Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

তালাশী সংবেদ

Icon

দিলরুবা পাপিয়া

প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২২, ১২:২৮

তালাশী সংবেদ

ছবি : মামুন হোসাইন

নিতান্তই সহজ সরল আজব আলী। কারো সাতে-পাঁচে নেই। দু’টা কটু কথা দূরে থাক, ইচ্ছে করে কেউ তার গায়ের উপর পড়লেও হাতটা দিয়ে সরাবে না। আত্মীয়-অনাত্মীয়, চেনা-অচেনা বাছ বিচার নেই, চোখের নাগালে আসার আগেই আদাব, সালাম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠে। তবে একটু আলাভোলা।

আজব আলীকে সকলে আজু বলে ডাকে। বেশ আমুদে মানুষ। হাটবার আজুর খুব প্রিয় একটা দিন। এই এলাকায় রবি, বুধ হাটবার। বিহানবেলা থেকেই আজু খুব স্ফূর্তিতে থাকে। তার স্ফূর্তির কারণটা শুনলেই বোঝা যায় সে কতটা নাবালক কিসিমের! হাটের দিন সুধির ঘোষের মিষ্টির দোকানে বসে আজু পেট চুক্তি আমিত্তি খায়। এটাই স্ফূর্তির কারণ। বহুদিনের অভ্যাস। বাজার-সদাইয়ে টান পরলেও পেট চুক্তি আমিত্তি খাওয়ায় কখনও টান পরে না।

এই বয়সে পেট চুক্তি আমিত্তি খাওয়া তোমার জন্যে ঠিক না বাজান। স্বপনের কথায় আজব আলীর সাফ জওয়াব- কতদিন আর খামুরে বাপ! দেখপি সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।

সময়ে ঠিক হওয়ার সময়টা যে কবে আসবে, আল্লামালুম!

সেদিন সক্কাল সক্কাল ক্ষেতখলা শেষ করে, গাও- গোসল ধুয়ে সবার আগে আগে আজব আলী হাটে রওয়ানা হয়। আকাশী রঙের পাঞ্জাবিখান এই পর্যন্ত তার গায়ে দেখেছে এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। পাঞ্জাবিখানার বয়স কম করে হলেও আট/নয় বছর তো হবেই। পরিপাটি করে ঘাড়ে ঝুলিয়ে হাটে যায়, ফিরে এসে দেরাজ খুলে সঠিক জায়গায় রেখে দেয়। এমনই হয়ে আসছে বহুদিন। এর অন্যথা যদি হয়ে থাকে সে কারো জানা নেই। খোঁজ খবর নিয়ে দেখা যেতে পারে। কিন্তু এমন বিনাশ্রমে কারই বা আগ্রহ আছে! তবে এইটুকুন ভদ্রতা সে বজায় রাখে, একখানা সাদা সেন্ডু তার গায়ে শীত গরম বারমাসই থাকে।

আজুর ছয় সন্তান। চার মেয়ে রানু, শানু, বেনু, ঝুনু। দুই ছেলে স্বপন আর নয়ন দুই মাথায় থেকে চার বোনকে মধ্যখানে বেঁধে রেখেছে। এদের সকলের নাম রেখেছে ওদের মা, জামিলা। জামিলা প্রাইমারি শেষ করে হাই পাশ। বাবা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু অল্প বয়সেই ওদেরকে ছোটো ছোটো রেখে তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন। তাই তো জামিলার আজ এই অবস্থা!

তবে আজু আলাভোলা হলেও মানুষ হিসেবে খাঁটি। জামিলার দুঃখ অন্য জায়গায়, আজু সন্তানদের একরত্তি শাসন-বারণ করে না। শুধু একতরফা প্রশ্রয় দিয়েই খালাস। শাসন যা করার, মা-ই করে। বাবা তাদের কোনো কিছু নিয়েই তেমন মাথা ঘামায় না। এমনকি ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা নিয়েও কোনো চাপাচাপি নাই।

সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে লোকটার কি আদৌও কোনো মাথাব্যথা আছে? এতো বড়-সড় ধারী ছেলেমেয়েদের কোলে-কাঁখে বসিয়ে এমন আহ্লাদ করে যে, পাড়া-পড়শী কেন, স্বয়ং ওদের মা-ই খেপে যায়। অনেকে এটাকে আজুর আদিখ্যেতাও বলে! তার বদলে যদি এক- আধটু ধমক- ধামক দিতো জামিলা বেঁচে যেতো। ন্যায়- অন্যায়, ভুল- ভ্রান্তি, চাওয়া- পাওয়া, শেখা- না শেখা সব নিয়ে জামিলার মাথা খারাপের যোগাড়। একজন দুজন নয়, ছয় ছয়টি ছেলেমেয়ে। সারাক্ষণ একজন আরেকজনের সাথে লেগেই থাকে।

মেঝো মেয়েটা পড়াশুনায় ভালো। বড় ছেলেটাও চলনসই। বাকিদের তেমন নেক নাই। তাই এদের ভবিষ্যত ভেবে জামিলা বেজায় চিন্তিত। পড়ালেখা না হলেও অন্তত মেয়েগুলোকে সেলাই, নামাজ- কুরআন, ঘর- সংসারের কাজে তো দক্ষ করতে হবে। এই নিয়ে জামিলা সারাদিনই ব্যস্ত।

এরইমধ্যে বড় ছেলে স্বপন নার্সিং পড়া শেষ করে কোনোরকমে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চাকরিতে ঢুকেছে। বড় মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছে। যদিও গায়ের রং একটু মেটে বলে বেশ কসরত করে, টাকা- পয়সা খরচা করে বিয়ে দিতে হলো।

তবে বিপদে আছে সেজো মেয়ে বেনুকে নিয়ে। মেয়েটি বোবা। কানেও কম শোনে। কিন্তু চেহারার কাটিং কুটিং মাশাআল্লাহ, দেখার মতো। গাও-গেরামের আলো আঁধারীতে এমন বাড়ন্ত বয়সের দায় যে মেয়ে নিজে সামলাতে পারে না, তাকে নিয়ে মা-বাবার দুঃচিন্তার সীমা থাকে না।

এই মেয়েটা আজুর চোখের মণি। বাপসোহাগী। গায়েপায়ে বড়সড় না হলে আজু বোধ করি ওকে কোলে নিয়ে ঘুরতো। মেয়েটাও বাপের সিথানী। সক্কালবেলায় চক্ষু কচলাইতে কচলাইতে আজুর বিছানায়, আজুর বুকের উপর ঝাপ দিয়া পরবে, এই অভ্যাস ছোটোবেলার। বয়সে বড় হয়ে উঠলেও অভ্যাসটা ছাড়তে পারে নাই। মা কতোভাবে বোঝায়!

তুই বড় হইছিস না? এতো বড় শরীলডা নিয়া বাপের গায়ের উপর হঠাৎ পরলে, তোর বাপের ব্যথা লাগবো না?

শুনে সে তেমনি ভাবলেশহীন থেকে শুধুই মাথা দুলিয়ে হাসে!

শানুটা গঞ্জের কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। আবাসিক হলে থাকতে হবে। এতোটা বাড়তি খরচ চালানো আজুর জন্যে কঠিন। সে একটু উশখুশ করলেও জামিলার কারণে শেষতক পেরে উঠলো না। প্রথম ভর্তির টাকাটা, হলে উঠার বাক্স-পেটরা জামিলাই কিনে দিলো। এতো জীবন হাঁস, মুরগি, ছাগল, লাউটা, ডিমটা, কাঁঠালটা বেঁচে নিজের একটা তহবিল সে তৈরি করেছে। তাছাড়া স্বপনের চাকরি হবার পর সংসারের কিছুটা হাল সে-ও ধরেছে।

শানুকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্নটা স্বপনই দেখিয়েছে। তার ভরসাতে জামিলাও সাহসটা করতে পেরেছে। গ্রামের সারল্য আর শহরের আভিজাত্যের মিশেলে তার একটি স্বতন্ত্র আদল তৈরি হয়েছে। যা তাকে আগের চেয়েও খানিকটা আত্মবিশ্বাসী করেছে। এই মেয়েটিকে নিয়ে জামিলার অনেক স্বপ্ন।

শানুর মতো জামিলাও খুব ভালো ছাত্রী ছিলো। আজও মনে পড়ে, ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পাওয়ার পর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাকে মেডেল দেয়া হয়। এর আগে কখনও এমনটা ঘটে নাই। এই ব্যতিক্রমের কারণ- এলাকায় প্রথম কোনো মেয়ে বৃত্তি পেলো। গলায় মেডেল পরে জামিলা যখন বাড়ি ফিরলো, পাড়ার লোকেরা দল ধরে জামিলাকে দেখতে আসলো। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। জামিলার বাবার সুখের সীমা রইলো না! তিনি মনস্থির করলেন- এই মেয়েকে যে করেই হোক পড়াশুনা করাবেন!

কিন্তু সেই সৌভাগ্য তার আর হয়নি। নিজের দেহ ত্যাগের সাথে সাথে জামিলার সৌভাগ্যও তিনি পাতালপুরীতে নিয়ে যান। তাই তো জামিলা নিজের অভিলাষ ছেলেমেয়েদের মাঝে দেখতে চায়।

ঝুনুটা সবথেকে ছোটো হয়েও সবচেয়ে মুখরা! কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। তার সাথে একটু রয়েসয়ে, ভেবে চিন্তে কথা বলতে হয়। যেমন- বাবার সরলতার সুযোগে কেউ কিছু বলে ফেললো। অন্য ভাই-বোনরা ছেড়ে দিলেও ঝুনু তাকে খপ করে ধরে ফেলবে এবং তার মাথায় যা আসে তাই শুনিয়ে দিবে। এর ভালো-মন্দ দুইই আছে কিন্তু তার কোনো মাথাব্যথা নেই।

জামিলা মাঝেসাঝে বোঝাতে চায়, আবার ভাবে সবাই তো সয়েই যাচ্ছি, একজন কিছু ঝামটা মারা শিখেছে শুনিয়ে যাক।

নয়ন একেবারেই ছোটো! কেউ কেউ মজা করে বলে ‘আজুর থৈল্লা ঝারা পোলা’! সব ভাইবোনের আদরের নয়ন। যদিও ঝুনু ওর সাথে একটু লেগে থাকে। কারণ বেশ ক’বছর সবার ছোটো জায়গাটা ঝুনুর পুতুলের বাক্সেই ছিলো। সেই কদর এখন কিছুটা কমে গেছে। তাই নয়নের সাথে তার যতো খুনসুটি, রেসারেসী।

ছয় সন্তানের জননী জামিলার ভরা বাগান আগের চেয়ে অনেক নিরিবিলি হয়ে গেছে। স্বপন, রানু, শানু তিনটা মানুষ কমে গেছে। হৈ- হুল্লোড়, মারামারি, কাড়াকাড়ি নেই বললেই চলে। জামিলার কাটাবাছা, রান্না, মাজাঘসা, ধোয়ামোছা, আজুর নিত্য কেনাকাটা সেসবও সিজিল। এখন আর কোনো কিছুতেই টান পরে না। বিছানা- বালিশ, কাঁথা- কম্বল, থালা- বাটি, কল তলা, কোথাও আর আগের হুজ্জুত নাই।

জামিলার মন কখনও হু হু করে ওঠে। পিঠাপিঠি ছয় সন্তানকে মানুষ করতে কতো কাঠখড়ই না পুড়িয়েছে! কতো মাথা গরম করেছে! গালমন্দ করেছে! আর আজ, সবই শূন্য পড়ে আছে। পড়ে থাকা সময় ওদের জন্য হাহাকার করছে।

ওরা দু-চারদিনের জন্য যখন আসে, জামিলার ঘর কল-কাকলীতে ভরে উঠে।

বড় ছেলেটা আগে বাড়ি থেকেই নার্সিং কলেজে যাতায়াত করতো। কলেজে ক্লাসের একটা নির্দিষ্ট সময় ছিলো। কিন্তু চাকরিতে তা নেই। আজ সকাল, তো কাল রাতে ডিউটি। তাই হাসপাতালের কাছাকাছি একটা মেসে ঠাঁই নিয়েছে।

সারাক্ষণই বাড়ির চিন্তায় মন উচাটন হয়ে থাকে। বাবা এমন সহজ-সরল, আজকাল এমন লোক সমাজে অনেকটা অচল। যে যেভাবে পারে ঠকিয়ে যায়, ওদের ক্ষেত- খলায় হাত লাগায়। ক্ষেতের বেগুনটা, গাছের কলার ছড়িটা নিজের মতো তুলে নেয়। বাড়িতে থাকতে স্বপন অনেক কিছু তদারকি করতো। মা-ও তাগাদা দিয়ে পাঠাতো। তাই স্বপন সব সময় বাড়ির খবরা-খবর নিয়ে অস্থির থাকে।

তবু যে স্বপনের চাকরিটা জুটলো। আজকাল চাকরি আর কলসী কাঁখে গাঁয়ের বধূ- দুইই বিরল। আশা করেনি এতো সহজে কিছু হবে। কতজন পাশ করে উপরওয়ালার ভরসায় বছরের পর বছর বসে আছে। না থেকেই বা কি করবে, সবার তো আর মামা, চাচা, মন্ত্রী মিনিস্টারের জোর নেই। তাই আল্লাহ ভরসা।

কিন্তু স্বপনের কপাল ভালো। নার্সিং কলেজেরই এক শিক্ষকের সুপারিশে মামা, চাচা ছাড়াই একটি নামী বেসরকারি হাসপাতালে তার চাকরি হয়েছে। নার্সিং কলেজের ওই শিক্ষক কেন স্বপনকে এতোটা স্নেহের চোখে দেখতেন স্বপন নিজেও জানে না।

যাই হোক, দেখনেদার স্বপনের এটাও তো একটা গুণ যে, তার চেহারায় মুগ্ধতা আছে। তাছাড়া মানবিক, বিনয়ী। ওরা বংশগতভাবেই খুবসুরত, সহজ-সরল। আজব আলীও দেখনেদার। স্বপন বাপ-দাদার লছন পেয়েছে।

রানু শ্বশুর বাড়ির বড় সংসার নিয়া মহা ব্যস্ত। বড় বাড়ির বউ। অনেক দিন পর পর ২/৩ দিনের জন্য আসতে দেয়। জামিলা তরস্ত করে একটু পিঠা, একটু পায়েশ, নাড়ু নানান উলুফা তৈয়ার করে মেয়ে, মেয়ের জামাইকে খাওয়ায়। ওদের উসিলায় বাড়ির সকলেরই খাওয়া হয়। খালি বাড়িতে আজকাল অনেক কিছুই করতে ইচ্ছা করে না। ওরা যখন বাড়ি আসে, জামিলার ঘরে যেন খই ফুটে। আজব আলীও ছেলে-মেয়েদের পেয়ে আহ্লাদে আটখানা হয়।

অনেকদিন থেকেই আজব আলী চোখের সমস্যায় ভুগছে। কিন্তু ডাক্তার দেখাতে রাজি হয় না। ছেলেকে কয়েকবার তারিখ দিয়েও নানা টালবাহানায় বাতিল করেছে। কিন্তু এখন আর চলতে পারছে না। তাই নিজ থেকেই ছেলেকে খবর পাঠালো। একেই বলে ঠ্যালার নাম বাবাজি! স্বপন বললো- তোমরা দুজনই চল। মায়েরও তো কতো সমস্যা। এই বয়সে রোগ- বালাই না থাকলেও মাঝেমধ্যে পরীক্ষা- নিরীক্ষা করা দরকার। জামিলা আপত্তি করলো না।

বিনু, ঝুনু, নয়ন বাড়িতে রইলো। জামিলা ওদের জন্য কিছু রান্না-বান্না করে গেলো। এর আগেও তারা দু-একবার থেকেছে। তখন অবশ্য শানু বাড়িতে ছিলো। বিনুকে নিয়ে একটু চিন্তা থাকে। জেদী মেজাজের, কারো কথা শুনতে চায় না। তবুও কিছু করার নেই। আল্লাহ ভরসা করে ওরা রওয়ানা হলো।

স্বপনদের হাসপাতালে চোখের ভালো ডাক্তার নাই। তাই অন্য একটা হাসপাতালে দেখানো হলো। আজব আলীর চোখের অবস্থা খুব খারাপ। ছানি পড়েছে অনেক দিন থেকেই। কিন্তু এখন ছানি পোক্ত হতে হতে জটিল আকার ধারণ করেছে। ডান চোখের ছানি পেকে গেছে। বাম চোখটা একটু ভালো। তাই হয়তো সে কিছুটা চলতে পারছে। ডাক্তার এই মুহূর্তেই হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিলো। ডাক্তার জানালো, যতো দেরি হবে চোখের অবস্থা ততই খারাপ হবে।

স্বপন আজব আলীকে এখনই ভর্তি করতে চাইছে। কিন্তু আজব আলী তবুও ডাক্তারকে অনুনয় করে কয়েকটা দিন সময় চাইলো। টাকা- পয়সার ব্যপার আছে। তাছাড়া বাড়িতে এসে একটু বুদ্ধি- সুদ্ধি তো করা দরকার।

জামিলারও তাই মত। উরুম দরুম কেমনে কি করা। একটু বুদ্ধি পরামর্শের তো দরকার আছে।

স্বপন যথেষ্ট বোঝানোর চেষ্টা করলো যে, এটা ডাক্তারের লাভ-ক্ষতির কিছু নাই। তোমার নিজের ক্ষতি। কিন্তু কাজে ঠেকলো না।

তবে জামিলা বাড়ি ফিরে তাড়াতাড়িই যোগাড়-যন্তে লেগে গেলো। নিজের তহবিল ঝেরেঝুরে যা আছে বের করলো। গাছের নারিকেল, কালিজিরা চাল, মাসকলাইয়ের ডাল, আরও যা সম্ভব সব দিয়া দিনঠিকা কামলা মদনের সাথে নয়নরে হাটে পাঠালো। মদন বেচাবিক্রি ভালোই বোঝে। তবুও পরি (প্রহরী) হিসাবে নয়নরে দেওয়া। বিশ্বাস হয় আবার হয়ও না।

স্বপন নিত্তিদিন বাড়ি আসতেছে, আর তাগাদা দিচ্ছে। এই অবস্থাতেও আজব আলীর কোনো বিকার নাই। জামিলা দিন-রাত হাতড়ে, দিনতিনেকের মধ্যে টাকা-পয়সা যদ্দুর পেরেছে যোগাড় করেছে। বাকিটা ছেলের উপর দায়িত্ব দিলো।

শানুর পরীক্ষা চলছে। রানুর বড় সংসার। তাই কেউ সময় দিতে পারলো না। শেষমেষ ছেলেমেয়ে তিনটাকে ঠিকা ঝি মায়মোনার হাতে ছেড়ে দিয়ে জামিলাই স্বামীকে নিয়ে হাসপাতালে গেলো। ছেলের নতুন চাকরি। বেশি ছুটিছাটা চাওয়া ঠিক না। আজুর কাছে সবসময় কেউ থাকতে হবে। তাই জামিলা উপায়হীন।

সেদিনই স্বপন সব ব্যবস্থা করে ভর্তি করালো। কিন্তু রাতে ডাক্তারের কথা শুনে জামিলার মাথায় আসমান ভেঙে পড়লো। ডাক্তার জানালো, আজব আলীর দুইটা চোখ একসাথে অপারেশন করা যাবে না। একটা চোখ খানিকটা ভালো হলে, আরেকটা অপারেশন করতে হবে।

হাসপাতালে দুইবারের খরচ, বাড়ির চিন্তা, বিশেষ করে বেনুর চিন্তায় জামিলার বুক ধড়ফড়ানু শুরু হলো। জামিলার হাই ব্লাড প্রেসার। মনে হচ্ছে প্রেসার বেড়ে মাথায় উঠে গেছে।

স্বপন জামিলাকে বুঝালো যে, চোখ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা অঙ্গ। ইনফেকশন বা যেকোনো সমস্যা হতে পারে। সুতরাং একটা চোখের সুস্থতা নিশ্চিত করে অন্যটা অপারেশন করা ভালো। যাতে করে একই সমস্যা দু’টাতে না হতে পারে। আবার দু’টো চোখ একসাথে বাধা থাকলে চলাচলেও সমস্যা। এইসব বিবেচনা থেকে ডাক্তাররা দুইবারে করেন। জামিলা বুঝলো, কিন্তু চিন্তা থেকে রেহাই পেলো না।

স্বপন বললো, মাঝেমাঝেই সে বাড়ি গিয়ে ওদেরকে দেখে আসবে। মায়মোনার স্বামীরে হাট- বাজার করে দিতে বলবে।

আজুর অপারেশন ভালোভাবেই হলো। ডাক্তার বললো- সব ঠিকঠাক থাকলে ৪/৫ দিন পরই আজু বাড়ি চলে যেতে পারবে। সেই সাথে এটাও জানালো, যেহেতু হাসপাতাল ছেড়ে দিবে তাই নিয়ম-কানুন কঠোরভাবে না মানলে খুব খারাপ কিছুও ঘটতে পারে, সেটা মনে রাখতে হবে। পনেরদিন কোনো পানি ছোঁয়ানো যাবে না। ঘুম বাদে সারাক্ষণ কালো চশমা পরে থাকতে হবে। আর মাসখানেক পরে এসে বাম চোখটা অপারেশন করাতে পারবে।

বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। আজব আলী এখন ডান চোখে ভালো দেখতে পাচ্ছে। তাই বাম চোখ নিয়ে আর তেমন তাগাদা নেই। স্বপন কয়েকবার এসে ঘুরে গেলো, কিন্তু আজু শুধু যাই- যাচ্ছি করছে। আগের বারের মতো নিজে লেগে থেকে টাকা-পয়সা যোগাড় করে জামিলাই ছেলেকে তারিখ দিয়ে দিলো।

সেই কতোটা বছর আলাভোলা মানুষটার জোয়াল কাঁধে নিয়ে টেনে যাচ্ছে জামিলা। দিনে দিনে শুধু মানুষটার বয়স বাড়লো, কিন্তু বিবেচনা বাড়লো না। এখনও ১৩/১৪ বছরের বালকটির মতো অকাতর হেসে খেলে কাটিয়ে দিচ্ছে দিন। তাই জামিলাই সম্বল।

কিছু বেচাবিক্রি করে টাকা- পয়সা যা যোগাড় হয়েছে তা আজব আলীর হাতে দিয়ে বললো- এহনই পোলার লগে কথা বইলা সব ঠিক কর। আর দেরি করুন ঠিক না।

তবে আজব আলীর আলস্য এতো সহজে কাটবে না।

কিছুদিন ধরে অর্থাৎ হাসপাতাল থেকে ফিরার পর থেকেই জামিলা খেয়াল করছে, বেনু খুব মনমরা হয়ে থাকে। ছটফট স্বভাবের বেনু কেমন জানি ঠাণ্ডা পাত্থর। মেজাজও একটু তিরিক্ষি। ওর বাপ যে এমন ভোলাভালা, তারও নজর কাড়লো বিষয়টা।

কন্যারা আজব আলীর অতি আদরের। তার মধ্যে বেনু বেজায় বাপসোহাগি। আজব আলী জিজ্ঞাসা করে- কি হইছেরে মা, বাজানরে কও। আমি তোমারে আসমানের চান আইন্যা দিমু!

বেনু এক ছিলুম হাসি দিয়া বাজানের সাথে খাইতে বসলো। আজব আলী কন্যারে লোকমা তুইলা তুইলা খাওয়াইলো।

হঠাৎ করেই শানু বাড়িতে আসলো। বড় ছুটি ছাড়া শানু খুব একটা আসে না। যাওয়া- আসার কয়টা টাকাও তার কাছে মূল্যবান। খুব কষ্ট করে চলে। বাবা সাধারণ একজন কৃষক। চাকরিজীবীদের মতো মাস ফুরালেই বেতন পায় না। এই কয়টা টাকা দিতে পরিবারকে কতোটা কষ্ট করতে হয় শানু তা জানে। তাই সে কোনো সময় নষ্ট করে না। পড়া নিয়েই মেতে থাকে। অনেক স্বপ্ন দেখে পরিবারকে নিয়ে। পাশ করে পরিবারের জন্য অনেক কিছু করার ইচ্ছা।

গতকাল পরীক্ষার তারিখ দিয়েছে। শানু এসেছে ফরম ফিলাপ আর সারা বছরের বকেয়া পরিশোধের টাকা নিতে। কিন্তু বাবাকে বলতে পারছে না। কিছুদিন আগেই হাসপাতাল থেকে ফিরলো। আবার আরেকটা চোখ অপারেশনের জন্য টাকা যোগাড় করছে। এই অবস্থায় কিভাবে টাকা চাইবে? শানু লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে আছে। শেষ পর্যন্ত মাকে সব বললো। জামিলাও মহাচিন্তায় পড়েছে। তবুও আজব আলীর কাছে নিয়ে গেলো।

জামিলার কথা শুনে আজব আলী একবার নিজের ঘরে গেলো। ফিরে এসে শানুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো- আমি তো এক চোখেই দুনিয়া দেইখা ফুরাইতে পারতেছি না মা। আরেক চোখ দিয়া কি করুম? আমার পোলা-মাইয়্যারাই আমার চক্ষু। যা, এই টাকাটা লইয়্যা তাড়াতাড়ি যা। ভালো কামে দেরি করিস না। শানু বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। পরদিন সকাল সকাল শানু হোস্টেলে ফিরে গেলো! সাথে নিলো মা-বাবার মহব্বতের কবজ!

বাড়িটা যেন খাঁখাঁ করছে। চারপাশটা কেমন উদ্ভ্রান্ত, অদ্ভুতুড়ে ঠেকছে জামিলার কাছে। যদিও ঝুনুর চিৎকার চেঁচামেচিতে কিছুটা সরব।

এই মুহূর্তে শানুকে এই টাকাটা দেয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না। কিন্তু আজব আলীর চোখের অপারেশন কতোটা জরুরি জামিলা জানে। এখন কি উপায় করবে তাই ভাবছে।

সকাল থেকে ঝুনু বাড়ি মাথায় তুলছে। ঝুনু আর বেনু এক বিছানায় ঘুমায়। পিঠাপিঠি ভাই-বোনরা এমনিতেই একটু লেগে থাকে। তার উপর ঝুনু ঝগড়াটে আর বেনু জিদ্দি। মশারি-বিছানা, কাপড়-চোপড় গুছানো এসব নিয়ে লেগেই থাকে। বেনু যেহেতু কথা বলতে পারে না, এই সুযোগটা ঝুনু পুরোপুরি কাজে লাগায়।

যা বলছিলাম, বেনুটা খুব অসংগত আচরণ করছে। কারণে অকারণে জিদ দেখানো, সময় মতো না খাওয়া, না গোসল। ঠিকঠাক মতো কিছুই করছে না। কোনো কারণে সে যে স্বস্তিতে নেই, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। যে বাবা তাকে বুকে আগলে এতটুকু ডাঙর করেছে সেই বাবা ডাকলেও চেঁচামেচি করছে। দিনরাত মুখ গুজে বিছানায় পরে থাকছে।

দুপুর বেলায় জামিলা ভাত বেড়ে সবাইকে ডাকছে। আজব আলী বেনুকে ডাকতে গিয়ে দেখে এই ভর দুপুরে সে কাঁথা মুড়ে শুয়ে আছে। আজব আলী তাকে কোনোভাবেই তুলতে পারলো না। মাঝেমধ্যে জোর করে আজব আলী, জামিলা মিলে তাকে কয়েক লোকমা খাওয়াচ্ছে।

বেনুর শরীর ভেঙে পড়েছে। মেয়ের এই অবস্থা আজব আলী কোনোভাবেই মানতে পারছে না। চিন্তা করলো, স্বপন আসলেই বিনুকে ডাক্তার দেখাতে পাঠাবে।

স্বপন এলো। কিন্তু বেনুকে কিছুতেই বাড়ি থেকে বের করা গেলো না। শেষপর্যন্ত জামিলা, আজব আলী সবাই মিলে রওনা দিলো।

হাসপাতালেও বেনু একই রকম জিদ করছে। ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকাতে জামিলা তাকে হাতে পায়ে ধরলো। শেষমেষ আজব আলী অনেক বুঝিয়ে নিয়ে ঢুকলো। আবার অনেক বুঝিয়ে কয়েকটা টেস্ট করানো হলো।

স্বপন রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের রুমে ঢোকার আগে একনজর দেখলো। ওর চক্ষু চড়কগাছ। মা-বাবাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকতে সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু এই ভালো। সে নিজে থেকে কিচ্ছু বলতে পারবে না। শুধু মনে মনে নিজের অসহায়ত্বকে পরখ করলো। বোবা, অবুঝ বোনটার এই যন্ত্রনা, অপমান সে মানতে পারছে না।

সে ডাক্তারের কাছে নিজের পরিচয়টা চেপে রাখলো। এই পরিস্থিতিতে কি করবে তার পরামর্শ চাইলো। সহজ, সরল আজব আলী কিছুই বুঝতে পারছে না। তবে জামিলা ডাক্তারের নানান প্রশ্ন, নিজের অভিজ্ঞতা আর ছেলের মুখ দেখে আন্দাজ করতে পারছে। ভয় আর লজ্জায় তার শরীর হীম হয়ে আসছে। চোখে অন্ধকার দেখছে।

বেনু এক কোণে চুপচাপ বসে আছে। কোনো জিদ করছে না। ওর মুখটা দেখে জামিলা আরও অসহায় বোধ করছে। কিভাবে গ্রামের মানুষকে মুখ দেখাবে? সারা গাঁয়ে তো ডি ডি পরে যাবে। কতোজন কতো কথা শুনাবে। দু’চারজন ওর মুখে থুতু দিবে। অথচ একটা বোবা, নিষ্পাপ মেয়ের সাথে এতো বড় অন্যায় যে জালিম করেছে ওরা তাকে জানে না। তার কিচ্ছু হবেও না। হয়তো কেউ জানবেও না।

আজব আলীর সামনেই সব আলোচনা হলো। সে ঠাণ্ডা পাথর হয়ে বসে আছে। একটা কথাও বলছে না। যেন কিছু হয়নি। যেন যন্ত্রণাকাতর এই মেয়েটির সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। যেন অচেনা মানুষের অজানা কিছু কথা এখানে আলোচনা হচ্ছে, যাতে তার কিছু যায়-আসে না। তার চেহারায় ছিটেফোঁটাও কোনো অভিব্যক্তি নেই।

জামিলা খপ করে ডাক্তারের হাত ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। স্যার- আমার মেয়েডারে বাঁচান। আমগর ইজ্জত বাঁচান। এসব কথায় যদি ডাক্তারের মন গলেই যেতো তাহলে আর শহরের সেরা সেরা ফ্ল্যাটবাড়িগুলো ডাক্তারদের হতো? তাদের কি আসে যায় এতে! তারা মামুলি যা করে এক্ষেত্রেও তাই করলো। বরং গোপনীয়তার অজুহাতে, সাবধানতার অজুহাতে ব্ল্যাকমেইলের মতো বেশ টাকা দাবি করলো। উপায়হীন হয়ে স্বপন রাজি হলো। কিন্তু টাকা কোথা থেকে, কিভাবে দিবে তা জানে না।

স্বপন যে বাসায় মেস করে থাকে আপাতত ওদেরকে সেখানেই নিয়ে গেলো। ওর রুমমেট বাড়ি গেছে। না আসা পর্যন্ত চালানো যাবে। তাদেরকে ঘরে রেখে সে কিছু খাবার কিনে আনলো। তবে কেউ কিচ্ছু মুখে তুললো না। সবাই যেন মুখ লুকিয়ে থাকতে চাচ্ছে। সে রাতে সবাই বাতি নিভিয়ে খুব তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লো। কিন্তু কে কখন ঘুমালো তা কেউই জানলো না।

সকাল বেলায় জামিলা ঘুম থেকে জেগে চিৎকার করে স্বপনকে ঢেকে তুললো।

আজব আলী, বেনু কেউ ঘরে নাই। কোথায়, কখন গেলো কিচ্ছু টের পায়নি ওরা। রাতে বেনু বাবাকে জড়িয়েই শুয়েছিলো।

স্বপন বললো- মা, চিন্তা করো না। আশেপাশেই হয়তো আছে। বেনুকে নিয়ে বাবা হয়তো একটু ঘুরে দেখাচ্ছে।

এতো স্বাভাবিক গলায় স্বপন কথাগুলো বললো যেন তারা এখানে বেড়াতেই এসেছে। যেন সব পান্তা ভাত। নির্ভার সময় কাটাচ্ছে। অথচ কি কঠিন সময় তারা পাড়ি দিচ্ছে!

স্বপন জানে যতো গোপনেই কাজটি সমাধা হোক, গ্রামের লোক হাওয়া থেকেই সব পেয়ে যাবে। বাড়ি থেকে আসার সময় জনে জনে জানতে চেয়েছে বেনুকে কোথায়, কেন নিয়ে যাচ্ছে! কি এমন অসুখ করেছে? গতকাল হাসপাতালেও গ্রামের দুজনের সাথে দেখা হয়েছে। একই কথা জানতে চেয়েছে। সুতরাং ডাক্তারের পিছনে যতো টাকাই ব্যয় করুক বাবা, মা, বেনু কারো সুখ ফিরিয়ে দিতে পারবে না। গাঁয়ের লোকের মুখে তালা দিতে পারবে না। ওরা আন্দাজেই নোংরা কথা বলবে। সারা জীবনের জন্য এই পরিবারটিকে সেকথা মাথা নিচু করে শুনতে হবে।

যাক, তবুও বেনুটা রক্ষা পাক।

দেরি দেখে একটা সময় স্বপন ওদের খোঁজ করতে গেলো। বের হওয়ার সময় গেটের পাশে ‘মায়ের দোয়া’ হোটেলের ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলো তার বাবাকে দেখেছে কি না। ওর নাম বাদশা। আজব আলী যখনই স্বপনের কাছে আসে এই হোটেলে বসে চা, পরাটা খায়। বাদশা চেনে। বললো, খুব ভোরে সে যখন হোটেলের ঝাপ খোলে তখন একটা মেয়েকে সাথে নিয়ে বেরোতে দেখেছে।

স্বপন মোড়ের দিকে এগুলো। কোন্ দিকে যাবে বুঝতে পারছে না। তবে কি বাবা বাড়ি চলে গেলো? মনে মনে রাগ হতে লাগলো। এতোটা বয়সেও লোকটার বোঝ হলো না। এই অবস্থায় ওর সাথে পরামর্শ না করে বাড়ি চলে গেলো! ভীষণ মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ভাবছে আর সামনে এগোচ্ছে। বাড়ি গিয়ে দেখে আসবে নাকি? কিন্তু মা তো ওর দেরি দেখে আরও চিন্তায় পরবে। তাই উল্টো ওর মেসের দিকে রওয়ানা হলো। হয়তো গিয়ে দেখবে এতোক্ষণে ফিরে এসেছে।

মেসে ঢোকার মুখে স্বপন বাদশাকে আবার জিজ্ঞেস করলো। বাদশা বললো, খেয়াল করেনি। স্বপন ওর কাছ থেকে নাস্তা কিনে মেসে ফিরলো।

কিন্তু আশ্চর্য বাবা, বেনু কেউ ফিরেনি।

মা, ছেলে দুজনেই খুব চিন্তায় পড়লো। খেতে খেতে মায়ের সাথে আলোচনা করছে এখন কি করবে।

এরমধ্যেই বাদশা দৌড়ে এলো। ভাই- কয়জন কাস্টমারের মুখে একটা কথা শুনলাম। চলেন যাইতে যাইতে কই।

স্বপন সাথে সাথেই রওনা দিলো। জামিলাও বেরিয়ে পড়লো। স্বপন অনেক বুঝিয়ে মাকে রেখে গেলো।

ওরা আধা দৌড়ে যাচ্ছে। স্বপন বাদশার পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে আর বার বার জিজ্ঞেস করছে- কি শুনেছো আমাকে বলো! বলো!

কাস্টমাররা বলাবলি করতাছিলো দুইডা মানুষ ট্রেইনে কাটা পড়ছে। কইলো একজন পুরুষ, একজন মহিলা। এক সিএনজি ওয়ালা নাকি চৌরাঙ্গীর মোড়ের হাসপাতালে দিয়া গেছে।

স্বপনের কানে সীসার মতো কথাগুলো ঢুকছে। মাথা কাজ করছে না। সে দৌড়াচ্ছে। চৌরাঙ্গীর মোড় কিছুটা দূরে। হেঁটে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। বাদশা একটা অটোরিকশা থামিয়ে টান দিয়ে স্বপনকে তুললো।

সাদা চাদর ঢাকা অবস্থায় ইমার্জেন্সিতে দুটো লাশ পাশাপাশি পরে আছে। চাদরের জায়গায় জায়গায় যেন লাল রক্তজবা। আহা, কয়েক ঘণ্টা আগেও তাদের দেহে প্রাণ ছিলো। চারপাশে স্বজন ছিলো। কি ব্যথা বুকে নিয়ে তারা চলে গেলো? তাও আবার দুটো প্রাণ এক সাথে। কতো মহামূল্য প্রাণ দুটো কয়েক ঘন্টার মধ্যেই উচ্ছিষ্ট, অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে!

স্বপন লাশ দুটির কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না। একটু দূরে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাদশা ওকে হাত ধরে টেনে লাশের কাছে নিলো। তারপর নিজেই লাশের মুখের উপর থেকে খুব যত্নের সাথে আস্তে আস্তে কাপড়টা সরালো। এতো সাবধানে যেন মানুষটা ব্যথা পাবে, ব্যথায় কুঁকড়ে জেগে উঠবে।

স্বপন চোখ বন্ধ করে আছে। বাদশা তাকে আলতো করে ধাক্কা দিলো। চোখ খুলতেই চোখ পড়লো সামনে থাকা অসাড় মুখটির উপর। স্বপন তাড়াতাড়ি মুখটা ডেকে ফেললো। আহা কি মায়াময় মুখখানি। স্বপন আবার কাপড়টা সরিয়ে কাছ থেকে দেখলো। বাদশা কিছুই বুঝতে পারছে না। শুধু তাকিয়ে দেখছে।

স্বপন পাশের রক্তাক্ত লাশটির কাছে গেলো। সে- ও বাদশার মতোই যত্নে, সাবধানে কাপড়টা সরালো। এই মুখটি চিনতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

মুখটা থেঁতলানো। চাপ চাপ রক্ত। ওরা নাকে, কানে তুলো গুজে দিয়েছে। গায়ের কাপড় রক্তে চোপ চোপ। তবে মনে হচ্ছে দেহটি বাড়ি খেয়ে রেললাইনের মাঝখানে স্লিপারের উপর পরেছে। তাই খণ্ড- বিখণ্ড হয়নি। স্টেশনের কাছাকাছি বলে তখন হয়তো ট্রেনের গতিও কম ছিলো। এটি কি অসাবধানতাবশত এক্সিডেন্ট? নাকি বাবা ইচ্ছে করে.…! স্বপন আর ভাবতে পারছে না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।

বাদশা বললো- কি হইছে ভাই? তারা কি আপনার লোক না? তাইলে বোধকরি ভুল হইছে। চলেন।

স্বপন বললো- বাদশা তুমি অনেক কষ্ট করেছো। দোকানে যাও। তোমার অনেক দেরি হয়ে গেলো। আমার একটু দেরি হবে। মাকে খবরটা দিও ভাই যে, আমি তাদেরে খুঁজতাছি। মা খুব চিন্তায় আছে। বলে স্বপন বাদশাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো।

বাদশা যাওয়ার পর স্বপন বাবার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আরো কিছু সময় নিরবে কাঁদলো। হাসপাতালের ইমার্জেন্সি। লোকে লোকারণ্য। যে যার মতো আসা- যাওয়ার মিছিলেই আছে। কারো দুদণ্ড ফুরসৎ নেই যে, দাঁড়িয়ে অন্যের কান্না দেখবে বা সহানুভূতি জানাবে। বড়জোর কিছু সময় তামাশা দেখবে।

রক্তজবা চাদরটা সরিয়ে স্বপন আবার বাবার মুখখানি দেখলো। ঠিক দেখছে তো! নিজের কাছে প্রশ্ন রাখছে- বাবা আমার উপর এইটুকু আস্থা রাখতে পারলো না? মানুষের বাজে কথা হয়তো বন্ধ করতে পারতাম না। তবে তোমার বেনুকে তো সুস্থ করে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু বেনু কোথায়? স্বপন চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। দুজন যেহেতু একসাথে ছিলো, সুতরাং বেনুর তথ্য এখানেই পাওয়ার কথা।

বাবার পাশে দাঁড়িয়েই বেনুর কথা ভাবছে। আহা...বাবার কলিজা বেনু। কয়েক ঘণ্টা আগেও তারা একসাথে ছিলো।

কোথায় গেলি বোন! কাল রাতেও বাবার গলা জড়িয়ে শুয়ে ছিলি।

স্বপন ইমার্জেন্সির দায়িত্বে থাকা নার্স, ডাক্তারদের খোঁজ নিতে গেলো। এখানে এই মুহূর্তে সবাই খুব ব্যস্ত। কাছাকাছি কোথাও বাস এক্সিডেন্ট হয়েছে। বড় ধরনের এক্সিডেন্ট। ইমার্জেন্সিতে প্রচুর লোকজন, চিৎকার, চেঁচামেচি, কান্না। যে ক’জন ডিউটিতে আছে তারা সামলাতে পারছে না। তাই বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড বয়দের পাঠানো হয়েছে সহায়তা করার জন্য।

স্বপনের এসব দেখার সময় নেই। তার চোখদুটো সারাক্ষণ চারদিকে বেনুকে তালাশ করছে। বোবা, অসুস্থ বোনটি।

অল্পক্ষণের মধ্যেই ইমার্জেন্সির একজন ওয়ার্ডবয়ের কাছ থেকে জানতে পারলো- ঐ লাশের সাথে একজন মহিলাও ছিলো। তার জ্ঞান ছিলো না, তবে তখনও বাঁইচা ছিলো। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কাঁটাছেঁড়া। যে ট্রলিতে শুয়ানো হইছিলো সেখানেও প্রচুর রক্ত জমা ছিলো। জান আছে দেইখা স্যাররা তাড়াতাড়ি সার্জারি ওয়ার্ডে রাশেদ স্যারের কাছে পাঠাইছে। যদি বাঁচানো যায়! রাশেদ স্যার তো মানুষ বাঁচানীর কারিগর। আপনে এহনই ঐখানে যান। শুনছি এহনও বাঁইচা আছে।

স্বপনও রাশেদ স্যারের কথা অনেক শুনেছে। বাবার এমন অস্বাভাবিক মৃত্যু, এর মাঝেও এই খবরটা শুনে সে সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া জানালো। তারপর দৌড়ে গেলো সার্জারি ওয়ার্ডে।

হ্যা, এটা বেনুই! এতো দুঃখেও স্বপনের চোখ ঝলমল করে হাসছে। আনন্দাশ্রু ঝরছে। বেনুকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। স্বপন মনে মনে বলছে- আমাকে বাঁচালি বোন! তবু তো মা-কে কিছু একটা দিতে পারবো! তোকে আসমানে তুলে নাচতে ইচ্ছে করছে!

বেনুর জ্ঞান ফিরেছিলো। কিছুক্ষণ দেখে আবার ওকে ঘুমের ঔষধ দেয়া হয়েছে। শারীরিক যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছিলো। নাড়ীও দূর্বল। স্যালাইন চলছে। নার্স বললো ব্লাডও লাগতে পারে। বিভিন্ন জায়গায় কাঁটাছেঁড়াতে ঔষধ, সেলাই, বেন্ডেজ দেয়া হয়েছে। আপাতত অবজারভেশনে রেখেছে। কথা বলছে না বলে ওদের পক্ষে কিছু জানাও সম্ভব হচ্ছে না। স্বজনকে পেয়ে তারা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললো।

স্বপন আসার পর ডাক্তারকে খবর দেয়া হলো। তিনি সাথে সাথেই আসলেন এবং স্বপনের কাছ থেকে রোগী সম্পর্কে বিস্তারিত জানলেন। সব কথা শুনে ডাক্তার নিজেও খুব মর্মাহত। তিনি নিজ দায়িত্বে বেনুর চিকিৎসার সর্বোচ্চ ব্যবস্থা করবেন বলে স্বপনকে নিশ্চিত করলেন।

ডা. রাশেদ এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় যে উপকারটি করলেন, ময়নাতদন্ত ছাড়াই আজব আলীর লাশ নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে দিলেন। নিজে গিয়ে এ্যক্সিডেন্টে মৃত্যু হয়েছে এই মর্মে কাগজ করে দিলেন। কারণ তিনি জানেন আত্মহত্যা করেছে এই বিষয়টা গাঁয়ের লোক জানলে বাকি জীবন আর পরিবারটি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। যদিও কি ঘটেছিলো তারা কেউ জানে না। শুধুই আন্দাজ। হয়তো খুঁজে খুঁজে তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু স্বপনের সেই ইচ্ছেটা এই মুহূর্তে নেই।

সব শেষ করে, কাগজপত্র নিয়ে স্বপন ইমার্জেন্সিতে গিয়ে দেখে মা বাদশাকে ধরে ঠিকই এখানে চলে এসছে। স্বামীর লাশ খুঁজে পেয়ে পাশে বসে নিরবে বিলাপ করছে। স্বপনকে দেখে দৌড়ে এসে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। তার চিৎকারে পুরো হাসপাতাল কাঁপছে। স্বামী, সন্তানের ব্যথার চাঁপাকান্না বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো হাসপাতালটিকে যেন ভাসিয়ে নিচ্ছে। স্বপন একটুও থামানোর চেষ্টা করলো না।

সে মা-কে বেনুর কাছে নিয়ে গেলো। ফেরেশতার মতো ডাক্তারকে দেখালো। জামিলা অনেক কষ্টে বেনুর কাছে নিজেকে শান্ত রাখলো। ডাক্তার শব্দহীনভাবে বেনুকে দেখতে বলেছে। এই মুহূর্তে বেনুর ঘুম খুব জরুরি।

ওরা এখনও জানে না কি ঘটেছিলো! বাবা কিভাবে চলে গেলো! বেনু কিভাবে বেঁচে থাকলো! নার্স বলছিলো- জ্ঞান ফিরার পর বেনু আশেপাশে কাউকে খুঁজছিলো। কে জানে, ঘুম থেকে জেগে উঠে বেনু কি করবে! বাবা ছাড়া বেনুকে কে সামলাবে।

বাবা ছিলো বেনুর আসমান- জমিন। ইচ্ছে মতো ঝাপ দিতো!

লাশবাহী গাড়িতে গতকালের উলঝলুল আজব আলী আজ নিথর হয়ে পড়ে আছে। তার নামও বদলে গেছে। আজ আর কেউ আজব আলী, আজু, বাবা, ভাই এসব কিছুই বলছে না। শুধু বলছে ‘লাশ’!

যতোক্ষণ দেহে প্রাণ থাকে একটি মানুষকে বাঁচানোর জন্য অনেক মানুষ সর্বশক্তি সঁপে দেয়। অথচ মুহূর্তের ব্যবধানে কতো দ্রুত সেই মানুষটিকেই সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরে সমাহিত করতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

আজব আলীর লাশ দাফন নিয়েও সবাই মহা ব্যস্ত। স্বজনদের হাজারও আহাজারির মধ্যেই দ্রুত শেষ হলো তার সমাহিতকরণ!

পরদিন ভোরে ছেলের হাত ধরে জামিলা বেনুর হাসপাতালে রওয়ানা হলো। পিছন ফিরে দেখলো তার বত্রিশ বছরের সোনার মদিনা খা খা করছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫