
‘একাত্তরের দিনগুলি’ মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গ্রন্থ। ফাইল ছবি
‘একাত্তরের দিনগুলি’ বাংলাদেশি কথাসাহিত্যিক জাহানারা ইমাম রচিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গ্রন্থ। যা একটি ঐতিহাসিক দলিল। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এরপর আরো অনেকবার এটি পুনঃমুদ্রিত হয়।
বইটি ব্যক্তিগত দিনলিপি আকারে লেখা, যার শুরু ১৯৭১ সালের ১ মার্চ এবং সমাপ্তি ঐ বছরের ১৭ ডিসেম্বর। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঢাকা শহরের অবস্থা ও গেরিলা তৎপরতার বাস্তব চিত্র এতে উঠে এসেছে।
বইটিতে তাঁর সন্তান শাফি ইমাম রুমী অন্যতম প্রধান চরিত্র হিসেবে দেখা দেয় এবং তাঁর মৃত্যুর জন্য জাহানারা ইমাম শহীদ জননী উপাধি পান। বিজয়ের একান্নতম বছরে এই বই থেকে ডিসেম্বর মাসের দুইটি দিনের দিনলিপি পুনঃপ্রকাশ করা হলো
১৫ ডিসেম্বর, বুধবার ১৯৭১
আজ হোসেন সাহেব এবং ওঁর নিচতলার ভাড়াটে আসলাম সাহেব সপরিবারে আমাদের বাসায় এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এখন ছেলে-বুড়ো মিলে পঁয়তাল্লিশজন লোক আমার বাসায়। আজ সারাদিন কান ঝালাপালা করে রকেটিং এবং স্ট্রেফিং চলেছে। সারাদিন কানে তুলো, ঘাড়ে লেপ, মাথা বিছানায় গোঁজা। আজ সাড়ে আটটা- সাড়ে বারোটা কারফিউ নেই।
খবর পেলাম গতকাল পেছনের গলির এক বাড়িতে বোমা পড়ে শরীফের বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার তোফাজ্জল হোসেনের মেয়ে মারা গেছে। ঐ বোমার আঘাতেই গতকাল ইলেকট্রিক এবং টেলিফোনের তারও ছিঁড়েখুঁড়ে গেছে। আজ সারাদিন কোলকাতা রেডিও খোলা আছে। বারবার শুনতে পাচ্ছি- পাক আর্মিকে সারেন্ডার করার নির্দেশ। এজন্য আজ বিকেল পাঁচটা থেকে আগামীকাল সকাল নয়টা পর্যন্ত আকাশযুদ্ধ বন্ধ থাকবে- বলা হচ্ছে।
এই রকম মুহুর্মুহু বোমাবর্ষণের মধ্যেই সারা সকাল ধরে এসেছে ইলা, বাদশা, আতা ভাই, কলিম, নজলু, হুদা, রেণু, মঞ্জুর, আতিক, হামিদা, জুবলী, রফিক, মাসুমা। সবাই এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আর আমি সবাইকে বকছি এরকম স্ট্রেফিংয়ের মধ্যে কেন বেরিয়েছে? মাথার ওপর প্লেনের শব্দ হলেই ওদেরও দু’হাতে কান চেপে বিছানায় মাথা গুঁজে বসতে বলছি।
মঞ্জুর বললেন যে গভর্নমেন্ট হাউসে হেভি বম্বিং হয়েছে। বাঁকাকে তাই মতিঝিলের অফিস থেকে তুলে ধানমন্ডিতে তার ভাগনে প্রিন্সের বাড়িতে দিয়ে এসেছেন। গভর্নর মালেক হোটেল ইন্টারকনে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। ইন্টারকনকে এখন ইন্টারন্যাশনাল জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। লুলু গত দু’দিন আসতে পারেনি। আজ এগারোটার দিকে এসে ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব। সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না মাত্র দেড় দিনের ব্যবধানে শরীফের হার্ট এটাক, মৃত্যু, জানাজা এবং দাফন পর্যন্ত শেষ! বিছানায় মাথা গুঁজে অবোধ শিশুর মত কাঁদতে লাগল সে।
এর মধ্যে রান্নাঘরের দিকটাও সামলাতে হচ্ছে। ছয়টি বাড়ির ছয়টি বিভিন্ন পরিবারের পঁয়তাল্লিশজন লোকের রান্নার দায়িত্ব কেউই আগবাড়িয়ে নিচ্ছে না। অগত্যা লক্ষ্নৌয়ি আদব-কায়দা বিসর্জন দিয়ে আমাকেই আগবাড়াতে হল। একেবারে নাম ধরে ধরে ডেকে সকালের নাশতা ও চা বানানো থেকে শুরু করে দুপুর ও রাতের রান্না ও পরিবেশনের ডিউটি বন্টন করে চার্ট বানিয়ে দিলাম। এই ডামাডোলের মধ্যে বাবার জন্য স্পেশাল রান্না করা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মঞ্জু সমাধান করে দিল এ সমস্যার। ওদের বাসা থেকে বাবার জন্য সকালে নরম রুটি, দুপুরে নরম ভাত, কম মশলার মাছের ঝোল, এসব করে বয়ে এনে বাবাকে খাওয়াচ্ছে।
১৬ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার ১৯৭১
আজ সকাল ন’টা পর্যন্ত যে আকাশযুদ্ধ বিরতির কথা ছিল, সেটা বিকেল তিনটে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। দুপুর থেকে সারা শহরে ভীষণ চাঞ্চল্য ও উত্তেজনা। পাক আর্মি নাকি সারেণ্ডার করবে বিকেলে। সকাল থেকে কলিম, হুদা, লুলু যারাই এল সবার মুখেই এক কথা। দলে দলে লোক জয় বাংলা ধ্বনি তুলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে কারফিউ উপেক্ষা করে। পাকসেনারা, বিহারিরা সবাই নাকি পালাচ্ছে।
পালাতে পালাতে পথেঘাটে এলোপাতাড়ি গুলি করে বহু বাঙালিকে খুন-জখম করে যাচ্ছে। মঞ্জুর এলেন তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে, গাড়ির ভেতরে বাংলাদেশের পতাকা বিছিয়ে। তিনিও ঐ এক কথাই বললেন। বাদশা এসে বলল, এলিফ্যান্ট রোডের আজিজ মোটরসের মালিক খান জীপে করে পালাবার সময় বেপরোয়া গুলি চালিয়ে রাস্তার বহু লোক জখম করেছে। মঞ্জুর যাবার সময় পতাকাটা আমাকে দিয়ে গেলেন।
বললেন, ‘আজ যদি সারেণ্ডার হয়, কাল সকালে এসে পতাকাটা তুলব।’ আজ শরীফের কুলখানি। আমার বাসায় যাঁরা আছেন, তাঁরাই সকাল থেকে দোয়া দরুদ কুল পড়ছেন। পাড়ার সবাইকে বলা হয়েছে বাদ মাগরেব মিলাদে আসতে। এ. কে. খান, সানু, মঞ্জু, খুকু সবাই বিকেল থেকেই এসে কুল পড়ছে। জেনারেল নিয়াজী নব্বই হাজার পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে আজ বিকেল তিনটের সময়।
যুদ্ধ তাহলে শেষ? তাহলে আর কাদের জন্য সব রসদ জমিয়ে রাখব? আমি গেস্ট রুমের তালা খুলে চাল, চিনি, ঘি, গরম মশলা বের করলাম কুলখানির জর্দা রাঁধবার জন্য। মা, লালু, অন্যান্য বাড়ির গৃহিণীরা সবাই মিলে জর্দা রাঁধতে বসলেন। রাতের রান্নার জন্যও চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি এখান থেকেই দিলাম। আগামীকাল সকালের নাশতার জন্যও ময়দা, ঘি, সুজি, চিনি, গরম মশলা এখান থেকেই বের করে রাখলাম।