Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

জাহানারা ওরফে জাহান

Icon

মৌসুমী বিলকিস

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২২, ১৫:৪৩

জাহানারা ওরফে জাহান

গল্প। প্রতীকী ছবি

কাটা চুল ঝরে পড়ছে। চোখে জল। নিঃশব্দে কাঁদছে ছোট্ট মানুষটি। 

‘নড়ছিস ক্যানে?’, ধমকায় বাপ।

‘আমার চুল...’, ফুঁপিয়ে কাঁদে মানুষটি। 

পড়শিরা উঠোনে দাঁড়িয়ে। 

‘কী সুন্দর চুলগুলা!’

 ‘বেচারি জাহানারি!’

আসলে জাহানারা। এ গ্রামের মানুষরা নাম বিকৃত করে। তাতে কেউ কিছু মনেও করে না। কিন্তু আজ তার চুল কাঁচির আঘাতে ঝরে পড়ছে কেন? 

‘আহা রে! মাউড়া বাচ্চা।’, কেউ বলে। 

নাজিয়াও নিঃশব্দে কাঁদে।

তার মনে পড়ে যাচ্ছে... 

‘টানিস ন্যা, লাগছে।’ 

‘কী জট! এই দ্যাখ।’

চিরুনির কয়েকটা দাঁড়া ভাঙা। দেখায় নাজিয়া। 

হাসে জাহানারা।

‘এ মাসের পাঁচ নম্বর চিরুনি।’

‘ছ’নম্বরটাও তুই কিনবি।’, জাহানারা খিকখিক করে হেসে ওঠে যেন কত মজার কথা বলেছে।  

‘মারব একখান চড়। লিজের যত্ন লিজে করতে পারিস ন্যা?’ 

দুজনের হাসি থামতেই চায় না। গম খেতের সবুজ পাতায় ঢেউ তোলে হাওয়া। ঢেউ চলে যায় দিগন্তের দিকে। 

নাজিয়া চুলের জট ছাড়ায়। একটা কাচের চিরুনি চুলের ভেতর ওঠানামা করে। কিছু কিছু চুল আটকে চিরুনিতে। নাজিয়া চুলগুলো ছাড়িয়ে দলা পাকিয়ে থুতু ছিটিয়ে পাশে ফেলে রাখে। 

‘তোর পিঠে দাগ কেনে রে?’ নাজিয়া উদ্বিগ্ন। জাহানারা চুপ। 

‘আবার!’, খানিক বিরতি নিয়ে বলে নাজিয়া। 

এতক্ষণ চুলে পিঠ ঢাকা ছিল। আঁচড়ানোর জন্য দু’ভাগ করতেই জাহানারার পিঠে আড়াআড়ি একটা লালচে টাটকা দাগ দেখা গেল। আরও কতকগুলো আবছা দাগ চামড়ার সঙ্গে প্রায় মিশে গেছে। 

‘কখন?’

জাহানারা চুপ। আনমনা চেয়ে থাকে দূরে। মনে পড়ে যায় সপাৎ সপাৎ কঞ্চি পড়ছে পিঠে। 

জাহানারার সৎ মা আসিয়া বিবি পেটাচ্ছে তাকে। 

‘বল, আর পুড়াবি?’ অস্বাভাবিক রেগে আসিয়া। 

‘হবে না, আর হবে না...’ নিজেকে বাঁচাচ্ছে জাহানারা। 

চুলের খোঁপা ধরে সৎ মা যখন হিড়হিড় করে উঠোনের একদিকের জ্বলন্ত উনুনের কাছ থেকে আর একদিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তখনই চুলগুলো পিঠের ওপর খসে পড়ে। কঞ্চির আঘাত পড়ে চুলে। চুল কাঁপে তরঙ্গের মতো। 

‘চুল সরা, সরা বলছি’, মায়ের ধমকে সে পিঠ থেকে চুল সরায়। কঞ্চির সমস্ত আঘাত এসে পড়ে পিঠে।

ফ্যান শুকিয়ে গেছে এবং ভাত পুড়েছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোকে ফ্যানের ভেতর এক চিমটে নুন ও সামান্য ভাত দিয়ে খেতে দেয় সে। আজ ফ্যান দিতে পারবে না। পারবে না বলেই আরও রেগে গেছে। খাবার নষ্ট। হতাশায় রাগ বেড়ে গেছে তার। 

জাহানারার সৎ বোন আম্বিয়া, তার থেকে খানিক ছোট, চেঁচিয়ে ওঠে, ‘মারিস ন্যা মা।’ মায়ের হাত থেকে কঞ্চি কেড়ে নিতে চায় সে। 

আসিয়া রেগে নিজের মেয়ের পিঠে গুম গুম শব্দ করে কিল বসিয়ে দেয়। জাহানারা বোনকে বাঁচাতে গেলে আসিয়া তার পিঠে আবার কঞ্চির আঘাত করে। অসম্ভব বেদনায় জাহানারা মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে পা আর হাতগুলো পেটের কাছে নিয়ে আঘাত প্রশমনের চেষ্টা করে। যেন সে নিজের মায়ের পেটে ঢুকে আছে, এমনভাবে গোল হয়ে পড়ে থাকে।

সৎ মা হাল ছেড়ে দিয়ে গালাগালি দিতে দিতে উনুনের কাছে যায়। ‘আমার হয়েছে যত জ্বালা’, তড়পাতে থাকে। উনুন থেকে পুড়ে যাওয়া ভাত নামায়। পোড়া ভাতের গন্ধে ভরে ওঠে বাড়িটা। ছটফট করতে করতে, চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে জাহানারার। ‘মা...’ বলে সুর তুলে কাঁদতে থাকে।

তার সুর করে কান্না শুনে মৃত সতিনের উদ্দেশে গালাগালি দিয়ে গজগজ করতে থাকে আসিয়া, ‘বাচ্চা সাথে লিয়ে মরলে আমার হাড় জুড়াতো’।

পরনের আধছেঁড়া ইজের আর সারা গায়ে ধুলো মাখামাখি। চোখের পাতা আর গালে ধুলো লেগে জাহানারার মুখ অদ্ভুত দেখাচ্ছে। উঠোনে গোটানো শরীরটার ওপর মাথার চারপাশে একরাশ চুল ধুলোয় মাখামাখি হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে যেন এক এক গোছা চুল এক একটি ফণা।

একজন একজন করে পাড়ার মেয়েরা, বাচ্চারা এসে দাঁড়িয়েছে। নাজিয়ার দাদি এগিয়ে আসে, ‘মারতে মারতে তো মেরেই ফেলবি বাচ্চাটাকে। আহা রে! উঠ।’, দাদি জাহানারার হাত ধরে মাটি থেকে তোলার চেষ্টা করে। 

ছোট বোন আম্বিয়াও তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে। 

সৎ মা চেঁচায়, ‘মারবো না তো কী? ভাতগুলা পুড়িয়ে ঝাঁঝরা করে ফেলেছে। চাল নাই ঘরে। ছেলেপিলের মুখে কী দিবো?’

‘তাই বলে নাই কথায় যাই কথাই রোজ মারবি? যা, আমাদের বাড়ি থেকে চারটে চাল নিয়ে আই।’, দাদি বলে।

জাহানারা উঠে দাঁড়িয়ে ধুলো মাখা হাতের চেটো দিয়ে চোখ মোছে। গালের ধুলোয় অশ্রু মিশে কাদা কাদা।  

আম্বিয়া ছোট ছোট হাত দিয়ে জাহানারার গায়ের ধুলো ঝাড়ে। 

ইজের ঢিলে হয়ে নেমে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি ইজেরের দড়ি ধরে পুরোনো গিঁট খুলে নতুন করে গিঁট দেয় জাহানারা। 

‘চাল যে আনবো শোধ করবো কী দিয়ে? অর বাপ তো দক্ষিণে যায়ে বসে আছে। না টাকাকড়ি পাঠায়, না বাড়ি আসে।’, সৎ মা হাঁড়ি থেকে না পোড়া ভাত বাঁশের হাতা দিয়ে আলাদা করে মাটির গামলায় তোলে। 

তার ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো এতক্ষণে ধুলো মাখা গায়ে উঠোনে এসে দাঁড়ায়, ‘মা, খাবো।’

‘খাবো ছাড়া কথা নাই মুখে?’ আসিয়া রেগে আছে। ‘ফ্যান নাই। নুনমরিচ দিয়ে খা। থালি আন।’

বাচ্চারা থালা নিতে এক চিলতে মাটির দাওয়ায় ওঠে।

দাদি বলে, ‘জাহানারাকেও চাট্টে দে।’

আসিয়া গর্জে ওঠে, ‘অর খাওয়া বন্ধ। অত ভাত পাবো কুনঠে? একথাল করে খায়।’

‘খোদার জীব। ওরম বুলতে আছে?’, দাদি বোঝানোর চেষ্টা করে। 

‘কী যে খোদার ছিষ্টি! না ছেলে না মেয়ে! না বিহে হবে না রোজগার করতে পারবে।’

‘তা হোক। খোদা যখন মুখ দিয়েছে, খেতে তো দিতেই হবে।’

জাহানারার কান্না থেমে গেছে। জটলার মধ্যে সে খোঁজে নাজিয়াকে। নেই। বোধহয় ইশকুলে গেছে। সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড়ে আমবাগানের দিকে চলে যায়। 

বাগানের এক প্রান্তে আম, জাম, আতা ও অন্যান্য কয়েকটা গাছের ঘন জটলা। জাহানারা একটা অশ্বত্থ গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে ঘাসের ওপর বসে কাঁদছে। 

তার জন্ম দিয়েই মরে গেছে মা। সে ছেলে না মেয়ে জানে না। লোকেরা হিজড়ে বলে ডাকে। হিজড়ে কী ভালো করে বোঝে না। মা থাকলে বোধহয় বুঝিয়ে দিতো। মাকে চেনে না। তবু মার কথা ভেবেই কাঁদে। নাক দিয়ে শিকনি ঝরে। ডান হাতের চেটোয় শিকনি মুছে চেটো মুছে নেয় ইজেরে। খিদেয় পেটে মোচড় দেয়। কান্না থামিয়ে একটা মুথা ঘাসের গুচ্ছ টেনে তোলে।

গোড়ার ছোট্ট ফোলা অংশটার ধূসর আবরণ সরিয়ে চুষতে থাকে। ঘাসের সবুজ চিবোয়। বিস্বাদ। তবু খায়। কয়েকটা মোটা লাল পিঁপড়ে মুখে সাদা ডিম নিয়ে সার দিয়ে যাচ্ছে। শুকনো পাতা চাপা দিয়ে একটা পিঁপড়ে ধরে। পিঁপড়েটাকে মেরে মুখে পুরে চিবোতে থাকে। টকটক। তবু খায়। আনমনে খেতে খেতে মায়ের কথা ভাবে।

ঝুপ করে একটা পাকা আম এসে পড়ে হাতের নাগালে। আম ত্বকের হলদে-সবুজ আভা ছড়িয়ে পড়ে তার চোখে। 

চমকে উঠে দেখে সে। ঘাসের গুচ্ছ ফেলে আম তুলে নেয়। বোঁটার কাছ থেকে এক ফোঁটা স্বচ্ছ ঘন আঠা গড়িয়ে পড়ছে। অবিকল তার চোখের জল। সে গাছগুলোর শাখা প্রশাখার দিকে মুখ তুলে তাকায়। একটাও আম নেই। আমের মৌসুম শেষ। বাগানে তাই ভিড় নেই। শুধু কয়েকজন রাখাল গরু চরাচ্ছে দূরে আর কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে ঝাঁটা দিয়ে শুকনো পাতা জড়ো করছে। উনুন জ্বালাতে লাগবে।

একদিন সে অনেক দূরে চলে যাবে। কেউ খুঁজে পাবে না তাকে। সৎ মাও না। আব্বাও না। ভাবতে ভাবতে আমটা দু’হাতের মাধ্যে অল্প চাপ দিয়ে ঘোরাতে থাকে। হাতের ধুলো লেগে যায় খোসায়। চাপ দিয়ে দিয়ে আমটাকে তুলতুলে করে নেয় সে। আমের পিছনে দাঁত দিয়ে কেটে ছিদ্র বানায়।

ছিদ্রে মুখ দিয়ে শুষে নিতে থাকে শাঁস। আবার হাতের তালুর মধ্যে চাপ দিয়ে ঘোরায়, আবার রস শোষে। রস শেষ হলে খোসা ছাড়ায়। আঁটি ও খোসায় লেগে থাকা যাবতীয় শাঁস শেষ করেও ক্ষুধার্তের মতো ধুলো মাখা খোসা চিবোতে থাকে। সাদা হয়ে যাওয়া আঁটিটা ছুড়ে ফেলে দেয়। খোসা চিবোতে চিবোতে হাই তোলে। প্রবল ঘুম পায় তার। 

গাছের ওপর একটা পাখি টুই টুই করে ডেকে চলে। গাছের জটলায় হাওয়া ঢুকে অদ্ভুত শব্দ ওঠে। 

চ্যাটচ্যাটে হাত ইজেরে মুছতে মুছতে ঘাস আর শুকনো পাতার ওপর শুয়ে পড়ে। শুয়ে শুয়েই হাতের চেটোয় মুখ মোছে। চেটো মুছে নেয় ইজেরে। মুখে লেগে থাকে অপূর্ব স্বাদ। তাজা আঠার বিস্বাদ নেই। আঠার জন্য গলার ভেতর মৃদু চুলকুনিও নেই। পাখির শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমে তলিয়ে যায় জাহানারা।

সন্ধ্যা নামে। শেয়াল ডাকছে, ঝিঁঝিঁ ডাকছে। মানুষের সাড়াশব্দ নেই। জাহানারাকে খুঁজতে আসেনি কেউ। 

ঘুম ভেঙে ভয়ে ভয়ে উঠে বসে সে। নড়াচড়া করতে সাহস হয় না। সুযোগ পেলে মানুষকে কামড়ে দেয় শেয়াল। গ্রামের অনেককে কামড়েছে। একেবারে ছোট বাচ্চা পেলে কামড়ে মেরেও ফেলে। ভয়ে তার প্রাণ শুকিয়ে যায়। 

নিজের মা থাকলে কি এমন হতো? মারলেও আদর করে ঘরে নিয়ে যেত। ভাত খেতে দিত। খেতে দিয়ে তালপাতার বাতাসও করতো। তালপাতার পাখা হাতে মায়ের মুখ ভাবার চেষ্টা করে।

লাল ফুল ছাপ সবুজ শাড়ি পরে বাতাস করছে মা। হাতের পাখা ক্রমাগত নড়ছে। মাথায় ঘোমটা। ঘোমটার ভেতর মায়ের মুখ অন্ধকার। নাক মুখ চোখের বদলে চাপ চাপ কালো। 

প্রবল অস্বস্তি হয় জাহানারার। মায়ের মুখ মনে পড়ছে না। কিছুতেই না। অস্ফুটে কাঁদে, ‘মা...মা...’।

অশ্বত্থ গাছের ডাল হাতির শুঁড়ের মতো নেমে আসে। কোলে তুলে নেয় তাকে। ধীরে ধীরে গাছের গুঁড়ি দু’ভাগ হয়ে যায়। 

জাহানারা স্থির হয়ে দেখে, ভাগ হয়ে যাওয়া গুঁড়ির ভেতর ধবধবে সাদা বিছানা, বালিশ, কোল বালিশ। দেখে, বিছানার ওপর ভেসে থাকা অপরূপ আলো।

ডালটি তাকে নামিয়ে দেয় বিছানায়। ভয় কেটে গেছে। বালিশে মাথা রাখে সে। ডালটি ঠেলা দিয়ে এগিয়ে দেয় কোল বালিশ। কোল বালিশ আঁকড়ে ধরে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে ডালটির দিকে। ডালটি তার পাতাগুলি দিয়ে হাত বোলানোর মতো তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত বুলিয়ে দেয় ক্রমাগত। পাতা নেড়ে বাতাস দেয়। চোখের ওপর পাতা বুলিয়ে যেন চোখ বন্ধ করতে বলে। 

জাহানারা চোখ বন্ধ করে টের পায় পাতার বাতাস। শিরশিরে বাতাসে ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে স্পষ্ট দেখে মায়ের হাতে তালপাতার পাখা নড়ছে। 

দু’ভাগ হয়ে যাওয়া গুঁড়ি আকাশের দিকে মুখ তুলে জাহানারাকে পেটের ভেতর নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।

আধখানা চাঁদের ওপর ভেসে যায় ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। 

‘মারবো এক চড়। সুজা হয়ে দাঁড়া।’, বাপ ধমকায়।

জাহানারা টানটান হয়ে দাঁড়ায়। চোখ থেকে টপটপ জল ঝরছে। নিঃশব্দে কাঁদছে নাজিয়া। হাঁটু পর্যন্ত লম্বা চুল খসে পড়ছে জাহানারার চারদিকে। 

আব্বার হাতে কাঁচি। নির্দয় মনে হচ্ছে কাঁচিটাকে। আব্বাকেও। হাত থেকে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে কাঁচিটা। কিন্তু পারছে না। পারবে না। আব্বার কথা অমান্য করে কোথাও যেতে পারবে না। আব্বার হাতের মার মনে আছে। খেপে গেলে রক্ষা নেই। ছোট ছোট সৎ ভাইবোন, সৎ মা কাউকে ছাড়ে না। একবার খেলে সাতদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের চুলগুলো শেষ হতে দেখে জাহানারা।  

বাপ তাকে হাত দিয়ে জোর করে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। চুল কাটছে।

এক্ষুনি সে যদি আব্বার থেকে লম্বা হয়ে যেত আর আব্বাকে এক ধাক্কায় মাটিতে ফেলে দিতে পারতো। মাটিতে পড়ে যাওয়া বাপের ভয়ার্ত মুখ স্পষ্ট দেখতে পেয়ে খুশি হয়। আব্বা ভয় পেয়েছে। সৎ মাও ভয় পাবে। ডান হাত মুঠো করে বাজুর ওপর ভাঁজ করে ধরে। ভিতরে ভিতরে এক ধরনের সাহস পায়।

‘এই, হাত নামা।’, বাপ ঠাস করে এক চড় দেয়। 

আচমকা চড় খেয়ে নিজের হাতগুলো সরু আর রোগা মনে হয়। তাড়াতাড়ি হাত নামিয়ে নেয় জাহানারা।

চুলগুলো অসম্ভব ছোট হয়ে গেছে। 

‘কেউ আসছে কি দেখ।’

‘উঁহু, কেউ নাই।’ 

‘পুঁতে ফেলি?’

‘হুঁ।’

নাজিয়া গম খেতের ভেতর হাত দিয়ে মাটি সরিয়ে দলা পাকানো চুল গর্তে রেখে মাটি চাপা দেয়।

‘এসব করতে হয় ক্যানে?’

‘বুদ্ধু! চুল পেলে তোর ক্ষতি করে দেবে কেউ।’

‘কী আর ক্ষতি?’

‘শুনিসনি?’

‘কী?’

‘বটতলা পাড়ার আফসানা রে। ঘুমিয়ে ছিলো। কে অর চুল কেটে নিয়ে গুণ করলো।’

‘পাখি হয়ে গেলছিলো?’

‘সব জানিস!’

‘পাখি হলে ভালোই হবে। কেউ মারতে এলে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ পালাবো।’

‘দূর বোকা। আমি কার সাথে খেলবো?’

‘আমাকে কেউ গুণ করবে না।’

‘নারে, ভয় লাগে।’ 

নাজিয়া জাহানারার কাঁধে মুখ গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকে। 

দূরে আলের ওপর সার দিয়ে হেঁটে যায় নদীতে স্নান করে ফেরা মেয়ের দল। আলের ওপর তাদের ভেজা পায়ের ছাপ, ছাপে লক্ষীর পায়ের আদল।  

দু’হাতে ভেজা কাপড় ধরে মাথার ওপর তুলে জাহানারা সমস্ত শক্তি দিয়ে আছড়ে ফেলছে কাঠের পিঁড়িতে। 

সোডার জল ছিটকে পড়ছে। কাচতে কাচতে হাঁপিয়ে উঠছে। হাত খোঁপা খুলে পিঠময় ছড়িয়ে পড়ে চুল। হাঁটুর কাছাকাছি দোলে। পাড়ার বাচ্চারা নদীর জলে খেলছে। জল ছিটাচ্ছে। ডুব সাঁতারে অনেক দূর ভেসে গিয়ে ভুস করে জলের ওপর মুখ তুলে শ্বাস নিচ্ছে জোরে জোরে। খুব ইচ্ছে করছে ওদের সঙ্গে খেলতে। এক ডালি কাপড় কাচা এখনো বাকি। 

সৎ মায়ের শাড়ি, সৎ ভাইবোনদের হিসু করা কাঁথা, চাদর, বালিশের ওয়াড়, মশারি সব সোডা জলে ফুটিয়েছে। বাঁশের ডালিতে নিয়ে নদী অব্দি বয়ে এনেছে। কেচে, স্নান করে আবার বাড়ি অব্দি বয়ে নিয়ে যেতে হবে। দেখে সে, একটা পানকৌড়ি জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে যায়। 

নাজিয়া উঁচু পাড়ের ঢাল ধরে নেমে আসছে। যেন বা উড়েই আসছে। দেখতে পেয়ে দু’পা তুলে লাফায় জাহানারা। পায়ের চাপে বসে যাওয়া ভেজা বালিতে জল উঠে আরও ভিজে গিয়ে থলথল করে বালি। নাজিয়া ছুটতে ছুটতে এসে ধাক্কা দেয় আর সেই ধাক্কায় দুজনই জলে এসে পড়ে। এই ইচ্ছাকৃত ধাক্কায় দুজনই খিলখিল হাসে। তাদের হাসির শব্দ উঁচু নদী পাড়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে।

হাসতে হাসতে এ ওকে টেনে নিয়ে যায় গভীর জলের দিকে। জলের নিচে পা ঠুকে ঠুকে নিজেদের ভাসিয়ে রাখে তারা। জলের তলায় ঝকঝকে বালির ওপর ঢেউয়ের মতো আলোর খেলা দেখছে দুজন। দুজনের পা জলের ওপরিতল থেকে সরু সরু দেখাচ্ছে। 

‘তোর পা কাঠি হয়ে গেলছে।’

‘তোরও। দ্যাখ।’

জাহানারা হঠাৎ ডুব দিয়ে সাঁতরে ভেসে যায় খানিক দূর। চুলগুলো মাথার পিছনে শ্যাওলার মতো ভেসে তাকে অনুসরণ করে। নাজিয়া সাঁতরে তার পিছে পিছে। জাহানারা জলের ভেতর ঘুরে গিয়ে মুখোমুখি হয় তার। 

জলের তলায় কথা বলে নাজিয়া, ‘তোকে জলপরীর মতো লাগছে।’ 

তার কণ্ঠ বিলম্বিত ও গম্ভীর হয়ে জলের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে। মুখ থেকে একগাদা বুদবুদ ভেসে যায় জলের ওপরিতলে। তারা দুজনেই ভেসে ওঠে জলের ওপর। শ্বাস নেয় জোরে জোরে। মুখে লেপ্টে থাকা ভেজা চুল সরায়। 

হাঁপাতে হাঁপাতে জাহানারা বলে, ‘আজ ইশকুলে কী পড়লি?’

‘দেখাচ্ছি চল।’

জল যেখানে তটে এসে মিলছে তার কাছেই ভেজা বালির ওপর আঙুল দিয়ে লেখে আর উচ্চারণ করে নাজিয়া, ‘ক-এ আকার কা, খ-এ আকার খা, গ-এ আকার গা...’ 

দুজনের চুল থেকে জল ঝরে টপটপ। ওর দেখাদেখি জাহানারাও লেখে আর উচ্চারণ করে। নাজিয়া ইশকুলে যা শেখে ইশকুলে না গিয়ে জাহানারা এভাবেই পড়া শিখে নেয়।

ম-এ আকার মা অব্দি এসে সে বিচলিত হয়ে পড়ে, ‘এবার চল। নাহলে পিঠে পড়বে।’ মা নয় সৎ মায়ের কথাই ভাবে সে। নদীতে স্নান করছে নতুন কয়েকজন। গামছা পাকিয়ে চুলে ঝাপটা মেরে মেরে জল ওড়ায় জাহানারা। নাজিয়া দেখে। 

‘তোর চুল এট্টু লম্বা হয়েছে।’

জাহানারা চুল টেনে ধরে কতটা লম্বা হয়েছে বোঝার চেষ্টা করে। 

‘এ হপ্তায় চুলে আওলা লাগিয়ে দিবো। দাদিকে বলবো ভিজিয়ে বেঁটে রাখতে।’

‘দিস। এখন তো চল।’

আদিগন্ত খেতের আল ধরে ফিরতে থাকে দুজন। নাজিয়া ভেজা গামছা মাথার ওপর ধরে। হাওয়ায় উড়তে উড়তে শুকোয় গামছা। এক রাশ চুল দুলিয়ে হাঁটে জাহানারা। ঘাসহীন শুকনো আলের ওপর পায়ের জলছাপ। 

জাহানারার চুল কাটা শেষ। তাকে ঝাঁকড়া চুলের এক বালক মনে হচ্ছে। ছোট বোন আম্বিয়া কেটে ফেলা লম্বা চুল কুড়িয়ে গোছা করছে। সৎ মা দাওয়ায় বসে শুকনো খেজুর পাতার পাটি বুনছে। 

নাজিয়ার দাদি ভিড়ের ভেতর থেকে এগিয়ে আসে, ‘তা কী সিদ্ধান্ত লিলে বাপ? চুল কেটে ফেললে যে বড়?’ 

জাহানারার বাবা বলে, ‘দক্ষিণে নিয়ে যাবো। জোগাড়ের কাজ করবে। আমিও খাটবো, উও খাটবে। বাড়তি কডা টাকা আসবে ঘরে।’ 

‘বাচ্চাটাকে অতদূর টেনে লিয়ে যাবা? এতটুকুন বয়স, কাজ কি পারবে?’

‘শিখে লিবে।’

‘তাও, মাউড়া বাচ্চা, গেরামে সবার সাথে থাকতো।’

‘অর তো বিয়েটিয়ে হবে না। নিজের পেট চালানো শিখে লিতে হবে লিজেকেই।’

‘তো উখানে গিয়ে কী পরিচয় দিবা?’

বাপ একটু ইতস্তত করে, ‘কেনে?... আমার ছেলে। এখন থেকে জাহান বুলে ডাকবা। অর নাম আজ থেকে জাহান রাখা হলো।’

জাহানারা চমকে বাপের দিকে তাকায়। জটলায় গুনগুন শব্দ ওঠে। সারা গ্রামে খবর হয়ে যায়, হিজড়ে জাহানারার জাহান নাম দিয়ে ছেলে সাজিয়ে বাবা ওকে কলকাতার নির্মাণ শিল্পে কাজ করতে নিয়ে যাচ্ছে। 

গ্রামের মানুষ অনেকে দেখতে আসে। 

‘জাহান্নারি বুলবো না জাহান বুলবো?’

‘ইট বহাতে পারবি তো?’

‘শহরের লোক হয়ে যাবি তো রে!’

বড় অসহায় লাগে। আম্বিয়ার হাত থেকে ছিন্ন চুলের গোছা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে জাহানারা দৌড় দেয় বাগানের দিকে। সৎ মা পাটি বুনতে বুনতে দেখে। কিছুই বলে না আজ। উপস্থিত লোকজন জাহানারার বাবা ও নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বেশি আগ্রহী। নাজিয়া তাকে অনুসরণ করে কিছুদূর যায়।

দাদি ডাকে, ‘নাজি, যাস ন্যা। এট্টু কাঁদুক একলা।’

নাজিয়া অনিচ্ছা সত্তে¡ও দাঁড়িয়ে পড়ে। জাহানারা দৌড়তে দৌড়তে বাগানের ছায়ায় মিলিয়ে যায়।

পাতার ফাঁকে ফাঁকে রোদ এসে পড়ছে ঘাস আর শুকনো পাতায়। জাহানারা অশ্বত্থ গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে। হাতে কাটা চুলের গুচ্ছ। গত সপ্তাহে নাজিয়া চুলগুলোর কত যতœ করেছে।

‘মাথাটা এট্টু পিছন দিকে হেলা।’

জাহানারা পেছনে মাথা হেলায়। চুলের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত আমলকী বাটা মাখিয়ে দিচ্ছে নাজিয়া। দু হাতের আঙুল দিয়ে সিঁথি কেটে গোছা করে চুল ধরে ধরে আমলকী মাখাচ্ছে। মাখানো শেষ হলে চিরুনি দিয়ে চুল দু ভাগ করে কালো কার দিয়ে বেঁধে দুটো বিনুনি করছে। কষে বিনুনি দুটো বেঁধে দিয়েছে মাথার দু’প্রান্তে। কয়েক দিন এভাবেই থাকবে। তারপর খুলে এঁটেল মাটি দিয়ে চুল পরিষ্কার করে নেবে। 

‘আমার কেন এরম চুল হয় না? দেখ, পাটের ফেসের মতো।’, নিজের চুল ধরে দেখায় নাজিয়া। তার আঙুলগুলো আমলকীর কষে কালো হয়ে গেছে। 

‘তোর চুলে লাগিয়ে দি?’

‘নারে। যতই যা কর ও আর ভালো হবে না।’

‘হবে রে, হবে। তোর যখন বিয়ে হবে দেখবি সুন্দর করে চুল বেঁধে দিবো।’

‘যা!’, লজ্জা পায় নাজিয়া। 

শুকনো পাতায় খসখস শব্দ। একটা কাঠবিড়ালী। সামনের দু’পায়ে কিছু একটা ধরে সে খাচ্ছে। লেজ নাচাচ্ছে। জাহানারাকে দেখছে খাওয়া থামিয়ে। অশ্বত্থের পাকা ফল কুড়িয়ে হাতের তালুতে নিয়ে এগিয়ে দেয় সে। 

কাঠবিড়ালী ফলটা নেয়। কিছুটা খেয়ে ফেলে দেয়। তারপর জাহানারার কোলে, ঘাড়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে। 

জাহানারা এক হাতে ধরে আর এক হাত দিয়ে আদর করে তার পিঠে, মাথায়; যেমন সে মাঝে মাঝেই করে। 

কাঠবিড়ালী চোখ বন্ধ করে আদর খায়। 

‘আমি কে কাঠবিড়ালী? ছেলে না মেয়ে রে?’

কাঠবিড়ালী চোখ বন্ধ করে লেজ নাচায়। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে জাহানারা। 

‘এবার যা। আব্বা খুঁজে না পেলে পিঠের চামড়া তুলে দিবে।’

বিচলিত হয়ে ওঠে সে। কাঠবিড়ালী গাছে উঠে যায়। একবার পিছন ফিরে দেখে তাকে। উঠে পড়ে জাহানারা। অশ্বত্থ গাছের কোটরে চুলগুলো রেখে দেয়। গাছকে বলে, ‘আমি যতদিন না ফিরি রেখে দিও।’ 

অশ্বত্থ গাছের পাতারা সরসর শব্দ তোলে। জাহানারা ছোট ছোট হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে অশ্বত্থ গাছ। 

জটলার প্রত্যেকটি গাছের পাতা চঞ্চল হয়ে দোলে।

‘তোর যা আছে গুছিয়ে লে।’

কীই বা আছে জাহানারার? একটাই নতুন ফ্রক। বাকি সব ছেঁড়া। ইজেরগুলোও তাপ্পি দেওয়া, ফুটিফাটা।

‘জামাটা পরবো আব্বা?’, ভয়ে ভয়ে বলে সে।

একটু ভেবে নেয় বাপ। বুঝি বা বুকের ভেতর কোথাও মোচড় দিয়ে ওঠে। ‘পর’, বলে বিড়ি টানতে টানতে চটের থলে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় হাটের দিকে। আজ হাট বার। 

তার সৎ মা চরকায় রঙিন সুতো কাটছে। চাকা ঘুরছে। লাছি থেকে সুতো জমা হচ্ছে কাঠিতে।

বাপ বাড়িতে থাকলে মারার সাহস পায় না সৎ মা। আসলে নিজেই বাবার মারের ভয়ে থাকে। ভাতে চুল পড়েছে। মার। কোথাও গিয়ে একটু দেরি হয়েছে। মার। মারের কোনো জটিল কারণ নেই। জাহানারা মাটির ঘরের জামাকাপড় ঝোলানোর বাঁশের ডাপ থেকে নিজের ফ্রকটা খুঁজে নেয়। অন্যান্য জামাকাপড়ের তলায় পড়ে কুঁচকে গেছে।

মাটির দাওয়ায় বেরিয়ে ফ্রক পরে। মাটির দেয়ালে পোঁতা আয়নায় মুখ দেখে। আয়নার নিচের তাক থেকে কাচের চিরুনি নিয়ে চুল আঁচড়ায়। কয়েকটা দাঁড়া ভাঙা। ‘আর ভাঙবে না’, নিজের মনেই বলে। 

আসিয়া চরকা থামিয়ে লাছির ছিন্ন সুতোর মুখ খুঁজতে খুঁজতে অপাঙ্গে দেখে। 

ভাইবোনগুলো কেউ বাড়িতে নেই। কোথাও খেলছে বোধহয়। জাহানারার জুতো নেই। একজোড়া ছেঁড়াখোঁড়া হাওয়াই চপ্পলও না। সে মাকে একবার দেখে নিয়ে উঠোন পেরিয়ে বেরোতে যায় আর পায়ে ব্যথা পায়, ‘আ...!’। এক পায়ে ভর দিয়ে লাফায় সে। বাঁ পায়ে কাঁটা ফুটেছে।

ওভাবেই ডান পায়ের হাঁটুর কাছে বাঁ পায়ের পাতা উল্টে ধরে দেখার চেষ্টা করছে। পায়ের তালুতে ছোট ছোট গর্ত। খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে শক্ত হয়ে আছে চামড়া। 

আসিয়া চরকা বন্ধ করে উঠে আসে, ‘চুপ করে দাঁড়া’।

জাহানারা আসিয়ার কোমরে দু’হাতের ভর দিয়ে দাঁড়ায়।

আসিয়া কিছুই দেখতে পায় না, ‘উসরায় আয়।’ জাহানারাকে ছেড়ে সে ব্লেড আর সুচ নিয়ে আসে। 

জাহানারা এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এসে মাটির বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে। আসিয়া পায়ের নিচে ব্লেডের প্রান্ত আলতো করে ঘষে ঘষে কাঁটা খুঁজছে। ব্লেডের ঘষা খেয়ে কাঁটাটা একটু বাইরে বেরোয়। সুচ ও ব্লেড দিয়ে ধরে এক টানে কাঁটা বের করে আনে আসিয়া, ‘দেখেশুনে চলতে পারিস ন্যা? তোর বাপকে বুলে বুলেও একজুড়া চটি আসে না বাড়িতে।’

আসিয়ারও জুতো নেই। বাচ্চাদেরও নেই। আছে কেবল আব্বার। বেশ লম্বা কাঁটা। সামান্য ব্যথা অনুভব করে জাহানারা। তবু সেই ব্যথা নিয়েই পাড়া বেড়াতে যায়। প্রত্যেকটা বাড়িতে ঘুরে বেড়ায় অযথা। সবার সঙ্গে গালগল্প করে। পাড়ার কলতলায় গিয়ে অযথাই জল পাম্প করে। তেষ্টা না পেলেও আঁজলায় ধরে জল খায়। পা ভেজায়। ভেজা পায়ে লেপ্টে যায় রাস্তার ধুলো। অবশেষে আসে নাজিয়ার বাড়ি। 

‘লে, খা।’, দাদি ঠোঙায় মুড়িয়ে তার হাতে গুঁজে দেয় কয়েকটা নারকেল নাড়–। নাজিয়াকেও দেয়। নাজিয়া খায়। জাহানারা খায় না। হাতেই ধরে থাকে। 

‘তা’লে কলকাতার লোক হয়ে যাবি?’

জাহানারা উত্তর দেয় না। আঙুল দিয়ে ফ্রকের ওপর দাগ কাটে। 

‘কত দূর চলে যাবি!’

জাহানারা নাজিয়াকে বলতে পারে না তার যাওয়ার ইচ্ছে নেই। উঠে পড়ে সে। 

‘টেরেনে যাবি তো? আমি কুনুদিন টেরেনে চাপিনি।’ 

ট্রেনের কথা শুনে খানিক উৎসাহ পায় জাহানারা। সে কোনোদিন ট্রেনে-বাসে চাপেনি। ট্রেনের কথা শুনেছে কিন্তু ট্রেন দেখেনি। বাস দেখেছে কিন্তু চাপার দরকার হয়নি। সে নাজিয়ার চোখে সরাসরি তাকায়। নাজিয়ার দাদি সেদ্ধ আলুর খোসা ছাড়াচ্ছে।

‘ভালো থাকো তুমরা।’, জাহানারা ধীরে ধীরে উঠোন পেরোতে থাকে।

‘নিজের দেখভাল করিস।’, দাদি খানিক জোরেই বলে।

তাকিয়েই থাকে নাজিয়া। জাহানারাকে পেছন থেকে দেখছে সে। জাহানারা পাঁচিলহীন উঠোন পেরিয়ে, ধুলো রাস্তা পেরিয়ে নিজেদের বাড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছে। দিন শেষের হলদে আলো তেরছা হয়ে পড়ে আছে উঠোনে।

জাহানারার দীর্ঘ ছায়া তাকে অনুসরণ করছে নিঃশব্দে।  

আম্বিয়ার হাতে নারকেল নাড়ুর ঠোঙা ধরিয়ে দেয় জাহানারা, ‘সবাইকে দে।’

আম্বিয়া প্রথমেই একটা নাড়ু জোর করে জাহানারার মুখে গুঁজে দেয়। দেয় ছোট ভাইবোনদের। নিজে একটা খায়। তারপরেও বেঁচে যায় দুটো। মাকে একটা, আব্বাকে একটা দেয়। 

‘হচে কিনা দেখ’, জামাকাপড়ের থলে জাহানারার দিকে এগিয়ে দেয় আব্বা। 

জাহানারা খুলে দেখে একটা ফুল প্যান্ট, দুটো হাফ প্যান্ট, দুটো গেঞ্জি, একটা স্যান্ডো গেঞ্জি, একটা গামছা। 

‘এত!’ মনে মনে খুশি হয়। কিন্তু সে তো পরতে চায়নি এই ছেলেদের প্যান্ট জামা। প্রিয় একমাত্র ফ্রকের কথা ভেবে মন খারাপ হয় তার। তবু নতুন জামাকাপড় একটা একটা করে পরে আব্বাকে দেখায়।

রোগা শরীরে ফুল প্যান্টের কোমর একটু ঢিলে হয়ে নেমে যেতে থাকে। হাত দিয়ে ধরে ফেলে সে। আব্বা ব্যাগ থেকে একটা নতুন ছোট বেল্ট বের করে পরিয়ে দেয়। অবাক হয়ে দেখে ছোট ভাইবোনেরা। 

আগলহীন উঠোনের সামনে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া পাড়ার দু-একজন এসে দাঁড়ায়। ‘ভালোই তো লাগছে রে জাহানারি!’, একজন বলে।

‘জাহান বল’, আব্বার স্বর কঠিন। 

‘জাহানই বটে। এক্কেরে ব্যাটাছেলে লাগছে!’, হাসাহাসি করে লোকজন। 

ঠিক এই মুহূর্তে কেন্নোর মতো কুঁকড়ে যেতে ইচ্ছে করে জাহানারা ওরফে জাহানের। সন্ধের অন্ধকার হুড়মুড়িয়ে এসে বাড়িটা ঢেকে দেয়। 

সকাল সকাল ব্যাগ গোছাচ্ছে জাহানারা ও আব্বা। আসলে গোছানোই আছে, টুকিটাকি জিনিসগুলো ঢুকিয়ে নিচ্ছে। সৎ মা আসিয়া একটা বড়সড় মুড়কির পোঁটলা ধরিয়ে দেয় জাহানারার হাতে, ‘খিদে লাগলে খাস। বাপকেও দিস।’

জাহানারা নিঃশব্দে পোঁটলা নিয়ে আব্বার হাতে দেয়। আব্বা ঢুকিয়ে নেয় বড় সাইড ব্যাগে। 

নাজিয়ার দাদি বড়সড় কাগজের মোড়কে হালুয়া দেয়, ‘লে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে খাস।’ আব্বাকে বলে, ‘মাঝে মাঝে বাড়ি লিয়ে আসো। বাচ্চা মানুষ। এক লাগাড়ে অতদিন থাকতে পারে?’

‘আনবো। অত চিন্তা কোরো না বড় মা।’, আব্বা উত্তর দেয়। 

নাজিয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে। জাহানারাও। পরস্পরকে দেখছে। পাড়ার লোকেরা যে যা পারে জাহানারার হাতে দিতে থাকে। ফল, মুড়ির নাড়ু, চিড়ে ভাজা। একটা একটা করে বড় ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয় আব্বা। 

বিকেলের শেষ বাস ধরতে হবে পাশের গ্রাম অব্দি হেঁটে গিয়ে। পাড়ায় উপস্থিত প্রত্যেকে রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে। আব্বার কাঁধে বড় ব্যাগ, হাতে একটা পোঁটলা। জাহানারার কাঁধে ছোট ব্যাগ। ব্যাগের ভারে ডান কাঁধ ঝুলে পড়ছে। জাহানারার হাওয়াই চপ্পলের আঘাতে ধুলো উড়ছে। ধুলোয় ভরে উঠছে ফুল প্যান্টের নিচের দিক।

তাদের পেছনে লাইন দিয়ে হাঁটছে কিছু বাচ্চাকাচ্চা ও কয়েকজন পুরুষ-মহিলা। পাড়ার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে আসে তারা। দুটি কুকুর হাঁটছে ভিড়ের পেছন পেছন। পরিচিত ছাগলগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করে দেখছে। 

আম বাগানের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে জাহানারা, আব্বা, কয়েকজন পুরুষ। বাস পর্যন্ত যাবে তারা। বাকিরা খানিকটা এসে থেমে গেছে। একজন জাহানারার ব্যাগ কাঁধে নেয়। জাহানারা হেঁটে যেতে যেতে পেছন ফিরে দেখছে প্রিয় গ্রাম, মানুষজন। নাজিয়া, আম্বিয়া হাত নেড়ে বিদায় দিচ্ছে। জাহানারাও হাত নাড়ে। একেবারে দলের পেছনে হাঁটে। একটু দূরে তার প্রিয় গাছের দঙ্গল প্রবল কেঁপে ওঠে। জাহানারা টের পায় তাদের পাঠানো শিরশিরে বাতাস।

‘জাহানা...জাহান, তাড়াতাড়ি হাট রে, বাসে জাগা পাবো না।’, আব্বা চেঁচায়। 

জাহানারা হাঁটে। অনিচ্ছায়। পেছনে পড়ে থাকে তার নিজস্ব নাম, লম্বা চুল, একটি ফ্রক।

আসিয়া তালপাতার পাখা নেড়ে বাতাস করে। থালায় গোছানো গরম ভাত। হালকা ধোঁয়া উড়ছে। দু’টুকরো বেগুন ভাজা, পাঁচ মিশালি শাক। এক বাটি ডাল, তাজা কুচো মাছের ঝোল। লুঙ্গি পরে মাটির দাওয়ায় খাচ্ছে জাহান। 

‘চারটে ভাত দি?’

‘না। আম্বিয়ার শ্বশুরবাড়ির জামাকাপড়গুলা আজ দিয়ে আসি?’

‘যা ভালো মুনে করিস।’

‘তুমার শাড়ি পছন্দ হয়েছে?’

‘আমার আর পছন্দ অপছন্দ!’

‘নাজিয়ার শাড়িডা ওর মাকে দিয়ে দিও। শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিবে।’ 

বারো বছর পর আজ গ্রামে ফিরেছে সে। নাজিয়ার দাদি মারা গেছে। জাহানের আব্বাও। 

‘বোনের তো ভালোই বিয়ে দিয়েছিস রে!’

‘তুই নাকি রাজমিস্ত্রি হয়েছিস?’

‘লতুন ঘর তুলবি শুননু? তার লেগেই বাড়ি আসেছিস?’

‘কলকাতায় কেউ বুঝতে পারে না যে তুই ব্যাটাছেলেও না, মেয়েছেলেও না?’

‘কী সব বকর বকর কর তুমরা? লিজের লিজের কাজে যাও। এত পথ আসেছে। ঘুমাক এট্টু।’, জাহানের সৎ মা বিরক্ত হয়ে বলে। 

জাহান এঁটো হাত ধুয়ে লুঙ্গিতে মুছতে মুছতে বেরিয়ে যায়। সোজা হাঁটতে থাকে আমবাগানের দিকে। বাগান খুঁজে পায় না। একটাও গাছ নেই। সব কৃষি খেত।

ছোট ছোট শর্ষে গাছের চারায় হাওয়া খেলছে। সে অবাক হয়ে গাছের দঙ্গলটার স্থানে আসে যেখানে কেটেছে তার অগুনতি একলা মুহূর্ত। নেই, গাছগুলি নেই। ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। হঠাৎই সে দেখতে পায় অশ্বত্থ গাছের কাটা গুঁড়ি প্রায় মাটির সাথে মিশে আছে।

সে মাটিতে বসে কাটা গুঁড়ির গায়ে হাত বোলায়। গুঁড়ির মাঝখান থেকে উগরে দেওয়ার মতো উঠে আসে তার ছিন্ন চুলের গুচ্ছ, যা সে গুঁড়ির ভেতর রেখেছিল গ্রাম ছাড়ার আগে। চুলগুলি মাথার ওপর স্থাপন করে। একরাশ চুল ছড়িয়ে পড়ে পিঠে। একটা কাঠবিড়ালীর বাচ্চা ছুটে পালায়। আবার জাহানারা হয়ে যেতে ইচ্ছে করে তার।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫