
বইয়ের প্রচ্ছদ
প্রচ্ছদ এমন একটি শিল্প যার সৃষ্টি হয় একটি বইয়ের বিষয়বস্তু বা গল্প উপন্যাস কবিতাকে আশ্রয় করে। তাই প্রচ্ছদকে বলা যায় বইয়ের আয়না। কেননা একটি সুন্দর প্রচ্ছদ বইটিকে আর্কষণ করে হাতে নেবার জন্যে, বা বইয়ের ভেতরের লিখিত বিষয়বস্তুকে পাঠকের কাছে উপস্থাপিত করে বইয়ের প্রচ্ছদ। একটি বইয়ের প্রচ্ছদ বইকে করে তোলে আকর্ষণীয় এবং এর মধ্য দিয়ে বইয়ের নাম, লেখকের নাম সহ আরো কিছু তথ্য মেলে ধরে পাঠকের চোখে। এই অপরিহার্য কাজটি সম্পন্ন করেন প্রচ্ছদ শিল্পীরা।
প্রকৃতপক্ষে বই বিক্রির ক্ষেত্রে মানসম্মত লেখা যেমন জরুরি, তেমনি সেটিকে নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করাও প্রয়োজন। প্রচ্ছদ শিল্পে বাংলাদেশ নতুন মাত্রা যোগ করেছে বহুকাল আগেই, দিনে দিনে এই শিল্পে বাংলাদেশের প্রচ্ছদ শিল্পীরা যোগ করছেন নান্দনিক দ্যোতনা।
একটু পেছন ফিরে দেখি ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলার রাজধানী তখন কলকাতায়। সেখানেই বাংলা বইয়ের মুদ্রণ ও ছাপার কাজের শুরু। আর বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদের আদি যুগ বলতে বোঝানো হয় একেবারে প্রথম দিকের চিত্রশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, শ্রী আশু, ফণীভূষণ গুপ্ত, পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী, সমর দে, অন্নদা মুনসী, কাজী আবুল কাশেম প্রমুখ শিল্পীর প্রচ্ছদকেই। এরপর সত্যজিৎ রায়, মাখন দত্ত গুপ্ত, জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, খালেদ চৌধুরীরা কাজ করেন। সময়ের নিয়মে পূর্বজদের হাত ধরে প্রচ্ছদ শিল্পে আসেন রণেন আয়ান দত্ত, অজিত গুপ্ত, সমীর সরকার, পূর্ণেন্দু পত্রী প্রমুখ শিল্পীরা আর প্রচ্ছদ শিল্পকে করে তোলেন সমৃদ্ধ। এছাড়া বিশ্বভারতী প্রকাশিত বইয়ের প্রচ্ছদের একটি বিশেষ ধারাও রয়েছে রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পনায় তৈরি।
কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলের ছাত্র জয়নুল আবেদিন এবং কাজী আবুল কাশেম বাংলাদেশের প্রচ্ছদ শিল্পের পথ-প্রদর্শক। জয়নুল আবেদিন কলকাতা আর্ট স্কুলে পড়ালেখা করার সময় হানাফি পত্রিকায় কার্টুন, টেবিল ল্যাম্পের শেডচিত্রন, বুলবুল পত্রিকায় স্কেচ অঙ্কন করে সুধী সমাজের সমাদর লাভ করেন। ২০১৯ সালে বেদের মেয়ের সপ্তম সংস্করণের প্রচ্ছদে যে বেগুনি রঙের নারী মুখটি আমরা দেখতে পাই সেটা ১৯৫১ সালে প্রকাশিত পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের ‘বেদের মেয়ে’ বইয়ের জন্য জয়নুল আবেদিন এক টানে যে নারী মুখটি আঁকেন তা ছিল গাঢ় লাল রঙের। মাথার ঝাঁকার সবখানি স্পষ্ট নয়। ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত শামসুদ্দিন আবুল কালামের ‘কাশবনের কন্যা’ বইয়ের মলাটে নারীর অবয়ব আর কাশফুল দুটিই ফুটিয়ে তুলতে জয়নুল আবেদিন ব্যবহার করেছিলেন মাত্র দুটি রং।
তেমনি কাজী আবুল কাশেমের প্রচ্ছদ এবং অলঙ্কার মানুষের অন্তর স্পর্শ করে। আবুল কাশেম এদেশের প্রচ্ছদে যুক্ত করেছিলেন প্রাচ্য দেশীয় তুলিতে রেখাঙ্কন চিত্ররীতি। কবি গোলাম মোস্তফার ‘সাহারা’, ‘রক্তরাগ’, ‘হাস্নুহেনা’, ‘আলোক মালা’; আবদুল কাদির ও রেজাউল করীমের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘কাব্য মালঞ্চ’; আবুল ফজলের ‘সাহিত্য ও সংস্কৃতি’; অলোক গুহের ‘অগ্নি-বীণা বাজান যিনি’; রেজাউল করীমের ‘সাধক দারাশিকোহ’; শেখ মোছলেম আহমদের ‘শারাবান তহুরা’; নীলিমা ইব্রাহিমের ‘শাহী এলাকার পথে’; আবদুল হকের ‘দিলরুবা’; শামসুল হকের ‘চম্পা চামেলী’ প্রভৃতি বইয়ের কাজ করেছেন শিল্পী কাশেম। তাঁর সূক্ষ্ম রেখা ও মোলায়েম তুলির পরশে আঁকা প্রচ্ছদ প্রতিভাত হয়ে ওঠে অনবদ্য রূপে।
তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের সময়কালকে যদি বাংলাদেশের প্রচ্ছদের আদি যুগ ধরি তাহলে দেখবো শিল্পীর সংখ্যা ছিল হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র। এঁদের মধ্যে জয়নুল আবেদিন, কাজী আবুল কাশেম ছাড়া ছিলেন নন্দলাল বসু, কামরুল হাসান, খালেদ চৌধুরী, ইমদাদ হোসেন, আবদুর রউফ, মোস্তফা মনোয়ার, কাইয়ুম চৌধুরী। পরের দিকে যুক্ত হন আমিনুল ইসলাম, আশীষ চৌধুরী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, হাশেম খান, মুর্তজা বশীর, প্রাণেশ মণ্ডল, কালাম মাহমুদ, সিরাজুল হক, কাজী মোহাম্মদ ইদরিস, মুকতাদির, গোপেশ মালাকার, হারাধন বর্মণ, নিতুন কুণ্ডু প্রমুখ শিল্পীরা।
তবে বাংলাদেশের প্রচ্ছদশিল্পের অন্যতম প্রধান শিল্পী কামরুল হাসান। তাঁরও চিত্রশিক্ষা হয় কলকাতা সরকারি আর্ট কলেজে। গ্রামে গ্রামে ব্রতচারী আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি নানামাত্রিক ছবি আঁকতেন। আর তাই হয়ত সাধারণ মানুষের জীবন ঘনিষ্ঠ এই শিল্পীর রেখার বর্ণবিন্যাস এবং অফুরন্ত উদ্ভাবন সবাইকে অবাক করে দেয়। ঐতিহ্যকে বইয়ের প্রচ্ছদে দৃশ্যমান করে কামরুল হাসান বাস্তবের নতুন এক দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রচ্ছদ শিল্পে। কামরুল হাসানের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে খ্যাতিমান প্রচ্ছদ শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পরপরই তার প্রচ্ছদ আঁকা শুরু হয়। শিশু-কিশোরদের পত্রিকা ‘প্রতিভা’র প্রচ্ছদ দিয়ে তার হাতেখড়ি। এ দেশের সাহিত্য ও শিল্প আন্দোলনের অভিরুচি তৈরিতে কাইয়ুম চৌধুরী এক অনন্য সাধারণ শিল্পী। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত লুইস হেনরি মর্গানের ‘আদিম সমাজ’ বইয়ের অনুবাদ গ্রন্থের প্রচ্ছদে দেখা যায় দুজন নরনারীর তীর–ধনুক হাতে শিকারের আগের মুহূর্তখানি; কিন্তু প্রচ্ছদে কাইয়ুম চৌধুরীর মায়া ও ভালোবাসায় রেখাচিত্রের টানগুলো যেন বাস্তবতায় ফুটিয়ে তুলেছে বাঙ্ময় আদিমকালের জীবন। কাইয়ুম চৌধুরী শুধু যে প্রচ্ছদ শিল্পী ছিলেন তা কিন্তু নয়। তিনি বইয়ের প্রথম কয়েকটি পৃষ্ঠা কেমন হবে, লেটারিংয়ের ধরণ কেমন হবে এসব নিয়েও বিস্তর ভাবনা চিন্তা করেছেন। তিনি কাজও করেছেন সব মাধ্যমে।
কাইয়ুম চৌধুরীর সমসাময়িক প্রচ্ছদশিল্পী আবদুর রোউফ সরকারের হাতে আঁকা সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ্র ‘লালসালু’, আবু ইসহাকের ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ বা কাজী হাসান হাবিবের হাতে করা মাহমুদুল হকের বই ‘জীবন আমার বোন’–-এর প্রচ্ছদ ভাবনা সময়ের থেকে এতটাই এগিয়ে যে, দেখলে মনে হয় প্রচ্ছদটি আজকের আঁকা।
কাইয়ুম চৌধুরী ছাড়াও ষাটের দশকের শেষে ও সত্তর দশকের শুরুর দিকে আরও কয়েকজন কাজ করেন এ শিল্প নিয়ে। তাঁরা হলেন- সবিহ-উল-আলম, রফিকুন নবী, আবুল বারক আলভী, কাজী হাসান হাবিব, হামিদুল ইসলাম, বীরেন সোম, সৈয়দ লুৎফুল হক।
বাংলাদেশের প্রচ্ছদ শিল্প দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছিল, তবে নতুন এক দিশা পেল সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। ব্লকের দিন পেরিয়ে জিংক-লাইনোর পর বাংলাদেশে এখন অফসেটে ছাপার কাজ চলছে। এখন ইলেকট্রিক কালিতে যে কোনো রং বসিয়ে দেওয়া যায় চট করে। ফন্ট ছোট বড় করে দেখা যায়। তবে পরিবর্তনের শুরুটা এত সরল ছিল না। সে সময়ের শিল্পীরা সেটা ভালো করে জানেন, কতখানি গ্রহণ-বর্জনের ভেতর দিয়ে আসতে হয়েছে এ শিল্পকে। সেই সময়ে যাদের প্রচ্ছদ নতুন ভাবনায় ও শৈল্পিকতায় প্রচ্ছদ শিল্পকে নতুন মোড় দিলো তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- শওকাতুজ্জামান, সৈয়দ ইকবাল, মাহবুব আকন্দ, ফখরুল ইসলাম রচি, মাহবুব কামরান, আফজাল হোসেন, শেখ আফজাল, খালিদ আহসান, আইনুল হক মুন্না, মামুন কায়সার, অশোক কর্মকার, মাসুক হেলাল, সমর মজুমদার। পরবর্তী সময়ে ধ্রুব এষ, অশোক কর্মকার, রফি হক, জাফর ইকবাল জুয়েল, পঙ্কজ পাঠক, উত্তম সেন, মোবারক হোসেন লিটন, শিশির ভট্টাচার্য, ইউসুফ হাসান, আনওয়ার ফারুকসহ অনেকে নব্বই দশকে নিজেদের নাম প্রতিষ্ঠিত করেন।
বাংলাদেশের প্রচ্ছদে বৈপ্লবিক পরিবর্তনটি ঘটিয়েছেন শিল্পী ধ্রুব এষ। প্রচ্ছদের বহুমাত্রিক মাধ্যমকে সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি এ শিল্পকে নিয়ে গেছেন এক ভিন্নমাত্রায়। সেই ধারায় বাংলাদেশের প্রচ্ছদশিল্পে নতুন নতুন ভাবনা, ফর্ম ও নান্দনিকতার নতুন আঁখর যুক্ত করে সাম্প্রতিককালে প্রচ্ছদশিল্পকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে গুপু ত্রিবেদী, নাজিব তারেক, সব্যসাচী হাজরা, নিয়াজ মোরশেদ তুলি, গৌতম ঘোষ, আমজাদ আকাশ, শিবু কুমার শীল, তৌহিন হাসান, মিতা মেহেদী, আবু হাসান, মোস্তাফিজ কারিগর, সব্যসাচী মিস্ত্রী, রাজিব রায়, মামুন হুসাইন, নাসিম আহমেদ, রাজীব রাজু, কাজল চৌধুরী, নির্ঝর নৈঃশব্দ্য, রাজীব দত্ত, আয়ুব আল আমীন, চারু পিন্টু প্রমুখ শিল্পীরা। প্রতিনিয়ত প্রচ্ছদে বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়ে আসছেন, ছাপ রাখছেন স্বাতন্ত্র্য প্রতিভার। এমনকি চিত্রশিল্পী না হওয়া সত্ত্বেও সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্, ফজলুর আলম, বিলু কবীর প্রমুখ লেখক করেছেন তাঁদের নিজেদের বইয়ের প্রচ্ছদ।
মোঘল আমলে তৎকালীন আরবি-ফার্সি বইয়ের লেখকদের বই দেখলে বোঝা যায় প্রচ্ছদ কোনো বিষয় ছিল না; বরং অলংকরণের বর্ধিত রূপ ছিল প্রচ্ছদ। এখন প্রচ্ছদ অনেক বড় একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সেই প্রচ্ছদ শিল্পকে আরো বেশি অর্থবহ করে তুলেছে বাংলাদেশের প্রচ্ছদ শিল্পীরা। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রচ্ছদ শিল্পে যুক্ত হয়েছে রঙ্গীন পালক, আন্তর্জাতিক সম্মানে ভূষিত হয়েছে বাংলাদেশের প্রচ্ছদ শিল্পী। প্রচ্ছদ শিল্পকে উৎসাহ দিতে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র প্রতি বছর শ্রেষ্ঠ প্রচ্ছদ শিল্পীকে পুরস্কৃত করছে। যার ফলে নবীন প্রতিভাবান অনেক শিল্পী প্রচ্ছদ আঁকতে উৎসাহী হচ্ছেন। অনেকেই ভালো কাজও করছেন। চিত্রশিল্পীরা প্রচ্ছদ আঁকাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করছে, যা নিঃসন্দেহে ভালো দিক।
একটা সময় ভাবা হতো প্রচ্ছদ শিল্প বাণিজ্যিক ব্যাপার। মেইনস্ট্রিমের কোনো শিল্প নয়। লেখক যখন লেখেন, সেই লেখাকে আশ্রয় করে প্রচ্ছদের জন্ম হয়। সে ক্ষেত্রে লেখা যতো দিন বেঁচে থাকবে- প্রচ্ছদও ততো দিন বাঁচবে; কিন্তু এখন ভাবনা বদলের সময় এসেছে সমকালীন ও পরবর্তী প্রজন্মের হাত ধরে সৃজনশীলতার যে ধারাবাহিক প্রবাহ, তা থেকে প্রচ্ছদ শিল্প বিচ্ছিন্ন নয়। তবে সৃষ্টিকর্মকে সবসময় হতে হয় নিটোল যা শুধু প্রযুক্তি দিয়ে সম্ভব নয়। ভালোবাসা, মায়ার সঙ্গে প্রযুক্তির সমন্বয়, আগ্রহের সঙ্গে পেশাদারিত্বের সুযোগ প্রয়োজন শিল্পীর। সমন্বয়টা ঠিকঠাক হলে প্রতিটি প্রচ্ছদই হয়ে উঠবে অর্থবহ, বিশেষ কাজ। পাঠক তার কাঙ্ক্ষিত বইটি আরও একটু যত্নে রাখবেন হয়ত তাঁর প্রজন্ম এবং পরিবারও।