Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

ভাষাপ্রেমী উইলিয়াম কেরী

Icon

মামুন রশীদ

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২২, ১২:৩২

ভাষাপ্রেমী উইলিয়াম কেরী

উইলিয়াম কেরী। ছবি: সংগৃহীত

বাংলা গদ্যের আজকের যে অবস্থান, তার পেছনে যাদের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রাখতে হয়, সেখানে বিদেশির সংখ্যাই বেশি। ধর্মপ্রচারের জন্য এসে তারা বাংলা ভাষা শেখেন। আর কাজের সুবিধার জন্য তারা বাংলা ভাষাকে বিজ্ঞান সম্মত একটি কাঠামোর উপর দাঁড় করান। এ পর্বে আমরা পর্তুগিজ পাদ্রি মনোএল-দা-আসসুম্পসাম এবং ইংরেজ ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হেলহেডের কথা মনে রেখেও যাকে সবচেয়ে বেশি সম্মানের সঙ্গে সামনে এগিয়ে রাখি, তিনি উইলিয়াম কেরী।

১৭৯৩ সালের ১৩ জুন ‘প্রিন্সেস মারিয়া’ জাহাজে চেপে স্ত্রী-পুত্রদের নিয়ে রওনা হন বঙ্গদেশের পথে। এই যাত্রাই ছিল মাতৃভূমি থেকে চিরবিচ্ছেদের যাত্রা। ৯ জুন ১৮৩৪ সালে ভারতবর্ষেই তিনি মারা যান। 

উইলিয়াম কেরীর জন্ম ১৭৬১ সালের ১৭ আগস্ট ইংল্যান্ডের নরদামটনশায়ারের পলাসপিউরি গ্রামে। ছেলেবেলা থেকেই আগ্রহ ছিল বিদেশি ভাষায়। মাত্র বারো বছর বয়সে শেখেন ল্যাটিন ভাষা। এরপর গ্রিক। তারপর একে একে হিব্রু, ডাচ, ইতালিয়ান ও ফ্রেঞ্চ। শেষে বাংলা। ডাচ ভাষার একটি বইও অনুবাদ করেছিলেন ইংরেজিতে। পাঠ নিতেন প্রকৃতি থেকেও। যা তাকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে দক্ষ করে। এক্ষেত্রে এতটাই দক্ষতা অর্জন করেছিলেন যে, তারই সম্পাদনায় প্রকাশ পায় বিখ্যাত উদ্ভিদতত্ত্ববিধ ড. রক্সবার্গের সুপ্রসিদ্ধ বই ‘ফ্লোরা ইনডিকা’। বিজ্ঞানী রক্সবার্গের অকাল মৃত্যুই উইলিয়াম কেরীকে এ বই সম্পাদনার দায়িত্ব এনে দেয়। 

উইলিয়াম কেরী প্রথম জীবনে কৃষিকাজ, জুতা সেলাইয়ের কাজ শিখেছেন। পেশা পাল্টাতে পাল্টাতে ১৭৭৯ সালে যোগ দেন এক দোকানে। মদ্যপ, বদমেজাজি দোকান মালিকের সঙ্গে তার প্রায়ই ধর্ম বিষয়ক তর্ক বাধত। তর্কে জেতার জন্য ধর্মবিষয়ক বই পড়তে শুরু করেন। ১৭৮১ সালে যখন তার বয়স কুড়ি, বিয়ে করেন দোকান মালিকের স্ত্রীর ছোট বোনকে। ১৭৮৬ সালে শিক্ষক হন একটি অবৈতনিক পাঠশালায়। তত দিনে বেরিয়ে গেছে ক্যাপ্টেন কুকের ‘ভ্রমণ বৃত্তান্ত’ বইটি। এ বই পাল্টে দেয় কেরীর চিন্তার জগৎ। তিনি পৃথিবীর অখ্রিষ্টান ‘হিদেন’ জাতিসমূহের মুক্তির উপায় খুঁজতে পাদ্রি হন, তখন ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দ। ১৭৯২ সালে প্রকাশ পায় তার An Enquiry into the obligations of Christians to use means for the conversation of the Heathen বইটি। একই বছরের ২ অক্টোবর তারই প্রচেষ্টা ও উদ্যোগে গঠিত হয় The Particular Baptist Society for propagating the Gospal amongst the Heathen নামের সমিতি। এই সমিতির সভা থেকেই তিনি জানেন জন টমাসের কথা, যার সঙ্গেপরবর্তী সময় চলে আসেন ভারতবর্ষ, তথা বঙ্গদেশে। 

বাংলাদেশে আসার পথে, জাহাজেই তিনি টমাসের কাছে বাংলা শিখতে শুরু করেন। কলকাতায় এসে মুন্সী হিসেবে নিয়োগ করেন রামরাম বসুকে। এগিয়ে চলতে থাকে ধর্মপ্রচার ও বাংলা ভাষা শেখার কাজ। ১৭৯৫ সালের মধ্যেই বাংলা ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। এ সময়ের তার লেখা একটি চিঠিতে বাংলা শেখা ও লেখার প্রথম নমুনা মেলে। ১৮০১ সালে যোগ দেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগে। এখানে যুক্ত ছিলেন ১৮৩১ সাল পর্যন্ত। 

মূলত শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজপর্বেই তিনি বাংলা গদ্যের বিকাশে সামনে থেকে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। কলেজের ছাত্রদের প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তকের অভাব মেটাতে নিজে যেমন একের পর এক বইয়ের কাজ করেছেন, তেমনি স্থানীয় পণ্ডিতদেরও উৎসাহিত করেছেন। তার সেই উদ্যোগ ও উৎসাহেই বাংলা গদ্য পায় প্রাথমিক রূপ। বাংলা গদ্যের প্রথম যুগকে এজন্য অনেকে উইলিয়াম কেরীর প্রভাবের যুগও বলেন। উইলিয়াম কেরীর লেখা বইয়ের মধ্যে রয়েছে- নিউ টেস্টামেন্ট (১৮০১); বাংলা ব্যাকরণ (১৮০১; কথোপকথন (১৮০১); ওল্ড টেস্টামেন্ট-মোশার ব্যবস্থা (১৮০২); কৃত্তিবাসের রামায়ণ ও কাশীরাম দাসের মহাভারত (১৮০২); ওল্ড টেস্টামেন্ট-দাউদের গীত (১৮০৩); ওল্ড টেস্টামেন্ট-ভবিষ্যদ্বাক্য (১৮০৭); ওল্ড টেস্টামেন্ট-য়িশরালের বিবরণ (১৮০৯); ইতিহাসমালা (১৮১২); বাংলা-ইংরেজি অভিধান (১৮১৫-২৫) এই অভিধানে স্থান পেয়েছিল প্রায় পঁচাশি হাজার শব্দ। 

ধর্মপ্রচারের জন্য এলেও উইলিয়াম কেরী ভালোবেসেছিলেন বাংলাদেশের মানুষ ও বাংলা ভাষাকে। সতীদাহ প্রথা বিলোপেও তার অবদান চিরস্মরণীয়। উইলিয়াম কেরীর মূল্যায়নে শ্রীসজনীকান্ত দাস লিখেছেন, ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পক্ষে তিনি সব মিলিয়া এক জন উইলিয়াম কেরী, কোনও অপ্রিয় তুলনার দ্বারা অথবা বৈদেশিকত্বের কারণ দর্শাইয়া আজ তাঁহার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা চলে না।’ ...‘কেরীকে স্বীকার করার মধ্যে আমাদের পূর্ব্বপুরুষকে স্মরণের পুণ্য আছে।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫