Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

মানিকের লেখক-মন

Icon

শহীদ ইকবাল

প্রকাশ: ২১ মে ২০২২, ১৫:২৪

মানিকের লেখক-মন

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

বাংলা সাহিত্যে প্রথম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় দিয়ে মানুষের মানুষকে চেনাজানা হলো, আগের কালের সবকিছু বিধিবালাই ছিন্ন করে। মনে করা নয় শুধু, এমনটা প্রতিকূল উজানো পরিব্যাপ্ততায় নিশ্চিত যে, আধুনিক যুগমানস ওঁরই হাতে ধরা পড়লো, গড়ে উঠলো বিপুল কলেবরের তুলি। ওঁর লেখায় ‘কলমপেষা’ ধার- ধরা পড়ে, মাত্র একুশ বছর বয়সেই। বন্ধুরাই বাজি ধরেছিল, তখন অতসী মামী লেখা হলো, শক্তিটুকুও ধরা পড়লো। বাজিমাৎ।

পরে আর পেছানো নয়, এক নতুন জিনিস আমদানি হলো, ওই সময়খণ্ডে তার হাতেই। কথাকাররূপে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাথমিক গড়নটুকু এভাবে! তখন রবীন্দ্রযুগ শেষ নয়। রবীন্দ্রসূর্য পশ্চিমে হেলে পড়তে শুরু করেছে মাত্র, ‘আধুনিক’ কবির দল উন্মাদ! পাউন্ড-এয়েটস-এলিয়ট-লরেন্স তাড়া করছে তাদের। বিশ্বযুদ্ধের ফোঁকড়ে আটকে আছে তাবৎ জীবনের মুহূর্তগুলো। উন্মাদনায় ছেয়ে গেছে প্রাণের প্রান্ত-অন্ত। প্রভাব বললে কম হয়, এক প্রকার ‘গ্রাস’ করে ফেললো পাশ্চাত্যের এয়েটস জীবনানন্দকে, বোদলেয়ার বুদ্ধদেব বসুকে, মালার্মে সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে, এলিয়ট বিষ্ণু দে-কে। কিন্তু এর বাইরেও নানা মাপে ঘটে অনেক কিছু।

প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্য-শৈলজানন্দ-সজনীকান্ত নগরের পচা-গলা-বাসি জীবনের ধ্বংসচিহ্ন নিয়ে ক্লিন্ন-কিন্নর সংবাদে প্রখর হয়ে ওঠেন। তারও দাম কম নয়! জারানো মলিন বস্তি-ব্রথেল নির্মমতার কষ্ট-চাদরে ভুনিয়ে গড়লেন অমিয় রূপ। ওতে স্থিরতা ভাঙলো, মাখলো স্ফূর্তি। অসহায়তা বা গ্লানিময়তার নয়, আরও নির্জলা রোদের স্পষ্ট দিশা তৈরি হলো। আতঙ্ক আর নির্বিচারের দৈন্যসাধিত কলোরব, জীবনের শতভাগ উপস্থিতি নিয়ে বাস্তবে রূপ পরিগ্রহ করলো। তখন আর নয় প্রথা-পুরনো-তথাকথিত আভিজাত্য পোলিশ কিছু। পালাবদল ঘটে চলে সাহিত্যে। চূর্ণীকৃত মনের স্তর আর অবগুণ্ঠিত কাল অন্দরে আছড়ে পড়ে। জহুরি তুলে নেয় নতুন তুলি, বেজে ওঠে বারামখানার কালোয়াতি- গম্ভীরনাদ। এ মহাকাব্যের অলৌকিক শক্তির মহানায়ক নয়, ধীরোদাত্ত গুণের নায়ক নয়, এ মাঝি-কুবের।

লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যোগ করেন, ঠিক নিঃশব্দে- নিছক অনির্দিষ্ট অলক্ষ্যে। কী অভ্রান্ত পথ ওঁর। মনের জন্য। মনোরোগের চিকিৎসা। নির্ভার-নিপাট সে সমাজচোখ। সার্বভৌম মানুষের শক্তিটুকু অন্বেষণ। ছিন্ন সমাজের জনতার প্রশ্নে ভিন্ন প্যাটার্নের প্ল্যাকার্ড। কর্তৃত্ব-বিরোধী তা। সমগ্রতার সবটুকু মিলিয়ে। মানিক মনকে উপজীব্য করেন। মনকে ন্যস্ত করেন সমাজে ও শ্রেণিতে। যেটি চলমান স্রোতরেখার টান। উজান পেরুনো কর্তব্য। এই মনের ট্রিটমেন্ট দিতে শশী, এবং তারও- শশীর নিজেরও পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ কাম্য। মানিকের উপন্যাসে মনের ওপর পর্যবেক্ষণ আকর্ষণীয়- বিশেষত এ কালের আয়নায়। বলতে চাই তা ওতে অভ্রান্ত এবং লক্ষ্য নির্দেশিত। 

কুসুমের মন-শরীর পর্যাপ্ততায় ভরা। পূর্ণিমার চাঁদ। ‘লাজ রক্ত হইলা কন্য পরথম যৌবন’। প্রথম যৌবনের অভিঘাতে মুখর মন গভীরভাবে টানে, নিয়মিত স্বামীগণ্য পরাণকে অতিক্রম করে শশী ডাক্তারকে। শৃঙ্খলা আর নীতি কঠোর সমাজের বন্ধনটুকু ছিল পরাণের ঘরে। পরাণ প্রথাগত স্বামী; নেই পরাস্ত তাপ, কর্তৃত্বের আগুন, যুবা সংসর্গ সন্নিকট। বরাবরই কুসুমের কাছে পরাণ পরাণহীন, ব্যক্তিত্বশূন্য, লেশশূন্য। এ পরাণে কারো পরাণ জুড়ায় না। তাতে চান্দ্রশরীরে ঘটে গ্রহণ। ষোলকলা সান্নিধ্যহীন হয়ে পড়ে। পরাণে পরাণ ঘনায় না। সেই শূন্য মন্দিরে প্রাচুর্য নিয়ে উঠে আসে শশী। তার সান্নিধ্য, কাছে আসা, মনোরোগ নির্ণয় ও নিরাবরণ কুসুমতলে কুসুমিত হয়ে ওঠা! এটিরও এক-ঘা চিকিৎসা শুরু হয়। তলানিটুকুও বাদ যায় না। কুসুম চেতন-অচেতন জ্ঞান অতিক্রম করে, অধিকার করে; তাবৎ নিয়মনীতি অস্বীকার করে- অবুঝ বিহ্বলতায় বলে: ‘আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শরীর এমন করে কেন ছোটবাবু?’ ব্যস, এর অপরপক্ষে কপিলা ‘সব বড় রহস্যময় ও দুর্বোধ্য।... ‘পাঁক মাইখা মরস কেরে কপিলা? মাইনসে কইব কী? যা বাড়িত্ যা।’ উত্তরটুকু আরও প্রগল্ভ। বর্ষার বিষণ্ণতার প্রতিমায় ঘনাইয়া বলা : ‘মনডার অসুখ মাঝি, তোমার লাইগা ভাইবা ভাইবা কাহিল হইছি’। মনের কী বিচিত্র অভিপ্রায়! সেটুকু কী নিয়মে বাধা।

সমাজ-নীতির বন্ধন দিয়ে তা কি থামানো যায়! মনের দাম তবে কী? মনের চিকিৎসাইবা কেমন? শশী কুসুমকে মন আর মনের আকাঙ্ক্ষার কথা বললেও সেকি মনের চিকিৎসা করতে সক্ষম হয়! হয়নি। কুবের রহস্যময় মনের সন্ধান পায়নি, শশীও নয়- অনেক সময় কুসুমের অপেক্ষায় ‘মনটা কেমন করিয়া ওঠে’। সমস্ত ইচ্ছা আর চিকিৎসার মন্ত্র তার অস্ফুট অসংখ্য সংকেতে যেন নিষ্কার্য, নির্বাপিত প্রায়। শশীর কথনের ভেতরে মানিকের অভিপ্রায় আছে। দুর্জ্ঞেয় মনের তল নির্ণয়, তার গড়ন ও প্রকৃতি নির্ধারণ- সেটি তো বায়বীয় কোনো বিষয় নয়! প্রকৃতির স্পর্শে, প্রাত্যহিক দ্বন্দ্বময় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায়, উদ্ভিদ্যমান সমাজের কররোলে, অনুতাপ-অনুভবের রেখাতলে, প্রতিজ্ঞার নৈর্ব্যক্তিক অভিজ্ঞতাটুকুর পুনর্গঠন চলে। সমাজ-অদৃষ্টবাদী কাঠামোর চলকগুলো আমাদের ঐতিহ্য-ইতিহাস বা পুরাণকে মনযোগী করে তোলে, ব্যক্তির সত্তাতাত্ত্বিক জ্ঞানকে পরিস্রুত করে তোলে। পুতুলনাচের ইতিকথা বা পদ্মানদীর মাঝি গ্রামকেন্দ্রিক বৃত্তিভোগী সমাজমনে চিত্রায়িত। সে গ্রাম না সামন্ত, না পুঁজি-আশ্রিত। বিশ শতকের প্রথমার্ধের এ সমাজকাঠামো ব্রিটিশ উপনিবেশ প্রভাবিত পুঁজির প্রতিক্রিয়ায় দীপিত। তার সমাজ ও শ্রেণিমনে মেলে শ্রীনাথ, হারু, পরাণ কিংবা কুবের, আমিনুদ্দি, গনশার পেশা-জীবন- সর্পিল-অসুস্থ-কাতরোক্তিতে অধিভুক্ত।

এ উদ্যাপন নির্মম ও কঠোর, নিশ্চয়ই তা জঙ্গমতার সংগ্রামে পরিকীর্ণ। স্যবলটার্ন বা নিম্নবর্গীয় শ্রেণিকাঠামোতে এদের প্রতিকূলতা একদিকে যেমন শোষক প্রতীভূশক্তির দাপটে অন্যদিকে প্রকৃতিতেও। দৃশ্যমান এই নির্দিষ্ট শক্তির বাইরে অদৃষ্ট বা নিয়তির চালটুকু কম নয়। এতে ঝোঁক বেশি অদৃষ্টে, আবার এই অদৃষ্টই কর্তৃত্বের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। ভুলে যাওয়া চলে না, যাদব, শেতল বচনকথা। হোসেন মিয়া অন্য ধাতে গড়া। তার সৃজন বা জীবনবীক্ষা ভিন্ন প্রকৃতির- যা এই জলআলোহাওয়ায় বেশ আকর্ষণীয়। তবে মায়ার অধঃক্ষেপটুকু হারায় না। সে চলিষ্ণু সমাজে পূজ্য। তাইতো শ্যাওলা ধরা সমাজের ভেতরের ব্যক্তি রক্তশূন্য, কর্তব্যশূন্য। এ ব্যক্তির সিদ্ধান্তও আটকা থাকে যাদব পণ্ডিত বা যামিনী কবিরাজ, হোসেন মিয়ার হাতে। ক্রীড়নকের ভূমিকা তারা আদায় করে নিয়েছে পরিশ্রুত সমাজ কেন্দ্রে। নিশ্রেণিই কী ‘নিমন’ তৈরি করে! সেটি বোধ করি প্রতিক্রিয়াশীল সমাজের অভিমুখ। প্রতীভুর ইঙ্গিতের গভীরতায় মন-বস্তুটুকু নিছক তুচ্ছতায় মলিন। তার জৈবিক প্রখরতাও সমাজের কাঠিন্যে নিমজ্জিত।

এক পর্যায়ে কুসুম মিইয়ে যায়, কপিলা ময়নাদ্বীপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, আমিনুদ্দি বা শ্রীনাথ-পরাণের মূল্যহীনতায় নিয়তি আর কুসংস্কারের সর্পনাগ তাদের করে তোলে নির্বীর্য। শশী একপ্রকার নিজেও সেই নাগবেষ্টনে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়তে বাধ্য হয়। কুবের হোসেন মিয়ার নির্দেশকেই নিয়তি মান্য করে। সংসার-প্রেম-আনুগত্য-কর্তব্য-মনুষ্যত্ব সবকিছু মূল্যহীন ও অপ্রয়োগযোগ্য যেন। সমাজের তখন থাকে কী? মানুষগুলো এভাবে নির্বিশেষ বিশ্বাসটুকুও বিশ্বস্ত করতে পারে না! ভয় পায়। ভীত হয়ে জীবনের বিপরীতে দাঁড়ায়। জীবনের স্বতঃশ্চল অভিমুখ খুঁজে নেয়। জীবিকার তাগিদে, জীবনের অভিপ্রায়ে তুচ্ছ ‘গুবরে পোকা’ হয়ে শঙ্কাময় নির্মূল্যে বেঁচে থাকে। শক্তিটুকু তার তখন কুসংস্কার আর কু-বিশ্বাস। এর তলপৃষ্ঠে অহং-ও সক্রিয়। তা শক্তিও অর্জন করে। যাদবের ইচ্ছামৃত্যু বা কবিরাজের যুক্তি ও ভক্তিহীন চিকিৎসা যেমন গাঁওদিয়ার সমাজে প্রযোজ্য তেমনি মনের চিকিৎসাও কেউ নেয় না। বিজ্ঞান অকার্যকর।

আগেও বলেছি মন কী? সে তো বহুকালের কুৎসিত-কুশ্রী সমাজে আঁটা মূল্যবোধ! সমাজ দৃষ্টিতে তা-ই ‘ন্যায়’। শশীর মতো আধুনিক নগরমনস্ক ডাক্তারও এর চাপে পড়ে ভাবাবেগে অদৃষ্টটুকুতে হাত পেতে নেয় কেন? সে সংস্কারটুকু তো উপনিবেশ-প্রশ্রয়ের সমাজ-অর্থনীতি তৈরি করে দিয়েছে! সে শ্রেণিমন, কর্তৃত্ব, সংস্কারের কণারাশির প্রকটত্বেই সৃজিত। সেটি ভাঙতে পারা কঠিন। কঠিনটুকু তো এই বর্তমানেও করপোরেট পুঁজির গলিত নিঃশ্বাসে দূষিত। আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণিমন এই তথাকথিত পচনশীল পুঁজির প্রতিক্রিয়ায় নষ্ট ও নির্বাপিত। প্রকট বিচ্ছিন্নতা আর ভোগবাদের নির্বিকার অভ্যেস এখন যেমন রপ্ত হয়ে চলছে তেমনি বাড়ছে ভীতমনের অদৃষ্টের আস্থা। মানিকের উপন্যাসের রোগগ্রস্ত রোগীদের রোগমুক্তি ঘটেনি, তার ক্রুদ্ধ-আদেশে কেউ বিজ্ঞানমনস্কও হয়নি; এমনটি সত্য মনে হয়- যখন এই বিদ্যমান সমাজ- সন্তপ্ত মানুষের বদলে, বিনষ্ট ভোগবাদের সঙ্গে অদৃষ্টশক্তিও প্রযুক্তিশাসিত ব্যক্তিকে করেছে অন্ধ, ফেলে দিয়ে অনালোকিত গহ্বরে।

তবে তো মানিকের সমাজ দৃকপাত শুধু তার কালকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করে না, এই বর্তমানকেও। সমাজের রোগমুক্তি ঘটে বিজ্ঞানমনস্কতায়। ব্যক্তি তার দর্শনটুকু ঠিক করে নেয়। কিন্তু তা কোথায়- এই প্রযুক্তিশাসিত কর্পোরেট সমাজে? মানিকের সমাজ-চশমা সে উত্তরটিই প্রকাশ্যে এনেছে- অন্তত এখনকার এই সমাজে। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫