
আফসানা বেগম।
আগে কমবেশি যাওয়া হলেও কলেজজীবনে ঢাকায় নিয়মিত বসবাসের সুবাদে বইমেলায় আমার রোজকার উপস্থিতি আশির দশকের শেষ বছরটি থেকে। তখন সত্যিই দিনের বেলা ওটা আমার কাছে প্রাণের মেলাই ছিলো। প্রতিটি মুহূর্তে কেবল আড্ডা আর আড্ডা। তবে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে কোনো বই ছাড়া ফিরেছি বলে মনে পড়ে না।
ছোট জায়গা, কিছু প্রিয় আর কিছু অজানা প্রকাশনীর স্টল, কয়েক পাক দিলেই মুখস্ত হয়ে যেতো কোথায় কী সাজানো আছে। মনে করে রাখা লিস্ট থেকে প্রতিদিন দুই-তিনটি বই আমার সঙ্গে বাড়িতে রওনা দিতো। সারাবছর কি আর বই কিনতাম না? কিনতাম বটে, তবে বইমেলায় কেনা বইয়ের ছিল অন্য এক আবেদন।
প্রথম পাতাটা উলটে নিজের নামের নিচে ‘বইমেলা’, আর তারপর কমা দিয়ে সাল লিখে রাখা। কিছু বছর পর সেই পাতাটা উলটে সালের দিকে তাকিয়ে উল্লেখ্য বছরের আড্ডার স্মৃতিতে হাবুডুবু খাওয়া, সে এক অন্যরকম আনন্দ।
বাংলা একাডেমির মাঝখানে বট গাছটার নিচে বসে আড্ডার ফাঁকে স্কুল-কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতাম। কখনো সমবেত কণ্ঠে জনপ্রিয় কবিতা আবৃত্তি করতাম আমরা। হাসি-ঠাট্টায় ব্যস্ত অবস্থাতে কখনো কোনো বর্ষীয়ান কবি বা লেখককে হেঁটে যেতে দেখলে হুট করে নীরব হয়ে যেতাম। সামান্য দূরত্ব রেখে একভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে তার হেঁটে যাওয়া দেখতাম, দেখতাম মানুষই তো, তবে কী করে আমাদের সমস্ত অনুভূতি বুঝে ফেলেন, কী করে আগে আগে সব জেনে যান আর লিখে ফেলেন!
হাজার হাজার নতুন বইয়ের গন্ধে ঠাসা জায়গাটাতে নামকরা লেখক-কবিদের দেখার আশায়ই হয়তো বসে থাকতাম কোনো বিকেলে। বাসার সান্ধ্য আইনের যন্ত্রণায় ফিরতে হতো তাড়াতাড়ি। তাই সবদিন তাদেরকে দেখা ভাগ্যে জুটত না। তবু যারা আমাদের সে সময়ের ‘ক্রেজ’ তাদের দেখতেই হবে, একটি-দুটি বইয়ে লেখকের অটোগ্রাফ নিতেই হবে, এ ছিল অনিবার্য ব্যাপার।
সবচেয়ে আগের স্মৃতি হিসেবে যা মনে পড়ছে, সম্ভবত ১৯৮৫ সাল, আমার আছে জল বইটিতে হুমায়ূন আহমেদের স্বাক্ষর নিতে পারলাম না। সন্ধ্যা পর্যন্ত সেদিন তিনি মেলায় এলেন না। ভেবেছিলাম পরদিন, যেটা ছিল মেলার শেষ দিন, আবার বইটি হাতে করে নিয়ে গিয়ে অটোগ্রাফ চেয়ে নেব। কিন্তু সে রাতে উপন্যাসটি এক টানে শেষ করার পরে ১৩-১৪ বছর বয়সি আমি অনায়াসে উপন্যাসের ১৪ বছর বয়সি মেয়েটির মধ্যে ঢুকে গেলাম।
সারারাত কেঁদেকেটে পরদিন আর ঘর থেকে বেরোনোর উপায় থাকলো না। বাড়ির সবাই জ্বর-টর হয়েছে ধরে নিল। কালবৈশাখীর কারণে সামান্য ঠান্ডা আবহাওয়ায় দিনভর চাদরের নিচে আত্মগোপন করা সহজ হলো। তার পরের বহুবছর সেই এক রাতের স্মৃতি তাড়া করল আমাকে আর বইটির দিকে তাকালেই অটোগ্রাফ না পাওয়ার দুঃখ। এমনিতে বহু বইয়ের প্রথম পাতাটিতে লাইনে দাঁড়িয়ে জোর করে প্রিয় লেখকের শুভেচ্ছাবার্তা আদায় করা ছিল। মাঝেমধ্যে সেসবের দিকে তাকিয়ে থাকতে বেশ লাগত। গর্ব হতো কাউকে দেখাতেও।
তবে তখন বুঝিনি, সময়ের স্রোতে নতুন অনেক কিছু জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, আগের গুরুত্বময় জিনিস উপেক্ষিত হয়। তাই হয়তো জীবনের প্রতিযোগিতায় ছুটতে ছুটতে আর ধাপে ধাপে জায়গা পরিবর্তন করতে করতে নিজস্ব সম্পদের মতো আগলে রাখা বইয়ের ভান্ডার কোথা থেকে কোথায় চলে গেছে, আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে পিছনে তাকালে হিসাব মেলানো যায় না।
১৪ বছর বয়সের আবেগ অনেক আগে পেছনে ফেলে এসেছি। আজ এত বছর পরে জানি, বইয়ের পাতার প্রতিটি শব্দ কি বাক্যই লেখকের অটোগ্রাফ। শত শত শব্দ বইয়ের পাতায় পাতায় লেখকের সৃষ্টিশীলতা, বুদ্ধিমত্তা আর রসবোধের কথা বলে। একমাত্র তারাই পারে জীবিত লেখককে মেরে ফেলতে আর মৃত লেখককে মৃত্যুর পরেও বহুবছর বাঁচিয়ে রাখতে। আজ আর অটোগ্রাফের জন্য লাইনে দাঁড়াই না, আগলে রাখা অটোগ্রাফসমেত বই হারিয়ে যাওয়ায় দুঃখ পাই না। আজ নিজের মতো করে তালিকা করে নিয়ে বইমেলায় যাই, নীরবে বই কিনে ফিরি, বাদ পড়লে অনলাইন বই বিক্রি কার্যকলাপের শরণাপন্ন হই।
আজ আর আগের মতো ঢাকঢোল পিটিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিই না, বই হাতে বাংলা একাডেমি চত্বরে বসে থাকি না বলে কি বইমেলার আবেদন আমার কাছে কমেছে? একদম নয়। দেশ থেকে দূরে থাকলে কখনো কেবল মেলার জন্য আসা কঠিন হয়ে যায়, নিজেকে বোঝাই, বইমেলা বইয়ের দোকান বই অন্য কিছু তো নয়! অথচ একুশ আসতে আসতে আর নিজেকে ধরে রাখা যায় না।
তাই মেলার টানে ঠিকই জায়গামতো এসে দাঁড়াই। এখন লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হয়ে বইমেলার টান বরং আরেকরকমভাবে বেড়েছে, নিজেকে কোনোভাবে আয়োজনটির সঙ্গে যুক্ত ভাবতে অন্যরকমের আনন্দ হয়। জীবনের একেক ধাপে বই আর বইমেলা কতো ভাবেইনা আমাকে জড়িয়ে রেখেছে!
লেখক : গল্পকার ও অনুবাদক