
কোল্লাপাথর শহীদ সমাধিস্থল। ছবি: গাজী মুনছুর আজিজ
মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের উদ্যোগে ৫১ জন শহীদকে কাফনসহ সমাহিত করেছেন কৃষক মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান। এ সমাধিসৌধ রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার ১০ নম্বর বায়েক ইউনিয়নের বিদ্যানগর গ্রামে। কোল্লাপাথর শহীদ সমাধিস্থল নামেই এটি বেশি পরিচিত।
এ সমাধিস্থলে সমাহিত আছেন মুসলমান, হিন্দুসহ বিভিন্ন ধর্মের মুক্তিযোদ্ধা। আবদুল মান্নান শহীদের নিজ হাতে গোসল করিয়ে দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করেন নিজেরই জমিতে। আবদুল মান্নান চেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের কবর নিজ দেশেই হোক। সেজন্যই তিনি এ সমাধি গড়েছেন। দাফন-কাফন ও কবর খোঁড়ার কাজে তাকে সহযোগিতা করেছেন তারই ছেলে মুক্তিযোদ্ধা এম এ করিম।
মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান বেঁচে ছিলেন ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত। বেঁচে থাকাকালে এ সমাধিসৌধের দেখাশোনার কাজ তিনিই করতেন। সমাধিসৌধের জন্য তিনি ১৯৭২ সালে তার নিজের ৬৫ শতাংশ জমিও দান করে গেছেন। এ ছাড়া যুদ্ধপরবর্তী সময়ে সমাধিসৌধের রক্ষণাবেক্ষণ বা সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নিজের অনেক টাকাও খরচ করছেন।
এ সমাধিসৌধে শায়িত ৫১ জন শহীদের মধ্যে সাতজন রাষ্ট্রীয় বিশেষ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে আছেন- বীর উত্তম নায়েব সুবেদার মইনুল ইসলাম ও সুবেদার বেলায়েত হোসেন, বীর বিক্রম আনসার ইলাহী বস্ক পাটুয়ারি, সুবেদার আব্দুস সালাম ও ল্যান্সনায়েক আব্দুস সাত্তার, বীর প্রতীক নোয়াব মিয়া ও মোহাম্মদ জাকির হোসেন।
১৯৭১ সালের ১৬ জুলাই এ সমাধিসৌধে প্রথম শহীদ হিসেবে তৈয়ব আলীকে কবর দেওয়া হয়। এ ছাড়া এখানে শায়িত অন্য শহীদরা হলেন- মো. শাকিল মিয়া, আব্দুর রশিদ, সিপাহি শহীদুল হক, সিপাহি আনোয়ার হক, বারী খন্দকার, জামাল উদ্দিন, আব্দুল আউয়াল, আবেদ আহাম্মদ, সিরাজুল ইসলাম, ফরিদ মিয়া, মতিউর রহমান, তাজুল ইসলাম, মো. শওকত, আমির হোসেন, আব্দুস সালাম সরকার, জাহাঙ্গীর আলম, শ্রী পরেশ চন্দ্র মল্লিক, আজিজুর রহমান, তারু মিয়া, নায়েব সুবেদার বেলায়েত হুসেন, রফিকুল ইসলাম, মোরশেদ মিয়া, শ্রী আশু রঞ্জন দে, মোশারফ হুসেন, সিপাহি নরুল হক, আব্দুল কাইয়ুম, সিপাহি হুমায়ুন কবির, ল্যান্সনায়েক খালেক, সিপাহি মোসলীম মীর্ধা, আব্দুল অদুদ, সিপাহি তমিজ উদ্দিন, মতিউর রহমান, ফারুক আহাম্মদ, মোজাহীদ নূর মিয়া, নায়েক মোজাম্মেল হক, নায়েক সুবেদার আব্দুস ছালাম, নোয়াব আলী, সিপাহি দর্শন আলী, জাকির হুসেন, আব্দুল জব্বার, নায়েক আব্দুস সাত্তার এবং সিপাহি আক্কাছ আলী।
এ ছাড়া এখানে শায়িত অন্য অজ্ঞাত শহীদদের নাম জানা যায়নি। যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা এম এ করিমের বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর। তখন তিনি স্থানীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। বাবার এ সমাধি গড়ার কাজ দেখে তিনি সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসেন। আর তখন থেকেই সমাধিসৌধের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তিনি নিয়মিত কাজ করে আসছেন।
১৯৯৬ সালে এম এ করিম নিজের দুই বিঘা জমি ৬৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে ঢাকায় আসেন এ সমাধিসৌধের অবকাঠামোর নকশা প্রণয়ন ও অনুমোদনের জন্য। অনেক কষ্টের পর একদিন তিনি হাতে পেলেন তার বাবার গড়া কোল্লাপাথর শহীদ সমাধিসৌধের অবকাঠামোর নকশা।
তারপর সেই নকশা অনুযায়ী কাজ এগিয়ে চলে। সে বছর সরকারিভাবে প্রথম সমাধিস্থলের উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে হয় সমাধিসৌধের উন্নয়ন কার্যক্রম। সব মিলিয়ে ব্যতিক্রমী এ সমাধিসৌধ মুক্তিযুদ্ধের অনন্য স্মৃতি।