
গল্প। প্রতীকী ছবি
সেরাতে আমরা দশ নম্বরের বাড়িটা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে দ্রুত পায়ে হাঁটছিলাম অন্ধকার গলির ভেতর দিয়ে, বাড়ির দেয়াল এবং ঝোপঝাড়ের আড়ালে আড়ালে।
হঠাৎ কেঁদে উঠল বিন্নি, ঘুমাচ্ছিল আমার কোলে, কাঁধে মাথা রেখে।
শায়লা ওকে তাড়াতাড়ি আমার কাছ থেকে নিলো এবং ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করল যাতে ওর কান্না থেমে যায়। কিন্তু বিন্নি কিছুতেই থামছে না। তখন আমরা একটা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লাম।
ফাঁকা বাড়ি। বারান্দায় পা দিতেই বুঝলাম লুটপাট করা হয়েছে। বাড়ির লোকগুলো হয়তো পালিয়ে গেছে আগেই। কিংবা ধরে নিয়ে গেছে ওরা।
শায়লা একটা টুলে বসে বিন্নিকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিল।
আমি খেয়াল করলাম, পুরো এলাকাটাই ফাঁকা এবং আমরা যে বাড়িটাতে ঢুকেছি, সেটা নিরাপদ নয় বলেই কেউ আর নেই ওখানে।
আমি শায়লার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম, ‘চলো।’
শায়লা উঠতে যাচ্ছিল, তখন আবারো কেঁদে উঠল বিন্নি।
হঠাৎ একটা লোককে দেখে চমকে উঠলাম, যেন একটা ছায়া এগিয়ে আসছিল। উঠানের খুব কাছে একটা ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো লোকটা, হাতে বল্লম।
লোকটা বল্লম মাটিতে পুঁতে রেখে দেশলাই জ্বালিয়ে বিড়ি ধরাল। আমি তার মুখ দেখতে পেলাম- কী ভয়ঙ্কর একটা মুখ! দেশলাইয়ের আগুনে বিড়ি ধরাবার সময়েও লোকটা তাকিয়ে ছিল আমাদের দিকে। আর আমি তার চোখ দুটোতে দেখতে পাচ্ছিলাম ভীষণ ক্রোধ আর রক্তপিপাসা!
সে হয়তো আগে থেকেই আমাদের উপর নজর রাখছিল ঝোপের আড়াল থেকে। এবার এগিয়ে এলো এবং ভয় আর আতঙ্ক গ্রাস করল আমাদের। মনে হচ্ছিল, কোনো জাদুবলে এক মুহূর্তে যদি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারতাম।
তখন বল্লম হাতে লোকটা খুব কাছে এসে পড়েছে, বলল, ‘আপনারা এখানে কী করতেছেন?’
‘আরে! এ তো বাংলায় কথা বলছে!’ আমরা ভাবলাম, এবং যেন বেঁচে উঠলাম ওই বাক্যের ভেতর।
বললাম, ‘আমরা।’
‘হ্যাঁ। কিন্তু এখানে কেন?’
‘আমরা সি ব্লক থেকে আসতেছি।’
‘ও। কিন্তু এখানে থাকলে মারা পড়বেন।’
আমরা তার সঙ্গে আবারও অন্ধকার গলির ভেতর দিয়ে, দেয়াল এবং ঝোপের আড়ালে আড়ালে, ছায়ার ভেতর ছায়া হয়ে এগিয়ে যেতে থাকলাম।
বহুদূর হেঁটে যখন একটা আলো ঝলমলে রাস্তায় গিয়ে উঠলাম, আমি বল্লমধারী লোকটার মুখের দিকে তাকালাম আবারও; দেখলাম, আত্মবিশ্বাসে দৃঢ় একটা মুখ, সাহস আর শক্তিতে উজ্জ্বল!