Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

প্রগাঢ় হাসান মোশতাক-নীলে

Icon

হামিদ কায়সার

প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২২, ১৩:৪৬

প্রগাঢ় হাসান মোশতাক-নীলে

প্রগাঢ় হাসান মোশতাক-নীলে- হামিদ কায়সার

কথা ছিল সকাল দশটা কি সাড়ে দশটার মধ্যেই ডাক্তার সাহেব আমাকে দেখবেন। তারপর আরামসেই এগারোটার মধ্যে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে বারোটার আগেই পান্থপথ থেকে পৌঁছে যেতে পারব কাটাবন। সেখানে বারোটায় আমার জন্য পেন্ডুলামে অপেক্ষা করবেন মোশতাক আহমদ। আমি তার সাক্ষাতের জন্য পুরোপুরি তৈরি। হাতে ‘ঝিনুক নীরবে সহো’ পাণ্ডুলিপির এ-ফোর সাইজের প্রায় চারশ পৃষ্ঠার প্রিন্ট। যাতে ইচ্ছেমতো জায়গায় জায়গায় দাগিয়েছি আর যা খুশি লিখেছি মন্তব্য, কারণ লেখকই আমাকে সে অধিকার দিয়ে রেখেছেন। অবশ্য লেখক আমাকে পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছিলেন ই-মেইলে। যেহেতু স্ক্রিনে পড়তে অভ্যস্ত নই, তাই প্রিন্ট আউট দিয়ে নিয়েছি।

এত বড় বিশাল পাণ্ডুলিপি পাঠ করাটা আমার জন্য আক্ষরিক অর্থেই কঠিন! কেননা নিজের লেখালেখি থুয়ে অনুরোধের পর অনুরোধে আসা অসংখ্য কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গদ্য পাঠ করতে গিয়ে দেখেছি, মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে পড়াটা বড়ই মর্মদায়ক, যন্ত্রণাকর, চরম বিরক্তির ব্যাপার। যা আপনি মন থেকে পড়তে চাইছেন তা হয়তো প্রিয়াকে চুম্বনের মতোই একটানা বসে দ্রুত পাঠ নেয়া যায়! কিন্তু যা পড়তে হচ্ছে অনুরোধে, তা সত্যিকার অর্থেই ঢেঁকি গেলার মতো! পড়া তো এগোই-ই না, রাগে-দুঃখে মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। সে পীড়ন থেকে বাঁচার জন্যই আজকাল ফেসবুক এড়িয়ে চলি, মেইলবক্সও দেখি না-দেখার মতো করে। ট্যাগওয়ালারা হয়ে উঠেছে দু-চোখের বিষ! যারা জোর করেই কিছু একটা পাঠ চাপিয়ে দিতে চাইছে!

কিন্তু মোশতাক আহমদ-এর ‘ঝিনুক নীরবে সহো’র পাঠ অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণই ভিন্ন। মনের ইচ্ছেতে তো বটেই, এ বইটির পান্ডুলিপি পড়ার জন্য বুঝি দীর্ঘদিন থেকে তৈরিই হয়ে রয়েছি, সেই যেদিন তালিম মামা আজ থেকে পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর আগে আমাকে মোশতাক আহমদের কবিতা পাঠের অনুরোধ জানিয়েছিলেন।

হ্যাঁ, আমি মোশতাক আহমদকে কবি হিসেবে অনেকদিন থেকেই চিনি। আমার মামা তালিম হোসেন দেখা হলেই বলতেন আমাকে, ‘মোশতাক কিন্তু ক্যাডেট কলেজে আমার ব্যাচমেট, ভালো কবিতা লেখে। তুমি কিন্তু পড়ো ওর কবিতা!’ আমি তালিমের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম যে পড়ব এবং ঠিকই পড়েছি, এখনও পড়ছি, পড়েই যাচ্ছি, ফেসবুকে অথবা পত্রপত্রিকায়, যেখানেই সামনে আসে মোশতাকের কবিতা কি গদ্য- সবই, পড়তে ভালো লাগে আমার, ভালো লাগা নিয়েই পড়ি তার সমস্ত লেখা।

তালিম আমাকে মোশতাক আহমদের কথা বলতেন- মোশতাকের কবিতার কথা বলতেন, রফিক কায়সারের কথা বলতেন, তাঁর ঋদ্ধ ব্যক্তিত্বের কথা বলতেন। আমি শুধু শুনতাম, তাদের কথা শুনেই যেতাম। কোনোদিন যে দেখা হবে, আমার ভাবনায়ও ছিল না। কিন্তু একদিন জীবনের প্রায়-পড়ন্ত বেলায় এসে দুজনের সঙ্গেই দেখা হয়ে গেল একসঙ্গে, তালিম মামারই উত্তরার বাসায়, তবে কিনা তখন তালিমের নিঃসাড় দেহটাই কেবল পড়েছিল খাঁটিয়ায়, প্রাণপাখি উড়ে চলে গেছে কোন দূরের দেশে, যে দেশের খোঁজ আমাদের কারোরই জানা নেই! 

সেদিন তালিমের জানাজা-শেষে দুজন সাহিত্যবেত্তার সঙ্গেই কথা হলো; সে-সূত্রে আমরা পরস্পরের ফেসবুক বন্ধুও হয়ে উঠেছি ক্রমে ক্রমে। একদিন সে ফেসবুকেই কবি মোশতাক আহমদ ইনবক্সে আমাকে নক দিয়ে জানান, ‘আমি কবি আবুল হাসানকে নিয়ে একটি ডকু-ফিকশন লিখছি। আপনার কাছে কি এ সংক্রান্ত কোনো স্মৃতিকথা বা সূত্র বা পত্রিকার কোনো তথ্য আছে?’ 

চট করেই মনে পড়ে গিয়েছিল বটুভাইকে। বটুভাই মানে কথাশিল্পী মাহমুদুল হক। একটা সময় বছরের পর বছর, ১৯৯০-৯১ থেকে ২০০০-২০০১ সময়কাল হবে; কত আড্ডা যে দিয়েছি বটুভাইয়ের সঙ্গে তার বাসায়, এলিফ্যান্ট রোড থেকে জিগাতলা; একদিন সে এলিফ্যান্ট রোডেই হবে, বটুভাই হঠাৎ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের গল্প জুড়ে দিয়েছিলেন। ‘এই জানো! শক্তি ঢাকায় এলেই আমার বাসায় আসেন। একদিন এসেই বললেন, তোমাদের আবুল হাসান ছেলেটাকে দেখলাম। কী ভালো কবিতা লেখে। কিন্তু ছেলেটা থাকবে না! একদিন দেখো হঠাৎ করেই চলে যাবে!’

কথাটা যে শক্তি অসুস্থ আবুল হাসানকে দেখে বলেছিলেন, তা কিন্তু নয়! তারও অনেক আগের প্রেক্ষাপট সেটা! তখন অসুখবিসুখের গন্ধ আবুল হাসানের চেহারাসুরতে প্রবল ছিল না। টাটকা সপ্রাণ রগচটা কবি! তাহলে শক্তি কীভাবে বললেন অমন কথা! কবিরা কি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা? আগে-আগেই সব দেখতে পান? 

আমি সঙ্গে সঙ্গেই মোশতাক আহমেদের মোবাইল নাম্বার নিই। ইনবক্স থেকে বেরিয়ে সোজা তাকে কল দিয়ে বসি। আমার সে অভিজ্ঞতার কথা জানাই! সেই সঙ্গে এও জানতে চাই, বুলবুল চৌধুরী সম্পর্কে আপনি কিছু লিখেছেন কিনা? কেননা, আমার মনে এমন অমূলক সংশয় মাঝেমধ্যেই উপস্থিত হয় যে, যেসব সাহিত্য ব্যক্তিত্ব একটু লো-প্রোফাইলে থাকেন, প্রচার প্রোপাগণ্ডার বাইরে নিভৃতে করে চলেন সাহিত্য সাধনা, তাদের কথা আমরা প্রায়শই ভুলে যাই, তাদেরকে কোনো পুরস্কার প্রদান করি না, খোঁজখবর রাখি না, এমনকি সাহিত্যের কোনো আলোচনায় নাম পর্যন্ত থাকে অনুল্লেখ। 

আমার আশংকাই সত্যি হয়! মোশতাক আহমদ জানান যে, বুলবুল চৌধুরীর প্রসঙ্গ সে আনে নাই। আমি তাঁকে অবিলম্বেই অনুরোধ করি, ‘পারলে এখনই বুলবুল ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেন, সিটিং দেন, বুলবুল চোধুরী ছাড়া যে আবুল হাসান অসম্পূর্ণ। এক কথায় মহাপাপ হবে!’

হ্যাঁ, মহাপাপই তো! একদিন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র বুলবুল চৌধুরীকে আবুল হাসানের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন কায়েস আহমেদ। কীভাবে? কায়েস আহমেদ হাত ধরে বুলবুল চৌধুরীকে নিয়ে গিয়েছিলেন বিউটি বোর্ডিংয়ের সাহিত্য আড্ডায়। সে আড্ডার প্রাণ ছিল নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসানরা। যেদিন বুলবুল চৌধুরী উপস্থিত হলেন সেখানে, সেদিন থেকেই আবুল হাসান আর বুলবুল চৌধুরী হয়ে উঠেছিলেন অভিন্ন হৃদয় বন্ধু! আবুল হাসানের প্রাণের বন্ধু কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গেও সখ্যতা হয়েছিল বুলবুল চৌধুরীর। তারপর থেকে সুগভীর বন্ধুত্বের পলিকণা বিস্তৃত! হাইকোর্টে নির্মলেন্দু গুণের মাধ্যমেই গাছগাছালির ধুম্র জগতে ঢোকে পড়েন বুলবুল চৌধুরী এবং আবুল হাসান। নারী অভিজ্ঞতাও হতে থাকে বিস্তর। নারী অভিজ্ঞতা অবশ্য বুলবুল চৌধুরীর আগেই সম্পন্ন হয়েছে। নারীর ভেতর দিয়ে তিনি তার সাহিত্যের উপাদান খুঁজতে থাকেন। আবুল হাসানকেও তিনি নারীর কাছে নিয়ে যান। সুতরাং আবুল হাসানকে আমূল জানার জন্য তো বুলবুল চৌধুরী অবশ্যই এক নির্ভরযোগ্য অবলম্বন! 

মোশতাক আহমদও সম্যক উপলব্ধি করলেন ব্যাপারটা এবং অচিরেই তিনি বুলবুল ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করলেন। কিন্তু সে বুলবুলভাই আর সারা শহর আঁতিপাতি করে চড়িয়ে বেড়ানো মানুষ নয়, লিভার ক্যান্সারের কামড়ে বিপন্ন বিছানায় শায়িত জড়বৎ। তবে তখনও তার প্রবল জীবনীশক্তি, স্মৃতি ষোলআনাই জাগ্রত, কথা বলাতেও ক্লান্তি নেই। করোনাকাল বলে হয়তো বুলবুল চৌধুরী যেমন মোশতাক আহমদকে সাক্ষাৎ দেননি, তেমনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র নিজেও করোনার মধ্যে অসুস্থ বুলবুল ভাইয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে সশরীরে তার সামনে হাজির হননি। তা সত্ত্বেও থেমে থাকেনি কাজ। 

বুলবুল চৌধুরীও মোশতাক আহমদের কথা শুনেই বুঝতে পেরেছিলেন ভালো একটা কাজ হতে যাচ্ছে। তিনি আমাকে বলেওছিলেন সে কথা, ‘ছেলেটা হাসানকে ধরতে পেরেছে হামিদ। আমি ওর সঙ্গে কথা বলেই বুঝেছি। যতটুকু পারি সাহায্য করব। হাসানের সঙ্গে আমার কত স্মৃতি! ওকে বলেছি আমার কাছে কিছু ডকুমেন্ট আছে, পাঠিয়ে দেব।’ 

ঠিকই, সে অসুস্থ অবস্থাতেও, খুব যত্ন করেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সেইসব মূল্যবান ডকুমেন্ট। আমার একটা আত্মতৃপ্তির জায়গা হলো, এ দুজন কবিআত্মা মানুষের মধ্যে যোগাযোগ ঘটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি! আশংকা ছিল, বুলবুল ভাই তার স্বাস্থ্য বিপর্যয়ে মোশতাক আহমদকে সঠিকভাবে সহযোগিতা করতে পারবেন কিনা। বুলবুল ভাই ক্যান্সারের যন্ত্রণাকে বাউন্স মেরে ঝিনুক নীরবে সহো-তে আবীরের রঙ ছড়াতে ভূমিকা রেখেছেন। 

জীবনের এই সময়ে আমি আশ্চর্য হয়ে যেমন ক্যান্সার-আক্রান্ত বুলবুল চৌধুরীর অদম্য প্রাণশক্তি চাক্ষুস করছিলাম, তেমনই সমানভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছি মোশতাক আহমদ কতটা দ্রুত অথচ কতটা অভিনিবেশ এবং যত্ন সহকারে গভীর তলদেশ থেকে তুলে আনছেন কবি আবুল হাসানসহ তার সময়কাল এবং তাবৎ চরিত্রদের! সেটা বিস্ময়করই! ধরুন, আজ সকালেই হয়তো বুলবুল চৌধুরী আর আবুল হাসানের কোনো ঘটনাক্রমের উৎস তিনি পেলেন, এক-রাতের মধ্যেই তা ঝিনুক নীরবে সহো-র মধ্যে সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন, ধারাবাহিকতা ঠিক রেখে অথচ শিল্পমানও অক্ষুণ্ন থাকছে, ভাষাও ঋজু-সংহত! আমিও সঙ্গে সঙ্গে তা পাঠের সুযোগ পাচ্ছি। হ্যাঁ, মহৎ প্রাণ কবি, ততদিনে আমার ই-মেইলে ঝিনুক নীরবে সহো-র পাণ্ডুলিপি তো পাঠিয়েছেনই, আপডেটও জানাচ্ছেন সময়ে সময়ে! 

এখানে উল্লেখ করতে হয়, আমার সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ার আগেই তিনি ডকু ফিকশনটি মোটামুটি লিখে ফেলেছিলেন। পরে তার ভেতরে ভেতরে নতুন করে সমন্বয় ঘটান বুলবুল চৌধুরী প্রসঙ্গ। শুধু যে বুলবুল চৌধুরী তা নয়, তিনি সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে ফোনে ফোনে যোগাযোগ করে তার লেখাটিতে উপযুক্ত তথ্য এবং চরিত্র যুক্ত করছিলেন। মোশতাক আহমদের এই শ্রম যে ব্যর্থ হয়নি, পাঠকমাত্র টের পাবেন। তিনি যেমন কবি আবুল হাসানের বোধ ও চৈতন্যকে শব্দে শব্দে জাগিয়ে দিতে পেরেছেন, তেমনি ষাট দশক থেকে আবুল হাসানের মৃত্যুকালীন সময় অর্থাৎ পচাত্তরের নভেম্বর পর্যন্ত সময়কালের একটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিকাশের ধারাবাহিক ছবিটিও ছোট ছোট আঁচড়ে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। 

স্বাধীনতা-উত্তর ঢাকা, ঢাকার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল, স্বাধীনতা পরবর্তী জাসদ গণবাহিনি সিরাজ সিকদার দুর্ভিক্ষ পীড়িত বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুর প্রভাব এবং পচাত্তরের পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তি আবুল হাসানের কাব্যযাত্রার ছবিটির যে কেবল বাইরের ছবি আঁকা হয়েছে, তা নয়, কবির অন্তর যাত্রার ছবিও ধরা পড়েছে গভীর সংবেদে। তাই মন কেমন করা একটা হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে ছত্রে ছত্রে, কাব্যকলাকাররা যাকে শনাক্ত করেছেন আবুল হাসানীয় বিষাদ বলে! তারপর আরো কতি চরিত্র কত ছবি ধরা পড়েছে মোশতাক আহমদের ক্যানভাসে! কবি ইকবাল হাসান, বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী, আহমদ ছফা, সুরাইয়া খানম, নির্মলেন্দু গুণ, জাহিদুল হক, জার্মানের সেই বন্ধু রাইনহার্ট হেভিক্যা- সবাইকে মিলিয়ে এ যেন এক মহাকাব্যিক আঁকর। আমি তো ঝিনুক নীরবে সহোর পাণ্ডুলিপি পড়ে দুদিন ঝিম মেরে বসেছিলাম। একটা ক্ল্যাসিক মুভি দেখার পর, সে যেমন ধরুন হোক গডফাদার কী পথের পাঁচালী বা খন্ডহর বা জেনেসিস- যখন চরিত্রগুলো নিবিড়ভাবে মনে দোলা দিয়ে যায় বারবার, কিছুতেই হৃদয় থেকে মুছে ফেলা যায় না ঘটনার কোনো প্রতিক্রিয়া, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের অনুরণন জিইয়েই থাকে মস্তিষ্কে, ঝিনুক নীরবে সহোর পাঠশেষেও তেমনই কী এক মোহাবেশে ডুবে থাকতে হয়। 


ডাক্তারের ডাকের অপেক্ষা করতে করতে এসব কথাই আমি ভাবছিলাম। আমার হাতে ঝিনুক নীরবে সহোর পাণ্ডুলিপি যেন একটি জীবন্ত অগ্নিগিরি। মৃত্যু হাতে নিয়েও জীবন নিয়ে কী বেপরোয়া আবুল হাসান। সুরাইয়ার সঙ্গে দাপুটে প্রেম করে বেড়াচ্ছেন! আল মাহমুদের বাড়িতে গিয়ে দুদিনের জন্য দখল করে নিচ্ছেন বেডরুম! লিখছেন একের পর এক সতেজ টাটকা পাথরে লাবণ্য ধরানো সব কবিতা! তারই যেন সম্প্রসারিত রূপ বুলবুল চৌধুরীর মৃত্যুশয্যা! ক্যান্সারে দিন দিন ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে শরীর, কিন্তু জীবনীশক্তি কি অফুরন্ত! মৃত্যুর রক্তচক্ষুকে ভ্রুকুটি দেখিয়ে জীবনের ঠোঁটে দিচ্ছেন অজস্র চুম্বন, তার প্রিয় গাছ-গাছালির ছায়াতেই খুঁজছেন ঠাঁই (আইচ্ছা তুমি যে কও গাছ-গাছালি, কী নাম না রাখছো সিদ্ধির। খাও যে, হের যতন কইরা আয়োজন করো। কী পাও হুনি? {বুলবুল চৌধুরীর উপন্যাস পাপপুণ্যি থেকে})। 

একই সময়ে তখন কোন্ স্বর্গীয় আনন্দে ডুবে ঝিনুক নীরবে সহোর নন্দনবাগান সাজাচ্ছেন কবি মোশতাক আহমদ।  চোখের খানিকটা অসুবিধাকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন না! সেই আকুল অধীরতাতেই তো তিনি আমাকে সময় দিয়েছেন পেণ্ডুলামে, বেলা বারোটায়! আমিও শব্দস্পন্দনে আবুল হাসানের নব্য জীবনদানকারীকে দেখতে অতীব ব্যগ্র! তাই যখন দেখলাম যে ঘড়ির কাটা ছুঁয়ে গেছে এগারোটার ঘর, তবু আমাকে ডাকার কোনো লক্ষণ নেই প্রকাশও নেই: অবিলম্বেই রিশিপসনিস্টকে উলটাপালটা খানিকক্ষণ ঝেড়ে বেরিয়ে আসি বাইরে। কিন্তু কাটাবনে, পেন্ডুলামে পৌঁছেও আমার ভেতরের রাগ কিছুতেই মুছতে চায় না। আমি ডাক্তারের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিষোদগার করতেই থাকি আর মোশতাক আহমদ, যিনি নিজেও ডাক্তার, আমাকে প্রলেপন যোগান সে ক্ষতে! তারপর তার লেখা আমার প্রিন্টকৃত পাণ্ডুলিপি তার হাতে বুঝে নেন। 

পাণ্ডুলিপির ভেতর কী এক আত্মমুগ্ধতায় দুজনই হারিয়ে যাই। আমি মোশতাক আহমদকে অবাক চোখে দেখি, তালিম মামার বাসায় বহু আগে যেমন দেখেছিলাম, অবিকল সেই ছবি; ঈষৎ তারুণ্যমাখা প্রাজ্ঞ মুখ বিনীত সলজ্জ! আমরা আমাদের দিকে তাকিয়ে দিয়ে নতুন আকাঙ্খা ব্যক্ত করি যে, ঝিনুক নীরবে সহো বইটি প্রকাশের পর আমাদের আবার দেখা হবে, পেন্ডুলাম বা অন্য কোথাও অথবা অন্য কোনোখানে!

যা কিছু মহাকাব্যিক, তারই ভেতরে যেন ট্র্যাজিক উপাদান লুকিয়ে থাকে। ঝিনুক নীরবে সহো যখন প্রকাশিত হয়, তখনই দেখো কোভিদ-ছোবলে আমি নিজেই পৌঁছে গিয়েছি মৃত্যুর প্রায় দ্বারপ্রান্তে! চৌদ্দদিন হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর বেশ কদিন বিছানা-আশ্রয়ে থাকার ফলে সবার কাছ থেকেই মোটামুটি বিচ্ছিন্ন। ১৪ জুনের পর বুলবুল ভাইয়ের কাছেও আর যাওয়া হলো না। তারপর বুলবুল চৌধুরীও পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিলেন। ইত্যবসরে ফেসবুক মারফত জানলাম, ঝিনুক নীরবে সহোর লেখক মোশতাক আহমদও গুরুতর অসুস্থ। শুনে এতটাই বিমূঢ় আর অসারত্ব ঘিরে ধরে যে, আমি আর কোনোক্রমেই পুস্তক ‘ঝিনুক নীরবে সহো’ সংগ্রহের কথা ভাবতে পারি না। কথা ছিল মোশতাক আহমদের হাত থেকে নেওয়ার! এ কোন অসুখ তাকে অমল বানিয়ে রেখেছে!

তারপর, দূর থেকেই যখন দেখছি, মোশতাক আহমদ বিছানা থেকে উঠে বসেছে, বহুদিন পর ছাদে যাচ্ছে, তার বন্ধু অনুরাগীরা তার বাসায় আসছে, ফেসবুকে ছবি ভাসছে; আহমাদ মোস্তফা কামাল দুর্দান্ত রিভিউ লিখছে- আমার অসারত্বও বুঝি ভেতরে-ভেতরে ঘুচে যেতে থাকে। আমি রকমারি মাধ্যমে ‘ঝিনুক নীরবে সহো’ সংগ্রহ করি। ঝকঝকে অফসেট পেপারে ছাপা কপিটা হাতে আসা-মাত্র বিমুগ্ধ হই। মনে হচ্ছে যেন আস্ত একটা রংধনু বুকে নিয়ে বসে আছি! এ বইটিকে আমি বলব বাস্তবিক অর্থেই বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের রংধনুজ্যোতি। 

প্রতিদিন একই নিয়মে সূর্য উঠে সূর্য ডুবে, সে এক অভ্যস্ততা। এই নিত্যনৈমত্তিকতার ভেতর যখন হঠাৎ একদিন আকাশের এক প্রান্তে রংধনুর আবির্ভাব ঘটে, তখন এক অপার্থিব মুহূর্ত উপস্থিত হয়। ঝিনুক নীরবে সহোর প্রকাশ যেন আমাদের প্রকাশনা জগতের আকাশে ছড়িয়ে দিল সেই রংধনুময় অনুভব। প্রচ্ছদের অভিনবত্ব, অঙ্গসজ্জার বহুবৈচিত্র্যতা তো আছেই- সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো মোশতাক আহমদের সুগভীর বর্ণনা, কবিসত্তা ছাপানো ক্ল্যাসিকাল গদ্যভাষা আর আবুল হাসানকে নতুন করে ফিরে পাওয়া; যে কবি হারিয়ে গিয়েছিলেন বিষাদবিপুল পচাত্তরে, তিনি যেন জেগে উঠলেন আবারো সবটুকু বেদনার গাঢ় নীলসমেত বাষ্পাচ্ছন্ন শব্দে শব্দে! 

কবিঅন্তপ্রাণরা সে কুয়াশায় ভিজুক! 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫