
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ও ফিদেল ক্যাস্ত্রো
তিনি একাধারে একজন বীর যোদ্ধা, অকুতোভয় শিকারি, অদম্য অভিযাত্রিক আর এর সবকিছু ছাপিয়ে একজন অসামান্য গল্পকার। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম এই কথাসাহিত্যিক কাটিয়েছেন বিতর্কে ভরপুর বর্ণাঢ্য এক জীবন।
জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে ঠিকরে ঠিকরে বের হওয়া পুরুষত্বে বলীয়ান এই সুপুরুষকে জন্মের পরের প্রথম কয়েকটা বছর তার মা তাকে মেয়েদের মতো সাজাতেন, মেয়েদের কাপড়চোপড় পরাতেন। তিনি বাবা (পাপা) হেমিংওয়ে নামে ব্যাপক পরিচিত ছিলেন, অথচ তার নিজের তিন পুত্রের সঙ্গে তার তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। ভুবনজোড়া যশ-খ্যাতির শীর্ষে থাকাকালেই তীব্র বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়ে নিজের থুতনিতে রাইফেল ঠেকিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন। অত্যন্ত জটিল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব আর্নেস্ট হেমিংওয়ের জীবনের কিছু দিক নিয়ে আজকের এই আয়োজন।
এড ও গ্রেস হেমিংওয়ে দম্পতির ঘরে ১৮৯৯ সালের প্রথম জুলাই আর্নেস্ট মিলার হেমিংওয়ের জন্ম হয়। এড পেশায় ছিলেন একজন চিকিৎসক এবং গ্রেস ছিলেন একজন অপেরা শিল্পী। দৃষ্টিজনিত বিভ্রাটের জন্য গ্রেসকে সংগীত জীবনকে ছাড়তে হয়। একজন তারকা শিল্পী হতে না পারার আক্ষেপ তাকে তাড়া করে বেড়ায়, যার ছাপ তার সন্তানদের প্রতিপালনে নানাভাবে দাগ কাটতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ গ্রেসের যমজ মেয়ের শখ ছিল, তার শখ পূরণের জন্য জীবনের প্রথম ছয় বছর বড় বোন মার্সেলিনের সঙ্গে মিল রেখে আর্নেস্টকে পোশাকে, বেশভূষায় মেয়ে সাজিয়ে রাখা হয়। স্ত্রীর এই কাণ্ডের হাত থেকে ছেলেকে রক্ষা করতে এড বছরে দুই মাস মিশিগান হ্রদের তীর ধরে ছেলেকে নিয়ে ক্যাম্পিং করতে যেতেন। সেখানে আর্নেস্টকে ছেলেদের পোশাক পরতে দেওয়া হতো, শিকার ও মাছ ধরার অনেক খুঁটিনাটি বিদ্যা তিনি সেসব ক্যাম্পিং থেকে রপ্ত করেন।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তার স্মৃতিচারণে তার বাবাকে কাঠখোট্টা আর নিষ্ঠুররূপে চিত্রিত করেছেন। ছেলেপেলেরা কোনো ভুলচুক করলে এড তাদের সঙ্গে অত্যন্ত রূঢ় আচরণ করতেন। এমনকি কখনো কখনো শক্ত দড়ি দিয়ে তাদের বেঁধে ঈশ্বরের কাছে তাদের ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধ্য করতেন। বালক আর্নেস্ট তার বাবার প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে বড় হয়েছেন। তিনি কখনো কখনো ভাঁড়ার ঘরে গিয়ে তার বাবার রাইফেল বুকে ঠেকিয়ে তার বাবার পিঠের দিকে তাক করতেন। বাবাকে তার গুলি করে মেরে ফেলতে ইচ্ছা করত। শেষ পর্যন্ত নিজেকে সংবরণ করে ফেলতে পারতেন।
হাইস্কুলে হেমিংওয়ে সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। অসম্ভব উদ্দীপনার সঙ্গে তিনি সব খেলাধুলায় নাম লেখাতেন, যা তাকে তার সহপাঠীদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় করে তোলে।
স্কুলে তার ইংরেজি শিক্ষক সর্বপ্রথম তার লেখনী প্রতিভাকে লক্ষ করেন। তিনি আর্নেস্টকে স্কুলের ম্যাগাজিনে লেখার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন এবং আর্নেস্ট স্কুলের লেখক দলের একজন পদ লাভ করেন। সেখানেই তার প্রথম গল্প জাজমেন্ট অ্যাট ম্যানিটাও প্রকাশিত হয়, যার রেশ বাকি জীবনের গতিপথ নির্মাণ করে। গল্পটা ছিল শিকারির, আত্মহত্যা করে যার জীবনাবসান ঘটে। খুব আশ্চর্যজনকভাবে আর্নেস্ট হেমিংওয়েও তার বর্ণাঢ্য শিকারি জীবনের মাঝখানে একদিন আত্মহত্যা করে মরে গেলেন। গল্পের সঙ্গে মিলে গেল গল্পকারের জীবন, এ যেন বিধাতার হাত থেকে কলম নিয়ে নিজের নিয়তি লেখা, যেন আপনারে ছাড়া করে নাই কাহারে কুর্নিশ!
স্কুলের ম্যাগাজিনে জাজমেন্ট অ্যাট ম্যানিটাও প্রকাশিত হলে বিভিন্ন মহলে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সাংবাদিকতা পেশায় জড়িয়ে যান; কিন্তু এতে বাদ সাধেন তার চিকিৎসক বাবা, তিনি চেয়েছিলেন ছেলেও চিকিৎসক হয়ে জীবে দয়া করে ঈশ্বরের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেবে; কিন্তু হেমিংওয়ে ধরলেন শব্দ, গল্প, উত্তেজনা আর প্রচ্ছন্নতার একটা অনিশ্চিত গন্তব্যের রোমাঞ্চকর পথ। শুরুটা হলো কানসাস সিটি স্টার পত্রিকায়। ১৭ বছরের বয়সের তরুণ মেতে গেলেন ক্রাইম বিটের রিপোর্ট অন্বেষণে। প্রথম কাজ ছিল স্টার পত্রিকার স্টাইলবুকটি ভালোভাবে রপ্ত করা। সংক্ষিপ্ত আকারের গদ্যরীতি, ছোট ছোট বাক্যের ব্যবহার, সহজ শব্দচয়নে ভূমিকা লেখা। পরবর্তীকালে স্মৃতিচারণে হেমিংওয়ে এই বিদ্যা অর্জনকে বলেছেন লেখক জীবনের শ্রেষ্ঠ অনুশীলন।
১৯১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ হেমিংওয়ের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সমস্ত মার্কিন মুল্লুকের তরুণদের হৃদয় জুড়ে স্বদেশি আবেগের জোয়ার বয়ে যাচ্ছিল। আর রোমাঞ্চের নেশায় আতুর উৎসাহ উদ্দীপনায় টইটম্বুর হেমিংওয়ের জন্য যুদ্ধ এলো সেরের উপর সোয়া সের হয়ে। দেশমাতৃকার তরে যেমন করেই হোক এগিয়ে যেতে হবে যুদ্ধে; কিন্তু দৃষ্টি বিভ্রাটের দরুন তিনি বাদ পড়েন। তবু দমবার পাত্র নন হেমিংওয়ে, রেডক্রসের অ্যাম্বুলেন্সে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আবেদন করলেন ফের। যেন উত্তেজনার মধ্যে তাকে থাকতেই হবে যেমন করেই হোক।
তিনি নির্বাচিত হলেন যুদ্ধের ইতালি অংশে। বালক হেমিংওয়ে ইতালি এসে প্রথম বুঝতে পারলেন পৌরুষের অবাধ অগাধ স্বাধীনতা। পুরুষদের মধ্যের বন্ধুত্ব, ঘণ্টার পর ঘণ্টা জুয়ার টেবিলে আড্ডা, কোনো জবাবদিহি নেই, নেই কোনো বাধা-অনুশাসন। হেমিংওয়ে তো ঠিক এমনটাই চেয়েছিলেন সব সময়। তবে তার সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল যুদ্ধে; কিন্তু তার দায়িত্ব ছিল সম্মুখ সমর থেকে অনেক পেছনে। যে যুদ্ধের উত্তেজনা অবলোকন করতে তিনি আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ইউরোপ আসলেন, অথচ এখানে তার বসে থেকে হাসি আনন্দে দিন কাটাতে হচ্ছে। তাই একসময় প্রাত্যহিক কাজ তার কাছে একঘেয়েমিপূর্ণ আর বিরক্তিকর লাগতে শুরু হলো। তিনি এক বন্ধুকে চিঠিতে লিখলেন, ‘আমি বিরক্ত। শুধু প্রাকৃতিক দৃশ্য, আর কিস্যু নেই। আমি এই অ্যাম্বুলেন্সের চাকরি ছেড়ে দেব। আমি এখানে কোনো যুদ্ধ দেখতে পাচ্ছি না।’
তবে যুদ্ধ আসা বাকি রইল না। পিয়েভ নদীর তীরে ইতালীয় শিবিরে ১৯১৮ সালের ৮ জুলাই সৈনিকদের মাঝে চকোলেট আর সিগারেট রেশন বিতরণ করছিলেন হেমিংওয়ে। অতর্কিতে হামলা চালাল জার্মান বাহিনী। তিনি আক্রমণের মধ্যে পড়ে গেলেন। একটা বিস্ফোরণ ঘটল, তিনি মাটিতে ছিটকে পড়লেন। তার পাশের সৈন্যটি মারা গেল, হেমিংওয়ে পায়ে আঘাত নিয়ে কোনোরকমে পালাতে সক্ষম হলেন। আসার সময় একজন আহত সৈন্যকে পিঠে এনে প্রাণ বাঁচান।
তাকে ভর্তি করানো হলো মিলানের রেডক্রস হাসপাতালে। যুদ্ধ দেখার জন্য মুখিয়ে থাকা তরুণের কাছে বোমার আঘাত, গোলাগুলি আর যুদ্ধের সাক্ষাৎ তো হলোই তার সঙ্গে আরো এলো প্রেম, উথাল-পাতাল প্রথম প্রেম। বোমার আঘাত থেকে কোনোরকম প্রাণে বেঁচে গেলেও হাসপাতালে আমেরিকান স্বেচ্ছাসেবী নার্স আগনেস ভন কুরস্কির প্রেমে ঝাঁজরা হয়ে গেলেন তরুণ আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার আগের কয়েক মাস আগনেস আর আর্নেস্ট মিলে মিলানের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ালেন। তার থেকে সাত বছরের বড় আগনেসের ঘন চুলের অরণ্যে হেমিংওয়ে আপাদমস্তক হারিয়ে গেলেন। যদিও আগনেস তাকে যুদ্ধ শেষে বিয়ে করার কথা দিয়েছিলেন; কিন্তু বালকসুলভ ছেলেমানুষিতে ভরসা করতে পারছিলেন না।
১৯১৮ সালের ক্রিসমাসের ছুটিতে হেমিংওয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে আমেরিকায় ফিরলেন পরিবারের কাছে। দেশে ফিরে যুদ্ধ ফেরত বীর হিসেবে তিনি বেশ প্রশংসিত হলেন; কিন্তু তার এ আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হলো না। তার প্রেমকে প্রত্যাখ্যান করে আগনেস তাকে একটি চিঠি লিখলেন, ‘আমি এখন এবং সবসময়ই তোমার থেকে বড় থাকব, এবং এটাই সত্য। আমি কোনোভাবেই মাথা থেকে বের করতে পারছি না যে তুমি ছেলেমানুষ, একটা বাচ্চা ছেলে।’
এই চিঠি হেমিংওয়ের সব কিছু এলোমেলো করে দিল। মাসের পর মাস নিজেকে ঘরের মধ্যে স্বেচ্ছাবন্দি করে রাখলেন। এক পর্যায়ে তার মা গ্রেস ছেলের উপর বিরক্ত হয়ে কড়া গলায় ছেলেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে বললেন। তারপর আর্নেস্ট শিকাগোতে পাড়ি জমান। সেখানে টরন্টো স্টার পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখেন এবং ছোটখাটো খুচরা কাজ করে নিজের মতো জীবন ধারণ করতে থাকেন।
একসময় নিস্তরঙ্গ জীবনে আবার এলো উদ্দীপনা। একদিন এক পার্টিতে হেডলি রিচার্ডসন নামের এক যুবতীর সঙ্গে তার আলাপ হয়। হেডলি ছিল তার চেয়ে আট বছরের বড়। সেন্ট লুইস নামের এক মফস্বলে মায়ের কড়া শাসনের বাইরে একটু মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিতে হেডলি শিকাগোর মতো মহানগরে আসেন। পরিচয়ের কিছুদিনের মধ্যেই তাদের মধ্যে গাঢ় প্রণয়ের সৃষ্টি হয়। নয় মাস পর তারা দম্পতি হিসেবে গাঁট বাঁধেন।
বিয়ের আসরে অতিথি হিসেবে আসা একজন লেখক ও হেমিংওয়ের বন্ধু স্রেউড এন্ডারসন এই নতুন দম্পতিকে প্যারিসে তাদের নতুন জীবন শুরু করতে পরামর্শ দেন। এন্ডারসন তার প্যারিসের শিল্পী লেখক বন্ধুদের সঙ্গে হেমিংওয়ের যোগাযোগ ঘটিয়ে দেন। টরন্টো স্টারের বিদেশি প্রতিনিধি হিসেবে অনতিকাল পরেই আর্নেস্ট-হেডলি দম্পতি প্যারিসে পাড়ি জমান। খুব দ্রুত হেমিংওয়ে প্যারিসের শিল্পী-বুদ্ধিজীবী সমাজে নিজের জায়গা করে নেন।
এই দম্পতি প্যারিসের ছোট একটা অ্যাপার্টমেন্টে তাদের সংসার শুরু করেন। এর পাশাপাশি নিরিবিলি লেখালেখির জন্য হেমিংওয়ে শ্যাবি হোটেলের সবার উপরের তলায় একটা রুম ভাড়া নেন। প্রতিদিন সকালে তিনি এখানে লেখার জন্য একাগ্রচিত্তে মনোনিবেশ করতেন। তিনি বলেছেন, শুরু করার মতো একটা ঠিকঠাক লাইন লিখে ফেলতে পারাটাই ছিল সবচেয়ে দুরূহ কাজ। তার কাছে লেখা বলতে ছিল দেখা, তারিয়ে তারিয়ে আস্বাদন করতে থাকা। যার থেকে একসময় আপনা-আপনি লেখার জন্ম হয়। তিনি প্যারিসের ক্যাফেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষদের দেখতেন, অচেনা অজানা মানুষদের সঙ্গে প্রাণ খুলে আড্ডা মারতেন, লেখক বন্ধুদের সঙ্গে চলত চুটিয়ে মদ্যপান।
প্যারিসে থাকাকালে হেমিংওয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার গেরট্রুড স্টেইনের সাহচর্যে আসেন। গল্প বিনির্মাণের নানা খুঁটিনাটি ও কৌশল নিয়ে তিনি হেমিংওয়েকে বিভিন্ন পরামর্শ দেন। তার অভিজ্ঞ মননপ্রসূত সেসব দিকনির্দেশনা হেমিংওয়ের লেখনী প্রতিভায় এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে।
১৯২৩ সালে হেমিংওয়ে স্পেনে বেড়াতে যান। স্পেনের ভাষা, সংস্কৃতি ও মানুষদের তীব্র অনুরাগ নিয়ে ফিরে আসেন। সেখানে গিয়ে ষাঁড়ের লড়াইয়ের প্রতি তার প্রবল আসক্তি তৈরি হয়। প্লামপোনাতে তিনি তার ছয় মাসের প্রসূতি স্ত্রীকে নিয়ে তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ ষাঁড়ের লড়াই দেখতে যান। দর্শক সারিতে তার স্ত্রী যখন ভয়ে কাতর হয়ে মুখ লুকাচ্ছিল, তখন হেমিংওয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দানবীয় আকারের ষাঁড়ের ছুটে যাওয়া দেখছেন অপলক দৃষ্টিতে। এই নেশার টানে পরের বছরও হেমিংওয়ে এক ঝাঁক লেখক বন্ধু নিয়ে ষাঁড় দৌড় উপভোগ করতে প্লামপোনাতে ছুটে যান।
এই ভ্রমণ তার প্রথম উপন্যাস দ্য সান আলসো রাইজেসের প্রেক্ষাপট বিনির্মাণ করে। যা ১৯২৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হলে পাঠক সমালোচকদের মন জয় করে ফেলে। খ্যাতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যক্তিগত জীবনে অনিয়ম আর বিশৃঙ্খলা বাড়তে থাকে। লেখক বন্ধুদের সঙ্গে প্রায়শ শিষ্যের মতো আচরণ করতেন, তিনি নিজে সবার গুরু সাজার চেষ্টা করতেন। যা অনেককেই রুষ্ট করত, কখনো কখনো বিবাদ হাতাহাতিতে রূপ নিত। সংসার জীবনও অবনতির দিকে যেতে থাকে। পলিন পাইফার নামের তার এক বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে তার তীব্র প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। হেডলি চরমভাবে প্রতারিত ও অপমানিত বোধ করে আর্নেস্টকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য একশ দিনের সময় বেঁধে দেন। আর্নেস্ট তার স্ত্রী ও ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে কেতাদুরস্ত- আধুনিক পলিনকে গ্রহণ করেন।
পলিনকে বিয়ে করে প্যারিস ছেড়ে ফ্লোরিডার কি ওয়েস্ট দ্বীপে চলে আসেন। এখানে তিনি গভীর সমুদ্রের মৎস্য শিকারের প্রতি গভীর আকর্ষণ অনুভব করেন। প্যারিসের নিপাট ভদ্দরলোক বুদ্ধিজীবী সমাজ পেছনে ফেলে একদল পাঁড় মাতাল, গতর খাটা জেলের সঙ্গে তিনি নতুন করে জীবনের নতুন বন্দর খুঁজে পেলেন।
দিনের বেলায় সাগরের মাছ তাড়া করে আর রাতে সাঙ্গোপাঙ্গদের সঙ্গে কিউবার মদের বোতল চোরাকারবার করতে করতে চলতে থাকল জেলে জীবন। সঙ্গে সঙ্গে চলল পরবর্তী উনস্যাস ফেয়ারওয়েল টু দ্য আর্মসের কাজ। আর্নেস্ট নিজেই নিজের নৌকা বানালেন, ধীরে ধীরে এক সময় হয়ে উঠলেন ভুবন বিখ্যাত সামুদ্রিক মৎস্য শিকারি। তিনি আটলান্টিকের প্রায় প্রতিটি মৎস্য শিকার প্রতিযোগিতায় জিততে থাকলেন; কিন্তু এই সব কিছু ছাপিয়ে গল্প লেখা রইল তার আরাধনার সবচেয়ে বেশি জায়গা জুড়ে। প্রতিদিন ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠে দুপুর পর্যন্ত একান্ত মনে নিমগ্ন হয়ে থাকতেন তার টাইপ রাইটারের মধ্যে। দিনের বাকি সময় কাটত হৈ-হুল্লোড় আর হাড় ভাঙা খাটুনির মধ্য দিয়ে। কি ওয়েস্টের বছরগুলোতে আর্নেস্ট আর পলিনের সংসারে দুটো সন্তানের জন্ম হয়।
১৯৩৩ সালে তার জন্য অ্যাডভেঞ্চারের নতুন দুয়ার খুলে যায়। তিনি আফ্রিকায় শিকারের ভ্রমণে যান, গিয়ে আফ্রিকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের তীব্র প্রেমে পড়েন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশপাশি তিনি ভয়াবহ রকমের আমাশয়ে আক্রান্ত হন। তাকে বিমানে করে নাইরোবির হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রায় মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যাওয়া হেমিংওয়ে বিমানের জানালায় তুষারশুভ্র গা দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান। যা তাকে তার সবচেয়ে বিখ্যাত ছোট গল্প দ্য স্নোজ অব কিলিমানজারো লিখতে অনুপ্রাণিত করে।
সুস্থ হয়ে হেমিংওয়ে আবার শিকারে ফিরে যান। তিনি একে একে মোষ, এন্টিলোপ ও সিংহ শিকার করেন। এই অভিজ্ঞতাসমূহ তার পরবর্তী সময়ের লেখনীতে ফুটে উঠেছে। তিরিশের বছরগুলোতে হেমিংওয়ে কিউবার হাভানায় থাকা এক আমেরিকান নারীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যান। সে সময়ে তিনি প্রায়শই কিউবা যেতে থাকেন। তখন তার স্ত্রী পলিন বাচ্চাদের সামলাতে হিমশিম খান।
১৯৩৬ সালে মার্থা গ্যালহর্ন নামের এক লেখিকা-সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে যান। মার্থা আর আর্নেস্টের সাংবাদিকতা ও গল্প লেখার প্রতি ছিল একই রকম অনুরাগ। ১৯৩৭ সালে তারা একই সঙ্গে স্পেনের গৃহযুদ্ধের সংবাদ কাভার করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। হেমিংওয়ে আমেরিকান পত্রিকা অ্যালায়েন্সের প্রতিনিধি হিসেবে স্পেনে গিয়ে পৌঁছান। কিছুদিন পর তিনি দ্য স্প্যানিশ আর্থ নামের একটা ডাচ সিনেমা প্রোডাকশনের সঙ্গে যুক্ত হন। মাঝখানে চিত্রনাট্যকার এই প্রোডাকশন থেকে সরে গেলে হেমিংওয়ে নিজ দায়িত্বে চিত্রনাট্যের কাজ শেষ করেন। কিছুদিন পর হেমিংওয়ে আমেরিকায় ফিরে আসেন। তিনি হলিউডে সিনেমাটি দেখিয়ে স্প্যানিশ রিপাবলিকানদের জন্য ২০ হাজার ডলার অনুদান সংগ্রহ করেন। গৃহযুদ্ধের উপর ভিত্তি করে লেখা তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘ফর হুম দ্য বেল টোলসে’ স্পেনে থাকা দিনগুলোর অভিজ্ঞতা ফুটে উঠছে। সে সময়টায় মার্থার সঙ্গে তার প্রবল প্রেম চলতে থাকে। কিছুদিন পর তিনি মার্থাকে বিয়ে করার জন্য দুই সন্তানসহ পলিনকে তালাক দিয়ে দেন।
১৯৩৯ সালে মার্থাকে বিয়ে করার পর তিনি কিউবায় চলে যান। হাভানার উপকণ্ঠে বেশ দৃষ্টিনন্দন একটি ভিলা কিনে সেখানে বাস করা শুরু করেন। সেখানে এই দম্পতি দিনের সময়টায় লেখালেখিতে মেতে থাকতেন, আর রাতের বেলা হাভানার দারুণ সৌন্দর্য উপভোগ করে বেড়াতেন। হেমিংওয়ে পুরোদমে গভীর সাগরে তার মৎস্য শিকার চালিয়ে যেতে লাগলেন। কিছুদিনের মধ্যেই হেমিংওয়ের পরিচয় ঘটে বৃদ্ধ কিউবান জেলে গ্রেগরিও ফুয়েন্টসের সঙ্গে। একসঙ্গে মাছ শিকার করতে করতে তাদের বন্ধুত্ব জমে যায়। গ্রেগরিওকে দেখে তিনি সৃষ্টি করলেন তার সান্টিয়াগো চরিত্রটি। আর সান্টিয়াগোকে দিয়ে বুনলেন তার বিখ্যাত উপন্যাস দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি। এই অমর সৃষ্টির জন্য তিনি পরবর্তীকালে পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন। তখন তার খ্যাতি গগনচুম্বী। দেখতে দেখতে শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ইউরোপ থেকে অনেক দূর হাভানায়ও সেই যুদ্ধের উত্তেজনা গিয়ে ঠেকল। মার্থার কাছে সংসারের চাইতেও পেশা বেশি গুরুত্ব পেল। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের বিশেষ সংবাদ প্রতিনিধি হিসেবে ইউরোপ চলে গেলেন। যা হেমিংওয়েকে যারপরনাই রুষ্ট করল। এর মধ্যে মার্থা রাজনৈতিকভাবে মিত্র বাহিনীর পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলতে লাগলেন। কিছুদিন পর হেমিংওয়েও কলিয়ার ম্যাগাজিনের বিশেষ যুদ্ধ প্রতিনিধি হিসেবে লন্ডনে গেলেন। অসম্ভব সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে শেষ দিন পর্যন্ত খবর সংগ্রহ করে যেতে লাগলেন। তার এই সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি পরবর্তী সময় মার্কিন সরকারের ব্রোঞ্জ স্টার পদক লাভ করেন।
যুদ্ধ শেষে হেমিংওয়ে আর মার্থার সম্পর্ক বিচ্ছেদ ঘটে। তবে তত দিনে বাবা নতুন প্রেয়সীর সন্ধান পেয়ে গেছেন। ম্যারি ওয়েলশ নামের তারই আরেক সহকর্মী। জীবনের বাকি দিনগুলোতে ম্যারি তার পাশে ছিলেন। চল্লিশের শেষের দিককার বছরগুলোতে হেমিংওয়ের মদ্যপান অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। তার লেখার মান নামতে থাকে, সব দিক থেকে হতাশা তাকে গ্রাস করে। ইতালিতে বেড়াতে গিয়ে সেখানে এক বিশ বছর বয়সের তরুণীর সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করেন। সেখান থেকে ফেরার পর তার উপন্যাস ‘অ্যাক্রস দ্য রিভার অ্যান্ড ইন্টু দ্য ট্রিস’ প্রকাশিত হয়। যার লেখার মান নিয়ে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক কাঠখোট্টা সমালোচনা শুরু হয়। সবাই কানাঘুষা করতে থাকে, এই বুঝি হেমিংওয়ের ক্যারিয়ারের নৌকা ডুবল বলে। বইটাকে প্রত্যাখ্যান করে সবাই বলতে লাগল বুড়ো তার শব্দের জাদু হারিয়েছে; কিন্তু আর্নেস্ট হেমিংওয়ে নামের বুনো ষাঁড়ের সামনে এ যেন লাল কাপড় ধরে দোলানোর মতো। পরবর্তী আট সপ্তাহে একটানা লিখে তিনি তার পরবর্তী উপন্যাস শেষ করেন। বইয়ের নাম ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’। যা এক সময় হয়ে উঠল তার নামের সমার্থক। সব সমালোচকের মুখে এক ঘা মেরে কুপোকাত করে দিয়ে তিনি আবার তার অবস্থান ফিরিয়ে নেন। এই বইয়ের জন্য তিনি ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে তার ছোট বিমানে করে আফ্রিকায় অভিযানে যান। বনের মধ্যে তার বিমান আকাশ থেকে পড়ে যেতে থাকে। তিনি সবার জীবন রক্ষা করতে গিয়ে মাথায় স্থায়ী আঘাত নিয়ে বাড়ি ফেরেন।
১৯৬০-এর জুলাই মাসে কিউবায় বিপ্লব দানা বাঁধতে থাকে। হেমিংওয়ে কিউবা ছেড়ে আমেরিকার কেচহামে ফিরে আসেন। তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্রমাগত অবনতি ঘটতে থাকে। তার বিষণ্ণতার তীব্রতা বেড়ে গেলে তাকে মায়ো ক্লিনিকে ভর্তি করে ইলেক্ট্রিক শক দেওয়া হয়। এই শক তার স্মৃতিশক্তি কেড়ে নেয়। এই স্মৃতির রাজ্য হারিয়ে গেলে তিনি আর কিছুই লিখতে পারেননি।
অবশেষে ১৯৬১ সালের ২ জুলাই, ঠিক তার জন্মদিনের পরের দিন, তার প্রিয় শিকারের রাইফেলটা তার থুতনিতে ঠেকিয়ে তিনি তার ভবলীলা সাঙ্গ করেন। আর্নেস্ট মিলার হেমিংওয়ে, সমস্ত জীবনের সঙ্গে কুস্তি লড়েছেন অকুতোভয় রোমাঞ্চে।