
প্রতীকী ছবি
কবিতা, কবি ও কবিতার পাঠক- এই বিষয়ে অনেক রকমের কথার ঘুড়ি উড়ছে। যে ঘুড়ি উড়তে বাতাসের প্রয়োজন নেই। এই বাতাসহীন বাতাসের বেগটা সৃষ্টির শুরু থেকেই শুরু হয়েছে। কারণ কবিতা সৃজন করা সহজ বিষয় না। রীতিমতো ধ্যানী বক হতে হয়। অন্যদিকে কবিতার নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞাও কোনো বোদ্ধা উপস্থাপন করেনি। পৃথিবীর যাবতীয় কিছুর সংজ্ঞা ও বিশ্লেষণ পাওয়া গেল। অথচ কবিতার যেন কোনো স্থির সংজ্ঞা নেই।
কবিতার ধরন, প্রকরণ- কবিতা, অকবিতা, গদ্য কবিতা, ছড়া কবিতার মতো বিচ্ছিন্ন কিছু নামে কবিতাকে আলাদা করে চেনা যায়; কিন্তু এর প্রকারভেদও ঠিক জানা যায়নি। ফলে সময়ের সাথে কবি ও কবিতার পটভূমি পরিবর্তন হলেও কবিতার আসল রহস্য কী! সেটার রহস্যটা আরও গাঢ় রহস্য হয়ে রয়। এর অর্থ এই নয় যে, কবিতা নিয়ে কোনো বোদ্ধাই সংজ্ঞা উপস্থাপন করেনি। বরং প্রত্যেক সংজ্ঞা উপস্থাপনকারী এক অর্থে বলেছে- এটাই যথেষ্ট সংজ্ঞা নয়। শেষে আরও জোর দিয়ে বলেছে- কবিতার নির্দিষ্ট করে বলার মতো সংজ্ঞা নেই। তাহলে কবিতা কী?
এ প্রশ্নের উত্তরণ যখন একজন কবিতার স্রষ্টা নিজেই বলতে পারে না। তখন তো কবিতা পিতামাতাহীন হয়ে পড়ে থাকে। পিতামাতাহীন সন্তান তো সবচেয়ে অনাদরে, অবহেলায় থাকার কথা; কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম। কারণ কবি তার প্রত্যেকটি কবিতাকেই সন্তানের মতো পরম যত্নে ধারণ করে। সন্তানকে বিশেষভাবে সাধারণের কাছে ছেড়ে দেওয়ার পূর্বে পরিমার্জন করে। যতক্ষণ না সেই সন্তান কবির কাছে পরিপূর্ণ মনে হয় ততক্ষণ তা পরম যত্নে রক্ষিত থাকে; কিন্তু যখনই মনে হয়, সন্তানটি সমাজের কাছে বিশেষ কিছুর পরিচয় বহন করতে সক্ষম। কবি তখনই তা সাধারণের মাঝে বিলিয়ে দেয়। তখন তা সাধারণের হলেও এই বিলিয়ে দেয়াতেই কবি আমৃত্যু জেগে থাকার বাসনা পূর্ণ করেন পৃথিবীর কাছে। দাবি রাখেন তার সন্তানের জন্মের দায়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখার; কিন্তু এই সন্তানকে বুঝতে সাধারণ পাঠক কতটা ঋদ্ধ? কতটা বোদ্ধা ও কবিতার সমঝদার তা সেভাবে আলোচনা না হলেও সময়ের সাথে আলোচ্য বলে বিবেচিত।
কেননা প্রায়শই শোনা যায়, এ সময়ের কবিতা পাঠকরা বুঝতে পারছে না। কবিতার মূল অর্থ নাকি খুবই অন্ধকার, দুর্বোধ্যও। কথাগুলো যতটা না ঠিক তার চেয়ে বেশি হচ্ছে কবিতাকে বুঝতে চেষ্টা না করা। কেননা বাংলা সাহিত্যের অধিকাংশ পাঠকই সেই পুরনো কবিতা মুখস্থ পড়ে এবং শুনে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে গুটিকয়েক লেখকের নাম তাদের মগজে এমনভাবে গেঁথে গেছে যে, এর বাইরে কোনো লেখককেই পরিপূর্ণ মনে করে না। অন্যদিকে যেহেতু সেসব মুখস্থ নামের কবিদের কবিতা অন্ত্যমিলে কারুকাজে সাজানো-গোছানো। পড়তে সময় ও মেধার যাচাই করার দরকার পড়ে না। তাছাড়া পাঠ্য বইয়ের মাধ্যমে তাদের কয়েকটি লেখা মাত্র জানার ভাণ্ডারে জমা। আর সেই সব কবিতাও মুখস্থ করতে হয়েছে শিক্ষকের ভয়ে অথবা পরীক্ষায় পাসের চাপে। এর বাইরে সাহিত্য নিয়েও তাদের কখনো কারও কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি। তাই অন্ত্যমিলহীন কবিতা বা প্রচলিত ছন্দের বাইরের কবিতাকে কঠিন ও দুর্বোধ্য বলে নিজেদের দায় সারে।
কবিতার সংজ্ঞার মতো এতকাল কবিতার স্রষ্টার জীবন নিয়েও একটা ঘোরলাগা বাতাস বইত। সাধারণ পাঠক মনে করত, কবি মানেই অন্য এক আধ্যাত্মিক জগতের কেউ। কবি হতে হলে সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে। উষ্কশুষ্ক চুল, এলোমেলো জীবনযাপন কবিকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করবে। কবিদের বসবাস হবে, কোনো পাহাড়ের চূড়ায়, নদীর তীরে, জনবিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপে, গহিন বনে, নির্জনে; কিন্তু বিশ্বায়নের প্রভাবে সেই ধারণায় কিছুটা ছেদ পড়েছে। কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে মানুষের সংখ্যা। প্রযুক্তির কল্যাণে খুব দ্রুত মানুষের কাছাকাছি যাওয়া যায়। কাছাকাছি যেতে না পারলেও অনেক সময় প্রিয় তারকাদের জীবনযাপন ও মতামত জানা যায়। আড়ালের অনেক কিছুই সামনেও চলে আসে; কিন্তু একটা সময় যা ছিল দুষ্প্রাপ্য। এই কারণে এ সময়ে এসে দ্রুত কবিদের কবিতার সাথে তাদের মতামতকেও পাঠক মিলিয়ে নিতে পারে। দিতে পারে পাঠকও মুক্ত ও খোলা অভিমত।
কবিতা সবাই লেখে না। কেউ কেউ লেখেন। আবার কেউ কেউ এর মধ্যে থেকে কবি হিসেবে স্বীকৃতি পান। এই স্বীকৃতি পাওয়াটাও এখন দুভাবে বিভক্ত। একজন কবি সাধারণ পাঠকের কাছে স্বীকৃতি পায়। অন্যজন পায় লেখক মহলে। এই যে লেখক ও পাঠকের কবি বা সাহিত্যিক হিসেবে দুভাগে বিভক্ত হওয়া এটাই মূলত এই প্রবন্ধের আলোচনা।
জীবনানন্দ দাশ বলেছেন- ‘সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি।’ আর এই বাক্যটি অধিকাংশই কবি ও পাঠক সত্যি বলে মেনে নিয়েছে। কবির ক্ষেত্রে যদি তাই হয় তাহলে আধুনিক এই যুগে এসে পাঠক সম্পর্কেও ভাবার সময় এসে গেছে। কেননা যে দেশে গাইড বই পড়ে অধিকাংশ মেধাবী ও শিক্ষিতজনের সার্টিফিটেক অর্জন হয়। সেই দেশে সাধারণ মানুষকে কবিতার ভালো পাঠক ভাবাটাও বোকামি নয় কি? লেখক যেমন একজন প্রকৃত লেখক হতে সাধনা দরকার। প্রয়োজন পড়ে নানান প্রস্তুতি। জানতে হয় মানুষকে মুখস্থ করার কৌশল। আগামী সম্পর্কে রাখতে হয় গভীর দর্শন। সেভাবেই যদি বলি পাঠকেরও কিছু প্রস্তুতি দরকার। বিশেষ করে কবিতা সম্পর্কে। কারণ পাঠক যদি কবিতা সম্পর্কে না জানে, তাহলে কীভাবে কবিতার পাঠোদ্ধার তার কাছে আশা করা যায়। তাই অধিকাংশ সময় শোনা যায়, এখন কবিতা কঠিন হয়ে গেছে। কবিতার অর্থ বোঝা যায় না। এই যে না বোঝার দায় এককভাবে কবিকে দেওয়া হয়, এর দায় কি কবির? পাঠক কি মনে করেন না কবিতা পাঠের জন্য তার প্রস্তুতি প্রয়োজন? কবিতায় যে নন্দনতত্ত্ব, শিল্প, অলঙ্কারের কথা বলা হয় তা কি তার পাঠের বিষয়বস্তু নয়?
সাধারণত কবিতা সমাজের চিত্র, আঁধার-আলোর আয়নামুখ। কবিতায় উঠে আসে সমগ্র পৃথিবীর ঘটনা-দৃশ্যের চিত্র। কবিতা যেহেতু পৃথিবীর যাবতীয় কিছুই ধারণ করে, লালন করে, ভালোকে রোপণ করে, মন্দকে প্রকাশ করে, প্রেমের মহত্ত্বের গুণগান করে। তাই কবিতার গুরুত্ব ও ব্যাপকতা যুগ যুগ ধরে প্রসারিত হচ্ছে। বিকশিত হচ্ছে কবিতার নন্দনতত্ত্ব ও সৌন্দর্যও। মাত্র কয়েকটি পঙ্ক্তির কবিতায় যখন একটি জাতি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল কিছুই ফুটে ওঠে তখন পাঠককে সেই কবিতা সম্পর্কে বুঝতে হলে নিশ্চয়ই সময় নিতে হবে। আরও সহজ করে বলতে হলে-
একটি উপন্যাসের সারসংক্ষেপ বলা যায় একটি গল্প, একটি গল্পের সারসংক্ষেপ হলো একটি ছোটগল্প, অন্যদিকে একটি ছোটগল্পের সারসংক্ষেপ হলো একটি অনুগল্প। আর এই সব বিষয়গুলোকে কয়েকটি লাইনে ফুটিয়ে তুললে পরে একটি কবিতা হয়। এজন্য কবিতার লেখক ও পাঠককে অবশ্যই ঋদ্ধ হতে হয়। কারণ অনেকগুলো বিষয়কে একটি উপমার মাধ্যমেও কবিতায় টেনে আনতে হয়। ধরুন- ‘লাইলি মজনুর বিচ্ছেদের মতো আমিও বিচ্ছেদের সুর শুনি।’ এই বাক্যটির মাধ্যমে লাইলি-মজনুর প্রেমের সমগ্র আখ্যান কবিতায় স্থান পেয়েছে। এই লাইনটি বলা মানেই পাঠককে লাইলি-মজনুর প্রেমের ইতিহাস সম্পর্কে জানার দাবি রাখে। কেননা কবি একটি ইতিহাসকে কেন নিজের সাথে তুলনা করলেন। তার গভীরতা কতটুকু সেটা না জানলে পাঠক বিচ্ছেদের বেদনা অনুভব করতে পারবে না। এজন্যই একজন কবি যতটা ঋদ্ধ তার কবিতার গভীরতাও ততটাই ঋদ্ধ। এজন্য একটা ঋদ্ধ কবিতার পাঠোদ্ধারে পাঠককেও মনোযোগের দাবি রাখে। সেজন্য পাঠককে মুখস্থ বুলির মতোই কবিতায় অন্ত্যমিল খুঁজে তার সারমর্ম দ্রুত বুঝতে চেষ্টা করাটা নিশ্চয়ই ঠিক হবে না। অথচ বাংলা কবিতার অধিকাংশ পাঠক এই শ্রেণির। যে শিক্ষক অন্ত্যমিলের কবিতা পড়ে যাবে আর তা গানের মতো শুনেই অর্থ বুঝে নেবে। বিশ্বায়নের প্রসারে, প্রযুক্তির অগ্রসরে শিল্প-সাহিত্যও যে এগিয়ে গেছে, সেটা বুঝতে হবে। এজন্য পাঠকের হাতেও যথেষ্ট সময় থাকা চাই। সঠিকভাবে শিল্পসাহিত্য জানার, পাঠ করার জন্য। সেই সঙ্গে তা থেকে আনন্দ উপভোগ করার। মনকে পবিত্র করার জন্য হলেও।
শুরুতে কবিতা লেখা হতো গানের জন্য। অর্থাৎ গীতিকবিতা। সেই কবিতায় সুর দেওয়া হতো। তা শ্রোতারা শুনত এবং নিজেরাও আয়ত্ত করত। নিজেরা গুনগুন করে গাইত। সে সব এখনো আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে; কিন্তু গীতিকবিতা ও পাঠের কবিতা এতকালে অনেকটা দূরত্বে অবস্থান করছে। দুটোর ভাষা ও গঠন, পঠন, শব্দের বিন্যাস, উপস্থাপন আলাদা আলাদা জায়গাজুড়ে অবস্থান করছে। পাঠের কবিতার জন্য পাঠককে অবশ্যই সুস্থ মননের অধিকারী হতে হবে। যে পাঠক কবিতার ভাষাকে সহজ হিসেবে দেখতে চায় তাদের গভীরে ডুব দেওয়ার ইচ্ছে বা সময় কোনোটাই নেই। তারা ভাবনার জগতে দোল খেতে চায় না। স্বপ্নের ঘোরে কবিতার ঘোরলাগা নেশায় মত্ত থাকতে চায় না। বিশেষ করে জীবন ও জীবিকার ফসল ফলানোর এই যুগে কবিতা নিয়ে তাদের ভাবনাকে গভীরে নিতে অক্ষম। এই কারণে তাদের চাওয়া কবিতা হোক সহজ ও ছন্দবন্ধ, অন্ত্যমিল সার; কিন্তু কবিতা দাবি করে পাঠকের কাছ থেকে আরও বিশেষ কিছু। আর কবি দাবি করে পাঠকের কাছে চিন্তার জগৎ, মননের অসারতা দূর করে মনোযোগ। পাঠক সেক্ষেত্রে ব্যর্থই বলা চলে। কিন্তু এই দোষ পাঠক কাঁধে নিতে চায় না। তারা চায় কবিরাই সেই দোষে দোষী হোক। কারণ কবিদের দোষ দিলেই একই সাথে অনেক কিছুর দায় তাদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া যাবে। মূলত এটাই পাঠকের প্রকৃত রূপ।
সাহিত্যের যতগুলো শাখা রয়েছে তার মধ্যে কবিতা প্রাচীন এবং উৎকৃষ্টতম শাখা। কবিতাকে শিল্পÑসংস্কৃতির মাতা জ্ঞান করা হয়। কবিতা এমন এক শাখা তা বুঝতে হলে অনুভব করতে হবে, আর অনুভবের জন্য দরকার সাধনা। প্রয়োজন জ্ঞানের ডালপালা মেলে মনের যত্ন নেওয়া। জ্ঞানের জগৎ প্রসারিত করে ভাবনাকে মেলে ধরা। অনুভবের দরজা খুলে শব্দের মালায় যে সুবাসিত আনন্দ বেদনা তার রস আহরণ করা। এটা অনেক বড় সাধনা।