
সবুজ বৃক্ষ ছাড়া সকল প্রাণী তার খাদ্য নিজে উৎপাদনে অক্ষম। ফাইল ছবি
মানুষের পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় ও পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়। বলা হয়ে থাকে এর বাইরে একাদশ ইন্দ্রিয় মন। আনন্দে, দুঃখে, উৎসাহে, কষ্টে, প্রেমে, কামনায় মানুষের ইন্দ্রিয়সমূহ সক্রিয় হয়ে ওঠে। শুধু মানুষ কেন পৃথিবীর বেশিরভাগ প্রাণীই ইন্দ্রিয় চেতনা সম্পন্ন। মানুষ অন্য প্রাণীর তুলনায় যেমন জ্ঞানে, গরিমায়, সভ্যতায় ও বুদ্ধিতে আগানো তেমনি ইন্দ্রিয় উপলব্ধির ব্যাপারেও মানুষ অন্য প্রাণীর থেকে আলাদা।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে মানুষই একমাত্র প্রাণী যে কিনা পৃথিবীর সকল স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক পন্থার বিপরীতে আপন সভ্যতা গড়ে তুলেছে। আজ এ কথা সর্বৈব সত্য যে সবুজ বৃক্ষ ছাড়া সকল প্রাণী তার খাদ্য নিজে উৎপাদনে অক্ষম। ফলে মানুষের এই দাপুটে সভ্যতা ধীরে ধীরে প্রাণ-প্রকৃতি বিধ্বংসী এক রাক্ষুসে সভ্যতায় পরিণত হয়। অথচ প্রাচীনকাল থেকে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের সঙ্গে বসবাস করে এসেছে। যখনই মানুষ অধিক ভোগ, অধিক আরাম ও অধিক জনসংখ্যার জন্য সঞ্চয় এবং অধিক উৎপাদনের কথা চিন্তা করেছে তখন থেকেই মানুষের সভ্যতা ক্রমেই সবুজ পৃথিবীর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিন দিন আমরা মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর জীবনযাপনের অধিকারকে হরণ করেছি। পৃথিবী নামক গ্রহটি যে কেবল মানুষের নয় বরং সকল প্রজাতির বসবাসের জায়গা, মানুষ আজ যেনো সে কথাটি ভুলতে বসেছে। আমরা মাটির বুক চিড়ে তুলে আনছি লোহা, স্বর্ণ, তেল ও খনিজ সম্পদ। নদী থেকে সমুদ্র থেকে প্রতিনিয়ত তুলে আনছি অগণিত মাছ। জমিকে অধিক উৎপাদনমুখী করতে শুরু করেছি রাসায়নিক সারের ব্যবহার। নির্বিাচারে বনভূমি ধ্বংস আজ আর অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়।
সেখানে গাছেদের মন আছে কিনা সে প্রশ্ন যেন হাস্যকর এক ব্যাপার। হ্যাঁ, আজ সময় এসেছে শুধু প্রাণবান সত্তা হিসেবেই নয় বরং মননযুক্ত সত্তা হিসেবে বৃক্ষকে মানুষের কাছে পরিচয় করিয়ে দেবার। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে প্রথম বৃক্ষরোপণ-উৎসব পালন করেন। রবীন্দ্রনাথ বনবাণী (১৩৩৮) কাব্যের ভূমিকাংশেই পরিবেশ নিয়ে তাঁর মূল্যবান মতামত ব্যক্ত করেছেন- ‘ঐ গাছগুলো বিশ্ব বাউলের একতারা, ওদের মজ্জায় মজ্জায় সরল সুরের কাঁপন, ওদের ডালে ডালে পাতায় পাতায় একতালা ছন্দের নাচন। যদি নিস্তব্ধ হয়ে প্রাণ দিয়ে শুনি তা হলে অন্তরের মধ্যে মুক্তির বাণী এসে লাগে। মুক্তি সেই বিরাট প্রাণসমুদ্রের কূলে, যে-সমুদ্রের ওপরের তলায় সুন্দরের লীলা রঙে রঙে তরঙ্গিত, আর গভীরতলে ‘শান্তম শিবম অদ্বৈতম’। আমরা কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৃক্ষ প্রেমের বহু গল্প শুনেছি। তাঁর আরণ্যক উপন্যাসটি প্রকৃতিপ্রেমের এক অনন্য সৃষ্টি। যেখানে রাজু পাঁড়ে নামক চরিত্রটি বন কেটে কৃষিজমি বের করতে একেবারেই নারাজ। যুগলপ্রসাদ বনবাদাড়ে ঘুরে ঘুরে বুনো গাছ রোপণ করে বেড়ায়। প্রকৃত অর্থে বিভূতিভূষণ নিজেই হয়ে উঠেছেন আরণ্যক উপন্যাসের চরিত্র। বিভূতির গ্রামে সলতেখাগি নামে আমগাছ কেটে ফেললে লেখকের ব্যথাদীর্ণ বর্ণনা পড়ে আমরা বৃক্ষের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত করতে বাধ্য হই। এমনই প্রাণবান সত্তা হিসেবে গাছকে চিনতে না পারলে আজকের নগরায়ণের যুগে এই উপলব্ধি জন্মগ্রহণ করবে না যে- গাছেদেরও আছে মন।
এই পৃথিবীতে মানুষ একসময় আকাশ দেখে অবাক হয়েছে। কারণ এই আকাশ থেকে বৃষ্টি হয়, রাতে জ্বলন্ত নক্ষত্র দেখা যায়, ঘোর বর্ষায় বিদ্যুতের খেলা চলে। এমনসব আশ্চর্যজনক ঘটনা মানুষকে আকাশ সম্পর্কে সমীহ জাগাতে সাহায্য করেছে। মানুষ তেমনি বৃক্ষ দেখে বিস্মিত হয়েছে। গাছে সময়ে ফুল ফোটে, ফল হয়, নতুন পাতায় নবজীবন পায়, গাছের ছায়াময় শীতলতা মানুষের শ্রান্তি দূর করে। প্রাণবাচক সত্তা মাত্রই রয়েছে তার গতিশীলতা। প্রাণহীন সত্তার গতি নেই রয়েছে চির স্থবিরতা। প্রাণীর স্নায়ু ইন্দ্রিয় যত সজাগ, যত অল্পে সাড়া দেয় বৃক্ষ ঠিক ততটা নয়। বৃক্ষের স্নায়ু অনেকখানি বোবা, অন্ধ বা পঙ্গু মানুষের মতো। ঠিকই অনুধাবন সক্ষমতা তার রয়েছে কিন্তু প্রকাশের ব্যাপারে সে অনেকখানি নমনীয়, সর্বংসহা। অথচ আমাদের বিখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু আবিষ্কার করলেন বৃক্ষও গতিশীল। এমনকি বৃক্ষের বৃদ্ধির গতিও নির্ণয় করা সম্ভব। একজন মানুষের যেমন শারীরিক অসুস্থতা আছে তেমনি বৃক্ষেরও রয়েছে অসুস্থতা। বৃক্ষের শরীরেও তাপমাত্রা ওঠানামা করে সময়ে অসময়ে। তারও রয়েছে মানুষের মতন চৈতন্য শক্তি, আছে অনুভূতি। এমনকি অবাক করার মতো কথা যে বৃক্ষেরও জ্বর হয়। হ্যাঁ শুনে অবিশ্বাস হতে পারে আমাদের; কিন্তু গাছে ফাঙ্গাস ইত্যাদির আক্রমণে গাছের শারীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। আধুনিক সময়ে ইনফ্রা-রেড-থার্মোমিটার দিয়ে গাছের তাপমাত্রা নির্ণয় করা হয়ে থাকে। একটি গাছ বৃষ্টিতে ভেজে, রোদে পোড়ে অথচ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে এ তার স্বাভাবিক অবস্থা কিন্তু গাছে যদি ছত্রাক বা ফাঙ্গাসের আক্রমণ হয় তবে স্তন্যপায়ী প্রাণী বা পাখির মতো তারও শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়।
মানব শিশু বা পশুর ফুটফুটে বাচ্চাকে আমরা কতই স্নেহ করি, সোহাগে জড়িয়ে রাখি। তা হোক মানব শিশু অথবা কুকুর ছানা বা গরুর বাছুর; কিন্তু পথের ধারে পড়ে থাকা বৃক্ষ শিশুকে আমরা পায়ে দলে যাই অনায়াসে। একটি বৃক্ষ শিশু যখন বীজের মধ্যে লুকিয়ে থাকে তার বাইরে থাকে শক্ত আবরণ। যেমন পাখির ডিমের বাইরে থাকে শক্ত আবরণ। সেই বীজই উপযুক্ত পরিবেশ পেলে এক পাতা দু’পাতা করে মহীরুহ বৃক্ষে পরিণত হয়। সদ্য অঙ্কুরিত বীজ থেকে জন্ম নেয়া চারা গাছের কোমর নরম পাতা, নমনীয় কাণ্ড আমাদের তো আসলে তুলতুলে মানব শিশুর কথাই মনে করিয়ে দেয়। এমন করে ভাবতে পারলে বৃক্ষ নামক সত্তাকে আমরা আরও আপন করে নিতে পারি। বৃক্ষকে আমাদের আপন করে নেওয়া জরুরি এই কারণে যে, বৃক্ষই একমাত্র প্রাণ যে নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করতে পারে এবং মানুষের মতো তাকে খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রকৃতিকে শোষণ ও কর্ষণ করতে হয় না। শুধু তাই নয় পশুপাখি সকল প্রাণীই খাদ্য গ্রহণ করে প্রকৃতি থেকে, শুধু মানুষ তৈরি করে নিয়েছে বা তৈরি করতে বাধ্য হয়েছে কৃত্রিম উৎপাদন ব্যবস্থার।
পৃথিবীতে নানা দেশ, নানা ভাষা, নানা জাতি। কত বিচিত্র এই পৃথিবী। আর এতসব দেশ, ভাষা ও জাতি প্রতিনিয়ত পারস্পরিক হিংসা, বিদ্বেষ ও হানাহানিতে লিপ্ত। আমরা দিনদিন কট্টর জাতীয়তাবোধ দ্বারা দারুণভাবে আক্রান্ত হচ্ছি। বিশ্ব সৌভ্রাতৃত্ববোধকে জাগ্রত করবার যেন কোনো আশাই আর আমাদের মাঝে অবশিষ্ট থাকছে না। অথচ নানান দেশের নানান বৃক্ষ লতা ক্রমেই নতুন দেশে নিজেদের মানিয়ে নেয়। প্রথমদিকে আবহাওয়া ও জলবায়ুগত সমস্যায় পতিত হলেও যে কোনো নতুন বৃক্ষের প্রজাতি নিজেকে মানিয়ে নিতে সময়ক্ষেপণ করে না। অল্পদিনেই সেসব বৃক্ষ, তার ফুল ও ফল আমাদের জাতীয় জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে। আজকের দিনে কৃষ্ণচূড়া বা রাধাচূড়া নামক গাছের ফুল দেখে কেউ ভাববেই না যে এই গাছটি ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে আমাদের দেশে এসেছে। আবার পান নামের গাছটি আমাদের সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। বিয়েতে, নিত্য অতিথি আপ্যায়নে বাঙালির পানের কোনো বিকল্প নেই অথচ এই পান আমাদের দেশে এসেছে মালয়েশিয়া থেকে। প্রেমে, প্রীতিতে আপন করে নেয়ার এই শিক্ষা বৃক্ষ আমাদের সর্বদা শুনিয়ে যাচ্ছে।
অবাক করার মতো ব্যাপার হলো গাছপালাও কথা বলতে পারে। হ্যাঁ আপনারা সত্যিই অবাক হবেন। কথা বলার প্রক্রিয়াটি ঠিক মানুষের মতো নয়। তবুও একে আমরা কথা বলাই ধরতে পারি। কেননা প্রত্যেকটি উদ্ভিদ নিজেদের মতো করে অন্য উদ্ভিদকে সতর্ক করার মতো সংকেত তৈরি করতে পারে। ধরুন বনের কোনো অংশে ফাঙ্গাসের আক্রমণ হয়েছে, এমন সময় গাছ বিভিন্ন সংকেত ও গন্ধ উৎপাদনের মাধ্যমে অন্যদের সতর্ক করে দিতে সক্ষম। প্রাণীদের মতোই ফেরোমেন নামক কামনীয় গন্ধের মতই বৃক্ষের এই সংকেত মুহূর্তেই বনের অন্যরা জেনে যায়। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু দেখিয়েছেন যে গাছও আতঙ্কিত হয়। যেমন মুলাক্ষেতে যদি গরু ছাগলের আক্রমণ ঘটে বা চাষি মুলা তুলতে আসে তখন পুরো ক্ষেত যেন ভূমি ছেড়ে পালাই পালাই অবস্থা তৈরি হয়। শুধু এই নয় গাছের আছে স্পর্শের অনুভূতি। মানুষ বা প্রাণীর স্পর্শ গাছ প্রাণীর মতো করেই অনুভব করে। আমরা লজ্জাবতী গাছের কথা সকলেই জানি। লজ্জাবতী গাছ যেভাবে স্পর্শে সাড়া দেয় অন্য গাছের এত অধিক স্পষ্ট সাড়া আমাদের চোখে পড়ে না। লজ্জাবতীর কোনো অংশে স্পর্শ মাত্রই তার পাতা বন্ধ হয়ে যায়। আবার সময়ে ধীরে ধীরে পাতা খুলতে শুরু করে। এভাবে যদি লজ্জাবতীর কোনো কাণ্ড গাছ থেকে আলাদা করে তাকে পানিতে রাখা হয় তাহলে তা প্রায় ৫০ ঘণ্টা পর্যন্ত জীবিত থাকে এরপর মরে যায়। গাছের কাণ্ড ভাঙলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। গাছে ধাতব কিছু দিয়ে আঘাত করলে গাছের বৃদ্ধির স্বাভাবিক থাকে না। ক্রেস্কোগ্রাফ নামক যন্ত্র দিয়ে বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু দেখিয়েছেন যে গাছের বৃদ্ধি শামুকের গতির থেকেও ছয় হাজার গুণ কম। আমরা গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিয়ে যাবার বেলায় যখন গাছের ডাল ভেঙে নিই অথবা হঠাৎ রাস্তা হাঁটতে গিয়ে গাছের অপ্রয়োজনীয়ভাবে গাছের পাতা ছিড়ে ফেলি তাতে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এমনকি গাছ এসব সময়ে পীড়িত হয়।
যেহেতু গাছের রয়েছে প্রাণ, আছে দুঃখ-কষ্ট ও আনন্দের অনুভূতি তেমনি রয়েছে এর সংগীতমুগ্ধতা। গাছ গান শুনতে ভালোবাসে। পৃথিবীতে সংগীত খুবই প্রাচীন একটি বিনোদন। মানুষের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের এক অসাধরণ শিল্পকলা এই সংগীত। পাখিরা গান গায়, সামুদ্রিক প্রাণীরও আছে সংগীতমুগ্ধতা কিন্তু গাছ গান শুনতে ভালোবাসে এমন কথা খুবই অবাক করবার বিষয়। বিজ্ঞানী জোয়েল স্টার্নহেইমার দীর্ঘ গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে, মৃদু সংগীতের ধ্বনি গাছের বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আবার অতি উচ্চঃস্বরের বেসুরো সংগীত গাছের বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে থাকে। বিজ্ঞানী জোয়েল স্টার্নহেইমার টমেটো গাছের ওপর সংগীত প্রয়োগ করে প্রমাণ করেছেন যে এতে টমেটোর আকার প্রায় আড়াই গুণ বেড়ে যায়। এমনকি ধানখেতে বিশেষ প্রোটিনের সুরে সংগীত বাজালে ধানের উৎপাদনও বৃদ্ধি করা সম্ভব। সংগীত নিয়ে গাছের এই আচরণ মানুষের আচরণের মতোই।
অনেক সময় বৃক্ষ লতাও আমাদের কাছে বন-বনানী রক্ষা করার আহ্বান জানিয়ে দেয়। গাছের নিজের রয়েছে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। বড় গাছ অর্থাৎ বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ যেমন অশ্বত্থ। এদের কাণ্ড ও বহিরাবরণ এত শক্ত যে সহজে কেউ এর ক্ষতি করতে পারে না। আবার গুল্ম, লতা বা বীরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। যাদের সহজেই মানুষ পায়ে দলে যেতে পারে তাদের রয়েছে নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। শেয়ালকাঁটা নামক গাছের পাতা ও বীজাধার কাঁটাযুক্ত হওয়ায় সহজে কেউ এই গাছে হাত দিতে চায় না। আলকুশী, চুতরা পাতা, আকন্দ, কাঁটা নটে, ফণিমনসা, ক্যাকটাস ইত্যাদি গাছের আছে নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা। এইসব গাছ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে পৃথিবীতে তাদেরও রয়েছে বেঁচে থাকার অধিকার। পাশাপাশি আমাদের এও মনে হয় যে, প্রকৃতি পরোক্ষে আমাদের শেখায় যে প্রকৃতি রক্ষা করাটা আমাদের অন্যতম নৈতিক দায়িত্ব।
বৃক্ষের ফল প্রথমত মানুষের নিকট খাদ্যবস্তু। আর বৃক্ষের নিকট মানুষ ও পশুপাখি তার ফলের মাধ্যমে বীজের স্থানান্তরের বাহক। মানুষের মতো গাছও জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চায় নিজের বংশের বিস্তার করতে। ফলে একটি স্বাভাবিক সুস্থ গাছ থেকে শুরু করে মৃতপ্রায় গাছ সকলই ফুল ও ফল দিতে চায়। গাছের ফল আমাদের কাছে শুধুই খাদ্যপিণ্ড নয়, বরং এর সৌন্দর্যমূল্যও অসাধারণ। আমরা যদি গাছের ফলকে শুধুই ভোগ্যবস্তু হিসেবে না দেখি পাশাপাশি ভোগ্য অধিক সৌন্দর্য হিসেবে দেখি তবেই বৃক্ষ সম্পর্কে আমাদের পরিপূর্ণ দর্শন জন্মে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পল্লীপ্রকৃতি গ্রন্থে যথার্থ বলেছেন- ‘গাছের ফল আমাদেরকে ডাক দেয় শুধু পুষ্টিকর শস্যপিণ্ড দিয়ে নয়। রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ দিয়ে।’ গাছে যখন ফুল ফোটে তখন আমাদের মন কতই না আনন্দিত হয়। বাড়ির নতুন বৌ যখন প্রথম সন্তানসম্ভবা তখন চারদিকে পরিচিতজনদের নিমন্ত্রিত করা হয়। এক ধরনের শোরগোল পড়ে যায়। গাছের ফুল কিন্তু তার গর্ভকালীন সময়। এ সময় গাছে পাতার সংখ্যা কমে যায়। গাছ যেন সকল কিছু উজাড় করে দেয় তার ফুলে এবং আরও পরে তার ফলে। আমরা যে সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হই তার বিপরীতে থাকে বৃক্ষের নবপ্রাণ জন্মদানের সাধনা। এই উপলব্ধি আমাদের মাঝে জন্ম নিলে আমরা শুধু সৌন্দর্য উপভোগ করেই ক্ষান্ত থাকবো না বরং বৃক্ষের এই নবপ্রাণের আগমনকে আরও সুন্দর করে তুলতে পারবো তার ফুল, ফল ও বীজের ক্ষতিসাধন করা থেকে বিরত থেকে।
অবাক করার মতো কথা হলো মানুষ সারাজীবনে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে যে পরিমাণ অক্সিজেন ব্যয় করে একটি মোটরগাড়ি মাত্র এক হাজার কিলোমিটার চললে ব্যয় হয় তার সমান। ফলে আমাদের ভাবনার সময় এসেছে পৃথিবী নামক গ্রহটিকে আমরা কীভাবে পরিশ্রুত ও নৈসর্গিক সুষমায় ভরিয়ে তুলতে পারি। নাকি দূষণের কবলে পৃথিবীকে আমরা ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করাব। মানুষ মাত্রই প্রকৃতি থেকে গ্রহণ করে। এই গ্রহণের বিনিময়ে হলেও মানুষকে প্রকৃতির প্রাপ্য ফিরিয়ে দেয়া উচিত; কিন্তু মানুষের প্রক্রিয়াজাতকরণ দ্রব্যাদি সহজে প্রকৃতিতে মিশে যেতে পারে না। ফলে তৈরি হয় ব্যবধান ও বিপর্যয়। তাই মানুষের ভাবনার সময় এসেছে পৃথিবীর ওপর কত কম জুলুম করে বাঁচা যায় তার পন্থা আবিষ্কার করা। ভোগসর্বস্ব জীবন পরিহার করে, যথাসম্ভব কম ভোগের মধ্য দিয়ে বাঁচা। প্রকৃতিবান্ধব ভোগব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারলে বর্তমান সভ্যতাকে মানুষ বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে পারবে না। বৃক্ষ সেই প্রকৃতিবান্ধব পরিবেশের প্রধানতম একটি উপাদান। সবুজ বনানী ও বৃক্ষ রক্ষা করতে পারলে আধুনিক সভ্যতার ধ্বংসোন্মুখ এই পতনকে রক্ষা করা সম্ভব হবে নতুবা আমাদের ধ্বংস অনিবার্য।
মানুষের আজ সময় এসেছে প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান করে বাঁচতে শেখা। সবুজ বৃক্ষের মধ্যে নিজের অস্তিত্বকে অনুসন্ধান করা। বৃক্ষ সত্তার মধ্যে মানবসত্তার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারলে মানুষ হয়ে উঠবে প্রকৃতির বন্ধু, প্রকৃতির সহায়ক শক্তি। এর মধ্য দিয়ে মানুষ ঘোচাতে পারবে তার আগ্রাসী মনোভাবের কালিমাময় রূপটি। এমনি করে কবি রবীন্দ্রনাথ কবিতায় রোমান্টিক ভাবাবেগে মিশে থাকতে চেয়েছেন পরিবেশ প্রকৃতির বুকে। তাঁর উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থের চৌদ্দসংখ্যক কবিতায় এই আকুতি প্রকাশ করেন-
যদি চিনি, যদি জানিবারে পাই,
ধুলারেও মানি আপনা।
ছোটো বড়ো হীন সবার মাঝারে
করি চিত্তের স্থাপনা।
হই যদি মাটি হই যদি জল
হই যদি তৃণ, হই ফুলফল
জীবসঙ্গে যদি ফিরি ধরাতল
কিছুতেই নাই ভাবনা।
যেথা যাব সেথা অসীম বাঁধনে
অন্তবিহীন আপনা।