
প্রতীকী ছবি
শুধু জ্যামাইকা বা পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জই নয়, পুরো ইংরেজি সাহিত্যেরও উল্লেখযোগ্য মহিলা সাহিত্যিক জাঁ রিস ১৮৯০ সালে ডোমিনিকায় জন্মগ্রহণ করেন। মা ছিলেন ক্রীয়ল, বাবা ব্রিটিশ। মাত্র ষোল বছর বয়সে ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন, তারপর ফ্রান্সে যান।
লেখালেখির শুরুতে ছোট গল্পই লিখেছেন। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ আশা-আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ে তাঁর স্কেচধর্মী ছোট গল্পগুলো এক সময়ে দারুণ পাঠকপ্রিয় হয়। ‘ওয়াইড সারগোস সী’ ১৯৩৩ তার অবিস্মরণীয় রচনা। ‘লেফট ব্যাঙ্ক’ ১৯২৭, ‘টাইগারস আর বেটার লুকিং’ ১৯৬৮ এবং ‘স্লিফ ইট অব রেডি’ ১৯৭৬ তার সর্বাধিক জনপ্রিয় গল্পসংকলন। ১৯৭৯ সালে মহৎ এই লেখক মৃত্যুবরণ করেন।
লম্বা একটা সারির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন বৃদ্ধ এবং এক শিশু। সবাই অপেক্ষা করছে কখন অনুমতিপত্র দেখিয়ে ভেতরের ঘরটায় প্রবেশ করতে পারবে। যেখানে নির্দিষ্ট দিনে গরাদঘেরা ছোট ছোট এক সারি খুপরির মধ্যে দিয়ে কয়েদিরা পনের মিনিটের জন্য তাদের বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে পারে।
দুর্বলভাবে, অথচ ঐকান্তিক ইচ্ছায় বৃদ্ধ ভিড় ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। অসভ্যের মতো চিৎকার করে কারারক্ষী যখন তাকে নিজের জায়গায় ফিরে যাওয়ার কথা বললো, বৃদ্ধ তখনও সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে।
‘পিছিয়ে যাও বলছি!’ কারারক্ষী ধমকে উঠলো।
‘তুমি আমার কথা বুঝতে পারছো না? তুমি কি ফরাসী নও?’ বৃদ্ধ মাথা নাড়লো। ‘ও, সেই জন্যে!’ বিদ্রুপের ভঙ্গিতে কথাটা বলে রক্ষী বৃদ্ধকে সারির দিকে ঠেলে দিলো। বৃদ্ধ হতচকিত হয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো। তারপর দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।
বৃদ্ধের চেহারাটা বেশ ভদ্রস্ত নরম স্বভাবের। ছোট ছোট করে ছাঁটা পাকা গোঁফ; কিন্তু ওঁর পোশাকের অবস্থা খুবই করুণ। মাথায় টুপি নেই, গলায় একটা লাল রুমাল জড়ানো। প্রায় ছানি পড়ে আসা একজোড়া ঘোলাটে চোখ। সঙ্গের ছেলেটি খুবই ছোট, কাঠির মতো শীর্ণ হাত-পা। এক হাতে বৃদ্ধকে শক্ত করের আঁকড়ে ধরে বড় বড় বাদামী চোখ মেলে কারারক্ষীর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সারিতে ওঁর মতো আরও কয়েকটা শিশু রয়েছে।
একজন মহিলার সঙ্গে রয়েছে দুটি বাচ্চা-একটি কোলে, অন্যটি মার ঘাঁগরা আঁকড়ে রয়েছে। সমস্ত ভিড়টাই নিশ্চুপ আর কী যেন একটা আশঙ্কায় থমথমে। নতমুখে মেয়েরা একে অপরের দিকে চোরা চোখে তাকাচ্ছে। মেয়েরা সাধারণত যেমনটা করে- বৈরীতায় নয়। বরং ওদের তাকানোর সেই ভঙ্গিতে সখ্যতারই একটা আভাস ফুটে উঠছে।
ওরা যেখানে অপেক্ষা করছে, সেই হল ঘর থেকে সোজা ওপরে উঠে গেছে একটা সিঁড়ি। সিঁড়ির শেষ প্রান্ত থেকে চলে গেছে সুদীর্ঘ একটা ফাঁকা-বারান্দা। চুনকাম থাকা সত্ত্বেও বারান্দাটা একদম যেন গা-ছমছমে আর অন্ধকার। এখানে ওখানে দেয়ালের গা ঘেঁষে সান্ত্রীরা সব বসে রয়েছে। স্যাঁতসেঁতে অন্ধকারে ওদের মনে হচ্ছে বিশাল এক একটা লোমশ মাকড়শার মতো।
যারা অপেক্ষা করছে তাদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা খুবই কম। আর মেয়েদের প্রায় সবারই অবস্থা চাবকে ঠান্ডা করে দেওয়ার মতো। কেবল সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি তরুণীর সাজসজ্জা খুবই সপ্রতিভ ধরনের। ওরা নিজেদের মধ্যে হাসছে, গল্প করছে; ওদের কালো চোখের অভিব্যক্তিতে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব।
সারিবদ্ধ জনতাকে ভয়চকিত মনে হলেও, ওরা খুব একটা অখুশি নয়। দেয়ালের গায়ে গুটিসুটি হয়ে রয়েছে একজন বৃদ্ধা। নিজের মনেই সে মুচকি মুচকি হাসছে। সুন্দর দেখতে কোনো ঈশ্বরের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিপূর্ণ মর্যাদায় দাঁড়িয়ে থাকা রক্ষীটা পা বদল করার সময় নিজের ভারসাম্যতা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। ওই লোকটাই ন্যায়, সততা আর দুর্বৃত্তকে শাস্তি দেওয়ার মতো অমোঘ এক শুভ শক্তির প্রতিভূতার। অনাবৃত ঢালু কপালটায় ফুটে উঠেছে একটা অবিলোপী ভ্রুকুটি, ভারি চোয়ালটা ঝুলে এসেছে সামনের দিকে। বেশ লম্বা আর বলিষ্ঠ চেহারা। উৎসুক চোখে সে তরুণী দুটির দিকে তাকাচ্ছে আর বুক ফুলিয়ে গোঁফ চোমরাচ্ছে।
সাারিটা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে। চোখে পড়ছে টেলিফোনের সারি সারি বক্সের মতো ছাদবিহীন ছোট ছোট খুপরিগুলো।
মাথার ওপরের চাতালটায় দেখা যাচ্ছে অন্য একজন সান্ত্রীর কুচকাওয়াজের ভঙ্গিতে যাওয়া-আসা-করা বা দুটোকে। সে কান পেতে শুনছে নিচের কথাবার্তা, সব কণ্ঠস্বর মিশে যেটা অন্তহীন একটা গুঞ্জনের মতো মনে হচ্ছে।
প্রথম রক্ষীটি তার ঘড়ির দিকে তাকালো, তারপর ভয়ঙ্কর রকমের উৎকট শব্দে দরজাগুলো সব খুলে দিতে লাগলো। চোখে মুখে বিহ্বলতার ভাব নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো একটা জনস্রোতে। ওদের দেখা করার সময় শেষ হয়ে গেছে। রক্ষী ইশারায় অপেক্ষমান দলটাকে এগিয়ে গিয়ে যার যার জায়গা নেওয়ার কথা বললো। তার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সেই কালো চোখ একটি তরুণীর দিকে সে কটমট করে তাকালো; কিন্তু আসন্ন সাক্ষাৎকারের প্রস্তুতি হিসেবে ছোট আয়নার দিকে তাকিয়ে মুখে পাউডার ঘষতে ব্যস্ত থাকার ফলে মেয়েটা ওসব কিছু লক্ষ্যই করলো না।
প্রতিটা ছোট ছোট খুপরির অন্য প্রান্তে তখন এসে দাঁড়িয়েছে এক একজন কয়েদী, গারদ আঁকড়ে রীতিমতো কষ্ট করে দর্শনার্থীর সঙ্গে কথা বলছে আর প্রায় প্রতিটা শব্দেই চমকে উঠছে। কেননা পনেরো মিনিট সময় তার কাছে মারাত্মক রকমের সংক্ষিপ্ত এবং প্রতিনিয়তই সতর্ক থাকতে হচ্ছে কখন রক্ষী তাকে সরে যেতে বলবে। পাছে রক্ষীর গলা ঠিক মতো শুনতে না পায় সেই ভয়েই সে তটস্থ।
আবার শুরু হয়ে গেলো সেই ক্লান্তিকর গুঞ্জন। ওপরতলার রক্ষীটি হাই তুললো। বাইরের রক্ষীটি উদাস চোখে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে গোঁফ চোমরাচ্ছে। অনুমতিপত্র নিয়ে নতুন আর একটা দল এসে দাঁড়ালো সিঁড়ির সামনে। রক্ষীটি ভারিক্কী চালে এগিয়ে এসে ওদের সার বেঁধে দাঁড়াবার হুকুম দিলো।
পনেরো মিনিটি শেষ হয়ে যেতেই আবার দরজাগুলো খুলে দেওয়া হলো।
পাশ দিয়ে ফিরে যাবার সময় রক্ষীটি তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকালো কালো চোখ সেই মেয়েটার দিকে। মেয়েটাও সোজা চোখ তুলে তাকালো। ওর চোখের দৃষ্টিতে তখন অবজ্ঞা বা প্রলোভনের কোথাও কোনো চিহ্ন নেই। অস্ফূট হেসে, প্রকৃতপক্ষে মেয়েটাকে পথ দেবার জন্যে রক্ষীটিকে সামান্য একটু পিছিয়েই যেতে হলো।
আগের চাইতে আরো বিহ্বল ভঙ্গিতে, ক্লান্ত দেহটাকে টানতে টানতে বৃদ্ধ এলো সবার পেছনে। বন্দীশালার ফটকে সবাইকে অনুমতিপত্র জমা দিতে হয়; কিন্তু বৃদ্ধ কিছু লক্ষ্য না করে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললো। অনুমতিপত্র যে জমা নিচ্ছিলো, পদস্থ সেই কর্মচারীটি চিৎকার করে উঠলো- ‘এই যে জনাব, আপনার অনুমতিপত্রটা!’ বৃদ্ধ আঁতকে উঠলো। ওর ঘোলাটে চোখ দুটো তখন জলে ভরে উঠেছে। অনুমতিপত্রটা যখন ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হলো, চকিতে হাত নাড়তে নাড়তে দুর্বোধ্য ভাষায় সে কী যেন সব অনর্গল বলতে লাগলো!
থমকে দাঁড়িয়ে একজন মহিলা ওকে ব্যাখ্যা করে বোঝালো যে পরের বারে দেখা করতে আসার সময় চাইলেই অনুমতিপত্রটা আবার ফেরত পাওয়া যাবে; কিন্তু বৃদ্ধ সেসব কিছুই বুঝতে পারলো না।
ফটকের সান্ত্রীটি হাঁক ছাড়লো, ‘যাও যাও; সরে যাও সব।’
বাইরে তখন পারিতে ফেরার ট্রাম ধরার জন্যে সবাই তাড়াহুড়ো করছে। হাসি-খুশিতে উচ্ছল তরুণী দুটি দৃপ্ত পায়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। বৃদ্ধ মাথা নিচু করে বিষাদময় ভঙ্গিতে হেঁটে চলেছে আর নিজের মনেই বিড়বিড় করছে। ছোট ছেলেটা খুদে খুদে পায়ে লাফাতে লাফাতে চলেছে ওর পাশাপাশি- তার তিনটি পদক্ষেপ বৃদ্ধের একটা পদক্ষেপের সমান। বড় বড় বাদামী চোখ মেলে সে স্তব্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে রয়েছে দূর্বোধ্য পৃথিবীটার দিকে।
ভাষান্তর : সুদেষ্ণা ঘোষ