Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

অভিযোগ-অনুযোগে একুশে বইমেলা

Icon

জোবায়ের মিলন

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৯:৩১

অভিযোগ-অনুযোগে একুশে বইমেলা

ফাইল ছবি

পা পা করে দুই সপ্তাহ পেরিয়ে অমর একুশে বইমেলা তৃতীয় সপ্তাহে আসীন। এর মধ্যেই ভরে উঠেছে মেলা প্রাঙ্গণ। অল্পসংখ্যক সরকারি প্রতিষ্ঠান একাডেমির মূল উঠানে আর বাকিরা সবাই ঐতিহাসিক স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। 

কয়েক বছর আগে মেলার কিছু অংশ বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে উদ্যানে সম্প্রসারণ করা হলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তবে এখন সর্বাঙ্গে মেলা চলছে সম্প্রসারিত স্থানে। সেই সঙ্গে লিটলম্যাগও এবার বহেড়াতলা ছেড়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলে এসেছে। 

প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসে হাজারও বইপ্রেমী, দর্শনার্থী। দেখা যায় ভিন্ন ভাষার বিদেশিদেরও। একুশে বইমেলা এখন শুধু লেখক, পাঠক, প্রকাশকের মধ্যে বৃত্তাবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে পড়েছে সর্বসাধারণের মধ্যে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষই এখানে আসেন। রোজ রোজ শত নতুন বই প্রবেশ করে মেলার প্রকাশনী ঘরে। কোণায় কোণায় চলে আড্ডা। 

আছে বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্র। আছে নিরাপত্তাকর্মী। হেল্পডেক্স। কত মানুষের আনাগোনা মেলাজুড়ে। তবে ভালোর সঙ্গে বিচ্যুতিও চোখ এড়ায় না। এ তালিকা খুব ছোটও নয়। কিছু ব্যত্যয় জানা যায় লেখক, পাঠক, প্রকাশক আর দর্শকের মুখে ও সরেজমিনে ঘুরে। 

মেলায় স্টল পাওয়া অনেক প্রকাশনীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলা একাডেমি প্রদত্ত সরবরাহকৃত পানির ব্যবস্থা অপ্রতুল। নিজেরাই পানি কিনে আনতে হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। মেলার আয়তন বৃদ্ধির দিকে কর্তৃপক্ষের খেয়াল সরব থাকলেও হাজার হাজার মানুষের এই মেলায় নেই পর্যাপ্ত শৌচাগার, যা প্রকাশনীগুলোতে কর্মরত কর্মী ও দর্শনার্থীদের বিপত্তিতে ফেলছে অনেক সময়ই। মেলা কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত খাবারের দোকান আছে, তাতে আকাশতুল্য দাম। সামান্য খাবারের দাম তিন থেকে চারগুণ বাড়িয়ে বিক্রি করছে দোকানিরা। 

স্টল-কর্মীরা জানান, আমাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েও যদি বাংলা একাডেমি একবেলা নাস্তা সরবরাহ করতো, তাতে অনেকটা বিপত্তি থেকে বাঁচা যেত। 

অন্বয় প্রকাশনীর কর্ণধার, শিশু সাহিত্যিক হুমায়ূন কবীর ঢালী জানান, বাংলা একাডেমি অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখার যে নির্দেশনা রয়েছে, তা বৈষম্যপূর্ণ। এক ইউনিটের স্টলে যে ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে, তিন বা চার ইউনিটের স্টল বা প্যাভিলিয়নের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা হয়েছে। নেই প্রশিক্ষণ। 

তার মতে, ‘এই ব্যবস্থাটি বাংলা একাডেমিই করতে পারতো টাকার বিনিময়ে। পুরো মেলাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে ফায়ার ইউনিট বসানো যেত, তাদের তত্ত্বাবধানে স্টলে স্টলে টিউব স্থাপন ও নজরদারীর ব্যবস্থা করলেই ভালো হতো।’ 

পাঞ্জেরী প্রকাশনীর দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা পূর্ববর্তী সমস্যাগুলোর সঙ্গে যোগ করলেন, ‘স্টল বরাদ্দের কাজটি আর একটু আগে হলে ভালো হতো।’ 

প্রথমা প্রকাশনীর পক্ষ থেকে এক কর্মকর্তা জানান, ‘প্রকাশনীগুলোকে মেলার গেইট খোলার এক ঘণ্টা আগে থেকে ও যখন-তখন বই প্রবেশের অনুমতি দেয়া থাকলেও গেইটের নিরাপত্তাকর্মীদের বাধার মুখে পড়তে হয় বার বার। এই গেইট দিয়ে না, ওই গেইট দিয়ে যেতে হবে। এতে সময় যেমন নষ্ট হয়, কাজও বিঘ্নিত হয়। নিরাপত্তাকর্মীদের কাছে এই নির্দেশনাটি আরো ভালোভাবে পৌঁছালে ভালো হতো।’

গল্পকার মোস্তফা হোসেইন মেলাকে দেখছেন ‘মিলন মেলা’ হিসেবে। তিনি বলেন, ‘এ মিলন মেলায় কী হচ্ছে, তা দেখভালের দায়িত্ব মেলা কর্তৃপক্ষের। লোকে লোকারণ্যতা দেখে বিমোহিত হওয়ার কিছু নেই। মূল উদ্দেশ্য সাহিত্যের উৎকর্ষ, পাঠকের উৎকর্ষ। সে দিকে খেয়াল কমালে আদতে কোনো লাভ নেই। এদিকে কর্তৃপক্ষের নজর কম। অপ্রয়োজনীয় অনেক অনেক প্রকাশনীকে স্টল দিয়ে বইয়ের নামে যা-তা প্রকাশ ও উপস্থাপনের সুযোগ করে দিচ্ছে বাংলা একাডেমি, যা উচিত নয়।’ 

তিনি বাংলা একাডেমির সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের দায়িত্বের কথাও বললেন। তিনি বলেন, ‘পাঠক সৃষ্টি, পাঠকের মন মেজাজ তৈরি ও পাঠকের কথা ভাববার কথা গ্রন্থকেন্দ্রেরই। তারা তাদের কাজ করছে না ঠিকঠাক। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ক্রমেই হয়ে উঠছে বারোয়ারী মেলার মতো। এট করতে দেয়া উচিত নয়।’ 

লেখক স্বকৃত নোমান বলেন, ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলায় কিছু স্টলে গাইড বই তোলা হয়েছে ও বিক্রির জন্য প্রচার করছে। এমন অনেক স্টল আছে নাম মাত্র খুলে বসে আছে! কী বই উপস্থাপন করছেন তারা, নিজেরাও তা জানেন না। এটি দেখবার দায়িত্ব বাংলা একাডেমির। পাঠকরা বোকা নয়, তারা শুধু বই কেনে না, মেলাকেও দেখে। অভিযোগ করে তারা ভালো বইয়ের অভাব। সূচি করে মেলায় না আসলে বই নির্বাচন করা অসম্ভব। নতুন পাঠকদের জন্য বই কেনা মুশকিল। রঙের বাহারে চেনা যায় না কোনটা কি বই, কার বই। কী মানের বই। ভুলে ভরা বইয়েরও অভাব নেই। এই বিষয়টিতে কারা নজর দেবে? কাদের দায়িত্ব? তথ্যকেন্দ্রগুলো শুধু হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে দিচ্ছে, ইঙ্গিতে স্টল পাওয়া সহজ নয়।’ 

মেলায় অমর একুশের আবহ নেই, কেন নেই? আবৃত্তি শিল্পী সাফিয়া খন্দকার রেখা বাংলা একাডেমির কাছে জানতে চান, ‘এ বছর ভাষা শহীদদের কোনো ছবি মেলাজুড়ে নেই কোন যুক্তিতে? অন্য বছরগুলোতে মেলায় একুশের গান বাজতে শোনা যেত, এ বছর গেল কই? অমর একুশে গ্রন্থমেলা নাম যেহেতু পরিবর্তন করা হয়নি, তবে বাকিগুলো কেন পরিবর্তন হলো? যদি একুশের মর্মকথার সুর পাওয়া না যায়, তবে একে একুশে গ্রন্থমেলা বলে লাভ কি! উত্তরগুলো বাংলা একাডেমির কাছেই প্রত্যাশা করি।’ 

লিটলম্যাগ ‘দৃষ্টি’র সম্পাদক বীরেন মুখার্জী ও ‘শব্দকুঠি’র নির্বাহী সম্পাদক বঙ্গ রাখালের পরামর্শ, লিটলম্যাগ যেহেতু কারো বিরোধী নয়, চলতি ধারার বাইরে, সেহেতু বাংলা একাডেমি লিটলম্যাগ নিয়ে তার ভাবনার প্রসার ঘটালে লিটলম্যাগ নয়, ভিন্ন ধারার সাহিত্য উপকৃত হবে। 

অমর একুশে গ্রন্থমেলা দিন দিন এগিয়ে চলেছে নানা উদ্যোগে আয়োজনে। কেবল বিক্রিতে সন্তুষ্ট না থেকে বইয়ের, পাঠের, পাঠকের অর্থাৎ মেধা ও মনন গঠনে বইয়ের সম্পৃক্ততা বাড়াতে ও বইয়ের মানোন্নয়নের দিকে সচেতন হতে হবে। এই মেলাকে বাণিজ্য মেলায় পরিণত না করার দিকে কঠোর খেয়াল রাখার পরামর্শ সচেতন মহলের। 

বই আর সব পণ্যের মতো নয়। বই শব্দটির সঙ্গে বিবেক, বোধ, বিবেচনা- সর্বোপরি প্রকৃত মানুষের সম্পর্ক বিরাজমান। সে বিষয়ের দিকে খেয়াল রেখেই বাংলা একাডেমি সিদ্ধান্ত নেবে বলে আশা করা হচ্ছে। চিন্তা, চেতনা, ভাবনা ও ভালোবাসায় জয় হোক অমর একুশে গ্রন্থমেলার। দূর হোক বাণিজ্যকেন্দ্রিক চেতনা।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫