অনুপ্রেরণাদায়ী নারী শিল্পী রোকেয়া সুলতানা

জাহিদ মুস্তাফা
প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২২, ১৩:৩৪

রোকেয়া সুলতানা। ছবি: সংগৃহীত
রোকেয়া সুলতানাকে চিনি ১৯৭৯ সাল থেকে- যেবার আর্ট কলেজে ভর্তি হই। তিনি তখন বি এফ এ ফাইনাল ইয়ারের শিক্ষার্থী। আমরা কলেজে ঢুকেই তাঁদের ব্যাচের র্যাগ ডে পাই। সেই সময়ে চারুকলার ছাত্র-শিক্ষকদের খাওয়া-দাওয়ার বিরাট ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁরা।
লাভলি আপা ছাপচিত্র বিভাগ থেকে স্নাতক পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেয়ে আইসিসিআরের বৃত্তি নিয়ে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান ১৯৮০ সালে। মাঝে এসে শিক্ষক সফিউদ্দীন আহমেদ ও মোহাম্মদ কিবরিয়াকে একে একে অনেকগুলো কাজ দেখিয়েছেন তাঁর। সৌভাগ্যবশত সেদিন আমি ছাপচিত্র বিভাগে ক্লাস করায় লাভলি আপার নিরীক্ষাধর্মী কাজগুলো দেখার সুযোগ পাই! স্যাররা তাঁর কাজের প্রশংসা করে খোশমেজাজে টুকিটাকি পরামর্শও দিলেন। আর আমি তো অভিভূত- কী করে এতো দারুণ ছবি আঁকা সম্ভব!
বিশ্বভারতী থেকে ভালো ফল করে স্নাতকোত্তর শেষে দেশে ফিরে চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাপচিত্র বিভাগে যোগ দেন লাভলি আপা! জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার ওমর খালেদ রুমির সংগে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। কাজকে ভয় পেয়ে কর্তব্য বিস্মৃত হয়ে থেমে যাবার মানুষ তিনি নন! একদিকে কর্মজীবন, সংসারের তুমুল ব্যস্ততার পাশাপাশি চললো তাঁর ছবি আঁকা।
এর সুফলও পেয়েছেন। অনবরত ছবি আঁকার জন্য তাঁর স্বীকৃতির পরিমাণ ঈর্ষণীয়! চারুকলার ছাত্রজীবনে জলরঙ ও ছাপচিত্রে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দিয়ে যার শুরু! ১৯৯৫ সালে নবীনশিল্পী চারুকলা প্রদর্শনীতে ছাপচিত্রে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার, ভারতীয় তৃতীয় দ্বি-বার্ষিক প্রিন্ট প্রদর্শনীতে গ্র্যান্ড পুরস্কার পেয়েছেন। যাত্রীবাহী বাসে ভিড় বাঁচিয়ে মা ও মেয়ে শিশুর সংগ্রামকে চিত্রিত করেছেন শিল্পী তাঁর এই অসামান্য প্রিন্টে। নীলাভ ও লালচে বর্ণের মিশেলে করা কাজটি এখনো আমার কাছে নারীজীবনের রূঢ় বাস্তবতা নিয়ে লেখা কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয়!
১৯৯৯ সালে জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন পুরস্কার ও নবম এশীয় দ্বি-বার্ষিক প্রদর্শনীতে সম্মানসূচক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ২০০০ সালে জাতীয় জাদুঘরে বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ আয়োজিত চারুকলা প্রদর্শনীতে তিনি দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠশিল্পী হিসেবে দৈনিক জনকণ্ঠ পুরস্কার, ২০০১ সালে অনন্যা শীর্ষ দশ নারী পুরস্কার, ২০০২ সালে জাতীয় চারুকলা পুরস্কার পেয়েছেন। ক্যানভাসে অ্যাক্রেলিক রঙ ঢেলে ঢেলে একরঙের সঙ্গে অন্য রঙের মিলমিশে যে তৃতীয়-চতুর্থ রঙের দ্যোতনা চিত্রপটকে রাঙায় সেই ধরণটি তিনি বারবার প্রয়োগ করে রঙের স্বাতন্ত্র্যকে আবার নতুন করে মেলে ধরেছেন! অনেক তরুণশিল্পী তাঁর ওই করণকৌশল গ্রহণ করে ছবি আঁকায় আরও নিবিষ্ট হয়েছেন। নবীনশিল্পীদের উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে এটি শিল্পী রোকেয়া সুলতানার একটি বড় সাফল্য।
নানা দেশ থেকে তিনি সম্মাননা পেয়েছেন। ২০০৩ সালে তিনি ফরাসী সরকারের ফেলোশিপ অর্জন করেন, ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রাস্কা, লিংকন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পান। ২০১৭ সালে তিনি কানাডার টরেন্টোয় ভিজিটিং আর্টিস্ট রেসিডেন্সি পেয়ে ওপেন স্টুডিও প্রিন্ট কর্মসূচীতে যোগ দেন।
দেশে বিদেশে অনেকগুলো একক ও যৌথ প্রদর্শনীতে তাঁর মর্যাদাকর অংশগ্রহণ আমরা লক্ষ্য করি! ১৯৮৬ সালে ঢাকায় তাঁর প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী হয় শেরাটন হোটেল আর্ট গ্যালারিতে। কোভিট- ১৯ এর আবির্ভাবের আগে ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার ক্যাসুলায় পাওয়ার হাউজ গ্যালারিতে তাঁর একক চিত্র প্রদর্শনী হয়েছে ‘মাতৃত্ব সর্বত্র’ শিরনামে। ২০১৬ সালে ভারতের বিশ্বভারতীর নন্দন গ্যালারিতে একক প্রদর্শনী করেছেন। ঢাকার বেঙ্গল শিল্পালয়ে ২০১৫ সালে ‘রোকেয়া’ শিরোনামে তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
মানুষ হিসেবে লাভলি আপা মিষ্টভাষী, দারুণ মায়াময়। বড়দের প্রতি তাঁর আন্তরিক সম্মানবোধ ও অনুজ শিল্পীদের প্রতি তাঁর স্নেহশীলতা এমনকি শ্রদ্ধা আমি প্রত্যক্ষ করছি গত চার দশক ধরে। গেল শতকের নব্বই দশকে লাভলি আপা কয়েকজন অনুজ ও সম্ভাবনাময় ছাপচিত্রীদের সঙ্গে নিয়ে ঢাকা প্রিন্টমেকার্স নামে একটি আর্টিস্ট গ্রুপ গড়ে তুলেছিলেন। শিল্পী অশোক বিশ্বাস, অশোক কর্মকার, আহমেদ নাজির খোকন, রফি হক ও রশীদ আমিন ছিলেন ওই দলে। এক বা একাধিক প্রদর্শনীও করেছেন তাঁরা।
তিনবছর আগে অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে আর টিভির তেজগাঁও কার্যালয়ের ছাদে আয়োজিত ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় একজন বিচারক হিসেবে দীর্ঘসময় তাঁর অসামান্য সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। আমাদের সঙ্গে আরেকজন বিচারক ছিলেন- আমাদের অনুজ শিল্পী আশরাফুল আলম পপলু। অটিস্টিক শিশুদের সঙ্গে কথা বলা আর ওদের ছবি আঁকা নিয়ে তাঁর যে আগ্রহ ও উচ্ছ্বাস সেদিন প্রত্যক্ষ করেছি- তা অতুলনীয় এবং আমাদের জন্য শিক্ষণীয়।
লাভলি আপা তাঁর অনুজ শিল্পীদল নিয়ে ছবি আঁকতে আমার জেলাশহর টাঙ্গাইলে গেছেন! এ দলে চারুকলায় আমার সহপাঠী আফরোজা জামিল কংকা ছিল! টাঙ্গাইলে আমার স্কুলজীবনের সহপাঠী আনন্দপাঠের সৈয়দ আমিনুল হক কায়সারের সন্তোষের খেজুরবাগানে গিয়ে থেকেছেন তাঁরা। আমার কর্মক্ষেত্রের ব্যস্ততার জন্য আমি ওই শিল্পায়োজনে থাকতে পারিনি। শিল্পী ড. রশীদ আমিন তাঁদের টাঙ্গাইলের বাড়িতে একবেলা সবার ভুরিভোজের ব্যবস্থা করেছিলেন। ওখানে আঁকা শিল্পীদের বেশকিছু চিত্রকর্ম দেখেছি।
শিল্পী রোকেয়া সুলতানার সৃজনকর্ম সংরক্ষিত হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় চিত্রশালা, জাতীয় জাদুঘর, বঙ্গভবন, গণভবনসহ নানাদেশের প্রতিষ্ঠানে। ভারত, পাকিস্তান, জাপান, ইরান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, নরওয়ে, নেদারল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বহুদেশে তাঁর চিত্রকর্ম প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে। রোকেয়া সুলতানা বাংলাদেশে নিজেকে একজন শক্তিশালী চিত্রশিল্পী হিসেবে অধিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছেন। একজন সক্রিয় ও অগ্রগণ্য চিত্রশিল্পী হিসেবে তিনি নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার তিনি এখন উৎস। ভালো থাকুন আমাদের প্রিয় অগ্রজ এই সৃজনশিল্পী।