
বাংলাদেশ বইমেলা। ছবি: সংগৃহীত
পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় ২ থেকে ১১ ডিসেম্বর, টানা ১০ দিন বাংলাদেশ বইমেলা ছিল।
এই বইমেলা ঘুরে তার বৃত্তান্ত জানাচ্ছেন সাম্প্রতিক দেশকালের কলকাতা প্রতিনিধি- সৌগত রায় বর্মণ
বাংলাদেশের ১০ম বইমেলা এবার বসেছিল কলেজ স্কয়ারে। যেখানে ঢুকতেই শোনা গেল বাংলা গান, ‘সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি!’ এই বইমেলার সব বই বাংলা ভাষায় লেখা। অতিথি বই-বিক্রেতারা কথা বলছেন বাংলা ভাষায়। হায় স্বদেশ! এ কোন বিদেশ!
দিঘির দুই পাড়ে মোট ৬৮টি স্টল। রাস্তার ওদিকেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি কলেজ আর এদিকে কফি হাউস, বইপাড়া। বাংলা সাহিত্যের পীঠস্থান।
এত দিন বাংলাদেশের বইমেলা বসত মোহরকুঞ্জে। এবারই প্রথম কলেজ স্কয়ারে। দেখা গেল ক্রেতা-বিক্রেতা দুপক্ষই খুশি। স্বাভাবিক। বইপাড়াতেই বইমেলা হওয়া উচিত। বইমেলা নিশ্চয়ই বড়বাজারে হবে না!
কথা হচ্ছিল আশুতোষ মিদ্দার সঙ্গে। তিনি একজন অধ্যাপক। তার কথায়, তিনি অনেক দূর থেকে এসেছেন কিছু বিশেষ ধরনের বইয়ের খোঁজে, যা তিনি কলকাতায় পান না। যেমন বাংলাদেশের আদিবাসী। তিনি এই বিষয়ে গবেষণা করছেন। আনন্দের সংবাদ, তিনি সেই বইটি খুঁজে পেয়েছেন। তার কিছু অনুযোগও আছে। বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিন কলকাতায় পাওয়া যায় না। একইভাবে কলকাতারগুলো পাওয়া যায় না ওপার বাংলায়। আদান প্রদানের কিছু বন্দোবস্ত কি করা যায়?
‘প্রান্তিক নওরোজ কিতাবিস্তান’-এর বিপণি-বিতানে গিয়ে দেখা হলো মালিকের সঙ্গে।
এমন অদ্ভুত নামের কারণ জিজ্ঞেস করাতে জানালেন, ১৯৪৪ সালে এই কলকাতার বইপাড়াতেই বিপণির নামকরণ করা হয়েছিল। নাম দিয়েছিলেন স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলাম। নওরোজ শব্দের অর্থ নতুন। আর কিতাবিস্তান মানে বইয়ের রাজ্য। সেই থেকে এই প্রকাশনী বই প্রকাশ করে যাচ্ছে। দেশভাগের পর তারা ওপার বাংলায় চলে যান।
হুমায়ূন আহমেদ কলকাতায় খুব পরিচিত নাম। তার লেখার সঙ্গে পরিচয় আছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের।
এবার দেখা গেল, তার মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস সমগ্র বেশ ভালো বিক্রি হচ্ছে। বিক্রি হচ্ছে, অলৌকিক উপন্যাস। ভূতের গল্প এবং অলৌকিকের চাহিদা এবারের বই বিক্রির মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মহম্মদ জাকির হুসেন ঢাকা থেকে তার পুস্তক সম্ভার নিয়ে এসেছেন। তিনি জানালেন, রবিন জামাল খানের বই পছন্দ করছেন ক্রেতারা। তাছাড়াও এম. জে আকবরের গান্ধী’জ হিন্দুইজম দ্য স্ট্রাগল এগেন্সট জিন্না’জ ইসলাম। বইটির অনুবাদ এখানে বেশ ভালো সাড়া ফেলে দিয়েছে। তাদের উল্লেখযোগ্য বই রবিন জামাল খানের দ্বিখণ্ডিত উপন্যাসটির বিক্রি খুব ভালো।
‘দ্রৌপদী’, ‘রাধেয়’ ও রুমির কবিতার অনুবাদ এখানেও পাওয়া যাচ্ছে। বিক্রি যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক। ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়ে চোখ ভিজে আসে পাঠকের।
পুরুলিয়া থেকে মানববাবু এসেছিলেন কলকাতায় তার কাজে। বাংলাদেশ বইমেলা হচ্ছে শুনে সটান এখানে। নতুন প্রজন্মের মানুষ তিনি। মুক্তিযুদ্ধের কথা বাপ ঠাকুরদার মুখে শুনেছেন। তিনি সংগ্রহ করেছেন বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী। সঙ্গে অজস্র বই। সবই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং দলিল।
তার কথায়, দেশভাগ কেন হয়েছিল তা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরও তা আমরা মনে রাখব কেন? বাংলাদেশের বই কেন কলেজ স্ট্রিটে পাওয়া যাবে না! বইয়ের কোনো সীমানা নেই। দুই দেশের মধ্যে বই কেন অনায়াসে যাতায়াত করবে না? আমাদের নতুন প্রজন্মের উচিত এই বিষয়টা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা। উত্তর খোঁজার চেষ্টা চলছে। সভামঞ্চে শোনা গেল এই প্রশ্নের উত্তর।
ডিজিটাল যুগ শুরু হয়ে গেছে। এই যুগ কোনো সীমানা মানে না। ই-বুক নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। পৃথিবীর সমস্ত বাঙালি যেন বাংলা ভাষার বই একসঙ্গে পড়তে পারে!
সত্যিই তো বই কেন রাষ্ট্রীয় নিয়ম-কানুনের মধ্যে আবদ্ধ থাকবে? লাল ফিতের পরোয়ানা যেখানে আছে সেখানেই থাকুক। আকাশ তো কারোর নয়। তবে আকাশপথে বই ঘুরে বেড়াক আপন মনে। সেটাই তো হওয়া উচিত। বই ধরা দেবেই, যে ধরতে চায়, তার কাছে। ক্রেতা ও বিক্রেতা দুপক্ষেরই দাবি একটাই, প্রতিবছর যেন এই কলেজ স্কয়ারেই বাংলাদেশ বইমেলার আসর বসে। দুই দেশের বইয়ের আদানপ্রদানে যেন কোনো রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ না থাকে।