Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

মিছিলের সেই মুখ সুভাষ মুখোপাধ্যায়

Icon

শৌনক দত্ত

প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২২, ১৩:৩০

মিছিলের সেই মুখ সুভাষ মুখোপাধ্যায়

সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ফাইল ছবি

কৃষ্ণনগর বললেই মনের কোণে উঁকি দেয় রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, গোপাল ভাঁড়, রামপ্রসাদের গান,রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায় সহ অসংখ্য জ্ঞানীগুণীর নাম কিংবা মনের অজান্তেই শৈশবের মাটির পুতুল।

তেমনি কবিতা প্রেমীদের কৃষ্ণনগরের কবি ও কবিতার কথা বললে কবিসহ তাদের অজস্র কবিতা বলে দিতে পারবে অনেকেই তবে কৃষ্ণনগরের কবি ও কবিতা বলতে গিয়ে চিরকাল সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হবে যে কবিতাটি তা হয়ত-

প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য

ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,

চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য

কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।’

যার কবিতা আধুনিক বাংলা কাব্যজগতে চল্লিশের দশকে এক নতুন স্বর তৈরি করেছে, সেই দীপ্ত স্বরের কাব্য ভূমিকায় বাংলা কবিতা পেয়েছে–ভিন্নমাত্রা। সেই কবি হলেন–কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। জয় গোস্বামীর মতে, ‘‘সুভাষ মুখোপাধ্যায় সাধারণ মানুষের কথাকে নিজের কবিতায় তুলে এনেছিলেন। সাধারণ মানুষের ভাষাই তাঁর হাতে হয়ে উঠেছিল কবিতা।’’ 

যদিও নিজের কবিতা লেখা নিয়ে তাঁর রসিকতার অন্ত ছিল না। কখনও তিনি নিজের কবিতা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমার মতো লোকেদের মা-সরস্বতী দিনের পর দিন নাকে দড়ি দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়ে মারেন।’ আবার লিখেছেন কোথাও, ‘আমার লেখায় আমি দেখেছি, যে জায়গাটা লোকে খুব প্রশংসা করেছে, এটা দারুণ লিখেছো, সে সব জায়গা, আমি দেখেছি, আসলে আমার নয়। অন্যের কথা। সাধারণ মানুষের কথা। আমি মেরে দিয়েছি। আত্মসাৎ করেছি। কেউ ভিক্ষে করে খায়। তুমি কী করো? না, টুকিয়ে, টুকিয়ে খাই।’ তবে দিনের শেষে নিজের কবিতা লেখার উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি চাই কবিতা দিয়ে মানুষের হাতগুলোকে এমন ভাবে কাজে লাগাতে যাতে দুনিয়াটা মনের মতো করে আমরা বদলে নিতে পারি।’

১৯৪০ সাল অবিভক্ত ভারতবর্ষ তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসন দ্বারা শৃঙ্খলিত ও পরাধীন। এমন সময়কালে একুশ বছরের টগবগে যুবক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিক’ প্রকাশিত হয়। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পরপরই হৈচৈ ফেলে দেয়। কবিতাগুলো আলোর মতো ছড়িয়ে পড়লো মানুষের মুখে মুখে, সাম্যবাদী আন্দোলনের কর্মীদের কাছে হয়ে উঠলো অমোঘ উচ্চারণ, যা তাদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরণিত করলো। যেসব সমালোচক রাজনৈতিক বিষয়-আশয় নিয়ে লেখা কবিতাকে বাঁকাচোখে দেখতে অভ্যস্ত, তাঁরাও ‘পদাতিক’ এর কবিতাগুলোকে অস্বীকার না করে, বরং প্রশংসাভরে গ্রহণ করলেন।

‘পদাতিক’ কাব্য গ্রন্থটি নিয়ে বুদ্ধদেব বসু লিখলেন: ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায় দুটি কারণে উল্লেখযোগ্য: প্রথমত, তিনি বোধ হয় প্রথম বাঙালি কবি যিনি প্রেমের কবিতা লিখে কাব্যজীবন আরম্ভ করলেন না। এমনকি, প্রকৃতি বিষয়ক কবিতাও তিনি লিখলেন না; কোনো অস্পষ্ট, মধুর সৌরভ তার রচনায় নেই, যা সমর সেনেরও প্রথম কবিতাগুলিতে লক্ষণীয় ছিলো। দ্বিতীয়ত, কলাকৌশলে তাঁর দখল এতই অসামান্য যে কাব্য রচনায় তাঁর চেয়ে ঢের বেশি অভিজ্ঞ ব্যক্তিদেরও এই ক্ষুদ্র বইখানায় শিক্ষণীয় বস্তু আছে বলে মনে করি।’

পদাতিক দিয়ে কবির যে কবিতা যাত্রা শুরু হয়েছিল এত বছর পরেও যদি সেইদিকে নজর দেয়া যায় দেখা যাবে শরতের আকাশের মতো, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা তেমনই অবাক মুগ্ধতায় পাঠকের মনের সেই স্থান দখল করে আছে, যার কোনও লয় নেই, ক্ষয় নেই, কেবল স্মৃতিতে উৎকীর্ণ হয়ে আছে! বিখ্যাত কোন চিত্রকর্মের মতো নানা অর্থে। এমনকি যাঁরা কবিতার নিয়মিত পাঠক নন,তাঁদের অনেকের কাছেও যাপিত জীবনের বিশেষ কোনো আবেগঘন মুহূর্তে কোনো না কোনোভাবে নাড়া দেয় তাঁর পঙক্তির দ্যুতি।

পদাতিক, চিরকুট ও অগ্নিকোণের পর ১৯৫১ থেকে ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে লেখা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ‘ফুল ফুটুক’ কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কবিতায় বাঁকবদলের স্বর নিয়ে উপস্থিত হয়। চিরচেনা বাংলা কবিতার দীর্ঘযাত্রায় এই কবিতাগুলো শহর-গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনের গভীর তাৎপর্য ও ব্যঞ্জনায় উন্মুখ হয়। 

ঐ সময়কালকে যদি যাপিত জীবন ও ইতিহাসের চোখে ময়নাতদন্ত করা যায় দেখা যাবে জনজীবন,ব্যক্তি কবি, আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও স্বদেশ এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে যেখানে ভাঙা গড়ার দোলাচাল চলছে রোজ। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় সংসার জীবনে প্রবেশ, অন্যদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও বিভিন্নমুখী পরিবর্তন ঘটেছে, বিশ্বে বিভিন্ন ঘটনার অভিঘাত নতুন তাৎপর্যে উপস্থিত হচ্ছে, ভারতবর্ষ স্বাধীন ও বিভক্ত হয়েছে, কমিউনিস্ট পার্টির রণরীতি বিভিন্ন পর্যায়ে দ্বিধা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকে পড়েছে। এমন পরিস্থিতি নিয়ে কবির মানস-প্রতিক্রিয়া ভিন্ন হতেই পারে। কবির দায়িত্ব শুধু কবিতা লেখা নয়, যুগের সত্যকে আবিষ্কার করা, সেইসাথে সেই সত্যকে কবিতার প্রাণময়তা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা। এই দিক থেকে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় পুরনো সোনার মতো যেন চির-নতুন! সুভাষ নিজেও বিশ্বাস করতেন যে, ‘কবিরা... আকাশ থেকে পড়েননি যে তাঁরা মেঘের রাজ্যে পাখা মেলবার স্বপ্ন দেখবেন; কবিরা হলেন সমাজের একজন-জীবনের সঙ্গে যুক্ত, জীবনের সংগঠক।’ তাঁর কবিজীবনের প্রথম দিন থেকে জন জীবনের কথা, কেবল কৃষ্ণচূড়ার উদ্ভাস নয়, নিষ্পত্র গাছের বেঁচে থাকার লড়াইয়েও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার কেন্দ্রে থেকেছে। কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা কবিতায় এক নতুন বিদ্রোহী স্বর নিয়ে এসেছিলেন বটে, কিন্তু চেতনার দিক থেকে কিছুটা মিল থাকলেও সুভাষের পথ ছিল সম্পূর্ণ নিজস্ব।

আশ্চর্য যে, তিরিশের দশকে কবিতা লিখতে শুরু করলেও ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও দেহলিপ্ত তিরিশি আধুনিকতার সঙ্গে নিজেকে জড়াননি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তাঁর পূর্বসূরি ও সমমনা অরুণ মিত্র (১৯০৯-২০০০) এবং সমর সেনের (১৯১৬-১৯৮৭) প্রভাবও সুভাষের কবিতায় দেখা যায় না। কৈশোরে রবীন্দ্রনাথের কবিতা তাঁর মনকে পুষ্ট করেছিল। সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার নিহিত সৌন্দর্য আর লোকবাংলার ছড়ার ছন্দিত কলস্বর তাঁকে মুগ্ধ করে রেখেছিল সারাজীবন। এইসব ইন্ধন থেকেই গড়ে উঠেছিল তাঁর কবিতার আটপৌরে কথোপকথনের ভঙ্গি ও বিশিষ্ট প্রকরণ। তবে বাংলা কাব্যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ধারায় কোনো পূর্বসূরিকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্ণিত করা না গেলেও তাঁর যথার্থ উত্তরসূরিকে আমরা দেখতে পাই সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায়।

শঙ্খ ঘোষের চোখে সুভাষের কবিতা প্রগাঢ় প্রেমের কবিতা তাঁর ভাষায়, 'সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা মূলত দেশকে ভালোবাসার, ভাষাকে ভালোবাসার, জীবনকে ভালোবাসার কবিতা। এর সঙ্গে আরো একটু বলা যায়- ভবিষ্যৎকে ভালোবাসার কবিতা।… এক আশ্চর্য সারল্য নিয়ে যে ভাবে তাঁর কবিতা পাঠকের কাছে এসে পৌঁছয়, তার কোনো পূর্বাপর নেই।'

সুভাষের এই গভীর প্রেম বিস্ময়বোধের রূপ নিয়েছিল তাঁর শেষ পর্বের কবিতায়।ঘরের জানলার পাশে বসে প্রায় ‘গণশত্রু’ বনে যাওয়া সুভাষ মুখোপাধ্যায় তবু জীবনের অভিজ্ঞতার আগুনে তাঁর সিদ্ধান্তের যে পরিমার্জন জরুরি ছিল, সেখান থেকে পিছিয়ে আসেননি এক পা-ও। কারণ, সুভাষ প্রতিদিনের সহজ বিস্ময় থেকেই বলেছিলেন তাঁর আটপৌরে মুখের ভাষায়: 'বেঁচে থাকার প্রত্যহই পরব/যা দেখে তাই ভানুমতীর খেলা ('ভানুমতীর খেল')। ‘আপনি মিলেছে যা/তাতেই খুশি, হোক না খুঁদকুঁড়ো/হোক কিছু তার চোখের জলে ভেজা' ('ভানুমতীর খেল')।

কবি সমর সেনের দেয়া হ্যান্ডবুক অব মার্কসিজম বইটি পড়ে মার্কসীয় রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করা সুভাষ আদর্শগত কারণে নেহরু থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্রকেও তীব্র-তীক্ষ্ণ সমালোচনা করেছেন নিজের কবিতায়, লেনিনকে টেনে এনেছেন আটপৌরে জীবনে, সেই সুভাষই ধর্মতলায় পুলিশের গুলিতে বারো জন মারা যাওয়ার পর গর্জে উঠেছিলেন, ‘রক্ত রাস্তা রক্ত; গুনতে গুনতে সেই বারোতে থেমে যাই’...

আসলে কবির কলম সব দল ও মতাদর্শের উপরে উঠে কথা বলে। মানুষের কথা বলে। বাংলা কবিতার ইতিহাসে তাঁকে অস্বীকার করার কোথাও কোন সুযোগ নেই। বাংলা কবিতা যত দূরেই যাক না কেন,বাতিঘরের মতো কাস্তে কলম নিয়ে মেহনতী মানুষের প্রতিনিধি হয়ে জেগে থাকবেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। কারণ সবার উপর মানুষ সত্য। আর মানুষের মধ্যে কবি।

বাতাসে ধ্বনিত তাঁর কণ্ঠ-

'সময়টা সুবিধের নয়

কিছু না ক’রে

যে পারে সেই হাতিয়ে নিচ্ছে

খোলা মঞ্চে

চোখের পর্দাটুকুও না ফেলে

বহুরূপীরা

ঘড়ি ঘড়ি নিজেদের রং বদলাচ্ছে।'

('ধর্মের কল')

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫