Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

মৃতের ছায়া, প্রাণের ছায়া

Icon

দ্বিত্ব শুভ্রা

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২২, ১৫:৫৪

মৃতের ছায়া, প্রাণের ছায়া

কবির ডায়েরি। ছবি: সংগৃহীত

এক.
লোকে নাকি মৃতকে ভয় পায়, মৃত মানুষকে ভয় পায় আর আমার অবাক লাগে। শুনেছি, অনেকে খুব কষ্ট পায়, মৃত্যু অনেক যন্ত্রণার, পানির জন্য কাকুতি মিনতি করে, হাঁসফাঁস করে- আমি অমনটা দেখিনি। জীবনের সেই মুহূর্ত- সবাই যখন বলছে এই শেষ! তখন আমি ঘোর বিস্ময়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকি।

হয়তো বুঝতে চাই সত্যি কি সে চলে গেছে অন্য জগতে? ঐ তো আমার সামনে নীরবে শুয়ে আছে। কী অপূর্ব! মসৃণ শান্ত মুখ। ঘুমন্ত চোখের নিচে অনেক স্বপ্ন। কারও অবয়বে লেগে থাকে মায়াবী আলো। স্বপ্নকে স্পর্শ করলে যেমন বুক ভরে আনন্দ হয়, তার পরশ ছড়িয়ে যায় শরীর জুড়ে, প্রথম প্রথম প্রেমে পড়লে চেহারা যেমন অজান্তেই উজ্জ্বল হয়, কারও কারও অবয়বে অমন রং ফুটে ওঠে।

মৃতের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আমার ক্ষণে ক্ষণে ইচ্ছে হয়, ইচ্ছে হয় তার কানেকানে বলি, এখন ভালো আছো তুমি? এখন ভালো আছো তুমি?

ডাক্তার, নার্স নই আমি, তবে হাসপাতালে কাজের সুবাদে কিছু মানুষের সাথে শেষ দিনকাল, কখনও মাস, কখনও বছরের চেনাজানা  হয়ে যায়। ক্যানসারের রোগী প্রথমে দুই পায়ে হেঁটে আসে, পাশাপাশি গল্প করতে করতে এখানে ওখানে যাই। ওষুধ নেয়, কেমোথেরাপি শুরু করে। একদিন তার ক্লান্ত লাগে, তবে হুইলচেয়ার অফার করলে দ্রুত না, না করে।

তার অবস্থা তো অত খারাপ নয় যে হুইলচেয়ারে বসবে! হুইলচেয়ার মানে এক প্রস্থ হেরে যাওয়া সেটাকে তারা সচেতনভাবে আড়াল করতে চায়। কিন্তু চলতে গেলে বুঝি, সে হাঁটছে আগের চেয়ে ধীরে, পথটা বেড়ে উঠছে তার কাছে। এরপর হুইলচেয়ার নিতে না করে না।

এরকম একজন তাকে পরিবারের কেউ বলেনি তার ক্যানসার হয়েছে, সব ট্রিটমেন্ট এমনভাবে চালানো হচ্ছে যেন অন্য কোনো শারীরিক সমস্যার চিকিৎসা চলছে। সে প্রায়ই বলত, ব্যথা! ব্যথা! ডাক্তার এত ওষুধ দিচ্ছে, ব্যথা যাচ্ছে না কেন? মরফিন দিয়ে ব্যথা সাময়িক কমানো হতো। আহ! আমি তাকে কীভাবে বলতাম, ঠিক হয়ে যাবে? এইসব প্রহসনে মাথা নত হয়ে আসে।

মৃত্যুর গল্প অনেক হলো, তিন-চার দিন আগে একজন রোগীকে দেখলাম, ট্রাকের সাথে মোটর সাইকেল অ্যাক্সিডেন্টের রোগী। একটা পা অলরেডি কেটে ফেলা হয়েছে, আরেকটা পা সেটা এত ভয়ংকর রকমভাবে চাপ খেয়েছে যে উরু থেকে গোড়ালি অব্দি মাংস ফেটে দো ফাড়া হাঁ হয়ে আছে। চ্যাপটা হয়ে ছড়িয়ে থাকা মাংসের মাঝে একটা লম্বা সাদা হাড়।

মাংসগুলো এত থেঁতলানো, ওগুলো দিয়ে যে কী করা যাবে সেটা ভাবা অসম্ভব। ওদিকে পেটে চাপ খেয়ে ভেতরের সমস্ত নাড়িভুঁড়ি থেঁতলে একপাশে সরে গেছে। সার্জন সেসবের অর্ধেকটা ফেলে দিয়েছিল। তখন পর্যন্ত সে বেঁচেছিল। 

একদিন মোহাম্মদপুর আসাদ গেট এরিয়ায় সকালের দিকে খুব জ্যাম। রিকশায় বসে অপেক্ষা করছি। এসময় দেখি এই জ্যামের ভেতর রাস্তার উল্টো দিক দিয়ে দুটো ছাত্র মোটর সাইকেল চালিয়ে আসছে। ছাত্রদের বয়স বড় জোর তেরো চৌদ্দ।

আমার আশ্চর্য লাগে, কোন বাবা-মায়েরা তার চৌদ্দ বছরের ছেলেকে ঢাকার মতো ট্রাফিক নিয়মকানুনহীন রাস্তায় মোটর সাইকেল কিনে দেয়? ওরা অ্যাক্সিডেন্ট করে করুক, মরে মরুক, আমার কিচ্ছু মনে হবে না। কিন্তু এদের মা-বাবা মোটর সাইকেল দিয়ে তাদের ইভ-টিজিংয়ের যে প্রণোদনা দিলো তার জন্য ঐসব পিতামাতার প্রতি ঘৃণা ছাড়া তখন অন্য কোনো বোধ আমার কাজ করল না।

দুই.

বিস্মিত হবার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে আমার। পৃথিবীতে যা কিছু হোক, জীবনে যা কিছু হোক, কোনো কিছু অবাক করে না। হাতটা কেটে নিলেও বোধটা এমন যেন এই কেটে নেয়াও একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। ঝড়বন্যা, যুদ্ধবিগ্রহ, খুনোখুনি, কেউ মরল, কেউ জন্মাল, বাজার, রাজনীতি, মূল্যবৃদ্ধি, তোমার সংকট, আমার সংকট- দুনিয়ার তাবৎ ঘটনা-দুর্ঘটনা সবই স্বাভাবিক।

তীব্র কোনো অনুভব নেই। না হাসি, না কান্না, না দুঃখ, না আনন্দ। মহাসাগরের মাঝখান যেমন থাকে, একটানা একরকম, সেইরকম। জলের নিচে হয়তো বৈচিত্র্য আছে কিন্তু তার কোনো প্রভাব নেই মহাসমুদ্রের ওপরে। অমনই আমি, হৃদয় ঝা চকচকে দ্যুতিহীন। নিষ্প্রভ কুয়াশার কুণ্ডলীতে মিলিয়ে যেতে দেখছি নিজের ছায়াটুকুও।

এই যে শামীম, কথা বলার সময় ঝকঝক করে চোখদুটো, ছায়া ছাড়াই দিব্যি আছে। বাবা, মা, তিন ভাই- পাঁচ জনই থাকে পাঁচ দিকে। শামীম এখানে আমার সাথে কাজ করে। মেজ ভাই আছে বেঙ্গল ফুডের কোনো এক জায়গায়, বাবা ঢাকায় সিএনজি চালায় কিন্তু বাবা বা ভাই তারা ঢাকার কোথায় কোন জায়গায় থাকে সে নাম বলতে পারে না।

ছোট ভাই আছে কোনো মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণির ছাত্র হয়ে। মা বাড়িতে একা ঘরদোর দেখে। ছায়া ছাড়া বেড়ে ওঠা একেকটা গাছ। বললাম, প্রেম ট্রেম করো? চাকরি বাকরি করে এমন একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করে ফেলো। ‘না, ম্যাডাম, বউকে দিয়ে চাকরি করাব না।’ কেন? এবার সলজ্জ মাথা নিচু করে না সূচক মাথা নাড়ায়।

দুবাহু বুকের মাঝে নিয়ে এক হাতের তালুতে আরেক হাতের তালু আলতোভাবে ধরে রাখে যেন সে কল্পনায় স্বপ্নের কারো হাত ধরে আছে। ওর অভিব্যক্তি দেখতে খুব ভালো লাগল আমার। ছায়াহীন বড় হতে হতে ছায়ার মর্ম জানা হয়ে গেছে তার, সে চায় অন্তত একজন তার ছায়াটুকু পাক।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫