লোকসাহিত্যের সংগ্রাহক: মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন

মুশনাদ মুনতাকা হক
প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২২, ১২:৩৩

মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন। ছবি: সংগৃহীত
হারামনি আমাদের সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। ১৩ খণ্ডে প্রকাশিত এই বইগুলোর দুই মলাটের ভেতরে ধরা রয়েছে বাংলা সাহিত্যের প্রাণভোমরা। আমাদের লোকসাহিত্যে এই স্বর্ণখনিকে যিনি সযত্নে সংগ্রহ করেছেন তিনি মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জানুয়ারি পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার মুরারিপুর গ্রামে তার জন্ম।
ছেলেবেলাতেই তার ভালো লাগতো বাউলদের নাচ-গান; তৈরি হয় মুগ্ধতা। সেই মুগ্ধতা বাড়ে স্কুলের ছাত্রাবস্থাতেই। বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুরেন্দ্রনাথ সেনের অনুপ্রেরণায় হাতেখড়ি হয় সাহিত্য সাধনার। তিনি যখন দশম শ্রেণির ছাত্র, তখন হাতে আসে কলকাতা থেকে প্রকাশিত প্রবাসী পত্রিকা। পত্রিকাটির সে সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংগৃহীত লালনের গান ছাপা হয়।
বিশ্বকবির সংগৃহীত লালনের গান কিশোর মুহম্মদ মনসুর উদ্দীনের মনেও লোকসংগীত সংগ্রহের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। তিনি নিজের গ্রামের বাউল প্রেমদাস বৈরাগীর কাছ থেকে লালন শাহের কয়েকটি গান সংগ্রহ করেন। তার পর গানগুলো পাঠিয়ে দেন প্রবাসী পত্রিকায়।
প্রবাসীর পাতায় ১৩৩০ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যায় সেগুলো প্রকাশ পায়। লোকসংগীত এবং লোকসাহিত্যের প্রতি তার এই আগ্রহ আরও বাড়ে রাজশাহী কলেজে বিএ পড়ার সময়। এ সময়ে তিনি ‘বাংলাদেশের পল্লীগান’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন কলেজের এক অনুষ্ঠানে। প্রবন্ধের বিষয় এবং ভাষায় মুগ্ধ হয়ে অধ্যক্ষ কুমুদিনীকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ফোকলোর চর্চায় মনসুর উদ্দিনকে উৎসাহ দেন।
এর পর মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন পুরোপুরি নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন লোকসংগীতের বিপুল ভাণ্ডার সংগ্রহে। গ্রামবাংলার বাউল-ফকিরদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তোলেন। লোকসংগীত সংগ্রহের জন্য ঘুরে বেড়ান দেশের নানা প্রান্তে।
লোকসংগীত এবং লোকসাহিত্য সংগ্রহে তিনি আর্শীবাদ পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও। তার প্রশংসা করে ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের পৌষ-সংক্রান্তিতে শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখেন- ‘বাঙলা দেশের গ্রামের গভীর চিত্তে উচ্চ সভ্যতার প্রেরণা ইস্কুল-কলেজের অগোচরে আপনা-আপনি কী রকম কাজ করে এসেছে, হিন্দ-মুসলমানের জন্য এক আসন রচনার চেষ্টা করেছে, এই বাউল গানে তারই পরিচয় পাওয়া যায়।
এই জন্য মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন মহাশয় বাউল সঙ্গীত সংগ্রহ করে প্রকাশ করবার যে উদ্যোগ করেছেন, আমি তার অভিনন্দন করি।’ মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন গ্রামীণ জনপদে ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করেছিলেন প্রায় ছয় হাজার লোকগান। তার রচিত এবং সম্পাদিত বইয়ের সংখ্যা ৪২টি।
এসব বইয়ের মধ্যে হারামণি ছাড়া তিন খণ্ডে প্রকাশিত বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনার বিষয়ে গবেষণাগ্রন্থ অন্যতম। মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন ছিলেন বিশ্বমানব। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি ফোকলোর ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার। ১৯৮৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মারা যাওয়া এই কর্মবীরের সে স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেছে।