
প্রতীকী ছবি
তার নিজের গল্প
সে নিজের একটি গল্প সৃষ্টি করতে চায়, তার নিজের জীবনের কোনো গল্প আর নতুন নেই, যা কথকের ভঙ্গির উপর নতুন হয়ে উঠতে পারে। মহিলাদের সঙ্গে গোপন প্রণয় আর ভ্রুণহত্যার স্মৃতি সব পুরুষের মগজে অ-কোষের মতো ঝুলে থাকে। সারারাত সে ভেবেছে একটি নতুন গল্প সে জীবন দিয়ে ফাঁদতে চায়, যা তার শ্রোতারা শুনে চমকে যাবে। রীতিমাফিক ঘুম থেকে উঠে ভদকায় লেবু চিপে সে তার দিন শুরু করে। তারপর ইয়োগা। গ্রীষ্ম আর শীত নেই, দুই পেগ ভদকার সঙ্গে আধাকাপ লেবুর রস। এটা কতটা স্বাস্থ্যবিধির মধ্যে পড়ে তা সে জানতে চায় না। সে কখনো সন্ধ্যার বারগুলো গুলজার করতে যায় না। চেনা কারো সঙ্গে দেখা হবার ভয়ে পারতপক্ষে বাসায়ই থাকে। তার সদাইপাতি, বইপত্র, জামাকাপড় সে অনলাইন থেকে নেয়, দরকার মতো শয্যাসঙ্গীও। সে একটি চুমুও ফ্রি পেতে চায় না যখন সেটা নিজের ইচ্ছায় হয়। সরাসরি টাকা দিতে না পারলে উপহার বা কোনোভাবে বিনিময় মূল্য ফেরত দেয়। তাকেও কেউ কামনা করলে সে টাকা দাবি করে বসতে পারে।
সারাদিন বাসায় থেকে সে এতই অভ্যস্ত যে বাইরে গেলেই আতঙ্কিত বোধ করে। হাঁটার রাস্তা পায় না খুঁজে। কারো সঙ্গে আলাপচারিতায় জমতে পারে না। তার একমাত্র সঙ্গী বেঁটে একটা কুকুর। সারাদিন ঘেউ ঘেউ করে। তাকে দাবড়ে দাবড়ে গল্পের প্রথম খসড়া শুনিয়ে তার কথা বলার খিদে মিটে যায়। বেঁটে কুকুরটা সারাদিন তার পায়ে পায়ে ঘোরে, লেজ নাড়ায় আর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে শুয়ে কল্পিত মাছি তাড়াবার জন্য কান দুটো উৎকর্ণ করে রাখে। তার মনিবের মতো তারও ঘুম প্রায় নেইই।
সে নিশুতি অধিবেশনে নির্ঘুম শ্রোতাদের গল্প শোনায়। একটি অনলাইন রেডিওতে। শ্রোতারা স্বভাবতই টিন-এজার হলেও তারা মানসিক হাসপাতালের রুটিন চার্টে অন্তর্ভুক্ত। ডাক্তাররা নিশ্চিত হতে পারেনি এমন আজগুবি গল্প শুনে রোগীরা আরো বিগড়ে যাবে কিনা। তাই হাসপাতালে ওই রেডিও নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ মানে তা ঘুষ দিলে সবাই শুনতে পায়।
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। এখনো তার কুকুর গল্পের খসড়া শুনতে পায়নি। সে প্রভুর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। তার সাড়া নেই। সে জাইলোফোন থেকে একটি অদ্ভুত সিম্ফনি বের করার চেষ্টা করছে। যার পুনরাবৃত্তিতে ক্লান্ত কুকুরটা বারান্দায় এসে দেখে কতকগুলো মানুষ শূন্যে ভাসছে। যাদের নড়াচড়া জাইলোফোনের সিম্ফনি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। তখন সে নিজেও শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়া থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে না।
অচিহ্নিতদের কথা
সিঁড়ির বাতি নেভাতে গিয়ে সে উপর তলার ল্যান্ডিংয়ে এসে দাঁড়ালো। এ সময় তার পায়ের শব্দ অন্য কারো নিউরনে সিগন্যাল দেয়, যদি একটা উড়ন্ত পাতাও পাক খেয়ে খেয়ে সেখানে পড়ে সে নির্ণয় করতে পারবে দোতলার সে এলো কিনা। তারা অনেক ভিড়ের ভেতর, যার যার বিশ্বস্ত সংসার-সঙ্গীর সঙ্গে থেকেও সাড়া দিতে পারে।
তারা পরস্পরকে ভালোবাসে না। কখনো বলেনি এই প্রসঙ্গে কিছু, অন্তত ‘তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে’ ধরনের বাক্যও না। ফোনালাপও নেই। তবু তারা পরস্পরের মধু চেখে নেয় যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে; কেন নেয়- সেটা প্রেম নয়, এমনকি শরীরের খুব দাহ থেকেও নয়।
দোতলার সে নিজেকে উন্মুক্ত করে রেখেছে, সে নিজে থেকে কারো চোখে ইঙ্গিত পৌঁছাবে না; কিন্তু যে কারো ইঙ্গিত গ্রহণে সম্মত। সে কোনো এক ভরা বর্ষায় ছাদে চিৎ হয়ে শুয়ে ভিজছিল, আর সেও গেলো বৃষ্টির অসংখ্য থাবায় ভিজতে থাকা শুকনো কাপড়গুলো বাঁচাতে, সেই প্রথম, তারা বিচ্ছিন্ন হবার পর দেখলো চারপাশের ফ্ল্যাটগুলো মানুষের চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে ঘরে ফিরে আবহাওয়ার সংবাদ গুগল করে দেখলো মাঝারি বৃষ্টিতে যথেষ্ট ধূসর পর্দা ঝুলছিল চারপাশে, তারপরও উৎকণ্ঠিত ছিল কেউ হয়তো ডোরবেল বাজিয়ে ঘরের কোনায় কোনায় ফিসফাস রেখে যাবে। তার মনে পড়ে, এমনই এক বৃষ্টিতে বাড়ির পুকুরে ডুবে ডুবে একজনের সঙ্গে মিলিত হয়েছিল যার ডাকাত স্বামী ফেরারি। তারা সেদিন পরিষ্কার দুপুরের বৃষ্টিতে নিজেদের লুকাতে পারেনি। সকাল না হতেই সে রেল স্টেশনে সবার আগে সিটি শুনতে উৎকর্ণ হয়ে পায়চারি করছিল।
শহর তাকে অবারিত সুযোগ করে দেয়। এখানে অসুখী মধ্য বয়সীদের খুব হলাহল। নিশ্চিত যাপনের অসমর্থিত বিয়েটাও সে ভেঙে দেয়। তার দরকার এমন নারী যার সঙ্গে প্রেম-ভালোবাসার উচ্চারণ নেই, যারা এসবে ক্লান্ত, কেবল শরীরের ভেতর এসে একটু জিরাতে চায়। যাদের মন কতকগুলো জ্যান্ত মাছের চৌবাচ্চায় পড়ে আছে।