
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে সূত্রপাত হয় স্বাধীনতার আন্দোলনের। ফাইল ছবি
শৈশবে একুশে ফেব্রুয়ারিতে খুব সকালে বাবা আমাদের শহীদ মিনারে নিয়ে যেতেন ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। এবং বাসা থেকে শহীদ মিনার পর্যন্ত খালি পায়ে যেতে হতো। গোটা শীতকাল মোজা জুতা পায়ে দেয়ার কড়াকড়ি থাকলেও শীতের ওই দিনটাতে আর জুতা পায়ে হাঁটতে দিতেন না।
এই নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হতো মূলত শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা যেন তৈরি হয় সে কারণেই। আমার বাবা নিজে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, সম্মুখ যুদ্ধে গুলিতে আহত হয়েছেন।
তিনি জানতেন, দেশের জন্য ব্যক্তির আত্মোৎসর্গের মাহাত্ম্য কী। আমাদের জন্ম হয়েছে একটা স্বাধীন দেশে। আমরা কখনো উপলব্ধি করতে পারব না পরাধীনতার গ্লানি কী! কতটা নিপীড়ন, শোষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে আমাদের পূর্বসূরিদের। কিন্তু একটা স্বাধীন দেশে বৈষম্যমূলক ও প্রতিহিংসার রাজনীতি আমাদের স্বাধীনতার এই পঞ্চাশ বছর পর এসেও উপলব্ধি করাচ্ছে সামাজিক বৈষম্য কী!
কোনো রাষ্ট্র বা জাতির ভেতরে যখন বৈষম্য বিরাজ করে সেটা হয় তার মূল দুর্বলতা। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, ‘পৃথিবীতে যদি অসাম্য না থাকত জাতীয়তাবাদ তা হলে আগ্রাসী হতো না। হতো বৈচিত্র্যের ব্যাপার; দখল ও উৎখাতের কারণ হতো না, হতো সহাবস্থানের ঘটনা।’
বৈষম্য থেকে মুক্তি
আজ যে স্বাধীন বাংলাদেশ, এই রাষ্ট্রের সূত্রপাত হয় মূলত বৈষম্য থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষায়। এ ক্ষেত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদ যেমন মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে, তেমনি কাজ করছে অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। যেখানে প্রধান করে দেখানো হয়েছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ।
বাঙালি মুসলমান পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে ভোট দিয়েছিল এবং তাদের ভোটের কারণেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল। অবিভক্ত ভারতের জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ ছিল মুসলমান, আর সেই মুসলমানদের এক-তৃতীয়াংশ বাস করত বাংলায়। আর তারা যখন ভোট দিয়ে জানিয়ে দিল যে তারা পাকিস্তান চায়, তখন তাদের দাবিকে অবজ্ঞা করা কঠিন হয়ে পড়েছিল।
কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান গঠিত হলেও পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে এসে মুসলিম জাতীয়তাবাদ গ্রহণযোগ্য হয়নি। যে কারণে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, ‘ওই রাষ্ট্রে হিন্দু-মুসলমান খ্রিষ্টানের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। সবাই সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে।’
কিন্তু এরপর ১৯৪৮ সালে তিনি উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে। এর পেছনে মূল কারণ ছিল আধিপত্যবাদ। তিনি চেয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের ওপর কর্তৃত্ব করবে। কিন্তু বাঙালিরা তা মেনে নেয়নি। কারণ তারা পাকিস্তান চেয়েছিল ইসলামের জন্য নয়, তাদের বৈষয়িক মুক্তির জন্য। যে মুক্তির সব পথ বন্ধ করে রেখেছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা।
ফলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে সূত্রপাত হয় স্বাধীনতার আন্দোলনের।
পাকিস্তানি শাসন শোষণের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম আর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। ৭০-এর দশকে যে সদ্য স্বাধীন দেশটাকে খাদ্য ঘাটতি, দুর্ভিক্ষ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত দেশ হিসেবে চিনেছিল বিশ্ব। সে দেশই স্বাধীনতার ৫০ বছর পর একটি মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার প্রক্রিয়ায় চলে গেছে।
একটি উন্নয়নশীল দেশ হয়েও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সারা বিশ্বের কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিবিড় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবহার এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে তার ভ‚মিকা, বৃক্ষরোপণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকের ইতিবাচক পরিবর্তন, স্বাস্থ্যসেবায় শিশুদের টিকাদান, নারী ও শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা, নারী ও শিশু উন্নয়নে অর্জন, নারীর ক্ষমতায়ন, শিল্প ও বাণিজ্য সম্প্রসারণে এগিয়ে আছে। বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের পাশাপাশি প্রসার ঘটেছে আবাসন, জাহাজ ও ঔষধ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও খাদ্য শিল্পের।
উন্নয়নের সুফল ভোগ
আমাদের দেশে কৃষি ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব উন্নতি নিঃসন্দেহে একটি দেশের জনগণের জন্য সুফলদায়ক। কিন্তু সেই সুফল কি সবাই পূর্ণ মাত্রায় ভোগ করতে পারছেন! বলা হয় দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু সেই খাবার কি দেশের প্রায় অর্ধেক নগরিকের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকছে না? জরিপে দেখা যায় দেশে মাছ মাংসের উৎপাদন বেড়েছে।
মূলত মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হিসাব দিয়ে যেমন সমাজের বঞ্চনা বোঝা যায় না, তেমনি মাছ মাংস উৎপাদন বৃদ্ধির হিসাব দিয়েও সাধারণ নিম্নবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের খাদ্যতালিকায় মাছ-মাংস না থাকার নির্মম বাস্তবতা বোঝা যায় না। বাস্তবতা হলো, স্বল্প আয়ের মানুষের পাতে এসব ‘বৃদ্ধি’র ভাগ পড়ছে না। স্বল্প আয়ের মানুষের ভাগের মাংসটা খেয়ে নিচ্ছে নিয়মিত ফাস্ট ফুডে যাওয়া দ্রুত বর্ধনশীল ধনী ও নব্য ধনীরা।
প্রবাসী শ্রমিকদের উন্নয়ন
বর্তমানে বিশ্বের ১৫৭টি দেশে বাংলাদেশের ৮৬ লক্ষের অধিক শ্রমিক কাজ করেন। প্রবাসী শ্রমিকদের জনসম্পদ হিসেবে দেখানো হলেও, তাদের রেমিট্যান্সের টাকায় ব্যাংকের রিজার্ভ বৃদ্ধি হলেও, এদেশের ভঙ্গুর শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে দক্ষ জনসম্পদ গড়ে উঠছে না। এটা যেমন দেশের অভ্যন্তরে নয়, তেমনি দক্ষ শ্রমিক আমরা বিদেশে পাঠাতেও ব্যর্থ হচ্ছি। উল্লেখ্য যে, বিদেশে ১ কোটি ২৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক আছেন। তবে তাদের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ দক্ষ। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া শ্রমিকদের ৬২ শতাংশ অদক্ষ এবং ৩৬ শতাংশ আধা দক্ষ।
অন্যদিকে দেশে লক্ষণীয়ভাবে দক্ষ কর্মীর স্থান পূরণ করছে লাখ লাখ বিদেশি কর্মী। দক্ষ কর্মী সংকটে বাংলাদেশ তার চাহিদা মেটাচ্ছে বিদেশি কর্মী দিয়ে। একটা দেশের প্রকৃত উন্নতি নির্ভর করে মূলত তার আভ্যন্তরীন কর্মী দক্ষতার ওপর।
অথচ বাংলাদেশে বৈধ বা অবৈধভাবে কাজ করছে ৫ লক্ষ বিদেশি দক্ষ কর্মী। বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (বিডা) তথ্য অনুযায়ী বিদেশি কর্মীরা বাংলাদেশ থেকে বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাছে। কেন দক্ষ কর্মী তৈরি হচ্ছে না, এখানে শুভঙ্করের ফাঁকিটা কোথায়?
অর্থ পাচার
দেশের আর্থিক খাতের দুটি ক্ষতিকর খাত হলো খেলাপি ঋণ ও অর্থ পাচার। এ দুটির মধ্যে আবার পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-এর সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। দেশ থেকে অস্বাভাবিক হারে টাকা পাচার বেড়েছে। ৬ বছরে দেশের চার লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা (৪৯৬৫ কোটি ডলার) বিদেশে পাচার হয়েছে।
অর্থ পাচার রোধে দেশে শাস্তির বিধান থাকা সত্তে¡ও কেন এ পাচার বন্ধ হচ্ছে না? বস্তুত দুর্নীতি বেড়েছে বলেই অর্থ পাচারের হারও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এসব দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালী ব্যক্তি ও নষ্ট রাজনীতির ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা।
সীমাহীন বৈষম্য বেড়েছে সম্পদের। একদিকে গত এক মাসে দেখা গেছে একদল লোক ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোন তুলে নিয়েছে অন্যদিকে ২৫ জন কৃষক মাত্র ২৫ হাজার টাকা শোধ করা সত্ত্বেও ঋণের দায়ে জেল খাটছেন।
এছাড়াও বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার পরিস্থিতি, বাকস্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত ও বিপন্ন। শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নে কি আমরা সন্তুষ্ট থাকতে পারি! আমাদের মধ্যে একটা শ্রেণি শোষক, এক শ্রেণি বঞ্চিত। একটা স্বাধীন দেশের নাগরিকদের মধ্যে এমন বিপুল বৈষম্য যাদের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে নিশ্চয়ই তাদের কাম্য ছিল না।