
গল্প। প্রতীকী ছবি
ছোটগল্পকার হিসেবে অধিক পরিচিত অ্যামব্রোস বিয়ার্স (১৮৪২-১৯১৪) একাধারে মার্কিন কবি ও সাংবাদিক। যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধকালের বেশিরভাগ সময় তিনি সৈনিক হিসেবে রণাঙ্গনে কাটিয়েছেন। একবার অসীম সাহসিকতায় একজনের জীবন রক্ষা করেন এবং যোদ্ধা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি সে সময় দুবার আহত হন।
এ ছাড়া যুদ্ধ থেকে ফেরার পর প্রেমিকা ও বাগদত্তার সঙ্গে তার বিয়ে ভেঙে যায়। যুদ্ধ নিয়ে তার গল্পগুলো একেবারে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু যুদ্ধকালীন দুর্ভোগ ও ব্যক্তিগত জীবনের বেদনার কারণেই হয়তো বা তার লেখা হয়ে উঠেছিল তিক্ত ও নৈরাশ্যবাদী। কখনো বা তীব্র ব্যঙ্গাত্মক। এ গল্পের শেষের দিকেও তিনি তারই স্বাক্ষর রেখেছেন।
১৯১৪ সালে তিনি মেক্সিকোর উদ্দেশে রওনা করেন, কিন্তু আর ফিরে আসেননি। তাকে আর কোথাও দেখাও যায়নি। তার অন্তর্ধান রহস্যের আজও সমাধান হয়নি। অনূদিত গল্পটির শিরোনাম ‘কিলড অ্যাট রেসাকা’, যা ১৮৯১ সালে প্রকাশ তার ‘টেলস অব সোলজার্স অ্যান্ড সিভিলিয়ানস’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। কেউ কেউ মনে করেন যে হেমিংওয়ের যুদ্ধ বিষয়ক রচনা অ্যামব্রোসের লেখনী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।]
আমাদের দলের সেরা সৈনিক ছিলেন লেফটেন্যান্ট হারম্যান ব্রেইল। তিনি আবার ব্রিগেড অধিনায়কের বিশেষ সহকারীও ছিলেন। আমি জানি না জেনারেল তাকে কোথায় পেয়েছিলেন। হয়তো ওহাইও’র কোনো রেজিমেন্ট থেকে হবে। আমরা কেউই তাকে আগে থেকে চিনতাম না।
চিনলেই বরং অবাক ব্যাপার হতো, কেননা আমাদের মধ্যে এমন দুজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না যারা একই অঞ্চল থেকে, এমনকি পাশাপাশি অঞ্চল থেকে এসেছিল। মনে হয় জেনারেল ভাবতেন যে তার নিজের স্টাফদের মধ্যে জায়গা করে নেওয়ার ব্যাপারটা সম্মানের বিষয়, যেগুলোতে এমনভাবে নিয়োগ দেওয়া উচিত যেন কোনো রকমের রেষারেষির সৃষ্টি না হয়, আবার গুরুত্বপূর্ণ এলাকার সৈনিকরাও নিজেদের বঞ্চিত মনে না করে। এমনকি তিনি নিজের কর্তৃত্বাধীন সেনাদের মধ্য থেকেও তাদের বেছে নিতেন না।
বরং কোনো একটা কৌশলে ব্রিগেড সদর দপ্তর তাদেরকে অন্য কোনো ব্রিগেড থেকে নিয়ে আসত। এরকম অবস্থায় তার চাকরি সম্পর্কেই আত্মীয়-স্বজন বা ছেলেবেলার বন্ধুবান্ধবের জানার তেমন সুযোগ থাকত না, বীরত্বের জয়গাথা গাওয়া তো অনেক দূরের ব্যাপার। অবশ্য কারও যদি খুব বড় সাফল্য থাকে সেটা ভিন্ন কথা। লেফটেন্যান্ট ব্রেইল ছিল ছয় ফুটেরও বেশি লম্বা আর তার শরীরের গাঁথুনি চমৎকার।
এমন নীলচে ধূসর চোখ আর হালকা চুল সাধারণত অত্যন্ত সাহসী লোকদের মধ্যেই দেখা যায়। যুদ্ধের সময় অন্য অফিসারেরা যেখানে পোশাক-আশাকের আড়ম্বরতার দিকে তত মনোযোগ দিতেন না, ব্রেইল কিন্তু প্রায় সবসময়ই পুরোপুরি উর্দি পরে থাকতেন। কাজেই সুবেশী হিসেবে সে সবার মনে দাগ কাটত। তার বিষয়ে আর কিছু বলতে গেলে বলতে হয় যে সে ছিল অত্যন্ত ভদ্র। মাথা ছিল পণ্ডিতের, আর হৃদয়টা সিংহের। বয়স বছর তিরিশেক।
আমরা যেমন শুরুতেই তার গুণাবলির পরিচয় পেলাম, তেমনি খুব দ্রুতই তাকে পছন্দ করে ফেললাম। আর তার ভালো হোক চাইতাম বলেই হয়তোবা সে আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার পর হওয়া প্রথম লড়াইয়েই বুঝে ফেললাম যে তার এমন একটি দোষ আছে, সৈনিকদের যা থাকতে নেই। সেটি হলো সে খামাখাই সাহস দেখাত।
স্টোন রিভারের সেই লুকোচুরির লড়াইয়ে, উন্মুক্ত মাঠের তুলা খেতেই হোক, ঘন সেডার বনের আড়ালেই হোক বা রেললাইনের আড়ালেই হোক, আমাদের সৈন্যরা যেখানেই অবস্থান গ্রহণ করত না কেন সে কখনো আড়াল নিত না। জেনারেল কড়া আদেশ না দিলে একবারও এর ব্যত্যয় হয়নি। আর তিনি যেহেতু অন্য অনেক বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, তার ব্যক্তিগত কর্মচারীদের বা বলতে বাধা নেই, নিজের সেনাদের জীবন নিয়ে চিন্তা করার ফুরসত কমই পেতেন।
পরের লড়াইগুলোতেও একই চিত্র দেখা গেল। সে এমন একটা পদে কাজ করত, ফুরসতকালীন তো বটেই, চাইলে এমনকি দায়িত্ব পালনের সময়েও নিরাপদ জায়গায় থাকতে পারত। তাতে তার সুনামের ক্ষতি হতো না বা সে বিপদেও পড়ত না। সেটা না করে গোলাগুলির বৃষ্টির মধ্যেও উন্মুক্ত স্থানে এমনভাবে ঘোড়ায় বসে থাকত, যেন একটা ভাস্কর্য।
কোনো বিশেষ দরকারে বা জেনারেলের সঙ্গে যাওয়ার জন্য ঘোড়া থেকে নামতে হলেও সে একই কাজ করত। অন্য সৈন্যরা যেখানে আড়াল নিত, খোলা জায়গায় সে একটা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকত। বয়স ও অভিজ্ঞতায়, পদবিতে উঁচু এবং সন্দেহাতীতভাবে সাহসী সৈনিকরাও যখন দেশের সেবা করার জন্য নিজ নিজ জীবন বাঁচিয়ে রাখতে পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকত, ব্রেইল তখন সবচেয়ে তীব্র গোলাগুলির দিকে মুখ করে উঁচু জায়গায় একই রকমভাবে অনড় দাঁড়িয়ে থাকত।
খোলা ময়দানে যুদ্ধ চলতে থাকলে প্রায়ই এমন ঘটে যে শত্রুদল একে অন্যকে পাথর ছুড়ে ঘায়েল করতে পারবে এমন কাছাকাছি চলে আসে। তখন তারা শুয়ে পড়ে মাটিকে এমনভাবে আলিঙ্গন করে যেন তারা এটাকে ভালোবাসে। পেছনে থেকে যুদ্ধ পরিচালনাকারী অফিসাররাও একই কাজ করে। আর সামনে থাকা অফিসারদের তো কথাই নেই। তাদের ঘোড়াগুলো হয় মারা গেছে বা সেগুলোকে পেছনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। হিসহিসানো সিসা আর চিৎকার করা লোহার নারকীয় ছাদের নিচে তারাও হামাগুড়ি দিতে বাধ্য হয়। মান-সম্মানের কথা তখন মনেও থাকে না।
এরকম পরিস্থিতিতে ব্রিগেডের স্টাফ অফিসারের জীবনও নিশ্চিতভাবেই ‘সুখের নয়’। মূল কারণ তার পদের নড়বড়তা, আর তার কর্তার মেজাজ এমন ঘন ঘন বদলাতে থাকে যে স্নায়ু এলোমেলো হয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়। অবশ্য তার অবস্থানের তুলনামূলক নিরাপত্তা এত বেশি যে এখান থেকে কেউ বের হলে সাধারণ লোকজন সেটাকে ‘অলৌকিক’ই বলবে। কিন্তু এরকম নিরাপদ অবস্থান থেকেও কখনো কখনো তাকে লড়াইয়ের অকুস্থলে ছুটতে হয়।
তাকে বলা হয় একেবারে সামনের সারিতে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখোমুখি কোনো রেজিমেন্টের অধিনায়কের কাছে সশরীরে কোনো বার্তা পৌঁছে দিতে, যাকে এ মূহূর্তে আলাদা করে চেনার উপায় নেই এবং যাকে পেতে হলে বেশ খোঁজাখুঁজি করতে হয়। বিশেষ করে, যখন কামান-বন্দুকের একটানা গর্জনের মধ্যে প্রশ্ন ও উত্তর উভয়ই সারতে হয় সাংকেতিক ভাষায়। এসব ক্ষেত্রে নিয়ম এই যে, নিজেকে কয়েক হাজার বন্দুকধারীর নিশানা বানিয়ে, মাথাটাকে নিচু করে প্রাণপণে ভোঁ দৌড় দেওয়া। আর ফেরার ক্ষেত্রেঅবশ্য ফেরার সুযোগ যে সবসময় ঘটে তা নয়।
কিন্তু ব্রেইলের অভ্যাস ভিন্ন। সে তার প্রিয় ঘোড়াটাকে একজন আর্দালির কাছে রেখে নীরবে বিপদের দিকে হেঁটে যেত। একবারও ঝুঁকে পড়ত না। তার ঋজু শরীর উর্দিতে আরও সোজা দেখাত, আর চোখে কী এক অদ্ভুত আকর্ষণ ফুটে থাকত। আমরা রুদ্ধশ্বাসে তাকে দেখতাম, আমাদের হৃৎপিণ্ড লাফাতে থাকত। একবার এমনি এক ঘটনার সময়, উত্তেজিত হলে তোতলায় এমন এক সিপাহি আবেগ সামলাতে না পেরে বলে উঠেছিল:
“আ-মি দু-দু-ড-ডলার বা-বাজি ধ-রছি য-দি না-নালাটায় প-পৌঁছুবার আ-আগেই তা-তারা তা-তাকে শুইয়ে না দে-দেয়।”
সেই নির্মম বাজিতে আমি অংশ নেইনি। আমারও মনে হয়েছিল এরকমই ঘটতে পারে। নিরপেক্ষ বিচারে বলতে হবে যে, জীবনীশক্তির এই প্রদর্শনীর একেবারেই কোনো প্রয়োজন ছিল না এবং এর পেছনে দৃশ্যত কোনো সাহসিকতা ছিল না, ছিল না কোনো কাহিনিও। দুয়েকবার আমরা তাকে বাধা দিতে গিয়েছিলাম, তখন সে মিষ্টি করে হেসে এমন চটুল উত্তর দিয়েছে যে আমরা এ বিষয়ে আর আগ্রহ দেখাইনি। একবার সে এক অফিসারকে বলেছিল:
“ক্যাপ্টেন, আপনার উপদেশ শুনিনি বলে আমাকে যদি কখনো পস্তাতে হয়, আশা করি কানে কানে ‘আমি তোমাকে আগেই সতর্ক করেছিলাম’ বলে আপনি আমার শেষ মূহূর্তগুলোকে আনন্দময় করে তুলবেন।”
আমরা ক্যাপ্টেনকে নিয়ে হেসে উঠেছিলাম-যদিও ব্যাখ্যা করতে পারব না কেন। আর সেদিন বিকেলেই যখন ওঁৎ পেতে থাকা শত্রুদের গুলিতে তার শরীর পুরনো কাগজের মতো ছিন্ন হয়ে গেল, ব্রেইল কিছুক্ষণ তার লাশের পাশে থাকল। কামানের গোলার ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়া রাস্তার উপর বসে সে মমতার সঙ্গে ক্যাপ্টেনের বিচ্ছিন্ন অঙ্গগুলোকে জোড়া লাগানোর বৃথা চেষ্টা করল।
এ ধরনের কাজকে বোকামি বলে নিন্দা করা সোজা, এবং এর অনুকরণ থেকে বিরত থাকাও কঠিন কিছু নয়, তবে শ্রদ্ধা না করা অসম্ভব। আর এই বীরত্বজনক বোকামির জন্যই বুঝি ব্রেইলকে সবাই পছন্দ করত। আমরা ভাবতাম সে এমন বোকামি না করলেই ভালো ছিল, কিন্তু সবসময়ই সে এমন করত আর প্রতিবারই একেবারে তাজা অবস্থায় কাজে ফিরে আসত।
অবশ্যম্ভাবী ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত ঘটেছিল। সম্ভাবনার সূত্রকে যারা হেলাফেলা করে তারা এমন এক শত্রুর মোকাবিলা করে যাকে খুব কমই পরাস্ত করা যায়। এটা ঘটেছিল জর্জিয়ার রেসাকায়, যে অভিযানে আমরা আটলান্টা দখল করতে সমর্থ হয়েছিলাম। আমাদের ব্রিগেডের সামনে ছিল খোলা মাঠজুড়ে শত্রুপক্ষের তৈরি করা মাটির বাঁধ আর তাদের পেছনে একটা ছোটো পাহাড়। ময়দানের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত পুরোটা জুড়েই আমরা গাছপালার নিচে অবস্থান নিয়েছিলাম।
কিন্তু যথেষ্ট কাছে থাকলেও দিনের বেলায় পাহাড়টা দখল করা সম্ভব ছিল না। আমরা রাতের অপেক্ষা করছিলাম, যখন অন্ধকার আমাদেরকে ছুছুন্দরীর মতো মাটি ওলটপালট করে ফেলার সুযোগ এনে দেবে। আমাদের অবস্থান ছিল তাদের থেকে পোয়া মাইল দূরে বনের কিনার বরাবর। মোটামুটিভাবে বলতে গেলে আমরা সারি বেঁধে একটা অর্ধবৃত্ত তৈরি করেছিলাম, যার দুই প্রান্তের মধ্যে একটা সোজা রেখা টানলে শত্রুপক্ষের দুর্ভেদ্য অবস্থান বোঝাবে।
“লেফটেন্যান্ট, কর্নেল ওয়ার্ডের কাছে যাও। তাকে বলবে সে যেন আড়ালে আড়ালে যতটা সম্ভব শত্রুদের নিকটে পৌঁছানোর চেষ্টা করে, আর অযথা গোলাগুলি খরচ না করে। দ্যাখো আবার ঘোড়ায় চড়ে যেও না যেন।”
জেনারেল যখন ব্রেইলকে এ আদেশ দিলেন আমরা তখন বনের একেবারে ডান প্রান্তে ছিলাম, আর কর্নেল ছিলেন বাম প্রান্তে। ঘোড়া না নিয়ে যাওয়ার আদেশের অর্থই ছিল যে তার উচিত হবে সোজা না গিয়ে ঘুরপথে বনের মধ্যে সৈন্যদের ভেতর দিয়ে যাওয়া। সত্যি বলতে কি এরকম বলে দেওয়ারও দরকার ছিল না, উন্মুক্ত জায়গা দিয়ে আড়াআড়ি গেলে যে খবরটা পৌঁছানো যাবে না, তা নিশ্চিত ছিল। কিন্তু কেউ বাধা দেওয়ার আগেই ব্রেইল মাঠের মধ্যে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল আর শত্রু পক্ষের অস্ত্রগুলো গর্জে উঠল।
“বোকাটাকে থামাও!” জেনারেল চিৎকার করলেন।
একজন সিপাহি যার বুদ্ধির চেয়ে উচ্চাশা বেশি ছিল সে এ আদেশ পালন করতে লাফিয়ে উঠল এবং ১০ গজ যেতে না যেতেই তার ও তার ঘোড়ার নাম যুদ্ধে শহীদ হওয়াদের তালিকায় উঠে গেল।
ব্রেইলকে আর ডেকে ফেরত আনার উপায় ছিল না। মাত্র দুশ গজ দূরে শত্রুসারির সমান্তরালে তার ঘোড়া এখন দ্রুত ছুটছে। একটা দেখার মতো দৃশ্য বটে! বাতাস কিংবা বুলেট তার মাথার টুপি উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল, আর তার লম্বা সোনালি চুল ঘোড়ার খুরের তালে তালে ওঠানামা করছিল। সে স্যাডলের উপর সোজা হয়ে বসা ছিল, বাঁ হাতে লাগাম, আর ডান হাতটা অযত্নে ঝুলানো। মাঝে মাঝে তার মাথা এপাশ ওপাশ ঘুরাচ্ছিল, তখন তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে যা ঘটতে যাচ্ছে সে বিষয়ে তার আগ্রহ ছিল স্বভাবজাত, তাতে কোনো ধরনের কৃত্রিমতা নেই।
দৃশ্যটা সাংঘাতিক নাটকীয় সন্দেহ নেই, কিন্তু তা কোনোভাবেই সাজানো অভিনয় ছিল না। সে যখন যে রাইফেলগুলোর আওতার মধ্যে পড়ছিল, সেগুলোই তার দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি চালাচ্ছিল। এদিকে বনের আড়ালে থাকা আমাদের নিজেদের প্রতিরক্ষা লাইনও শব্দ ও দৃশ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিল যে তারাও কম যায় না। নিজেদের জীবনের পরোয়া বা কারও আদেশের তোয়াক্কা না করে তারা লাফিয়ে উঠল আর দলে দলে মাঠে নেমে শত্রুপক্ষের অগ্রহণযোগ্য গোলাবর্ষণের প্রতিবাদে বুলেটের বন্যা বইয়ে দিল। ও দিকের হাতিয়ারও সমানে পাল্টা জবাব দিল।
অরক্ষিত জায়গায় নেমে যাওয়ার কারণে আমাদের সৈন্যদের মারাত্মক ক্ষতি হলো। দুই পক্ষের গোলন্দাজ বাহিনীও লড়াইয়ে যোগ দিল, কামানগুলো নিয়মিত বিরতিতে মাটি কাঁপানো বিস্ফোরণে গর্জে উঠতে থাকল। শত্রুপক্ষের গোলার টুকরো বাতাস ভেদ করে আমাদের দিকের বনে ঢুকল আর গাছের পাতা রক্তে রাঙিয়ে দিল। আমাদের দিকের কামানগুলোও প্রচুর ধোঁয়া ও ধুলো উড়াল।
লড়াইয়ে এরকমই হয়। ক্ষণিকের জন্য যুদ্ধের এই সাধারণ চিত্র আমার মনোযোগ টেনে নিয়েছিল। এখন, দুপক্ষের বজ্রমেঘের ফাঁকে কিছুটা স্পষ্ট জায়গায় আমার দৃষ্টি গেল। যার জন্য এই ধ্বংসযজ্ঞ ঘটল সেই ব্রেইলিকে দেখতে পেলাম। বন্ধু ও শত্রু দুই দলই তার ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে তা নির্ধারিত করে দিয়েছিল, যদিও দুই পক্ষের কেউই তাকে দেখতে পাচ্ছিল না। গোলাগুলির মাঝখানে সে শত্রুদের দিকে মুখ করে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। একটু দূরে তার ঘোড়াটা পড়ে আছে। আমি সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে ফেললাম কেন সে থেমে আছে।
সেনাদলে আমি ভ‚-জরিপকারী হিসেবে কাজ করতাম। যুদ্ধক্ষেত্রের মানচিত্র তৈরি করার জন্য আমি সকালবেলায়ই ময়দানটা দ্রুত দেখে নিয়েছিলাম। এখন মনে পড়ল যে ওখানটায় একটা সরু ও সর্পিল গিরিখাত আছে। শত্রুপক্ষের অবস্থান থেকে মাঠের মাঝামাঝি পর্যন্ত এসে এটা সমকোণে এগিয়ে গেছে। আমরা যেখানে ছিলাম সেখান থেকে এটা চোখে পড়ত না এবং মনে হলো ব্রেইলিও তা দেখতে পায়নি। স্পষ্টতই এটা অতিক্রম করা সহজ ছিল না।
তবে এখনো যে সে বেঁচে আছে সেটা একটা অলৌকিক ঘটনা। তার উচিত ছিল এখন পর্যন্ত পাওয়া দৈবের সহায়তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা। তাহলে সে সহজেই গিরিখাতটার কোনো একটা ফাঁকফোকরে ঢুকে নিশ্চিন্ত নিরাপদে থাকতে পারত। কিন্তু সে সেটা করল না। অন্য প্রান্তে কর্নেলের কাছে যাওয়ার উপায় ছিল না, আবার সে পিছিয়েও এলো না। দাঁড়িয়ে থেকে মৃত্যুর অপেক্ষা করতে লাগল। অবশ্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি।
সে লুটিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে, যেন কোনো জাদুমন্ত্রবলে, গোলাগুলি থেমে গেল। অনেকক্ষণ পর পর যে দুয়েকটি গুলির শব্দ শোনা গেল সেগুলো নীরবতা ভাঙতে নয়, বরং যেন মৌনতার কথা মনে করিয়ে দিতেই ছোড়া হয়েছে। দুপক্ষই যেন তাদের অর্থহীন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে। সাদা পতাকা হাতে আমাদের একজন সার্জেন্ট আর তার পিছু পিছু চারজন সৈনিক স্ট্রেচার নিয়ে ব্রেইলির লাশ আনতে গেল।
শত্রুপক্ষ থেকেও বেশ কয়েকজন অফিসার ও সৈন্য এলো। তারা তাদের টুপি খুলে এই পবিত্র মৃতদেহ স্ট্রেচারে তুলতে এবং বয়ে নিয়ে আসতে আমাদের লোকদের সহায়তা করল। আমাদের লোকেরা যখন লাশ নিয়ে ফিরছিল তখন শত্রুশিবির থেকে গোলা আর ঢাকের আওয়াজের বদলে শোকসংগীত ভেসে এলো। এটা ছিল একজন নিহত বীরের প্রতি তাদের সম্মান জানানো।
ব্রেইলের স্মৃতি হিসেবে তার জিনিসপত্র সবার মধ্যে ভাগ করে দিতে আদেশ করলেন জেনারেল। আমার ভাগে পড়ল রাশিয়ান চামড়ায় তৈরি পকেটে রাখার মতো ছোট্ট একটা ডায়েরি।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার বছর খানেক পর ক্যালিফোর্নিয়ায় যাওয়ার সময় আমি এটা খুলে অলসভাবে চোখ বুলাচ্ছিলাম। এতে একটা পকেট ছিল যা আমি দেখতে পাইনি। তা থেকে হঠাৎ একটা চিঠি পড়ল। এর কোনো খাম ছিল না, ছিল না প্রাপকের ঠিকানাও। হাতের লেখা থেকে মনে হচ্ছিল কোনো মেয়ের লেখা। ‘প্রিয়তম’ গোছের শব্দ দিয়ে তা শুরু হয়েছে, কিন্তু উদ্দিষ্ট ব্যক্তির নাম নেই।
চিঠিটাতে তারিখ দেওয়া ছিল ৯ জুলাই, ১৮৬২, স্থান সান ফ্রান্সিসকো। চিঠির শেষে উদ্ধৃতি চিহ্নের মাঝখানে ডার্লিং লেখা, কিন্তু এখানেও নাম উল্লেখ নেই। তবে প্রসঙ্গক্রমে চিঠির ভেতরে লেখিকার পুরো নাম দেওয়া ছিল-মারিঅ্যান মেন্ডেনহল।
চিঠিটি প্রেরকের শিক্ষা আর বংশমর্যাদার সাক্ষ্য দিচ্ছিল, তবুও এটা একটা সাধারণ প্রেমপত্রই, যদি প্রেমের চিঠিকে সাধারণ বলা যায়। এতে যে খুব বেশি কিছু ছিল তা নয়, তবে অন্যান্য কথার সঙ্গে এ কটা বাক্যও লেখা ছিল:
“জনাব উইন্টার বলে বেড়াচ্ছেন যে ভার্জিনিয়ার কোনো একটা যুদ্ধে, যেটাতে তিনি আহত হয়েছিলেন, তুমি একটা গাছের আড়ালে ভয়ে গুটিসুটি মেরে ছিলে। এ জন্য অবশ্যই আমি তাকে চিরকাল ঘৃণা করব। বোধহয় তার উদ্দেশ্য আমার চোখে তোমাকে হেয় করা। কথাটা আমি বিশ^াস করলে তার উদ্দেশ্য সফল হতো। আমি আমার ভালোবাসার সৈনিকের মৃত্যুও মেনে নিতে পারি, কিন্তু কাপুরুষতা নয়।”
এই কথাগুলো সেদিনের সেই আলোকোজ্জ্বল বিকেলে, অনেক দূরের একটা জায়গায় শ’খানেক পুরুষের জীবন কেড়ে নিয়েছিল। কে বলে নারী অবলা?
এক সন্ধ্যায় আমি মিস মেনডেনহলের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, উদ্দেশ্য তাকে চিঠিটা ফিরিয়ে দেওয়া। আমার আরও উদ্দেশ্য ছিল চিঠিটার ফল কী হয়েছিল তা তাকে বলা-সেজন্য তাকে দায়ী করা নয়। তার বাস ছিল রিঙ্কন হিলের একটা চমৎকার বাড়িতে। দেখলাম যে সে সুন্দরী, নাদুসনুদুস-এককথায় মায়াবিনী।
‘লেফটেন্যান্ট হেরমান ব্রেইলকে তো আপনি চেনেন,’ তাকে বললাম, ‘আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গিয়েছেন। তার জিনিসপত্রের মধ্যে আপনার লেখা এই চিঠিটা ছিল। আপনার কাছে তা পৌঁছে দিতেই আমার এখানে আসা।’
সে যন্ত্রের মতো চিঠিটা নিলো আর গম্ভীর হয়ে তাতে চোখ বুলালো, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল:
‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, যদিও এত কষ্ট করার কোনো দরকার ছিল না।’ তারপর হঠাৎই সে চমকে উঠল, তার মুখের রং বদলে গেল। ‘এই দাগটা’, সে বলল, ‘এটা কীএটা কীআপনি নিশ্চয়ই বলবেন না যে এটা।’
‘ম্যাডাম,’ আমি বললাম, ‘মাফ করবেন, কিন্তু আমাকে বলতেই হবে যে এটা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে খাঁটি ও সবচেয়ে সাহসী মানুষের রক্ত।’
সে সঙ্গে সঙ্গেই চিঠিটাকে পাশেই জ্বলতে থাকা কয়লার আগুনে ছুড়ে মারল। ‘উহ! আমি একদমই রক্ত দেখতে পারি না।’ সে বলল, ‘তা ব্রেইল কীভাবে মারা গেল?’
মনের অজান্তেই আমি কাগজের টুকরোটাকে আগুনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। ব্রেইল আমার কেউ নয়, তবু আমার মনে হয়েছিল যে এটা বিশেষ কিছু। আমি মেনডেনহলের একটু পেছনে ছিলাম। আমাকে প্রশ্ন করতে গিয়ে সে মুখটা ঘুরাল আর একটু উপরের দিকে তুলল। তার চোখে জ্বলন্ত চিঠিটার আলো প্রতিফলিত হলো। চিঠির গায়ে রক্তের দাগটি যে রকম তার গালেও আগুনের সেরকম গাঢ় লাল আভা ফুটে উঠল। এমন ঘৃণ্য অথচ এমন সুন্দর জীব আমি আর দেখিনি।
‘সাপের কামড়ে,’ আমি জবাব দিলাম।
মূল: অ্যামব্রোস বিয়ার্স
ভাষান্তর: কবির চান্দ