না। জেলখানায় তাঁর মামলা নিয়ে অনেকেই জানতে চায়। তাঁর কাতরতা দেখে জেলখানায় কয়েদি এক ব্যক্তির মায়া হয়। তাঁর বিবরণে - খুবই প্রাজ্ঞ- ‘আমার এই মাস্টার মশাই, একজন শিক্ষিত মানুষ।’ মাস্টার মশাই তাঁর সম্পর্কে জানতে চান। কাছে নিয়ে খুব আদর করেন। ওই ব্যক্তি ছিলেন চিটিংকেসের আসামি। ব্যাপারী, তাঁর মামলা ও ধারা কিছুই বলতে পারেননি। তখন তিনি অক্ষর চেনেন না, লেখাপড়া জানেন না, কীভাবে বলবেন এসব। ওই লোকটি তাঁকে কাছে ডেকে নিয়ে মূল্যবান কথা শোনান। ‘আনন্দ, এই কথাটা কে বলেছে জানিস? গৌতম বুদ্ধ। ইহকাল, পরকাল, পরজন্ম, পূর্বজন্ম, স্বর্গ নরক বলেনি। সুখ, ভোগ, বিলাস বলেনি। বলেছে আনন্দের কথা। অমৃতের পরশে অমরত্ব প্রাপ্তি হয়। যাহা আনন্দ তাহাই অমৃত।’ [২০১২, খ. ১ : ১৭৯] তাঁর মনে প্রচুর জিজ্ঞাসার জন্ম দেন ওই ব্যক্তি। এসব প্রশ্নই তাঁর জীবনে পরিবর্তনের সূচনা করে। মাস্টার মশাই প্রতিদিন ব্যাপারীকে কাছে নিয়ে বলতে থাকেন তাঁর ব্যক্তিজীবনের বিবিধ ঘটনা ও কাহিনি। বিচিত্র কথা বলে তাঁকে প্রণোদিত করেন। জেলখানার মাস্টার মশাইয়ের কথাগুলো এখানেও প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। ব্যাপারী চমৎকারভাবেই সেসব স্মরণ করেছেন, - ‘একজন বিপ্লবী, সে যদি বিপ্লবী না হতে পারত, তাহলে অবশ্যই ডাকাত হতো।... একজন কবি যদি কবি না হতে পারত, হয় পাগল হয়ে পথে পথে ঘুরত আর না হয় মদ খেয়ে শুয়ে থাকত কোন শুঁড়িখানায়। একজন সৈনিক যদি সৈনিক না হতে পারত, একটা গুণ্ডা খুনি হতো।’ [২০১২, খ. ১ : ১৮৩] মাস্টার মশাইয়ের কথা শুনে তাঁর স্বগত কথা- ‘জেলখানা হচ্ছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়।’ মাস্টার মশাই তাঁকে আরও বলেন, ‘যারা বই পড়ে তারা কমবেশি পাগল। নকশাল ছেলেদের দ্যাখ।’ এবং বলেন, ‘একেবারে মরে যাবার চেয়ে, যত কষ্টই হোক বেঁচে থাকা ভালো। বলা যায় না, বেঁচে থাকলে কোনোদিন এমন একটা সুযোগ হয়তো এসে যাবে...’ এসব কথায় তাঁর মধ্যে প্রেষণা তৈরি হয় এবং তিনি লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁকেই মনে প্রাণে গুরু হিসেবে গ্রহণ করেন। এবং বলেন, ‘গুরু যদ্যপি করে বেশ্যালয় গমন, তথাপি জানিবে গুরু পতিত পাবন। হোক চিটিংবাজ ঠগ জালিয়াত প্রতারক। তবু উনি আমার গুরু, আমার প্রণম্য।’ বলা যায়, একজন তরুণ নতুন করে স্কুলে ভর্তি হলো। তাঁর সঙ্গে মাস্টার মশাই কথা বলতে বলতে একদিন, ‘ওনার হাতে একটা ছোট কাঠি। সেটা আমার দিকে এগিয়ে দেন- নে ধর। এটা কী? এটা তোর কলম। আর এই উঠোন তোর লেখার কাগজ। আর বই? নিজের বুকে হাত রাখেন তিনি- আমি তোর বই।’ [২০১২, খ. ১ : ১৯০] সেই থেকে তাঁর বর্ণমালা শেখা ও বই পড়া শুরু। নিজে পণ করেন লেখাপড়া শিখবেন। এ দৃঢ়তা তাঁকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। আমরা যদি তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৯৫০-৫১ সনকে তাঁর জন্মসাল ধরি, তা হলে তিনি লেখাপড়া শুরু করেন প্রায় ২৫ বছর বয়সে। জেলখানার সুবিধা হলো- তাড়া নেই, আছে বইয়ের সমাহার। এসব সুযোগ তিনি কাজে লাগিয়েছেন। ফলত, তাঁর লেখক হওয়া, ও ধাপে ধাপে সকল সাফল্য অর্জন। একদিন ঘুমের মধ্যে তিনি স্বপ্নে দেখেন,- জেলখানার মেঝেতে জীবন ও অনাগত ভবিষ্যৎ লিখছেন, অক্ষর নয়। 

জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে বিভিন্ন স্থানে তাঁকে অবস্থান করতে হয়েছে। ঠিক ঘরবাড়ি নয়, শুধু দিন কাটানো। তাঁর জীবনের বড় অংশজুড়ে আছে দণ্ডকারণ্য-মরিচঝাঁপির স্মৃতি। এ থেকে তিনি ভারতবর্ষের রাজনীতি ও সমাজকে চিনতে পেরেছেন। ডান বাম যা-ই বলি শুধু রাজনীতির খেলা হয়েছে; কিন্তু এই অবহেলিত, বঞ্চিত মানুষের দিকে কেউ ফিরে তাকায়নি। বিশেষত মরিচঝাঁপিতে দরিদ্র মানুষের ওপর সবাই যে যার মতো নির্যাতন চালিয়েছে। অথচ এ দলিতরা কোন চাওয়া পাওয়ার দাবি করেনি, শুধু খাবারের জন্য দাবি তুলেছিল। মনোরঞ্জন নিজে বামপন্থার ব্যক্তি হয়েও কমিউনিস্টদের প্রতি তাঁর ঘৃণা জন্মেছে শুধু দলের নেতিবাচক ভূমিকার কারণে। সিপিএম-কমিউনিস্টরা শুধু লোভ দেখিয়েছে, আশার বাণী শুনিয়েছে, আশ্বাস দিয়েছে। বাস্তবে কিছুই করেনি। দারিদ্র্য ও বঞ্চনা নিয়ে একধরনের রাজনীতি করেছে। তিনি বলেছেন, ‘মরিচঝাঁপির ঘটনায় যে মানুষগুলোর ঘর পুড়েছিল, আহত, নিহত, ধর্ষিত হয়েছিল তাদের একটা বড় অংশ নমঃশুদ্র। উত্তর এবং দক্ষিণ দুই চব্বিশ পরগণা জুড়ে ছড়িয়ে আছে এই সম্প্রদায়ের মানুষ।’ [২০১৬, খ. ২ : ২০৬]

অধঃক্ষেপ

২০১১ সালের ২৯ ও ৩০ নভেম্বর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্দুমতী সভাগৃহে অনুষ্ঠিত দলিত সাহিত্য সম্মেলনে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি অংশগ্রহণ করেন। তখনো তিনি রিকশাচালক। জীবন এখানেই থেমে নেই। ২০১৪ সালে অর্জন করেন একাডেমি পুরস্কার। তখন থেকে অনেকেই ঘুরে ফিরে জানতে চেয়েছেন- কে এই মনোরঞ্জন ব্যাপারী। প্রথমে তাঁকে কেউ হিসেবে না নিলেও এখন তাঁকে নিয়ে মাতামাতি হচ্ছে। কারণ, ‘যাদবপুর কফি হাউস- যে হাউসের সামনে একদা আমি রিকশা চালাতাম। সেই কফি হাউসে এখন যারা বসেন তার মধ্যে আজ আছেন একদল আমার পাঠক।’ জেলখানা থেকে বের হয়ে আবার যাদবপুরে। তবে আগের মনোরঞ্জন নয়, নতুন একজন। বই ও শ্রমে নিমগ্ন এক মানুষ, নিষ্ঠাবান এক রিকশাচালক। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তায় বইপড়ুয়া রিকশাচালক দেখে মহাশ্বেতা দেবী কৌতূহলী হয়ে তাঁর নাম-পরিচয় জানতে চান। এ সুযোগে তিনি মহাশ্বেতার কাছে জিজীবিষা শব্দের অর্থ জানতে চান। এর আগে পরিচয় না থাকলেও এ শব্দের মাধ্যমে পরিচয় হলো। এ থেকেই তাঁর ভিন্ন যাত্রা শুরু। তিনি নিজেও তখন অন্যজীবন শুরু করতে চেয়েছেন। তাঁর কথায় ‘হোটেলে খেয়ে- রিকশার পর্দা বিছিয়ে রিকশার গদি মাথায় দিয়ে রেলস্টেশনে ফুটপাতে শুয়ে রাত কাটানো যে জীবন, বৃষ্টি এলে ভেজা, শীত এলে কাঁপা, পুলিশ এলে রাত দুপুরে লাথি মেরে তুলে দেওয়া যে জীবন তা আর তখন ভালো লাগছিল না। চাইছিলাম একটা ছোট ঘর হোক।’ [২০১২, খ. ১ : ২০৮] 

একাডেমিসহ বিভিন্ন পুরস্কার অর্জন, গণমাধ্যমে প্রচার এবং একাডেমিক পরিসরে আমন্ত্রণ ইত্যাদিতে গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে গেলো। যারা না চেনা ও না জানার অভিনয় করতেন, তারা কাছে আসতে শুরু করেন। কত বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে ও হচ্ছে। চারদিকে তাঁর অভ্যর্থনা। এটাই জীবনের রীতি। তাঁদের কথাও তিনি স্মরণ করেছেন। এসব বিষয়ে বিস্তারিত বলেছেন দ্বিতীয় খণ্ডে। তবে কোথায় যেন আরও কিছু বলার বাকি রয়ে গেছে। আমরা পাঠক হিসেবেও তা বুঝে নিতে পারি। তবে তাঁর লেখা পাঠ না করে ওই জীবন উপলব্ধি করা যাবে না। না বলার আক্ষেপ রেখেই তাঁর কথা তিনি শেষ করেছেন। ‘আর আমার কিছু বলার বা লেখার নেই। যতটুকু পেরেছি- বলেছি। যদিও বলা অংশের চেয়ে অনেক বেশি রয়ে গেল না বলা। আমি কেন, কোনো মানুষই বোধহয় জীবনের সব কথা অকপটে বলে যেতে পারে না। কিছু কথা মনের মধ্যে গোপন করে রেখে দিতে হয়। সেই না বলতে পারা কথারা তাকে রক্তাক্ত করে।’ [২০১৬, খ, ২ : ৩৯৭] এ রক্তক্ষরণ চলমান একইসঙ্গে মানোরঞ্জন ব্যাপারী ও পাঠকসমাজের হৃদয়ে। 


আকরগ্রন্থ

১. মনোরঞ্জন ব্যাপারী (২০১২)। ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন প্রথম খণ্ড। 

কলকাতা, কলকাতা প্রকাশন।

২. মনোরঞ্জন ব্যাপারী (২০১৬)। ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন দ্বিতীয় খণ্ড। 

কলকাতা এ বি প্রকাশনী।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫