পুরনো লেখকেই আস্থা
সমাদৃত হচ্ছে না নতুন লেখকের বই

আহমেদ সেলিম
প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২২, ১০:১২

ফাইল ছবি
পূর্ণ যৌবনে পা দিল বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে বইমেলা। দিন যত গড়াচ্ছে, মেলা ততই প্রাণবন্ত হচ্ছে। বিকেল হলেই লেখক, পাঠকের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে বইমেলা প্রাঙ্গণ। একইসঙ্গে প্রতিদিনই মেলায় আসছে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নবীন-প্রবীণ লেখকের লেখা শত শত নতুন বই। তবে এর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি বই ছাড়া বাকি বইগুলো আস্থা অর্জন করতে পারছে না পাঠকদের। হাজার হাজার বইয়ের মাঝে মানসম্মত বইয়ের আকাল অনুভব করছেন সচেতন পাঠক মহল। তাই মেলায় ঘুরে পুরনো লেখকদের বই নিয়েই ঘরে ফেরেন বেশিরভাগ পাঠক।
অন্যদিকে এবার শুরুর দিন থেকেই মেলা জমে উঠলেও, মেলার সাজসজ্জা নিয়ে ক্ষুব্ধ দর্শনার্থীরা। তারা বলছেন, যে ভাষার চেতনাকে লালন করে এই মেলার আয়োজন করা হয়, এবার সেই ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর; কিন্তু সেই আবহ ফুটিয়ে তুলতে পারেননি আয়োজকরা। তাছাড়া মেলার সাজসজ্জা অত্যন্ত নিম্নমানের। দেখলেই মনে হয় বাংলা একাডেমি দায়সারাভাবে মেলার আয়োজন করেছে।
সরেজমিনে বইমেলা ঘুরে দেখা যায়, বিকেলে বইমেলার দুয়ার খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ঢল নামে বইপ্রেমিকের। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই সব বয়সী দর্শনার্থী ও ক্রেতাদের পদধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠে মেলা প্রাঙ্গণ। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে বিকেল বেলায় মেলায় তিল ধারণের ঠাঁই মিলে না। মেলায় আসাদের মধ্যে অধিকাংশ তরুণ বয়সী। তরুণদের বইমুখী হওয়ায় আশাবাদী সাহিত্যিকরা।
মেলায় নতুন ও পুরনো লেখকদের হাজার হাজার বই প্রকাশিত হয়। এত বই প্রকাশিত হলেও, মানসম্মত বইয়ের শূন্যতা অনুভব করছেন পাঠকরা; কিন্তু কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে একাধিক প্রকাশক জানান, মেলায় আসা বইগুলোর মধ্যে অধিকাংশই তরুণ লেখকদের। এদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া বাকিরা লেখা দিয়ে পাঠকদের আকৃষ্ট করতে পারছেন না।
হাফিজুল ইসলাম নামের এক পাঠক বলেন, বইমেলায় আমার একান্ত পরিচিত ১৫-২০ জনের বই বের হয়েছে। তাদের অনুরোধ কিংবা সম্মানার্থে বইগুলো কিনেছি ঠিকই; কিন্তু পড়া হবে কি-না জানি না। কারণ এসব বইয়ে লেখার গভীরতা নেই। তবে মন থেকে কিনেছি প্রবীণ ও প্রতিথযশা লেখকদের বই। এই বইগুলো থেকেই জানার এবং শেখার অনেককিছু আছে।
বাংলাদেশের বইয়ের মানের ব্যাপারে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বইয়ের মান ভালো না। সম্পাদনা একেবারেই হয় না। সম্পাদনা করতে হয় বারবার পুনর্লিখনের মাধ্যমে। সারাবছর ধরে পাণ্ডুলিপি ধরে ধরে সম্পাদনা করে প্রস্তুত করতে হয়; কিন্তু আমাদের দেশে পাণ্ডুলিপি দেওয়ার এক দিনের মধ্যে বই প্রকাশ করা হয়। বিদেশে লেখকরা বই দিলে ১-২ বছর সে বইয়ের সম্পাদনা কনে, তারপর তা প্রকাশ করা হয়; কিন্তু আমাদের দেশে লেখকরা বই দিলে তার কোনো সম্পাদনা তো হয়ই না বরং বইয়ে নানারকম তথ্যগত ভুল থাকে।
তিনি আরও বলেন, ম্যারাডোনা, পেলে, মুহাম্মাদ আলী এদের যে বই বের হয়, তা কি তারা লেখেন? না, সেগুলো কোনো পাকা হাতের লেখক সুনিপুণ দক্ষতায় সেগুলো শুনে শুনে লেখেন; কিন্তু আমাদের দেশে সবাই লেখক। সবাই লিখতে পারে না। কাজেই সবার লেখা প্রকাশ করা উচিত নয়। আমাদের দেশের প্রকাশকরা সেগুলোর তোয়াক্কা করেন না। যে কেউ টাকা দিলেই, তার লেখা ছাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে হ্যাঁ, নবীন লেখকদের হয়তো প্রথম লেখা ভালো হয়নি, তবে দ্বিতীয় লেখা লেখা ভালো হতে পারে। প্রবীণরা তো চলে গেছেন, নবীন লেখকরাই আমাদের বইমেলার প্রাণ। তাদের প্রতি আমার শুভ কামনা রইল।
আগামী প্রকাশনের প্রকাশক ওসমান গণি বলেন, বইমেলার সব বই পাঠক সমাদৃত হয় না। বিশেষ করে তরুণ অনেক লেখক আছেন, যারা নিজের টাকা খরচ করে বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে বই বের করেন। পাঠকরা পড়লেন কি-না, তা কোনো বিষয় নয়। মেলায় বই বের হয়েছে এটাই বড় বিষয়। মেলায় বই বের হওয়াকেই তারা স্বার্থকতা মনে করেন। এ জন্য মানুষ নতুন লেখকদের অধিকাংশের প্রতি আস্থা রাখতে পারেন না।
মেলায় সবচেয়ে বেশি বই বের হয় কবিতার। তবে পাঠকদের আগ্রহের শীর্ষে রয়েছে- উপন্যাস ও ইতিহাসের বই। এসব বই বিক্রিও হয় সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়াও গল্প, গবেষণা, প্রবন্ধ, জীবনী, রচনাবলি, অনুবাদ, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, রাজনীতি, রম্য, শিশুতোষ ও সায়েন্স ফিকশনের প্রতিও আগ্রহ রয়েছে পাঠকদের।
মাওলা ব্রাদার্স প্রকাশনীর প্রকাশক আহমেদ মাহমুদুল হক বলেন, ইতিহাসভিত্তিক বইগুলো পাঠকরা বেশি কিনছেন। পাশাপাশি নতুন-পুরাতন সব বই বিক্রি হচ্ছে। সব মিলিয়ে এবারের মেলা খুবই প্রাণবন্ত মনে হচ্ছে।
শোভা প্রকাশের ব্যবস্থাপক আশিকুর রহমান শুভ বলেন, এবারের মেলায় উপন্যাস, ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে লেখা বইগুলো বেশি বিক্রি হচ্ছে। এসব বইয়ে পাঠকদের আগ্রহ বেশি মনে হচ্ছে।
অন্যদিকে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়ে গেলেও আজও বিক্রির শীর্ষে রয়েছে বাংলা সাহিত্যের কালোত্তীর্ণ লেখকদের লেখা বইগুলো। কয়েক প্রজন্ম পেরিয়ে এসেও পাঠকের মনে স্থায়ী আসন পেতে রেখেছেন তাঁরা। এখনো মেলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশের বই ভালো বিক্রি হয় বলে জানিয়েছেন প্রকাশকরা।
প্রকাশকরা বলছেন, জনপ্রিয় লেখকদের একেকটি গল্পগ্রন্থ কেনার চাইতে সমগ্র কিনতে আগ্রহী পাঠকরা। মেলা ঘুরে দেখা গেল, অনেক প্রকাশনী থেকেই জনপ্রিয় লেখকদের পুরনো বা বিষয়ভিত্তিক বই নিয়ে সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। যেসব লেখকের মৃত্যুর পর ৬০ বছর পেরিয়ে গেছে, তাদের অনেকের সম্পূর্ণ রচনাবলিও প্রকাশ পেয়েছে। ঐতিহ্য প্রকাশনী কয়েক বছর আগেই প্রকাশ করেছে, ৩০ খণ্ডের রবীন্দ্র রচনাবলি। কবিগুরুর গ্রন্থিত ও অগ্রন্থিত সব লেখা, চিত্রকর্ম ও পত্রাবলি রয়েছে এ রচনাবলিতে। সম্পাদনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন। এ ছাড়াও এ প্রকাশনী থেকে আরও প্রকাশিত হয়েছে সৈয়দ আকরম হোসেন সম্পাদিত দুই খণ্ডে এস ওয়াজেদ আলী রচনাবলি, ছয় খণ্ডে জীবনানন্দ দাশ রচনাবলি, ১০ খণ্ডে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলি, ১০ খণ্ডে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলি এবং ১৩ খণ্ডে আল মাহমুদ রচনাবলি। প্রতিটি রচনাবলির বিক্রিই ভালো বলে জানালেন ঐতিহ্যের ব্যবস্থাপক আমজাদ হোসেন কাজল।
অবসরে পাওয়া যাচ্ছে প্রতীক প্রকাশনীর বই। এ প্রকাশনা সংস্থা থেকে চলতি মেলায় প্রকাশিত হয়েছে- তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বনফুলের শ্রেষ্ঠ গল্প। এর প্রতিটির বিক্রিই ভালো বলে জানান অবসরের ব্যবস্থাপক মাসুদ রানা।
পাঠক সমাদৃত হচ্ছে দেশকাল পত্রিকার স্টল : বইমেলায় ব্যাপক পাঠক সমাদৃত হচ্ছে দেশের শীর্ষ ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘দেশকাল পত্রিকা’। মেলায় আসা বইপ্রেমীরা বাংলা একাডেমি চত্বরে দেশকাল পত্রিকার স্টলে (স্টল নং ৬৪৪) ঢুঁ মেরে কিনছেন ত্রৈমাসিক দেশকালের নতুন ও পুরনো সংখ্যাগুলো। এ ছাড়াও ত্রৈমাসিক দেশকালের প্রধান পত্রিকা দেশের প্রধানতম সাপ্তাহিক সম্প্রতিক দেশকালও কিনছেন তারা। প্রতিদিন বিকেলেই এই স্টলকে কেন্দ্র করে জমে ওঠে লেখক, পাঠকদের জমজমাট আড্ডা।
জুবায়ের আহমেদ নামে এক পাঠক বলেন, দেশে প্রতিদিন অনেক দৈনিক বের হয়। এ ছাড়াও সপ্তাহ, মাসে কিংবা ত্রৈমাসিক অনেক ম্যাগাজিন বের হয়; কিন্তু এসবে বেশিরভাগ পত্রিকা কিংবা ম্যাগাজিনে গতানুগতিক বিষয়ের বাইরে কিছু নেই। বেশ কিছুদিন আগে খোঁজ পেলাম সাম্প্রতিক দেশকাল ও দেশকাল পত্রিকার। এরপর থেকে এগুলোর নিয়মিত পাঠক। তিনি মনে করেন, এত মানসম্পন্ন পত্রিকা এখন দেশে আর নেই। ত্রৈমাসিক দেশকাল শুধু দেশ নয় এই উপমহাদেশের অন্যতম মানসম্পন্ন ম্যাগাজিন বলেও মনে করেন তিনি।