
সাহিত্য সমালোচক আবু সয়ীদ আইয়ুব। ছবি: সংগৃহীত
সাহিত্য সমালোচক ও রবীন্দ্রকাব্য এবং সঙ্গীতের ব্যাখ্যাতা আবু সয়ীদ আইয়ুব (১৯০৬-২১ ডিসেম্বর, ১৯৮২)-এর জন্ম কলকাতার ওয়েলেসলি স্ট্রিটে এক বনেদি পরিবারে। বাবা আবুল মকারেদ আব্বাস ছিলেন বড়লাটের করণিক। মা আমিনা খাতুন। অবাঙালি পরিবারটির কলকাতায় বসবাস তিন পুরুষ ধরে হলেও পারিবারিকভাবে তারা বাংলা ভাষা ও বাঙালি সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না।
আবু সয়ীদ আইয়ুব ছেলেবেলা থেকে ভগ্নস্বাস্থ্যের হলেও ছিলেন প্রচণ্ড মেধাবী। কলকাতার সেন্ট এন্টনিজ স্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে আইএসসি পাস করে ভর্তি হন পদার্থবিদ্যায়। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পদার্থবিদ্যায় অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। বিজ্ঞানের ছাত্র আইয়ুব আগ্রহী হন আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদে; কিন্তু অসুস্থতায় ছেদ পড়ে আগ্রহে। এমএসসি পরীক্ষা দেওয়া হয় না। দর্শনশাস্ত্র পড়ার জন্য ভর্তি হন। এ বিষয়ে এমএ পাস করে ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে গবেষণা করেন হোয়াইটহেডের ফিলসফি অব বিউটি নিয়ে।
অবাঙালি আবু সয়ীদ আইয়ুবের বাংলা শেখা সম্পূর্ণ নিজের আগ্রহে। সেই আগ্রহের পেছনে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিশোর বয়সে আবু সয়ীদ আইয়ুব উর্দু অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির পাঠ করেন। উর্দু পত্রিকা ‘কাহকুশান’-এ গীতাঞ্জলির অনুবাদ পড়ে তিনি এতটাই মুগ্ধ হন, যে আগ্রহী হয়ে ওঠেন বাংলা ভাষা শেখার বিষয়ে। উদ্দেশ্য মূল ভাষায় গীতাঞ্জলি পড়া। এ প্রসঙ্গে তিনি আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘গীতাঞ্জলি’ আমি প্রথম পাঠ করি উর্দু ভাষায়- তখনো বাংলা পড়তে বা বলতে শিখিনি।
ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’র চমৎকার অনুবাদ করেছিলেন নেয়াজ ফতহ্পুরী; যতোদূর জানি ঐ-অনুবাদ থেকেই উর্দু পদ্য-কবিতার (নসর-শায়েরীর) সূত্রপাত। ‘কহ্কুশান’ নামক মাসের পাদপুরণরূপে ব্যবহৃত এই গদ্য-কবিতাগুলি পড়তে পড়তে চোখে জল আসতো যে অতিশয় আনাড়ি কিন্তু নিঃসন্দেহে আন্তরিক পাঠকের বয়স তেরো, ... বছর তিনেক পর অপেক্ষাকৃত পরিণত রুচি ও বুদ্ধি নিয়ে ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’ পড়লাম। প’ড়ে আরো মুগ্ধ হলাম, কতোবার যে আবেগকণ্ঠে আবৃত্তি করলাম তার ইয়ত্তা নেই। ... ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’ পাঠ করে একটি সংকল্প এবং একটি প্রশ্ন মনে দানা বাঁধলো। সংকল্পটি মূল বাংলা ভাষায় ‘গীতাঞ্জলি’ পড়বার।
সুতরাং বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ আর মিলন সাহেবের ইংরেজি ভাষায় লিখিত বাংলা ব্যকরণ যোগাড় করে লেগে গেলাম সেই ভাষার চর্চায় যে-ভাষা আজ আমার মাতৃভাষার চেয়ে অনেক বেশি প্রিয়।’
তবে গীতাঞ্জলির পাঠের আগ্রহ থেকে বাংলা ভাষা চর্চায় মনোনিবেশ করলেও, এই ভাষাটি শিখতে তিনি যেমন লম্বা সময় ব্যয় করেছেন, তেমনি নিরবচ্ছিন্নভাবেও শুরুতে বাংলা ভাষা চর্চায় মনোযোগ দিতে পারেননি। যা উঠে এসেছে তার ‘পথের শেষ কোথায়’ বইয়ে ‘ভাষা শেখার তিন পর্ব এবং প্রসঙ্গত’ প্রবন্ধে। এই প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’-এ আমি লিখেছিলাম যে প্রথমে উর্দুতে এবং পরে ইংরেজিতে ‘গীতাঞ্জলি’ পড়ে মুগ্ধ হয়ে মূল বাঙলা ভাষার ‘গীতাঞ্জলি’ পড়বার দুর্দম আগ্রহই আমাকে বাঙলা শিখতে বাধ্য করে। কথাটা আংশিক সত্য।
মাস ছয়েক খুব অল্প পরিশ্রমের ফলেই আমি গীতাঞ্জলির সরল বাঙলা বুঝতে সক্ষম হই; আর ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’ তো ছিলোই হাতের কাছে। বাঙলা ভাষা শিক্ষা আমার তখন বেশিদূর এগোয়নি নানা কারণে, বোধহয় সবচেয়ে জোরদার কারণ ছিলো উর্দু কবিতার প্রতি আমার নব-উদ্বদ্ধু উৎসাহ।’
এই একই গদ্যে তিনি যেমন নিজের বাংলা ভাষা শেখার আরও দুটি পর্বের কথা উল্লেখ করেছেন তেমনি রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রতি ক্রমশ মুগ্ধ হয়ে ওঠার কথাও বর্ণনা করে বলেন, ‘আমি রবীন্দ্র-প্রেমিক তেরো বছর বয়স থেকেই-উর্দু অনুবাদে তাঁর গীতাঞ্জলি পড়ে। এ-প্রেম আরও অনেক গভীর হলো যখন ১৯৩৭ সালে একটি ভালো গ্রামোফোন কেনার সঙ্গতি হলো আমার, এবং তার সঙ্গে অনেকগুলি রবীন্দ্রনাথের গানের রেকর্ড-কনক দাস, অমিতা সেন, রাজশ্বেরী বাসুদেব, কণিকা মুখোপাধ্যায়, ইত্যাদি।’
রবীন্দ্র সাহিত্য এবং গানের প্রতি এই মুগ্ধতা তাঁর কমেনি কখনো। বরং বেড়েছে। সেই সরল স্বীকারোক্তিও একই গদ্যে। আবু সয়ীদ আইয়ুব বলেন, ‘পূরবী আমায় মুগ্ধ করেছিলো। কিন্তু এখন ঐ-কবিতাগুলি আমার মনে আর কতোটা উচ্ছ্বাস জাগায় না। কয়েক বছর পরে প্রায় একই সঙ্গে প্রকাশিত হলো ‘পরিশেষ’ এবং ‘পুনশ্চ’। পড়ে আমি অভিভূত হলাম। এ-অভিভব টিঁকে রইলো, ‘শেষ লেখা’ পর্যন্ত; টিঁকে আছে আজ পর্যন্ত’।
আত্মমগ্ন এবং সৃষ্টিমুখর আবু সয়ীদ আইয়ুব বাংলায় লেখালেখি শুরু করেন তিরিশের দশকে। এ সময়ে তার সঙ্গে অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে ‘পরিচয়’ গোষ্ঠীর সঙ্গে। প্রথম লেখা প্রকাশ পায় ১৯৩৪ সালে ত্রৈমাসিক ‘পরিচয়’ পত্রিকায়। ‘বুদ্ধিবিভ্রাট ও অপরোক্ষানুভূতি’ শিরোনামের প্রবন্ধটি পরবর্তীতে ‘পথের শেষ কোথায়’ বইয়ে স্থান পায়। পরিচয়-এ প্রবন্ধটি প্রকাশের পর তার গদ্যভাষারীতি এবং যুক্তি সুধীমহলে প্রশংসিত হয়।
সম্পাদক সুধীন্দ্রনাথ দত্তও তাঁকে নতুন প্রবন্ধ লিখতে উৎসাহিত করেন। ‘সুন্দর ও বাস্তব’ শিরোনামের দ্বিতীয় প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে তার রবীন্দ্রচর্চার সূত্রপাত। যা আবু সয়ীদ আইয়ুব নিজেই বলেছেন। তার প্রকাশিত বইয়ের তালিকা দীর্ঘ না। কিন্তু যে সামান্য কয়েকটি বই তিনি বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে রেখে গেছেন, সাহিত্যের বিচারে তো বটেই, যুক্তি ও দর্শনে এবং বাংলা সমালোচনা সাহিত্যেও অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ তার প্রথম প্রকাশিত বই।
বইটি প্রকাশের পরই সাড়া ফেলে। রবীন্দ্রসাহিত্য প্রসঙ্গে প্রচলিত আলোচনার যে ধরন ও রূপ তা রীতিমতো পাল্টে যায়। নেতির প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অবস্থানকে নতুন করে এই বইয়ে তিনি দেখিয়ে দেন। আবু সয়ীদ আইয়ুবের পরের বই ‘পান্থজনের সখা’। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত এই বইটিও পূর্ববর্তী বইয়ের সম্পূরক হিসেবেই চিহ্নিত।
এরপর প্রকাশ পায়, ‘পথের শেষ কোথায়’, ‘পোয়েট্রি এন্ড ট্রুথ’, ‘ভ্যারাইটিজ অব এক্সপিরিয়েন্স’, ‘ব্যক্তিগত ও নৈর্ব্যক্তিক’। অনুবাদ বইয়ের মধ্যে রয়েছে, ‘গালিবের গজল থেকে’, ‘টেগোর্স কোয়েস্ট’। সম্পাদনা করেছেন, ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ (হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সহযোগে), ‘পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা’ এবং 10 years of Quest অম্লান দত্ত সহযোগে।
তবে আবু সয়ীদ আইয়ুবের লেখা এবং চিন্তার বড় এবং প্রধান অংশ জুড়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আইয়ুব তার ‘ব্যক্তিগত ও নৈর্ব্যক্তিক’ বইয়ে ‘শান্তি কোথায় মোর তরে’ গদ্যটিতে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে আমি বিশদভাবে বলতে আরম্ভ করি ১৯৬৮ সালে, শেষ করি ১৯৭৭ সালে।
এই তেরো বৎসরের মধ্যে আমার মন এবং মতবিশ্বাস কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে, আশা করি সমৃদ্ধ হয়েছে, আশঙ্কা করি হয়তো-বা বিভ্রান্ত হয়েছে। তার ফলে কিংবা নিছক অনবধানতাবশত কোনো-কোনো টার্ম-এর ব্যবহারে হেরফের ঘটেছে।’ অন্যান্য রবীন্দ্র আলোচকের সঙ্গে আবু সয়ীদ আইয়ুবের চিন্তার প্রধান পার্থক্য, আবু সয়ীদ আইয়ুব তার কলম ধরেছিলেন রবীন্দ্র বিরোধীদের সমালোচনার উত্তর দেবার প্রয়োজন থেকে।
সেই সঙ্গে তিনি তার প্রবন্ধে দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের অমঙ্গলবোধের ক্রমবিকাশ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমার রবীন্দ্র-আলোচনার একটি হচ্ছে ট্রাজিক চেতনা’। অন্য একটি গদ্যে তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্র-কাব্যে আমি অমঙ্গলবোধের ক্রমবিকাশ দেখাবার চেষ্টা করেছি, তাঁকে আধুনিক সাব্যস্ত করবার জন্যে নয়। কবি রূপে তিনি কেমন করে আমার চোখে মহৎ থেকে মহত্তর হয়ে উঠেছেন সে কথাটা, সেই আনন্দটা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নেয়ার জন্যে।”
রবীন্দ্র কাব্যের প্রতি মাত্র তেরো বছর বয়সে যে মুগ্ধতা তৈরি হয়েছিল, তার কখনো পরিবর্তন হয়নি। মুগ্ধতা ছড়িয়েছে পরবর্তীতে রবীন্দ্রসঙ্গীতে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক আবু সয়ীদ আইয়ুব তার জীবনের বড় অংশ কাটিয়েছেন রবীন্দ্ররচনা অধ্যয়ন ও তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে। রবীন্দ্রকার্য দিয়ে রবীন্দ্রসাহিত্য ব্যাখ্যা শুরু করা আবু সয়ীদ আইয়ুব ‘শান্তি কোথায় মোর তরে’ প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথের গান প্রসঙ্গে বলার মধ্য দিয়ে ইতি টেনেছেন।
যেখানে বলছেন, ‘রবীন্দ্রকাব্য যখন কিঞ্চিৎ নিষ্প্রভ হয়ে যাবে শতবর্ষ পরে, তখনো রবীন্দ্রসংগীত সমানে জ্যোতিষ্মান থাকবে। কারণ আগেই বলেছি, একই ব্যক্তির মধ্যে মহৎ কবি এবং মহৎ সুরকারের এমন বিস্ময়কর যুগ্মতা এক শতাব্দীর মধ্যে কেন অর্ধ-সহস্রাব্দীর মধ্যেও একাধিকবার ঘটবে বলে তো মনে হয় না; কোথাও ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।’
আধুনিক মেজাজ এবং মৌলিক চিন্তার অধিকারী আবু সয়ীদ আইয়ুব, তার প্রবন্ধের মাধ্যমে চিন্তার নতুন দুয়ার খুলেছেন। দেখিয়েছেন, বাংলা ভাষায় সাহিত্য সমালোচনার নতুন উৎসমুখ। রবীন্দ্রপ্রেমিক আবু সয়ীদ আইয়ুব, যাকে শিবনারায়ণ রায় অভিহিত করেছিলেন ‘সৌম্য প্রমিথিউস’ বলে। এই অভিধা, প্রয়োগের বিষয়ে শিবনারায়ণ রায় ‘দেশ’ পত্রিকার ১৩৮৯-এর ১ মাঘ সংখ্যায় প্রকাশিত গদ্যে বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ বিগত হবার পরেও যে অল্প কয়েকজন মনীষীর সান্নিধ্য বাংলার রেনেসাঁসকে আমার চেতনায় প্রত্যক্ষ করে তুলেছিল আবু সয়ীদ আইয়ুব তাদের একজন।
তার দেহের কান্তি এবং আচরণের শালীনতা, তার অনাক্রম্য যুক্তিনিষ্ঠা এবং অনুভবের সৌকুমার্য, তার জিজ্ঞাসার ব্যাপ্তি এবং সরস বৈদগ্ধ্য তার নৈতিক দার্ঢ্য এবং সুবেদী রূপবোধ, তার বিশ্বনাগরিকতা এবং ঐতিহ্যচেতনা- সব মিলিয়ে তার অসামান্য ব্যক্তিত্ব আমাকে নিয়ত ভরসা যোগাত যে বাংলার রেনেসাঁস কোনো কেতাবী বিতণ্ডার বিষয় অথবা বিগত সমৃদ্ধির স্মৃতিমাত্র নয়, আমার সমকালেও তা জীবন্ত, জাগ্রত ও ফলপ্রসূ।’ আবু সয়ীদ আইয়ুব বিশ্বাস করতেন, ‘পণ্ডিৎদের প্রথম এবং প্রধান লয়াল্টি সত্যের প্রতি। দ্বিতীয় লয়াল্টি জনগণের প্রতি।’ এক্ষেত্রে দুটোতে বিরোধ বাধলে তিনি অসংকোচে প্রথমটাই গ্রহণের পক্ষে। অন্নদাশঙ্কর রায়কে লেখা
এক চিঠিতে প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে তিনি আরও লিখেছিলেন, ‘এই পথ সক্রেটিস থেকে আরম্ভ করে বহু নমস্য ব্যক্তি দেখিয়ে গেছেন। এটাই পথ। আমরা যেন সত্যকে ছেড়ে জনগণের কাছে মাথা না নোয়াই। তারা যদি আমাদের কথা না শোনে তবে নাই শুনল। তবু যা সত্য, যা উচিত, তাই বলতে হবে; যা প্রিয়, যা সুগ্রাহ্য, তা নয়।’ সমকালীন তো বটেই, উত্তরকালেও স্বতন্ত্র চিন্তার ধারক হিসেবে চিহ্নিত হতে থাকবেন আবু সয়ীদ আইয়ুব।