Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

আলী ইমাম: বাংলা শিশুসাহিত্যের বাতিঘর

Icon

অদ্বৈত মারুত

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২২, ১৫:৩৫

আলী ইমাম: বাংলা শিশুসাহিত্যের বাতিঘর

আলী ইমাম। ছবি: সংগৃহীত

স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে আমাদের শিশুসাহিত্য যাদের নেতৃত্ব ও অভিভাবকত্বে আজ এই পর্যায়ে এসেছে, তাদের মধ্যে আলী ইমাম (জন্ম ৩১ ডিসেম্বর ১৯৫০-মৃত্যু ২১ নভেম্বর ২০২২) অন্যতম। প্রখর মেধাশক্তির অধিকারী ছিলেন আলী ইমাম ছিলেন সুবক্তা।

বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে তার ছিল অগাধ জ্ঞান। কৈশোরেই আত্মস্থ করতে সক্ষম হয়েছিলেন শিশুসাহিত্যের সব ধরনের অনুষঙ্গ এবং নির্মাণ কলাকৌশল। শব্দের মায়াবী বন্ধনে রূপকল্পনার জাল বিছিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন লেখালেখির শুরুর ভাগেই। শৈশবেই আলী ইমামকে অনুপ্রাণিত করেছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বই ‘বুড়ো আংলা’। বলা যায়, এটিই তাকে টেনে এনেছে লেখালেখির জগতে।

এক সাক্ষাৎকারে তিনি বইটির প্রসঙ্গ টেনে স্বীকারও করেছেন, ‘আমি তো লেখালেখির জগতে আসলাম একটা বই পড়ে। সেটা হলো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বুড়ো আংলা’। বইটা আমি পড়ি ১৯৬৪ সালে, তখন ক্লাস এইটের ছাত্র। বইটি আমাকে স্কুল লাইব্রেরিতে পড়তে দিলেন বাংলা শিক্ষক কাজী নুরুল হক।

বইটি পড়েই বুঝলাম, সাহিত্য, ভাষা, শব্দ যা এমন একটা জিনিস যা মানুষকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যাবে, যা মানুষকে পাল্টে দেবে। আমারও চারপাশটা পাল্টে গেল। আমি বুঝতেই পারিনি লেখার ভেতরে, শব্দের ভেতরে একটা জাদুকরী প্রভাব থাকতে পারে। এরপর থেকে বুঝতে পারলাম আমাকে শব্দের সঙ্গে থাকতে হবে এবং আমি লেখালেখি শুরু করলাম।’

মোহনীয়, জাদুকরী শব্দে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘দ্বীপের নাম মধুবুনিয়া’র মধ্য দিয়ে আলী ইমাম শুরুতেই চমক সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে। এর তিন বছর পরই ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় উপন্যাস ‘অপারেশন কাঁকনপুর’। এটি পরবর্তীকালে নাট্যরূপ দিয়েছিলেন নাট্যকার মমতাজউদদীন আহমদ।

বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত নাটকটির প্রযোজনায় ছিলেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। ‘অপারেশন কাঁকনপুর’-এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে একাধারে প্রকাশ হয় উপন্যাস ‘তিরিমুখীর চৈতা’; গল্পগ্রন্থ ‘রুপোলী ফিতে’ ও ‘শাদা পরী’ এবং কাব্যগ্রন্থ ‘ধলপহর’। এই ৭২ বছর বয়স পর্যন্ত আলী ইমামের কলম একদিনের জন্যও থেমে থাকেনি। অবিরাম গতিতে তা প্রবহমান ছিল। শিশুমানস, শিশুজগৎ এবং শিশুকল্পনা ধারণ করে বহুধাবিস্তৃত রচনাসম্ভারে বহুবর্ণে রাঙিয়েছেন আমাদের শিশুসাহিত্য। 

আলী ইমাম বিশ্বাস করতেন, ‘বই স্বপ্ন দেখাতে শেখায়’। আজীবন সচেষ্ট থেকেছেন বই সঙ্গী করে। লিখেছেন তেমন ধরনেরই বই, যেসব বই শিশুকে স্বপ্ন দেখাবে, ভাবতে শেখাবে, কল্পনার জগতে পাখা মেলতে শেখাবে। অনুভবও করেছেন এ ধরনের বইয়ের প্রয়োজনীয়তা। ভেবেছেন শিশুকে প্রেরণা জোগানো, তাকে উদ্দীপ্ত করে তোলার মতো বই প্রয়োজন।

তা মেটানোর দায়টাও তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে। সাগরতলের রহস্য থেকে শুরু করে কল্পবিজ্ঞান, প্রাচীন উপকথা, লোককথা, রূপকথার সঙ্গে ইতিহাস ও ঐতিহ্যও তিনি শিশুদের উপযোগী করে লেখায় তুলে এনেছেন। 

বাংলা শিশুসাহিত্য রচনার দক্ষ কারিগর, সংগঠক এবং টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব আলী ইমাম আজীবন শিশুদের জন্য আনন্দনগরের সন্ধান করে গেছেন। তিনি জানতেন, জ্ঞানে, সৃজনে, কর্মে এবং সর্বতোভাবে একটি সুস্থ, সুন্দর আগামীর জন্য বিপুল আয়োজন থাকা প্রয়োজন। শিশু-কিশোররাই আগামী সাহিত্যের জীয়নকাঠি। তাদের জন্য প্রয়োজন স্বপ্নের জগৎ তৈরি করে যাওয়া।

আর তা সম্ভব হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে শোভা পাবে সৎ ও প্রকৃত সাহিত্য। আলী ইমাম এক্ষেত্রে সৌভাগ্যবানদের একজন। কারণ তিনি আমাদের শিশুসাহিত্যের অনিবার্য লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। শব্দের পর মায়াবী শব্দ বুনতে পারতেন।

প্রকৃতির এমন কোনো বিষয় নেই, যা তার চোখ স্পর্শ করেনি। দুহাতে লিখেছেন নীল সমুদ্রের গহিনে ঘুরে বেড়ানো কিশোরের কৌতূহলী মন থেকে শুরু করে কল্পবিজ্ঞানের যাবতীয় খুঁটিনাটি। রহস্যাবৃত গোয়েন্দাগিরির শ্বাসরুদ্ধকর ভ্রমণবৃত্তান্তের মধ্য দিয়ে তিনি এমন এক ধূসরজগতে ঢুকিয়ে দিতেন পাঠককে, সেখানকার অভেদ্য দরজা খুলে বের হওয়া যেমন কঠিন; বের হতে পারলেও ঘোরে আচ্ছন্ন রাখে বহুদিন। 

আলী ইমামকে কিংবদন্তিতুল্য শিশুসাহিত্যিক বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। তিনি নিজে যেমন ছিলেন অপূর্ব প্রাণশক্তির অধিকারী, তেমনি অন্যদের ভেতরে প্রাণপ্রতিষ্ঠা, অন্য মানুষের ভেতরের শক্তি তিনি অনায়াসে বের করে আনতে পারতেন। প্রকৃত অর্থে, তিনি ছিলেন কালের নায়ক।

আলী ইমাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। জন্মের ছমাস পরই পুরো পরিবার চলে আসেন ঢাকায়। বসবাস শুরু করেন পুরান ঢাকার ঠাটারীবাজারে। শৈশব-কৈশোরের পুরো সময়টাই কেটেছে পুরান ঢাকা তথা ওয়ারী, লিঙ্কন রোড, নয়াবাজার, নওয়াবপুর, কাপ্তানবাজার, ফুলবাড়িয়া এলাকায়।  

লেখালেখি তথা শিশুসাহিত্যচর্চা শুরু করেন কিশোর বয়সেই। আলী ইমাম বাংলাদেশ টেলিভিশনের কর্মকর্তা ছিলেন। কর্মজীবনের শেষ প্রান্তে তিনি একাধিক স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘হ্যালো, আপনাকে বলছি’ (১৯৯৯-২০০৪) নামে তার উপস্থাপিত সরাসরি অনুষ্ঠানটি জনপ্রিয় হয়েছিল। এছাড়া বাংলাদেশ টেলিভিশনের বিখ্যাত প্রামাণ্য শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’র (১৯৮০-১৯৮৭) আলোচিত প্রযোজক ছিলেন আলী ইমাম।

১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৭ বছর তিনি ইউনিসেফের ‘মা ও শিশুর উন্নয়নে যোগাযোগ কার্যক্রম প্রকল্প’ পরিচালক ছিলেন। ওই দায়িত্ব পালনকালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে, জার্মানির মিউনিখে, ব্রাজিলের রিওতে অনুষ্ঠিত ‘চিলড্রেন মিডিয়া সামিটে’ যোগদান করেন।

জার্মানির মিউনিখে অনুষ্ঠিত ‘প্রি জুঁনেসি চিলড্রেনস টিভি প্রোডাকশন প্রতিযোগিতা’র (২০০০) জুরির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি ছিলেন ‘সার্ক অডিও ভিজুয়াল বিনিময় অনুষ্ঠানে’র প্রধান সমন্বয়কারী (২০০০-২০০১)। 

পাঁচ শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা আলী ইমাম। উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে- সোনালী তোরণ; আলোয় ভুবন ভরা; দুঃসাহসী অভিযাত্রী; প্রিয়-প্রসঙ্গ; বুনোহাঁসের পালক; সেসুলয়েডের পাঁচালী; রক্ত দিয়ে কেনা; ভিনদেশী কিশোর গল্প; কাছের পাহাড় দূরের পর্বত; সাগর থেকে সাগরে; বাংলাদেশের কথা; বিদেশি পর্যটকদের চোখে বাংলাদেশ; দূরের দ্বীপ কাছের দ্বীপ; প্রাচীন বাংলা বৌদ্ধ বিহার; বাঙলা নামে দেশ; ডানা মলার দিন; দেখোরে নয়ন মেলে; কাছে থেকে দূরে; ধলপহর; হিজল কাঠের নাও; ঘাসের ডগায় হলুদ ফড়িং; অপারেশন কাঁকনপুর; পাখিদের নিয়ে; জাফলঙ্গের বিভীষিকা; সবুজ বাড়ির কালো তিতির; বাদাবনে লড়াই; হিমছড়ির ভয়ঙ্কর; সনুমামার অভিযান; ভয়ঙ্করের হাতছানি; নীল সাগরের প্রাণী ইত্যাদি।

শিশুসাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য আলী ইমাম পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, শিশু একাডেমি কর্তৃক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, ইকো সাহিত্য পুরস্কার, নেধুশাহ সাহিত্য পুরস্কার, লেখিকা সংঘ পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার। ভূষিত হয়েছেন অসংখ্য পদক ও সম্মাননায়।

বাংলা শিশুসাহিত্যের নতুন সৃষ্টির অন্যতম একজন আলী ইমাম জীবন থেকে ছুটি নিলেও তিনি বেঁচে থাকবেন অসংখ্য শিশু-কিশোরের হৃদয়ে। তরুণ থেকে বৃদ্ধ- তার সৃষ্টিশীল কর্মের কারণে মনে রাখবে শিশুসাহিত্যের অন্যতম বাতিঘর হিসেবেই।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫