
অলংকরণ: মামুন হোসাইন
জেনোর হাসি
দৌড় শুরুর আগে জেনো কচ্ছপকে কিছু দূর এগিয়ে রাখলেন।
একিলিস এটা মেনে নিলো। কারণ তার প্রতিযোগীর দৌড়ের সামর্থ্য এতই কম যে, তাকে কিছুটা এগিয়ে রাখা হলে তাতে ভয়ের কিছু নেই; বরং এটা তার সম্মান বাড়াবে।
কচ্ছপকে এগিয়ে রাখার শর্ত মেনে নেওয়ায় জেনো মুচকি হাসলেন।
জেনো একিলিসকে আরেকটা শর্ত দিলেন। তিনি বললেন, কচ্ছপকে যত দূর এগিয়ে রাখা হয়েছে, একিলিসকে প্রথমে তার অর্ধেক দূরত্ব পেরোতে হবে।
এ রকম অদ্ভুত শর্তের কথা শুনে একিলিস কিছুটা দ্বিধান্বিত হলো। কারণ দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রতিযোগীদের জন্য সব সময় একই গন্তব্য ঠিক করা হয়; কিন্তু দম্ভবশত একিলিস এ শর্তেও রাজি হয়ে গেল।
দৌড় শুরুর পর একিলিস যখন সেই অর্ধেক দূরত্ব পেরোয়, ততক্ষণে কচ্ছপ কিছুটা এগিয়ে যায়। তখন একিলিসকে বলা হয়, সেই দূরত্বের অর্ধেকটা পেরোতে।
বার বার নতুন শর্ত দেওয়ায় একিলিস দমে গেল। কারণ সে বুঝতে পারল, যতবার সে এই অর্ধেক দূরত্ব পেরোবে, কচ্ছপ ততক্ষণে সামান্য হলেও এগিয়ে থাকবে এবং কখনোই সে কচ্ছপকে অতিক্রম করতে পারবে না।
ডেমক্রিটাস
দার্শনিক ডেমক্রিটাস আবদেরার রাস্তায় হাঁটছিলেন। প্রোটাগোরাসকে দেখে দাঁড়ালেন। তার মনোযোগ প্রোটাগোরাসের মাথায় থাকা লাকড়ির বোঝাগুলোর দিকে।
থামো! থামো!
প্রোটাগোরাস থামলেন। ডেমক্রিটাসকে দেখে একটা গাছের ছায়ায় তিনি বোঝাগুলো নামিয়ে রাখলেন।
ডেমক্রিটাস লাকড়ির বোঝাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন। ছোট ছোট রশি দিয়ে বোঝাগুলোকে বাঁধা হয়েছে নিখুঁতভাবে।
তিনি বললেন, ‘এত ছোট রশি দিয়ে যেভাবে তুমি বোঝাগুলো বেঁধেছ, সূক্ষ্ম জ্যামিতিক জ্ঞান ছাড়া এটা অসম্ভব।’
‘ঠিক তা নয়। প্রতিদিন বাঁধাছাদার কাজ করতে করতে যে কোনো কাজে একটা দক্ষতা জন্মে, এটা তারই ফল। তবে বোঝা বাঁধা সংক্রান্ত আমার এ মতটাই শেষ কথা না। ওই যে জর্জিয়াস আসছে এ দিকে, সে হয়তো এ ব্যাপারে আলাদা কোনো মত দেবে।’
‘বলতে চাইছ, বোঝা বাঁধা সংক্রান্ত কোনো সাধারণ সত্য নেই?’ ডেমক্রিটাস গভীর চিন্তায় পড়লেন।
‘কোনো ক্ষেত্রেই নেই, আছে শুধু ভিন্ন ভিন্ন মত। তবে কারও মতের সঙ্গে অন্য কারও মত কিছুকালের জন্য মিলেও যেতে পারে; কিন্তু তারা যে চিরকাল একমত থাকবে এমনও নয়।
ডেমক্রিটাস হাসলেন। জর্জিয়াসের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আজকের আবহাওয়া কেমন? শীত শীত লাগছে না?’
‘আমার তো বেশ গরমই লাগছে। অনেকটা পথ হেঁটে এলাম।’
ডেমক্রিটাস উচ্চৈঃস্বরে হাসলেন। বললেন, ‘সত্য তাহলে আমাদের সবার মাঝখানে এক অতল খাদে গড়িয়ে পড়ছে।’
‘হ্যাঁ,’ প্রোটাগোরাস মাথা নাড়লেন।
‘তাহলে চলো আমরা সেই ভৌত শাসন প্রণালিকে খুঁজে বের করি, যা এসব ভিন্নতার সৃষ্টি করে চলেছে।’
জর্জিয়াস ও প্রোটাগোরাসকে কিছুটা চিন্তিত দেখাল।
প্রোটাগোরাস কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন, ‘কিন্তু সে সব ভৌত শাসন প্রণালি নিয়ে কি আমরা একমত হতে পারব?’
এম্পিডোক্লেস
সিসিলির আক্রাগাসের বাসিন্দা ছিলেন এম্পিডোক্লেস। কিংবদন্তি আছে যে, তার কিছু অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। তিনি মহামারি দূর করতে পারতেন। তার কথা শুনতো বাতাস ও বৃষ্টি, এবং তিনি ভেদ করেছিলেন সেই রহস্য, যা দিয়ে মানুষের বয়সকে থামিয়ে রাখা যায়।
দুই
পাউসানিয়াস একদিন তিমায়ুসকে বলেন, ‘এম্পিডোক্লেস জাদু জানতেন। জর্জিয়াস নিজে দেখেছে তাকে জাদু দেখাতে।’
‘কিন্তু কেন তিনি আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের ভেতর লাফ দিলেন? তিনি কি নিশ্চিত ছিলেন, মরবেন না?’ বলেন তিমায়ুস।
‘হয়তো না,’ পাউসানিয়াস মাথা নাড়ল। ‘তিনি শুধু চেয়েছেন, সবাই তাকে দেবতা ভাবুক। তাকে সেই সম্মানটা দিক।’
‘তুমি বলছ, এই আত্মহননের ভেতর সম্মান পাবার লোভ ছিল?’
‘তা জানি না। তবে তিনি দরিদ্রদের প্রতি মহানুভব ছিলেন। ধর্ম প্রচারের চেষ্টাও করেছেন,’- বলেন পাউসানিয়াস।
তিমায়ুস অন্য কিছু ভাবেন, ‘তা তিনি যাই করুন। আমি ভাবছিলাম, একটা মানুষ জ্বালন্ত আগ্নেয়গিরির মধ্যে কেন লাফিয়ে পড়বে? এতে অন্য মানুষের কী আসে যায়, কেবল বিস্মিত হওয়া ছাড়া?’
পাউসানিয়াস মৃদু হেসে বলেন, ‘এম্পিডোক্লেস যে কারণেই মরুক, এই মৃত্যু তাকে মহিমান্বিত করেনি। বরং তার ভাগ্যে জুটিয়েছে বেশ কিছু বিদ্রুপ।’
তিন
সিসিলির এক জলমগ্ন আগ্নেয়গিরির নাম রাখা হয়েছে এম্পিডোক্লেস। সামোটার লুসিয়ান লিখেছেন, এম্পিডোক্লেস আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণের সঙ্গে স্বর্গে উড়ে গেছেন। কেউ কেউ বিদ্রুপাত্মক গল্প বানিয়েছেন এ রকম যে, এম্পিডোক্লেস লাভা উদ্গীরণের সময় চাঁদে গিয়ে পড়েছেন এবং সেখানে তিনি শিশিরকণা খেয়ে বেঁচে-বর্তে ছিলেন কিছু দিন। কীভাবে তিনি লাভার আগুনে রোস্টেড মাংসপিণ্ডে পরিণত হলেন, তা নিয়ে কবিতা লিখেছে কেউ কেউ। ইতনা পাহাড়ের আগ্নেয়গিরিটাই সবচেয়ে বড় বিদ্রুপটা করেছে, তার আত্মাহুতির পর একদিন সে ফিরিয়ে দিয়েছে এম্পিডোক্লেসের একপাটি ব্রোঞ্জের জুতা।
লিখন পদ্ধতি
তিব্বতের নেথাং। পড়ন্ত বেলায় এক যোগী এলেন শ্রীজ্ঞান অতীশের সঙ্গে দেখা করতে। অতীশ যোগীর সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে কথাবার্তা বললেন। যোগী চলে গেলেন রাতে।
জয়শীল জিজ্ঞেস করলেন, ‘কার সঙ্গে এতো কথা বললেন, জো-বো?’
‘আমার পুরনো বন্ধু, মৈত্রী ভৃখোলী,’ বললেন অতীশ।
যোগী চলে গেলে সেই রাতে অতীশ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কোনো দিকে ঘাড় ফেরালেন না। শূন্যে দৃষ্টি মেলে থাকলেন সারারাত।
জয়শীল তাঁকে একাগ্রচিত্তে ঊর্ধ্বমুখে তাকিয়ে থাকতে দেখে কাছে যাননি। ভোরবেলা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী দেখছিলেন জো-বো?’
‘মৈত্রেয়নাথ ও মঞ্জুশ্রীকে দেখছিলাম।’
‘আকাশে?’
‘হ্যাঁ, তাঁরা দেখা দিলেন আকাশে যেন দুটি উজ্জ্বল তারা। তাঁদের কথাবার্তাই শুনছিলাম। সারা রাত ধরে দু’জন কথা বলছিলেন মহাযান শাস্ত্র নিয়ে। অদূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন বজ্রপাণি। আর দু’জনকে ঘিরে রেখেছিলেন দেবপুত্রগণ। তাঁরা শাস্ত্রের ব্যাখ্যা শুনছিলেন আমারই মতো।’
জয়শীল দেখলেন, প্রভূ শিগগিরই লিখতে বসে গেলেন। সারা রাত যে আলোচনা চলছিল, এখন সেটাই তিনি লিখবেন।
জি কুং
কনফুসিয়াস তার শিষ্যদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘গল্পের সিংহ কেন কুয়ার পানিতে নিজের ছায়া দেখে আক্রমণ করে? আর পরিণামে কেনই বা তার পতন ঘটে?’
জিং জি জবাব দিলেন, ‘সে নিজের ছায়া ডিঙাতে পারে না, তাই ক্রুদ্ধ হয়ে যা-তা করে বসে। মৃত্যু তার নিজের ক্রোধের ফল।’
ইউ জি অনেক ভেবে বললেন, ‘ক্ষমতা নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনে।’
জি কুং বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘গন্তব্যে পৌঁছাতে গিয়ে যে তার পথ চিনে রাখে, সে ব্যর্থ হয় না।’
কনফুসিয়াস এবার প্রসন্ন হয়ে হাততালি দিলেন। সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, জি কুংয়ের মতো কেউ থাকলে তার সঙ্গে লোককথা নিয়ে আলাপের তুলনা হয় না।
নিষাদপুত্র
দার্শনিক জেনো নিষাদকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেন, ‘তুমি যখন তীর ছোড়ো, একটা ক্ষুদ্রতম মুহূর্তের জন্য হলেও, তীরটাকে তার নিজ আয়তনের সমান জায়গায় থাকতে হয়, এ রকম যতগুলো ক্ষুদ্রতম মুহূর্তের কথা তুমি ভাবতে পারো, সেগুলোর যোগফলই সময়। আর সব মুহূর্তেই তীরটা তার সমান আয়তনের জায়গায় থেকেছে, অর্থাৎ প্রতিটা মুহূর্তেই যদি তীরটাকে তার সম আয়তনের জায়গায় থাকতে হয়, তাহলে সবকটি ‘থাকা’র যোগফল থাকাই হবে, আসলে যে যায়নি। কাজেই, গতি বলে কিছু নেই।’
একথা শুনে নিষাদ ভড়কে গেল। তাকে কিছুটা উদ্ভ্রান্ত দেখাল। মহর্ষি বসুমিত্রের দিকে তাকিয়ে সে বলতে থাকল, ‘এখন আমি শিকার করব কীভাবে? কী করে বাঁচব?’
মহর্ষি দৃঢ়তার সঙ্গে জেনোর মতকে খারিজ করে দিলেন। তিনি জোর দিয়ে বললেন, ‘থেমে থাকা বলে কিছু নেই। কারণ ছুড়ে দেওয়া তীরের ক্ষেত্রে আমরা কেবল দেখি তীরটা কত দূর গেছে এবং কত দূর যাবে। মাঝখানের সময়টাকে যদি বর্তমান বলা হয়, তাকে যত ক্ষুদ্রতমই ভাবা হোক না কেন, সেটা নেই। সেটাকে বোঝার আগেই তা অতীত হয়ে যায়। কাজেই তীরের জন্য বর্তমান বা ‘থেমে থাকা’ বলে কিছু নেই।’
নিষাদের মুখে এবার হাসি ফুটল। সে প্রণাম করতে গেল মহর্ষি বসুমিত্রকে।
‘থামো। থামো,’ মহর্ষি তাকে থামালেন।
‘আপনি বলছিলেন তীরটা ছুটছে,’ নিষাদ স্পষ্ট করতে চাইল।
‘আমি তা বলিনি। বলেছি, তীরটা থেমে আছে, এটা ঠিক নয়।’
‘কথা তো একই দাঁড়াল।’
‘না। তীরটা থেমে আছে, এটা যেমন বলা যায় না, তীরটা ছুটছে, এটাও বলা যায় না,’ মহর্ষি এবার দুটি মতই খারিজ করলেন।
‘কেন?’ নিষাদ বলল।
‘কারণ তীরটার যদি নিজের গতি থাকে, তবে সেটা ছুটতেই থাকবে। কোনো নিষাদ যদি তাকে গতি দিয়ে থাকে, তাহলে নিষাদ সদাবর্তমান থাকলে, তীরের গতিও সদাবর্তমান থাকবে, কিন্তু আমরা তেমনটা দেখি না। কাজেই তীরটা ছুটছে এমনো বলা যায় না।’
নিষাদ এবার হতাশ হয়ে বসে পড়ল। নিষাদপুত্র কাছেই ছিল। সে দ্রুত ঘরে ঢুকল এবং যত দ্রুত ঘরে গেল তত দ্রুতই সে ছুটে এলো বাইরে। হাতে তীর ও ধনুক।
‘আপনারা দাঁড়ান, আমি দেখাচ্ছি,’ বলে নিষাদপুত্র ধনুক উঁচিয়ে তাদের দিকে তাক করল।
‘এই কী করছ, কী করছ?’ দু’জনে রে রে করে উঠলেন।
‘বিশ্বাস না হলে, আমি দু’বারই পরীক্ষাটা করে দেখাব। এই যে দেখেন।’
বলতে না বলতেই তারা দৌড় দিলেন এবং এতো দ্রুত অদৃশ্য হলেন যে গতিটা বোঝা গেল না।
গাইজেস
গাইজেস এক রাখাল। গরু চরায় পাহাড়ের ধারে। এক বিকালবেলা পাহাড়ের গুহায় ঢুকে সে একটা পুরনো কফিন দেখতে পেল। ভূমিকম্পে সৃষ্টি হওয়া গুহার ভেতর কফিনের ঢাকনাটা ছিল খোলা আর দীর্ঘদেহী শবের হাতে চকচক করছিল একটা সোনার আংটি। সাহসী গাইজেস শবের আঙুল থেকে আংটিটা খুলে নিলো। ওটা ছিল অদৃশ্য হওয়ার জাদুর আংটি।
প্লেটোর ভাই গ্লুকন রিপাবলিকের দ্বিতীয় পুস্তকে এই গাইজেসের কথা বলেছিলেন। গ্লুকনের ধারণা ছিল, এই জাদুর আংটি যার হাতে পড়বে সে যত ন্যায়বানই হোক, যেহেতু অন্যায় কাজের পরিণাম নিয়ে তাকে ভাবতে হচ্ছে না, কাজেই সে অন্যায় কাজগুলোই করবে।
জাদুর আংটি পেয়ে গাইজেস রাখালগিরি ছেড়ে দিয়ে রাজা কান্ডালাউসের দরবারে বার্তাবাহকের কাজ নিলো। তার কিছুদিনের মধ্যে সে রাণীকে নিজের পক্ষে এনে তারই সাহায্য নিয়ে হত্যা করল রাজাকে। তারপর নিজেই হয়ে উঠল লিডিয়ার পরবর্তী রাজা এবং সে বিয়ে করল কান্ডালাউসের বিধবাকে।
গাইজেস অদৃশ্য হওয়ার ক্ষমতা পেয়ে এতটাই অভিভূত হয়ে পড়েছিল যে, যখন তখন আংটি ঘুরিয়ে অদৃশ্য হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল যত্রতত্র, অনুভব করছিল অদৃশ্য থাকার অদ্ভুত অবস্থাটাকে আর ভাবছিল এই ক্ষমতা দিয়ে সে কী কী করতে পারে। যে কারো বাড়িতে ঢুকে কোনো মূল্যবান জিনিস সে নিয়ে আসতে পারে অনায়াসে, কোনো সুন্দরী মেয়ের ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়তে পারে তার পাশে এবং যে অপরাধই সে করুক, জেলে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠবে না।
কিন্তু গাইজেসের মনে এই প্রশ্নটা বারবার উঁকি দিয়ে গেল যে, যে লোকের হাতে এই আংটিটা ছিল, কেন সে মারা পড়ল, আংটির অভাবনীয় ক্ষমতা কেন তাকে রক্ষা করতে পারল না?
গ্লুকন হয়তো অনেক কিছুই জানতেন না। গাইজেস জাদুর আংটি পেয়ে সে রাতে ঢুকে পড়েছিল তার পছন্দের মেয়েটার ঘরে। মেয়েটার কাছে গিয়ে যেইমাত্র সে দৃশ্যমান হয়, তৎক্ষণাৎ সে ‘ভূত ভূত’ বলে চিৎকার করতে শুরু করে। যখন সে বোঝাতে চেষ্টা করল, সে ভুত নয়, গাইজেস! মেয়েটা তখনও আতঙ্কিত হয়ে তার দিকে এটা-সেটা ছুঁড়ে দিতে থাকল এবং একটা ব্রোঞ্জের ফুলদানি ছুড়ে মারলে সেটা দেয়ালে লেগে ঝন ঝন শব্দে মেঝেতে পড়ে গেল। ততক্ষণে বাড়ির লোকজন জড়ো হয়ে গেল এবং গাইজেস অদৃশ্য হয়ে সটকে পড়ল সেখান থেকে। পরদিন সাক্ষাতে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেও মেয়েটার মন থেকে ভয় দূর হল না। সে এই অস্বাভাবিক ক্ষমতাকে ভয় পেতে থাকল এবং গাইজেসও এর অনিবার্যতাকে এড়াতে পারল না। সে নিঃসঙ্গ বোধ করল। এমনকি অদৃশ্য থাকার সময় মনের ভেতর যে অস্তিত্বহীনতার বোধ জন্মে সেটাও ক্রমশ স্থায়ী হয়ে যেতে থাকল। অন্যদের সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়ে পড়ল অস্বাভাবিক যার ভার বয়ে বেড়াতে বেড়াতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ল।
গাইজেস এসময় অদৃশ্য পরিব্রাজক হয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকল নানা দেশে। যে একটা ঘটনার মধ্যে সে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পেল, সেটা হলো ‘দেখা’। সে নানা অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায় আর নানাকিছু দেখতে থাকে। হাটে-বাজারে-নগরে-বন্দরে অবাধে ঘুরে বেড়াতে থাকে গাইজেস। যেখানে সবাই যেতে পারে না, সেখানে সে অনায়াসে পৌঁছে যায়- রাজসভা, রাজমহল, প্রমোদ-উদ্যান, জেলখানা সর্বত্র। এভাবে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর গোপন সমস্ত তথ্য সে জেনে ফেলল এবং তার কাছে গুপ্তচরবৃত্তিটাকে সবচেয়ে যুৎসই কাজ বলে মনে হলো। এ কারণে সে লিডিয়ার রাজার বার্তাবাহকের কাজ নিলো।
কিন্তু নিজ দেশের বার্তাবাহকের কাজে যোগ দিয়ে নিদারুণ সব সত্য জেনে যাওয়ায় সে বিমূঢ় বোধ করে। সে জেনে যায় কান্ডালাউস তার স্ত্রীর উপর কী ভীষণ নিপীড়ন করেন এবং কীভাবে তিনি লিডিয়াকে ক্রমশ ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। পরে আরও যা যা ঘটে, গাইজেস তার সবই করে দেশের মঙ্গল বিবেচনা করে।