Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

সানাউল্লা মুনসীর অলৌকিক স্বপ্ন

Icon

সুমন্ত আসলাম

প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২২, ১৫:১৭

সানাউল্লা মুনসীর অলৌকিক স্বপ্ন

অলংকরণ: মামুন হোসাইন

সানাউল্লা মুনসী স্বপ্ন দেখেন-সম্পূর্ণ ন্যাংটা হয়ে তিনি রাস্তার মাঝ বরাবর হাঁটছেন। বহুল জনসম্মুখে, প্রকাশ্য দিবালোকে, খুব আনন্দ নিয়ে হাঁটছেন। ফ্যাশন টিভিতে দেখা ফ্যাশন শোয়ের অলৌকিক মানবীদের মতো হাঁটছেন। তার গায়ে কোনো কাপড় নেই, কাপড়ের একটা টুকরোও নেই। কেবল কোমরের কাছে তাবিজ লাগানোর তাগাটা রয়েছে। বহু বছর আগে লাগানো কালো রঙের তাগাটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, চিকন হয়ে গেছে এবং সেটা কোমরের দু’পাশের হাড়ের সঙ্গে এমন ভাবে ঝুলে আছে, যেন একটু পরেই, ঠিক একটু সুযোগ পেলেই, নিজেকে মুক্ত করে পায়ের কাছে গিয়ে গড়াগড়ি খাবে আপনমনে।

স্বপ্নটা এটুকুই ঠিক ছিল; কিন্তু একটু পর খেয়াল করেন-কয়েক হাজার পিঁপড়া হেঁটে আসছে তার পেছনে পেছনে। পিঁপড়াগুলো শরীর বেয়ে ওঠার চেষ্টা করছে তার। তিনি যত জোরে হাঁটছেন, পিঁপড়েগুলোও তত জোরে হেঁটে আসছে। কোনোভাবেই পিঁপড়েদের খুব বেশি পেছনে ফেলে আসতে পারছেন না তিনি। প্রাণপণ চেষ্টা করছেন, কিন্তু না, নিজেকে রক্ষা করতে পারলেন না কিছুতেই। কেমন করে যেন একটা পিঁপড়ে তার পা বেয়ে, দু’পায়ের সংযোগ স্থলে গিয়ে থমকে দাঁড়াল একটু। তারপর কৌশলগত একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে পেছনের দিকে চলে গেল। এবং সেখানে গিয়ে গোলানো ময়দার মতো নরম জায়গাটায় একটা কামড় দিল কুট করে। উহ্ করে একটা চিৎকার দিলেন তিনি। ঘুমটা ভেঙে গেল ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই।

বিছানায় উঠে বসলেন মুনসী। সাধারণত এ ধরনের স্বপ্ন দেখে একটু হলেও দুঃচিন্তা করার কথা; কিন্তু দুঃচিন্তা তো দূরের কথা, বয়ঃসন্ধিকালের প্রথম প্রেমে পড়ার মতো পুলকিত মনে হলো তাকে, অন্যরকম একটা অনুভূতি দেখা গেল তার মাঝে, দিন শেষে পশ্চিম আকাশের গোলাপি আভাও দেখা গেল দু’গালের মাঝখানে। 

বেড সুইচ জ্বালালেন তিনি। বিছানায় টাঙ্গানো মশারি জাপটে মশা বসে আছে ছয়টা। প্রত্যেকটার পেট ফুলে ঢোলের মতো হয়ে গেছে, কালো অবয়বটা হয়ে গেছে লালচে। সঙ্গে সঙ্গে গলার কাছে চুলকানি পেল মুনসীর। একটু ফোলাও মনে হলো জায়গাটা। অন্য দিন হলে রাগে এতক্ষণ মশাগুলো দু’হাতের তালুতে চটকিয়ে ফেলতেন, আজ তা করলেন না। স্বপ্ন সংক্রান্ত ব্যাপারে মনটা ভালো আছে তার, মন ভালো থাকলে কোনো প্রাণী হত্যা তো দূরের কথা, কাউকে বকা দিতেও ইচ্ছে করে না তার। 

বিছানা থেকে পা নামিয়ে যেই না স্যান্ডেলে পা গলাবেন, ঠিক তখনই দেখতে পেলেন-একটা তেলাপোকা বসে আছে ডান পায়ের স্যান্ডেলে। পা স্থির করে বসে আছে ওটা, কিন্তু শুঁড় দুটি অস্থিরভাবে এদিক-ওদিক নড়ছে। বরাবরের মতো এ অমেরুদণ্ডী প্রাণীটিকেও কিছু বলেন না তিনি। অথচ স্রষ্টার সৃষ্টির প্রাণিকুলের মধ্যে এ দুটি প্রাণীকেই তিনি একবারেই দেখতে পারেন না, সবচেয়ে ঘৃণা করেন এবং চোখের সামনে পরলেই মেরে ফেলেন।

আলতো করে স্যান্ডেলটা নাড়া দিয়ে প্রাণীটিকে সরিয়ে দিলেন মুনসী। কিছুদূর গিয়ে আবার থমকে দাঁড়াল ওটা। কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়ে শুঁড় নাড়াতে লাগল, যেন ভীষণ বিরক্ত সে এবং এভাবে অযাচিত তাড়িয়ে দেওয়া তার জন্য চরম লজ্জাকর, অপমানজনকও।

সানাউল্লা মুনসী জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। সীমাহীন শূন্যতার দিকে তাকিয়ে নিজের কথা ভাবতে লাগলেন, ভাবতে ভাবতে নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওহে মুনসী, তুমি কি এবার তোমার এই স্বপ্নটাও পূরণ করবে?’

২.

স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন সানাউল্লা মুনসী। স্বপ্ন দেখতে অনেকেই ভালোবাসে; কিন্তু অনেকের সঙ্গে মুন্সীর পার্থক্য হচ্ছে-অনেকে স্বপ্ন দেখে ভুলে যায়, মুনসী ভোলেন না। মুনসী মনে করেন, আল্লাপাক মানুষকে স্বপ্ন দেখান সেই স্বপ্নটা পূরণ করার জন্য। স্বপ্ন তিনি এর আগে আরো অনেক দেখেছেন; কিন্তু সাড়ে তিন বছর আগে একটা স্বপ্ন দেখে তিনি আচমকা উপলব্ধি করেন-স্বপ্ন হচ্ছে সত্যি সত্যি পূরণ করার জিনিস। তারপর থেকেই স্বপ্ন দেখার পর সেই স্বপ্নটা পূরণ করার চেষ্টা করেন তিনি।

সাড়ে তিন বছর আগে মুনসী স্বপ্ন দেখেন-রিকশাওয়ালা হয়ে গেছেন তিনি, লুঙ্গি আর ছেঁড়া ধরনের একটা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে রিকশা চালাচ্ছেন শিস বাজিয়ে। স্বপ্নটা দেখে হন্তদন্ত জেগে ওঠেন ঘুম থেকে। ভোরের স্বপ্ন ছিল সেটা। সকালের প্রয়োজনীয় কাজ সেরে রিকশার খোঁজে বের হন, কিন্তু রিকশা কোথায় পাওয়া যায়, কোথা থেকে ভাড়া নিতে হয়-একেবারে গোলকধাঁধায় পড়ে যাওয়ার অবস্থা তার। অনেক খোঁজাখুঁজির পর রিকশার একটা গ্যারেজ পান তিনি। মালিককে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘একটা রিকশা দেওয়া যাবে?’

গ্যারেজের মালিক গুল ব্যবহার করেন। এক চিমটি গুল নিয়ে বাম পাশের মাঁড়ির কাছে রাখলেন। তারপর রসালো মুখে বললেন, ‘কীয়ের রিকছা?’

‘একটু চালানোর জন্য আর কী।’

‘চালাইব কেডা?’

‘কেন, আমি!’

‘আপনে!’ আরেক চিমটি গুল মাঁড়ির কাছে রাখলেন গ্যারেজ মালিক। গুল লাগানো নখটা নিজের লুঙ্গির সঙ্গে সঙ্গে মুছতে মুছতে বললেন, ‘ছখ কইর‌্যা চালাইবেন, না অন্য কিছু?’

‘শখ বা অন্য কিছু না, সত্যি সত্যি একজন রিকশাওয়ালা হতে চাই আমি।’ সানাউল্লা মুনসী খুব স্পষ্ট স্বরে বললেন, ‘মাত্র এক দিনের জন্য।’

‘মাত্র এক দিনের জন্য! কারণডা কওয়া যাইব?’

‘না। এটা একান্তই ব্যক্তিগত।’ 

‘বেক্তিগত অইলে থাউক; কিন্তু এত চকচকা চেহারা নিয়া তো রিকছাওয়ালা হওন যাইব না।’ গ্যারেজ মালিক মুনসীর আপাদমস্তক দেখে সন্দেহের স্বরে বললেন, ‘আপনার পিন্দনের পোছাক-আছাকওতো মাছছাল্লা নয়া মনে অয়, ওগুলাও তো চকচক করতাছে।’

‘রিকশাওয়ালা হতে হলে আমাকে কী করতে হবে?’

‘চেহারা তো আর বদলানো যাইব না। একটা পুরাতন ধরনের লুঙ্গি আর ছেঁড়া-ফাটা একটা গেঞ্জি অইলে বালো অয়।’

বাসায় ফিরে এলেন মুনসী। পুরাতন একটা লুঙ্গি এবং একটা গেঞ্জি খুঁজে বের করলেন কাপড়-চোপড়ের মধ্যে থেকে। তারপর আবার গ্যারেজে গিয়ে রিকশা ভাড়া নিলেন একটা। কিন্তু রিকশা চালানো যে এতো কঠিন, জানা ছিল না তার। রিকশার হ্যান্ডেল সবসময় একদিকে কাত হয়ে যায়। ব্যালেন্স রাখা খুবই মুশকিল। 

দুই ঘণ্টা চেষ্টা করার পর কোনোরকম রিকশার চালানো শিখলেন তিনি। তারপর একটা ভাড়াও পেলেন; কিন্তু নির্দিষ্ট জায়গায় যাওয়ার পথে একটা ঢাল বেয়ে উঠতে নিয়েই তিনি বুঝতে পারলেন-কলজেটা আর বুকের ভেতর থাকতে চাচ্ছে না, জিভটাও বের হতে চাচ্ছে মুখের ভেতর থেকে। তাদের সঙ্গে চোখ দুটোও ঠিকরে বের হতে চাচ্ছে একটু পরপরই। খুব কষ্ট করে আরো একটু এগিয়ে নিয়ে যেতেই হ্যান্ডেলটা বাঁকা হয়ে গেল রিকশার। পাশে একটা গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেল সেটা। চালক এবং আরোহী দুজনই পড়ে গেলেন মাটিতে। কিন্তু আরোহী ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারলেন মুনসীর গালে। দু’চোখ বেয়ে পানি নেমে এলো তার। মাস তিনেক আগে ছোট্ট একটা কারণে এভাবে একটা থাপ্পড় মেরেছিলেন এক রিকশাওয়ালাকে, তার চোখে বেয়েও পানি ঝরেছিল এভাবে। 

রিকশাওয়ালা হওয়ার স্বপ্ন দেখার পর মুনসী আরেকটা স্বপ্ন দেখেন-ফকির হয়ে গেছেন তিনি। ভিক্ষা করার জন্য ভাঙা একটা থালা দরকার, টিনের থালা। নিদেনপক্ষে রঙ উঠে যাওয়া পুরাতন কোনো বাটি। আজকাল বাসায় কেউ টিনের থালা ব্যবহার করে না, তাছাড়া পুরাতন কোনো থালাও রাখা হয় না বাসাতে। অনেক চেষ্ট চরিত্র করে এক ফকিরের কাছ থেকে ভাঙা একটা থালা ভাড়া নিলেন মুনসী। ফার্মগেটের কাছে একটা রাস্তায় ভিক্ষাও করতে বসলেন। আধঘণ্টার মধ্যে বেশ কয়েকটা পাঁচ টাকার কয়েন পরল থালাতে, একজন অবশ্য বিশ টাকার একটা নোটও দিয়েছেন। হঠাৎ একটা পুলিশের গাড়ি এসে থামে তার সামনে। তিনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দু’জন পুলিশ এসে দু’হাত চেপে ধরে তার, টেনে গাড়িতে তোলে তাকে। কোন দেশের প্রেসিডেন্ট নাকি আসবে আজ ঢাকায়। ঢাকাকে তাই ভ্রাম্যমাণ ফকিরমুক্ত করার জন্য সব ফকিরকে ধরে গাজীপুরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিন দিন পর ছেড়ে দেওয়া হবে তাদের।

তিন দিন পর বাসায় ফিরে আসেন মুনসী। ততদিনে বাসায় হুলস্থূল কাণ্ড ঘটে গেছে। দেশের এমন কোনো হাসপাতাল, থানা নেই যে খোঁজ নেওয়া হয়নি তার। রেডিও টিভিতে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে, পেপারেও দেওযা হয়েছে, ফেসবুকেও প্রচার চালানো হয়েছে। সারাদেশে যত আত্মীয়-স্বজন ছিল, ফোনের পর ফোন করে খোঁজ নিয়েছে সবাই। ফকির সাজা এবং পুলিশকর্তৃক ধরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা যখন জানাজানি হয়ে গেল, প্রথম ক্ষতিটা হলো মুনসীরই, দ্বিতীয়টাও তার। খুব চমৎকার একটা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল, কয় দিন পর বিয়ে। ভেঙে গিয়েছিল বিয়েটা। দ্বিতীয়টা হচ্ছে, সবাই মিলে জোর করে তাকে দেশের বিশিষ্ট মানসিক রোগের ডাক্তার মোহিত কামালের কাছে নিয়ে গেলেন। 

এবার চোখ ফেটে পানি এসে গেল মুনসীর। শেষ পর্যন্ত সবাই মিলে মানসিক রোগী বানিয়ে ফেলল তাকে! বেশ কয়েক দিন একটা ফকির বাসার গেটের সামনে এসে ঘ্যানর ঘ্যানর করত। ভিক্ষা না দেওয়া পর্যন্ত চিৎকার করতেই থাকত। কয়দিন আগে তার পুলিশ বন্ধুকে ব্যাপারটা বলায় ধরে নিয়ে গিয়েছিল ওই বুড়ো ফকিরটাকে।

ডাক্তার মোহিত বললেন, ‘সমস্যা কি আপনার?’

মুনসী কিছুটা রাগত স্বরে বলল, ‘কোনো সমস্যা নেই আমার।’

‘সমস্যা নেই আপনার? তাহলে একবার রিকশা চালাচ্ছেন, একবার ভিক্ষা করছেন-ব্যাপারটা কী?’

‘কোনো ব্যাপার-ট্যাপার নেই। আমার যখন যেটা ইচ্ছে করে, সেটাই করি আমি।’ ধীরে ধীরে আরো রেগে যাচ্ছেন মুনসী।

‘আর কী কী ইচ্ছে করে আপনার।’

‘অনেক ইচ্ছে করে। এই মুহূর্তে তিন গ্লাস ড্রেনের পানি খেতে ইচ্ছে করছে একসঙ্গে।’

ডাক্তার মোহিত কামাল আরো কয়েকটা প্রশ্ন করলেন মুনসীকে। তারপর কয়েকটা ওষুধ লিখে দিলেন তাকে। মুনসীর বড় মামা কঠিন কড়া মানুষ। তাকে দেখে সবাই যমের মতো ভয় পায়। মুনসীকে ডাক্তারের কাছে তিনি নিয়ে এসেছেন। প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে নিজের বাসায় নিয়ে গেলেন তিনি ভাগিনাকে।

মামার বাসায় মুনসীর কোনো কাজ নেই। খাবার খাও, ওষুধ খাও আর ঘুমাও। কাউকে না বলে বের হওয়া যাবে না বাসা থেকে। মামার ভয়ে মুনসী বেরও হন না। এরই মধ্যে সুয়োগ পেয়ে একটা গ্লাস নিয়ে বাসার বাইরে গিয়েছিলেন তিনি। বাসার সামনের ড্রেন থেকে তিন গ্লাস পানি খেয়ে বাসায় ফিরে এসেছিলেন দ্রুত। পরের দিন থেকেই পেটে আর কিছু রাখতে পারেন না মুনসী। যা খান তা-ই তরল হয়ে বের হয়ে আসে পেট থেকে। মামা ফোন করলেন ডাক্তার মোহিতকে, ‘স্যার, আপনি যে ওষুধগুলো আমার ভাগিনাকে দিয়েছেন, তার কি কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে?’

‘না তো!’ চেয়ারে হেলান দিয়ে ছিলেন ডাক্তার মোহিত। সোজা হলেন তিনি, ‘কেন, কোনো অসুবিধা হচ্ছে নাকি আপনার ভাগিনার?’ 

বিস্তারিত খুলে বললেন মামা। ডাক্তার মোহিত আবার চেম্বারে আনতে বললেন তাকে। মুনসীকে দেখে ডাক্তার বললেন, ‘ড্রেনের তিন গ্লাস পানি খেতে ইচ্ছে করেছিল আপনার, আপনি তাই খেয়েছেন। না?’

মুনসী কিছু বললেন না। তাদের কাজের বুয়ার দুই বছরের একটা বাচ্চা আছে। একদিন পানির ফিল্টার থেকে বাচ্চাকে পানি খাওয়াচ্ছিল বুয়া। রাগ করে তিনি বলেছিলেন, ফিল্টার থেকে খাওয়াতে হবে কেন, সরাসরি ট্যাপের পানি খাওয়ালে কি হয়? বুয়া তার বাচ্চাকে তাই খাইয়েছিল। পরের দিন থেকে বাচ্চাটা ডায়রিয়ায় মরতে বসেছিল প্রায়।

ডাক্তার মোহিত ওষুধ পাল্টে নতুন ওষুধ দিলেন। গত বিশ দিন ধরে সেগুলোই খাচ্ছেন মুনসী। গত কয়েক দিন ধরে বেশ শীত পড়েছে। মাঝরাতে আজ রাস্তায় বের হয়ে দেখেন, ফুটপাতে অনেক মানুষ বসে আছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বসে আছে কেন তারা? তারা বললেন, তাদের তেমন কোনো শীতের কাপড় নেই। ঘুমালে শীত আরো বেশি লাগে বলে তারা ঘুমাচ্ছেন না। মনটা খারাপ হয়ে গলে মুনসীর। প্রচণ্ড শীতে তারা ঘুমাতে পারছেন না, কোনো শীতের কাপড় নেই তাদের! অথচ তার তিনটা মোটা উলের সোয়েটার, দুইটা চামড়ার জ্যাকেট, ফুল হাতা মোটা গেঞ্জি আছে ছয়-সাতটা। কম্বল, লেপ, যেটা ভালো লাগে সেটাই গায়ে দিতে পারেন যখন তখন! অপরাধবোধে বিষণ্ণ হয়ে যান তিনি।

বাসায় ফিরে ঘুমাতে যান মুনসী। অপরাধবোধটা রয়েই গেছে, এবং সেই বোধ নিয়ে ঘুমানোর পরই ন্যাংটো হওয়ার স্বপ্নটা দেখলেন তিনি। যারা এত কাপড়-চোপর ঘরে রেখে বিলাসিতা করে, তাদের অন্তত একদিন, স্রেফ একদিন গায়ে কোনো কাপড় না রেখে, পরিপূর্ণ ন্যাংটো হয়ে, কনকনে শীতের রাতে কিংবা দিনে, উদাম দেহে রাস্তায় হাঁটা উচিত। এটা তাদের জন্য একটা শাস্তি, অন্যের ব্যথা অনুধাবন করার একটা প্রক্রিয়া।

কিন্তু মুনসীর নতুন স্বপ্নের ব্যাপারটা কেমন করে যেন টের পেয়ে যায় সবাই। মামাকে জানানো হয় সেটা। মামা আবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। অন্যরকম একটা ওষুধ দেন এবার ডাক্তার মোহিত কামাল। সেই ওষুধের কার্যকারিতায় স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়ে যায় সানাউল্লা মুনসীর। মরার মতো তিনি এখন ঘুমান, কখনো-সখনো এপাশ ওপাশ হন দু-একবার, তার পর ভোর হয়ে যায়, বেলা বয়ে যায়, দিন কেটে যায়, রাত চলে আসে। আবার ঘুম, স্বপ্নহীন ঘুম, আবার ভোর, দিন, রাত...।

মুনসী একদিন টের পান-তিনি এবার সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাচ্ছেন। স্বপ্ন না দেখতে পারার যন্ত্রণায় ছটফট করছেন; প্রতিদিন যে কমবেশি ভুল কাজ করছেন, অন্যায় করছেন, তার প্রায়চিত্ত না করতে পারার অনুশোচনায় পাগল হয়ে যাচ্ছেন। 

রাতে এখন আর ঘুমান না সানাউল্লা মুনসী। জানালা দিয়ে তাকিয়ে আকাশের তারা গোনার চেষ্টা করেন, হাত বাড়িয়ে চাঁদ ছোঁয়ার চেষ্টা করেন, কিংবা অন্ধকারের মাঝে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করেন। কিন্তু কী খোঁজেন মুনসী, তা তিনি নিজেই জানেন না। কখনো কখনো ছাদে গিয়ে হাত উঁচিয়ে আকাশ ধরতে চান, মেঘের কাঁধে ভর করে চলে যেতে চান দূর কোনো অজানার দেশে।

চুপিচুপি একা একাই একদিন ডাক্তার মোহিতের চেম্বারে চলে যান সানাউল্লা মুন্সী। রুমের সামনের হলুদ, নীল, কমলা রঙের প্লাস্টিকের চেয়ারগুলোর একটাতে বসে থাকেন চুপচাপ। ডাক্তারের রুমে রোগীর যাওয়া দেখেন, বের হওয়া দেখেন, আশা আর আশাহত মুখগুলো দেখেন। এক সময় সব রোগী চলে যায়, ঠিক তখনই মুনসী মনে করেন-এবার তার একটু যাওয়া দরকার। ধীরে ধীরে এক সময় তিনি যানও। ডাক্তার মোহিত বাসায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন; কিন্তু মুনসীকে দেখেই মুখটা হাসি হাসি করে বললেন, ‘আরে, মুনসী যে! কখন এলেন?’

‘অনেকক্ষণ।’ 

‘বসুন।’ মুনসী বসতেই ডাক্তার মোহিত বললেন, ‘তা কোনো সমস্যা?’

‘জি।’

‘কী সমস্যা, বলুন।’

‘আমি সত্যি সত্যি স্বপ্ন দেখা ভুলে গেছি।’

‘তাতে সমস্যা কী?’

‘যারা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে, তারা সেটা দেখা ভুলে গেলে, তারা আর তখন মানুষ থাকে না। মৃত মানুষ হয়ে যায়। মৃত মানুষের কোনো বোধ থাকে না, অনুশোচনা থাকে না, প্রায়শ্চিত্ত থাকে না, আশা থাকে না, স্বপ্ন থাকে না। এ সব না থাকার কষ্টে টিকটিকির খসে পড়া লেজের মতো তাদের আত্মা তরপায়, দুঃসহ একটা আতঙ্কে বুকের ভেতরটা কুকড়ে যায়। তখন কেবল নিজেকে নয়, সবকিছু মনে হয় মৃত; গাছ-পালা, আকাশ, মেঘ, চাঁদ-তারা-সব মৃত। মনে হয় মৃত পৃথিবী!’ মুনসী উঠে দাঁড়ান, ‘কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি আমি। দেখেছি, আমি একটা মানুষকে খুন করছি, যে আমার স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দিয়েছে, তাকে খুন করছি।’ ঝট করে পকেট থেকে একটা ছুরি বের করলেন মুনসী। বাটনে টিপ দিতেই খটাস করে লম্বা হয়ে গেল ছুরিটা, ‘আমি আবার স্বপ্ন দেখতে চাই, ডাক্তার মোহিত।’ 

চেম্বারে ঢোকার পর এই প্রথম মুনসী হাসলেন। ঘোলাটে চোখে ডাক্তার মোহিত দেখলেন, সেই হাসি হাসি মুখ নিয়েই তার দিকে এগিয়ে আসছেন সানাউল্লা মুনসী, যার ডান হাতে চকচকে একটা ছুরি, ছুরিটা বেশ লম্বা!

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫