Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

কবিতার দুর্বোধ্যতা

Icon

চঞ্চল আশরাফ

প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২২, ১৪:৩৩

কবিতার দুর্বোধ্যতা

প্রতীকী ছবি

এক

দুর্বোধ্যতার ‘অভিযোগ’ কবিতা সম্পর্কে প্রায় সব সময়ই ছিল। বিভিন্ন ভাষার ক্ষেত্রে তা কমবেশি লক্ষ্য করা গেছে। বাংলা কবিতার ইতিহাসের শুরু থেকেই ছিল এমন অভিযোগ, দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত চর্যাপদ সেসময়েই দুর্বোধ্য ছিল; সংস্কৃত ভাষায় পণ্ডিত মুনিদত্তর টীকা না-থাকলে সেগুলোর মর্মবস্তু সম্পর্কে জানা কঠিন, হয়তো অসম্ভব হতো।

চর্যাপদ যতটা দুর্বোধ্য, তারচে বেশি রহস্যময়। এর কারণ ছিল রাজনৈতিক। সহজিয়া বৌদ্ধদের প্রতি অপ্রসন্ন ব্রাহ্মণদের প্রতিহিংসা থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য কবিরা লিখেছিলেন এমন এক আড়ালব্যঞ্জক ভাষায়, যাতে ইঙ্গিত, প্রতীক ও রূপকের আশ্রয়ে রহস্যময়তা সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে, চর্যাপদ হয়ে উঠেছে তখনকার অবরুদ্ধ সমাজের দ্যোতক। কেমন সেই কবিতা? একটি উদাহরণ :

টালত ঘর মোর নাহি পড়িবেষী।

হাঁড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী।

বেঙ্গ সংসার বডহিল যায়।

দুহিল দধু কি বেন্টে ষামায়।

বলদ বিআঅল গবিআ বাঁঝে।

পিটা দুহিএ এ তিনা সাঁঝে।।

জো সো বুধী শোই নিবুধী।

জো সো চোর সোই সাধী।।

নিতি নিতি ষিআলা ষিহে সম জুঝঅ।

ঢেন্টনপাদের গীত বিরলে বুঝঅ।

পদটির শেষে বলে দেওয়া হয়েছে যে, ঢেন্টনপাদের কথা খুব কম লোকেই বুঝতে পারে। বোঝা যাচ্ছে, পদকর্তা জারি রেখেছেন তাঁর সেই প্রি-অকুপেশন, যাতে রচনাটি সমাজের বিপুল-গরিষ্ঠদের কাছে বোধগম্য না হয়ে ওঠে। দরিদ্রগৃহিণীর কষ্টকর যাপনচিত্রের মধ্য দিয়ে পরস্পরবিরোধী ইঙ্গিত-রূপকে বৌদ্ধ সহজিয়া সাধনার গূঢ় তত্ত্ব এ-রচনায় বোঝানো হয়েছে। যেমন, টিলার ওপরে ঘর চেতনাশীর্ষেরই দ্যোতক। চেতনার চূড়ায় উঠলে কী ঘটে, কী দৃশ্যমান হয়ে ওঠে ইত্যাদি বলিয়ে নেওয়ার জন্যে এমন একজনকে নির্বাচন করা হয়েছে, ব্রাহ্মণ এবং তাদের অনুগতদের রোষাণলে কবিকে যেন পড়তে না হয়। আর ভাষা তো পূর্বনির্ধারিত বিমূর্ততায় জড়ানো, যাকে ‘সন্ধ্যাভাষা’ বলে রীতিমতো দুর্বোধ্যতার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে।

দুই

জঁ আর্তুর র‌্যাঁবো, স্তেফঁ মালার্মে, পল ভ্যালেরির কবিতা সম্পর্কে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ ছিল বহুদিন। টি এস এলিয়টের ‘দি লাভ সং অব জে. আলফ্রেড প্রুফ্রক’ প্রকাশের ৩৬ বছর পরেও সাব্যস্ত হয়েছিল ‘পাগলের প্রলাপ’ বলে; বিষ্ণু দের ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরই বোধগম্য হয়নি। এরকম বহু উদাহরণ মিলবে; কিন্তু এঁদের কবিতা সম্পর্কে সেই অভিযোগ আজকাল আর ওঠে না। এখনকার কবিতা পড়ে যাঁরা বলেন ‘বুঝি না’, তাদেরকে পাঠক হিসেবে গ্রাহ্য করার দিনও ফুরিয়েছে বলে মনে হয়। কেননা বিমূর্ততার প্রতি পক্ষপাতের একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। সে প্রসঙ্গ এখানে বিবেচ্য নয়; কিন্তু কেন কবিতা ‘দুর্বোধ্য’ বলে অভিযোগ ওঠে? সমস্যাটি কি ভাষার, না টেকনিকের, না-কি বিশেষ ও অগম্য করে তোলার সচেতন অভিপ্রায়জাত? বা, কবির ‘নিজেরই মুদ্রাদোষে’ আলাদা হতে থাকার চাপ থেকে এমনটি ঘটে? কিংবা এই চারটিই? কবিতার ইতিহাসের দিকে তাকালে জবাবটা পাওয়া যায়; কিন্তু ঠিক কবে থেকে, কোন মোচড়ের সূত্রে বোধগম্যতার ব্যাপারটি বিবেচ্য হয়ে উঠলো? জবাবটা হতে পারে এমন : ফরাসি কবিতা রোমান্টিক সংবেদনশীলতা থেকে যখন সরে গেল, তখনই এর সূচনা ঘটলো। বছরটা ১৮৫৭, গ্রন্থটি ফ্ল্যুর দ্যু মাল, (বুদ্ধদেব বসুর বাংলা অনুবাদে ক্লেদজ কুসুম) কবি শার্ল বোদলেয়র। তাঁরই সময় থেকে ফরাসি প্রতীকবাদের পুষ্পায়ন। এরপর জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবো, ভেরলেঁ; স্তেফঁ মালার্মের কবিতায় এসে পরিণতি ও অবক্ষয়। উল্লেখ্য, ফ্লুর দ্যু মাল প্রকাশের বছর থেকে আধুনিক কবিতার সূচনা, এমন ধারণা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস করেছেন মাইকেল হ্যামবার্জার (১৯২৪-২০০৭); কিন্তু বোদলেয়রের এই অর্জন আকস্মিক বা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। পথটি দেখিয়েছিলেন এডগার অ্যালান পো, ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস যাঁকে ‘প্রথম সারির কবি’ হিসেবে দেখেনি। সাহিত্যের বাঁকবদল সম্পর্কিত আলোচনায় তাঁর কবিতাদর্শনও উপেক্ষিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও, পো’র ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অন্তত বোদলেয়রের ওপর তাঁর তাত্ত্বিক প্রভাবের দিক থেকে। কবিতা সম্পর্কে নিজের বক্তব্য ও অনুভূতি প্রকাশে পো’কে ব্যবহার করেছেন বোদলেয়র। উপদেশাত্মক ও নীতিমূলক কবিতার বিপরীতে ‘বিশুদ্ধ কবিতা’র ধারণা ও মতাদর্শ তিনি পেয়েছেন তাঁর দি পোয়েটিক প্রিন্সিপাল থেকেই। আর দি ফিলজফি অব কম্পোজিসন প্রবন্ধ থেকে গ্রহণ করেছেন কবিতায় অনুপ্রেরণার পরিবর্তে অনুশীলনের তত্ত্ব। থিওফিল গতিয়ের লা ফ্লুর দ্যু মাল কবিতাগ্রন্থের মুখবন্ধে এইসব মত প্রতিপাদন করে কবিতার সাঙ্গীতিক মূল্যের ওপর জোর দিয়েছেন। আরো গুরুত্ব দিয়েছেন কবিতার ভাস্কর্যধর্মী গঠন এবং বোদলেয়রের ‘Les parfums, les coutteurs et les sons Le confondent’-এর ভিত্তিতে বিকশিত ইন্দ্রিয়গুলোর পারস্পরিক সংযোগের ধারণার ওপর।

পো’র রচনা ভেরলেঁ কখনো পড়েননি; কিন্তু প্রতিধ্বনিত করেছেন সেই কথাগুলোরই। তাঁর ও র‌্যাঁবোর কবিতা আশ্চর্য রকম ভ্রান্ত ভাষ্য ও ভুল ধারণার দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফল। র্যাঁবোর ‘Le Bat eau Ivra’ পুরোপুরি পো’র অনুপ্রেরণায় রচিত না হলেও ফরাসি সাহিত্যে তাঁর প্রহেলিকা আত্মস্থ না করলে এ ধরনের রচনা সম্ভব হতো না। র্যাঁবোর একটি পঙ্ক্তিতে ঘূর্ণিঝড়ের কথা রয়েছে। যারা পো’র ‘টেলস অব মিস্ট্রি অ্যান্ড ইমাজিনেশন’ পড়েছেন, তাঁরা বুঝতে পারবেন তাঁর কবিতাপ্রবাহের উৎসটি কী। সাহিত্যের ইতিহাস এ সম্পর্কে নীরব থেকেছে।

অস্পষ্ট বা ভ্রান্ত উপলব্ধি বা চিন্তা কবির আত্মবিকাশের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। আধুনিক কবিতার শৈশবে এডগার অ্যালান পো’র ভূমিকা ছিল এরকমই। তিনি ‘একটি ইঙ্গিতময় অনির্দিষ্টতা’কে খাঁটি সাঙ্গীতিক কবিতার জরুরি উপাদান বলে উল্লেখ করেছেন। দি ব্যাকগ্রাউন্ড অব মডার্ন পোয়েট্রি গ্রন্থে জে. আইজ্যাক্স পো’র একটি মন্তব্যের উল্লেখ করেছেন। ইতিহাসে সেটিরও সঠিক স্থান হয়নি। মন্তব্যটি পো করেছিলেন টমাস মুরের কবিতা সমালোচনা প্রসঙ্গেই। সেটি কী? তা কোনো ফরাসি কবি যে পড়েননি, আইজ্যাকস ওই গ্রন্থে নিশ্চিত করেছেন। সুতরাং পো’র চিন্তনপ্রভাব আরো পরোক্ষ ও বিমূর্ত হয়ে এসেছে। তিনি ইঙ্গিত করেছেন যে, অতীন্দ্রিয়তার মাত্রাভেদই কবিতার আকাঙ্ক্ষা ও কল্পনার মধ্যেকার ব্যবধান গড়ে দেয়। তিনি বলেন, ‘এতে অতীন্দ্রিয় শব্দটি শ্লেগেল ও অপরাপর জার্মান দার্শনিকের প্রণীত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থের স্বচ্ছ বহির্প্রবাহের নিচে একটি অন্তর্স্রোত বা ইঙ্গিত থাকে, সেরকম রচনার ব্যাখ্যায় অভিধাটি প্রয়োগ করা হয়েছে। মানুষের অভ্যন্তর সত্তা বলতে আমরা তার অতীন্দ্রিয় বা দ্বিতীয় অভিব্যক্তিকেই বুঝি। গানের সংগীতের মতোই তীব্রবিপুল এর শক্তি।’

অনির্দিষ্টতা বিষয়ে স্তেফঁ মালার্মের তত্ত্ব অত্যন্ত স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, স্পষ্ট করে কিছু বলার মানে ক্রমোন্মচনের আনন্দ তিন-চতুর্থাংশ বিলীন করে দেওয়া। অর্থের ইঙ্গিত থাকবে শুধু, সব সময় কবিতা হবে প্রহেলিকার মতোই।’ তাঁর অনুসারী পল ভ্যালেরির বক্তব্য, ‘কোনো কোনো কবি পেতে চান কেবল নিজের আনন্দ। তাঁরা আমাদের সামনে প্রহেলিকা হাজির করেন।’

আর্থার সাইমন্স কবিতা রচনায় মালার্মের বিশেষ এক পদ্ধতির বয়ান দিয়েছেন, প্রতিপাদ্যজড়িত শব্দের ‘কাম্য ও যথার্থ বিকল্প’ সন্ধানের অনুশীলনই এর মূলকথা। শব্দের পর শব্দ পাল্টে ফেলার এই প্রক্রিয়ায় কবিতাটি যখন ত্রুটহীন সংহতিতে পৌঁছাচ্ছে বলে মনে হয়, পথের সমস্ত চিহ্ন তখন ভাববস্তু থেকে নিপুণভাবে মুছে ফেলা হয়েছে। শুরু থেকে প্রক্রিয়াটি কবি জানেন, ফলে তখনো ব্যবহৃত শব্দরাশির মধ্যেকার সম্পর্ক তিনি দেখতে পান; কিন্তু শেষ পর্যন্ত কবিতাটি সম্পর্কে পাঠক বিভ্রান্তিতে পড়েন। রচনার এই পদ্ধতি শেষ পর্যন্ত অনুসরণ করলে বোঝা যায়, একটা হেঁয়ালি দিয়ে শুরু করে বোধগম্যতার চাবিটি পাঠকের কাছ থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ফলাফল, মালার্মের শেষ দিককার দুষ্প্রবেশ্য সনেটগুলো।

বিশ শতকের জীবনধারা, চৈতন্য ও প্রযুক্তির মতোই অত্যন্ত জটিল ও সূক্ষ্ম আধুনিক কবিতার বুনন। জে আইজ্যাক্স বলেছেন, এর কাঠামো গড়ে উঠেছে উত্তেজনা ও দ্বন্ধের ভারসাম্য রক্ষার অনুশীলন থেকে। এর অভ্যন্তর অসংগঠিত ও অসংলগ্ন সব উচ্চারণের একটা গুচ্ছ বিশেষ। 

‘অকৃত্রিম কবিতা বোধগম্য হওয়ার আগেই সঞ্চারিত হতে পারে।’ কথাটি টি এস এলিয়টের, প্রায় সবারই জানা; কিন্তু সঞ্চারের সমস্যাই আধুনিক কবিতার প্রধান সমস্যা এবং এর কারণ হিসেবে দুর্বোধ্যতাকেই নির্দেশ করা হয়। এর শুরুটা কীভাবে হলো, বোঝার জন্য বোদলেয়রের ‘লা ফ্লুর দ্যু মাল’এর ভূমিকায় চিত্রকল্প সৃষ্টির আবশ্যকীয় মেটাফিজিক্যাল ও আধুনিক প্রক্রিয়ার যে বর্ণনা দিয়েছেন থিওফিল গতিয়ের, তা দেখা দরকার। পরস্পর-বিরোধী সব উপাদানের অদৃশ্য মেলবন্ধন তাতে ঘটেছে, সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনুভূতিগুলোর বিশৃঙ্খলা বা বিভিন্ন অনুভূতির একাঙ্গীকরণ। মূলত এটাই আধুনিক ইঙ্গিতময় কবিতার পরিচয় চিহ্ন।

তিন

আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্যতার একটি পশ্চাৎভূমি রয়েছে। সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য ১৬০০ সালের পরের ইংরেজি কবিতায় খানিকটা আলো ফেলতে হয়। তখন জন ডান ও অন্যান্য নবীন কবির সময়। অর্থাৎ মেটাফিজিক্যাল কবিতার কাল। তখনকার গণরুচি কেমন ছিল? প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, অগ্রসর কবি ও সাধারণ পাঠকের মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান, বিশেষ ধরনের সূক্ষ্ম, জটিল ও প্রায়-অগম্য কবিতার জন্য উন্নাসিক পাঠক আর পেশাদার কবির ঔদ্ধত্য এবং সাধারণ পাঠক ও তাদের সমালোচক প্রতিনিধিদের প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাব। সেই কবিদের সময় তখন, ফ্রান্সিস বোমন্ট বলেছেন ‘যাদের আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে বোধগম্য না হওয়া।’ বেন জনসনের মন্তব্য, ‘আজকাল স্বাভাবিক কোনো কিছুই ভালো নয়... দুমড়ে-মুচড়ে ফেলা জিনিসই বেশি পরিপাটি বলে গণ্য... বিকৃত না হলে কোনো কিছুই ভদ্রতাসম্মত নয়, সমকালীন রীতিসিদ্ধ নয়।’ তবে এর আগেই, ১৫৯৫ সালে জর্জ চ্যাপম্যান দুর্বোধ্য কবিতার জন্য বিশেষ ধরনের শ্রোতা সম্পর্কে বলেছেন, ‘অপবিত্র লোকদের আমি ঘৃণা করি। আমার বিস্ময়কর কবিতাগুলো শুধু সেই সব সন্ধিৎসু আত্মার উদ্দেশ্যে নিবেদিত, জ্ঞান যাদের মহৎ করেছে। তাঁর কবিতার এক গর্বিত অনুরাগীর কথা বলতে গিয়ে তিনি প্রকাশ করলেন দুর্বোধ্যতার প্রথম সনদ : শব্দের আকর্ষণ থেকে সৃষ্ট দুর্বোধ্যতা ও অলংকারের বাহুল্য বৃথা পাণ্ডিত্য আর অপরিণত মনের লক্ষণ; কিন্তু বিষয়ের গভীরে যেখানে নিজেকে আবৃত করে রাখা যায়, যথাযথ চিত্র ও অর্থপূর্ণ পঙ্ক্তির মধ্য দিয়ে যা উচ্চারিত হয়, সেই অন্ধকারে আচ্ছাদিত হওয়ার জন্য আমি মেহনত করে যাবো।’ বক্তব্যটি সমর্থন করেছেন ড. জনসনও। তিনি লেখেন, ‘শব্দ তাদের কাছেই কঠিন, যারা বুঝতে অক্ষম। সমালোচককে সব সময়ই বের করতে হবে বিব্রত হওয়ার কারণ কি লেখক, না নিজের দোষেই এমনটি ঘটছে। সব লেখক সব পাঠকের জন্য লেখেন না।’

জন ডান ও তখনকার কবিতার দুর্বোধ্যতা এই কারণে প্রাসঙ্গিক যে, এর পরিপ্রেক্ষিতে উঠে আসা আলাপগুলোর প্রায় সবই উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে আজ অব্দি রচিত ও অগম্য বলে অভিযুক্ত কবিতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। নতুন কিংবা বিশেষ ধরনের কবিতার কিছু পাঠক সব সময়ই কবির কাছাকাছি অবস্থান করেন, এমনটি দুর্লক্ষ্য নয়। টি এস এলিয়ট ‘দি লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফ্রক’ রচনা করেন ১৯১১ সালে, নির্বাচিত অঙুলিমেয় পাঠকরা তা পড়েন ১৯১৫ সালে আর সাধারণ পাঠকের হাতে পৌঁছায় ১৯১৭ সালে; কিন্তু কারও কাছে সেটি বোধগম্য হয়ে ওঠেনি। ১৯৫১ সালেও সাব্যস্ত হয়েছিল পাগলের প্রলাপ বলে। যারা এমনটি করেছিল, তারা জন ডানের সময় থেকেই ‘প্রতিক্রিয়াশীল পাঠকদের প্রতিনিধি’। 

চার

সাহিত্যভাষার প্রবাহবদল এবং কবিতাসম্পর্কিত চেতনা বা ধারণার পরিবর্তন দুর্বোধ্যতার অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। ফরাসি, ইংরেজি, জর্মন ও অন্যান্য ভাষার মতোই বাংলা কবিতায়ও এমনটি লক্ষ্যযোগ্য। গত শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকে বাংলা কবিতা রূপবদল করে আসছে। শুরুটা বোধ করি জীবনানন্দের হাতে, কেননা সজনীকান্তর মতো ‘প্রতিক্রিয়াশীল পাঠকের প্রতিনিধি’র আবির্ভাব তাঁর কবিতার রহস্যঋদ্ধ তরঙ্গ থেকেই ঘটেছিল। রবীন্দ্রনাথ সেই দলের নন; যদিও তিনি ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতার কেবল ‘চিত্ররূপময়’ তাটুকুই ধরতে পেরেছিলেন। তবে বিষ্ণু দে’র উর্বশী ও আর্টেমিস কবিতাগ্রন্থটি কেউ বুঝিয়ে দিতে পারলে তাকে পুরস্কৃত করবেন বলে যে ঘোষণা দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, আজ তা এক ধরনের সাহিত্যিক বিনয় কিংবা উদীয়মান তরুণ কবির প্রতি বয়োজ্যেষ্ঠসুলভ ঠাট্টা বলেই মনে হয়। কেননা, বইটির কোনো কবিতায় অগম্য বা অস্পষ্ট কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। জীবনানন্দের বেলায় এমনটি বলা যায় না, তাঁর বহু কবিতা আজও অব্যাখ্যাত রয়ে গেছে; কিন্তু সঞ্চারের যে সমস্যা আধুনিক কবিতাকে পাঠক থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে বলে রব উঠছে এলিয়টের কাল থেকে, তাঁর রচনা সম্পর্কে সেই আলাপ অসমীচীন। জীবনানন্দের কবিতা দুষ্প্রবেশ্য নয়, কেননা পাঠকের জন্য একটা দরজা তিনি কোনো না কোনোভাবে খুলে রাখেন। হোক তা ধ্বনিপ্রবাহ, কবিতার ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রাত্যহিক উচ্চারণ-পরম্পরার যোগ, প্রত্যুত্তরময় প্রশ্নের উত্থাপন ও বিস্তার ইত্যাদি। এলিয়টের বেলায়ও এমনটি দেখা গেছে। উভয়ের দুর্বোধ্যতার কারণ একই। চসার থেকে শেক্সপিয়রের সনেট হয়ে মেটাফিজিক্যাল এবং রোমান্টিক কবিদের রচনা পাঠের যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল ইংরেজি ভাষায়, সেই পরিমণ্ডল থেকে এলিয়টের কবিতা দুষ্প্রবেশ্য বটে। তেমনি মধ্যযুগের গীতিকবিতা থেকে গড়ে ওঠা রবীন্দ্র-নজরুল পর্যন্ত বাংলা কবিতার সংস্কৃতি থেকে পাঠ করলে জীবনানন্দ দাশের রচনার মতো অগম্য কিছু আর হয় না। এ এক অতিমানবীয় ভাষা, যার জন্য সমকালীন বাঙালি পাঠকের প্রস্তুতিও আশা করা কঠিন; কিন্তু একটু আগেই বলা হয়েছে, পাঠকের জন্য তিনি খুলে রাখেন একটি দরজা, যা দিয়ে প্রবেশমাত্র কবিতা সঞ্চারযোগ্য হয়ে ওঠে। এবং এর মধ্যেই সাধারণ পাঠকের ‘বিমোক্ষণ’ কিংবা পরিতৃপ্তি ঘটে; কিন্তু বুদ্ধিমান বা চিন্তাশীল যারা, কবিতার প্রকৃত মর্মে তারা হাজির হতে চান, সেটি চরিতার্থ করতে গিয়ে অন্য দরজার সন্ধান করেন। ধরা যাক, জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’। এটি খুব বিখ্যাত, বিশেষত প্রেমের কবিতা হিসেবে সাধারণ পাঠকের কাছে এর সমাদর, বেশ আগে থেকেই, প্রশ্নাতীত। এডগার অ্যালান পো-কথিত ‘সাঙ্গীতিক বহির্স্বর’সম্মত এর ধ্বনিকাঠামোর টান বাদ দিলেও, (দেওয়া যায় না, অপরিণত পাঠক এই দরজা দিয়েই ঢোকেন), অন্তত একটা দরজা এতে পাঠক পেয়েছে, তা এক ক্লান্ত ও নিরাশ্রয় পথিকের গল্প। এতে হাঁটার বর্ণনা আছে, বনলতা সেন নামের এক নারীর সঙ্গে সাক্ষাতের কথা আছে, সংলাপও; আছে জীবন সম্পর্কে একটা ডিসকোর্স; কিন্তু এতেই কি কবিতাটির বোধগম্যতায় কোনো মীমাংসা ঘটলো? ঘটলে, কেন তা আবার পড়তে হয়? বিভিন্ন ভাষ্য-ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দ্বারস্থ কেন হতে হয়? এমন তো নয় যে, কবিতাটির রচনাসময় থেকে ভাষা স্থির হয়ে আছে, কবিতা সম্পর্কিত ধারণা আগের মতোই রয়েছে; বা, যে-পরিবর্তন ঘটেছে, তা কবিতাটিকে দূরে ঠেলে দিয়েছে! ফের বলা দরকার, পো কবিতার জন্য আবশ্যকীয় দুটি শর্তের কথা বলেছিলেন : সাঙ্গীতিক বহির্স্বর ও ইঙ্গিতময় অনির্দিষ্টতা। বলেছিলেন, কবির কাজ হওয়া উচিত ভাববস্তুর তিন-চতুর্থাংশ আড়াল করা, কেননা অর্থের চেয়ে অর্থের ইঙ্গিত কবিতায় বেশি জরুরি। এই নির্দেশনা পুরো মাত্রায় কাজে লাগিয়েছেন ফরাসি প্রতীকবাদীরা। বিশ শতকের কবিতায় তাঁদের এই আন্দোলনের প্রভাব নানা দিকে বিস্তৃত হয়েছে। যা হোক, বোধগম্যতার যে দরজা উন্মুক্ত করার কথা বলা হয়েছে তা আসলে কবিতার এই এক-চতুর্থাংশই। বাকি তিন ভাগের জন্য রচনাটি বারবার পাঠ করতে হয়, অপেক্ষা করতে হয় পরবর্তী ভাষ্য-ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্য। ফলে দুর্বোধ্যতার ‘অভিযোগ’ নিয়ে সে-কবিতা টিকে যায়। বারবার আমরা হার্ট ক্রেনের ‘অ্যাট মেলভিলস টম্ব’ কিংবা এডিথ সিটওয়েলের ‘স্টিল ফলস দ্য রেইন’ পড়ি। জীবনানন্দ দাশের ‘ক্যাম্পে’, ‘বেড়াল’ পড়ি। 

পাঁচ

ফরাসি প্রতীকবাদী কবিরা মোটামুটি সংঘবদ্ধভাবে বুঝিয়ে দেন যে, কবিতা বোধগম্য হওয়ার শিল্পকলা নয়। সেই পাঠকদের তারা তাচ্ছিল্য ও অস্বীকার করতে চেয়েছেন, যারা সহজবোধ্য কবিতা চায়। স্তেফঁ মালার্মে তো বলেছেন, প্রথম পাঠেই যারা বুঝতে চায়, কবিতা সেসব নিষ্কর্মা ও বুদ্ধিহীন পাঠকের জন্য নয়। বোঝা যাচ্ছে, তাঁরা চেয়েছিলেন পাঠকের চিন্তন সক্রিয়তা; কিন্তু এমন আকাঙ্ক্ষা হঠাৎ করে হয়নি, এর এতটা পশ্চাৎপট রয়েছে। রোমান্টিকদের অলঙ্কারবাহুল্য, অতিকথন, নির্বিচার কল্পনা আর আবেগের অন্ধ উদগীরণ থেকে তাঁরা মুক্তি চেয়েছিলেন। ফলে, কবিতায় সংহতি ও সূক্ষ্মতা এলো, বস্তুজগতের চেয়ে এর বিশ্লিষ্ট রূপের প্রতি, বস্তুরাশির রহস্যময় আন্তঃসম্পর্কের প্রতি কবিদের আগ্রহ প্রবল হয়ে উঠল। তাতে যোগ হলো এক ধরনের মরমিপনা। এসবই প্রতীকবাদী কবিতার ধাঁধাসম জটিলতার কারণ। বিশ শতকের কবিতায় এর প্রভাব গভীরবিস্তৃত। যত কবিতান্দোলন এই শতাব্দীতে, প্রায় সবই প্রতীকবাদের একেকটি চূর্ণ নিয়ে গড়ে উঠেছে। সুররিয়্যালিজম, ইমেজিসম, এমনকি কনফেশনাল পোয়েট্রির বেলায়ও এটা বলা যায়। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির মনস্তত্ব, সমকালীন চিন্তাধারা, বিজ্ঞান, সৌন্দর্যবোধ ইত্যাদি। 

ফলে, প্রতীকবাদ থেকে আধুনিকতার সূত্রপাত এবং দুর্বোধ্যতার ‘কালিমা’ এতে অনপনেয়ভাবে জড়িয়ে আছে। বাংলা কবিতা এর স্পন্দন যে এড়াতে পারেনি, তা আগেই বলা হয়েছে। প্রাসঙ্গিক, ফরাসি প্রতীকবাদী কবিদের মতোই জীবনানন্দও এডগার অ্যালান পোর কবিতাসম্পর্কিত রচনার পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। নিয়েছিলেন সেই শিক্ষা, কবিতার বহিরঙ্গ দিয়ে প্রতিপাদ্যকে আড়াল করতে যা সাহায্য করে।

কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, দুর্বোধ্য যে-কোনো রচনাই আধুনিক? তাহলে তো যে উদ্ধৃতি দিয়ে আলোচনাটি শুরু হয়েছিল, তাও পেতে পারে এই অভিধাটুকু। না, সেটি হওয়ার নয়। কেননা, এটি গড়ে উঠেছে বিশেষ এক সংবেদনশীলতা থেকে, যার সঙ্গে গীতিকবিতার সম্পর্ক নেই। মধ্যযুগের রচনার মতো আধুনিক কবিতা সহজ নয়, বরং জটিল; গঠনমূলক ও ইতিবাচক নয়, বরং বিপর্যয়কর; একরৈখিক নয়, বরং বহুমুখী। বোধগম্য হওয়ার চেয়ে একে উপলব্ধিই বেশি জরুরি। সেজন্য পাঠককে আধুনিক চিন্তনবিশ্বের বাসিন্দা হতে 

হয়।  


লেখক- কবি ও গল্পকার

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫