Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

হারানো পেশার মানুষ

Icon

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৫:০৩

হারানো পেশার মানুষ

ছবি: সংগৃহীত

ব্যক্তির নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ-পরবর্তী জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য চাকরি বা অন্য কোনো বৃত্তিবিশেষই হলো তার পেশা। এর মাধ্যমে তিনি অর্থ উপার্জন করেন বা জীবিকা নির্বাহ করেন। বহমানতাকে আঁকড়ে ধরেই আমাদের জীবনযাপন। জীবন বা সময় দুটোই একে অপরকে পরিপূরণ করতে করতেই এগোয়, এগোতে থাকি ক্রমশ আমরাও। আমাদের কাছে কোনোটিই খুব প্রত্যাশিত নয়, বরং হঠাৎ বাঁকে পড়ে অন্যদিকে ঘুরে যায় যে গতিমুখ, সেই বদলের সঙ্গে মানিয়ে চলতে চলতে এগোনো, এভাবেই নিরন্তর প্রবাহ।

কালের যাত্রায় পাল্টায় অনেক কিছু। পরিচিত পথ অপরিচিত হয়ে যায়, কালের যাত্রার সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয় পেশাও। পেশা বদলায় সময়ের টানে, নতুন পেশা আসে, জীবিকায় গতি নামে কিংবা অন্ধকার। এটা মেনে নেওয়াই প্রগতিশীলতা। আমাদের ঢাকা শহর ৪০০ বছরের পুরনো। এক সময় এখানে ভারত থেকে নবাব-বাবুরা এলে ওই অঞ্চলের বিভিন্ন পেশাজীবীও তাদের সঙ্গে চলে আসেন। ফলে একটা সময় কলকাতার বহু পেশা ও বৃত্তি এখানে দেখা গেছে, যেগুলো কালের আবর্তে আবার হারিয়েও যায়। তবু তাদের স্বাক্ষর রয়ে গেছে।

ভিস্তিওয়ালা

ভিস্তি কথাটি এসেছে পার্সি শব্দ ‘ভেস্ত’ বা ‘বেহেস্ত’ শব্দ থেকে, যার অর্থ হচ্ছে স্বর্গ। কারবালার প্রান্তরে যুদ্ধের মাঝে জল বহন করে নিয়ে যাওয়ার সময় হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর দৌহিত্র হোসেন (রা.) তীরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে স্বর্গলাভ করেন, সেই থেকেই এই নাম এসেছে বলে মনে করা হয়। এক সময় শহরের রাস্তায় রাস্তায় দেখা যেত চামড়ার ব্যাগের মধ্যে করে জল বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ভিস্তিওয়ালারা। এই ভিস্তিওয়ালাদের দেখা মিলত কলকাতা থেকে উত্তর ভারতের প্রায় সর্বত্রই দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, গুজরাটের বড় বড় শহরে। ব্যাগগুলো তৈরি হয় মূলত ছাগলের চামড়া দিয়ে। ব্যাগগুলোকে বলা হয় মশক বা ভিস্তি। এরা মিউনিসিপ্যালিটির হয়ে জল বিতরণ করতেন। আবার ঘরে ঘরেও জল সরবরাহ করতেন। ভিস্তিরা তাদের কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, কর্মদক্ষতার কারণে সমাজে রীতিমতো সমাদর পেতেন। তারপরে দিন বয়ে যেতে যেতে আসে টাইমকল, জলের লাইন, ট্যাপ, টিউবওয়েল, জলের গাড়ি। এখন দোকানেও মেলে পানির বোতল। তাই ভিস্তিওয়ালাদের শেষ গন্তব্য অন্য পেশায় মিললেও, এই পেশা এখন ইতিহাস।

বাত্তিওয়ালা

ঊনিশ শতকের শেষের কথা। সন্ধ্যা হলেই ঢাকা ডুবে যেত নিকষ কালো অন্ধকারে। পরে ১৮৭০ সালে নবাব আব্দুল গণি নিজেই ঢাকায় একটি গ্যাস লাইট ফ্যাক্টরি স্থাপন করেন। সিদ্ধান্ত হয়, ওয়াইজঘাটে তৎকালীন মিউনিসিপালিটি অফিস থেকে শুরু করে চকবাজার পর্যন্ত কেরোসিনের ১০০টি সড়কবাতি স্থাপন করা হবে। পরে এ প্রকল্পের আওতায় ৬০টি কেরোসিন ল্যাম্পপোস্ট বসানো হয়। এই কেরোসিন বাতি জ্বালানো-নেভানোর জন্য ঊনিশ শতকে বাতিওয়ালা নামে এক নতুন পেশাজীবী সম্প্রদায়ের বিকাশ ঘটে। সন্ধ্যা নামলেই বড় বড় মই হাতে এই বাতিওয়ালাদের দেখা মিলত। বিদ্যুৎ এলেও ঢাকা শহরে কিন্তু দীর্ঘদিন পর্যন্ত কেরোসিন বাতির প্রচলন ছিল। ষাটের দশকেও ঢাকার কয়েকটি গলিতে কেরোসিন বাতির নিয়মিত ব্যবহার দেখা যেত। ১৯৩৫ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকার রাস্তায় ৮৬৯টি কেরোসিন বাতি ও ১ হাজার ৬৬টি বৈদ্যুতিক সড়কবাতি ছিল।

প্রতিদিন বাতি জ্বালিয়ে যাওয়া মানুষদের নিয়ে কবি শামসুর রাহমানেরও স্মৃতিচারণ রয়েছে। সামান্য জোর হাওয়া কিংবা বৃষ্টিতে সে বাতির আয়ু ফুরিয়ে নেমে আসত ঘোর অমানিশা। বিত্তবানদের ঘরে ঝাড়বাতির চল ছিল। আর বাকি সবাই নির্ভরশীল ছিল হারিকেন, কুপিবাতি আর মোমের আলোয়। বাতিওয়ালাদের নিয়ে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটি কবিতাও আছে।

‘আমি যেন সেই বাতিওয়ালা-

যে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে

অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য

নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার।’

১৮৮৬ সালে ব্রিটিশ সরকার নবাব আবদুল গণিকে কেসিএসআই উপাধিতে ভূষিত করে। পুত্র নবাব আহসানউল্লাহ পিতার এই প্রাপ্তিকে স্মরণীয় রাখার জন্য ঢাকার রাস্তায় গ্যাস বাতির ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দেন। নবাবের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, সড়কে তেলের বাতি বদলের উদ্যোগ নেওয়া হয়; কিন্তু নানা কারণে বিলম্বিত হতে থাকে গ্যাস বাতি স্থাপনের কাজ। ঢাকায় বিংশ শতাব্দীতে বৈদ্যুতিক সড়ক বাতি চালু হলেও পূর্ববঙ্গে প্রথম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী ছিলেন গাজীপুর জেলার ভাওয়াল পরগনার রাজা। শোনা যায়, ঊনিশ শতকেই তিনি বিলাত থেকে জেনারেটর আমদানি করে রাজবাড়ি আলোকিত করেছিলেন। 

শামসুর রাহমান লিখেছিলেন-

তোমার পাড়ায় আজ বড় অন্ধকার। সম্ভবত 

বাতিটা জ্বালাতে ভুলে গেছ, আমি অভ্যাসবশত

কেবলি আলোর কথা বলে ফেলি। মস্ত উজবুক

এ লোকটা-বলে দাও দ্বিধাহীন...নবাব আহসানউল্লাহ বারো বছর পর সড়কবাতি স্থাপনের ব্যবস্থা করে ফেললেন। তিনি তখন গ্যাস বাতির পরিবর্তে বিলাতি বিদ্যুৎ বাতির পেছনে খরচ করলেন লাখ লাখ টাকা।

মিনেট ক্যামেরাম্যান

বিশাল আকৃতির এই ক্যামেরা কালো কাপড়ে ঢেকে ছবি তুলে এক মিনিটের ভেতরে ডেলিভারি দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এই ক্যামেরায় কোনো ফিল্ম বা রিল ব্যবহার করা হতো না। আলোর তাপমাত্রায় অ্যাপারেচার মেপে ছবি তোলা হতো। ক্যামেরা সেট করা কাগজে ছবির ছাপ পড়তো। তারপর তা হাইপোর জলে ধুলেই ছবি হয়ে যেত। এক মিনিটে ছবি হতো বলেই এর নাম ছিল মিনেট ক্যামেরা। আসলে অফিস আদালতে জরুরি ছবির জন্য এর বিকল্প ছিল না। এত চেনা জানা শহর ছিল না তখনো। তাই অফিস-আদালতের কাজ ছাড়াও অনেকের কাছে ছবি তোলা ব্যাপারটাও বিস্ময়ের ছিল। গ্রাম থেকে শহরে আসা এসব সহজ-সরল মানুষের উপভোগ্য ছিল মিনেট ক্যামেরা। মিনেট ক্যামেরাম্যানরা ঢাকারই নাগরিক ছিলেন। ধীরে ধীরে স্টুডিও শিল্পের বিকাশের মধ্যদিয়ে আসে রিল ক্যামেরা। তাও একদিন অচল হয়ে যায়। আসে ডিজিটাল ক্যামেরা। তারপর অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলের যুগ। এখন মিনেট ক্যামেরা এক উজ্জ্বল ইতিহাস। সেই মানুষগুলো নিশ্চয়ই অন্য পেশার সঙ্গে মিলে-মিশে একাকার হয়ে গেছেন।

বিদরি সাজ

বিদরি শব্দের মানে হচ্ছে কোন ধাতব বস্তুর সাহায্যে অন্য একটি ধাতব বস্তুতে সূক্ষ্মভাবে কাজ করা। ধাতুর ওপরে এ ধরনের সূক্ষ্ম কাজকে বলা হতো বিদরির কাজ। বিশেষত বিয়ের কলসী বা কোনো ধাতব উপহারের গায়ে এ ধরনের সূক্ষ্মকাজ করা হতো। সোনা-রুপার গহনা ছাড়াও হুঁকাদানি, খাটের পায়া, পানদান চিলমচি, কড়াই- এসবের ওপর সুন্দর বিদরির কাজ হতো। এসব খোদাই কাজ এখনো নবাবীকাল বা তার আগের সময়কে মনে করিয়ে দেয়। অনেকে ভালো কলমের গায়েও নাম লিখিয়ে নিতেন এই বিদরিদের দ্বারা। কোম্পানি আমলে ঢাকায় এই পেশার বেশ কদর ছিল। জেমস ওয়াইজের বর্ণনায় (অনু : পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জাতি, বর্ণ ও পেশার বিবরণ, অনুবাদ : ফওজুল করিম, ২০১৪) বিদরির কাজের বিশদ বর্ণনা আছে। তখনকার ঢাকায় শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরাই এই পেশায় নিয়োজিত হতো এবং যতটা জানা যায়, এটা ছিল বংশপরম্পরায় চালু থাকা কাজ। জেমস ওয়াইজের বর্ণনানুযায়ী, খোদাইয়ের খ্যাতি ছিল ঢাকাই বিদরিদের। ধাতব সব সৌখিন বস্তুর ব্যবহার কমে এলে এইসব পেশারও গুরুত্ব কমতে থাকে ধীরে ধীরে। তারপর এক সময় হারিয়ে যায়।

বাজনদার বা বাজুনিয়া

সম্প্রদায়ের নাম ছিল নাগার্সি। গ্রামে-গঞ্জে এখনো এ পেশার লোক রয়েছেন, তবে সংখ্যায় খুবই কম। সাধারণত ঢাকায় যারা লেপ-তোশকের ব্যবসা করেন তারাই নাগার্সি। গান-বাজনার পেশায় নিয়োজিত এইসব পেশাজীবীরা ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত। ওই সময় তাদের ছাড়া কোনো উৎসব-আনন্দই হতো না। তবে এদের সামাজিক মর্যাদা কম ছিল। এরা মুসলমান হলেও নিজেদের পেশার বাইরের মুসলমানরা তাদের সঙ্গে খেত না, আত্মীয়তাও করতো না। বাজুনিয়াদের সাধারণ বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ছিল সানাই, তবলা, ঝনঝনা, মঞ্জুরি, করতাল, নাকাড়া প্রভৃতি। বলা যায়, এরা ছিল সংগীতজ্ঞ সম্প্রদায়। এদের দলে বাইজিরাও অন্তর্ভুক্ত হয়ে গান করত। জেমস ওয়াইজ এদের মুসলিম সম্প্রদায়ের বলে বর্ণনা করলেও (সূত্র : প্রাগুক্ত, পৃ. ৭১, ৭২) সার্বিকভাবে সমাজে এদের সম্মান ছিল না। ক্রমশ দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার কমে আসে। মাইক চলে আসার পর এদের অবস্থা আরও দুর্বল হয়ে যায়। তবে বাজনদাররা এখনো আছেন, যদিও সংখ্যায় খুব কম। এরা এখন অনেকেই নিজেদের পরিচয় দিতে চান না। উৎসবের ধরন বদলেছে, সাউন্ডসিস্টেম নাগরিক জীবনের অনেক উপাচারকে এখন পিছু ঠেলে দিয়েছে। তেমনভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে পুরনো ঢাকার বাজনদার সম্প্রদায়।

বহুরূপীয়া

বহুরূপী কলকাতায় এখনো হরহামেশাই দেখা যায়। হঠাৎ করে দেখা যায়, দুর্গা বা শিব সেজে কেউ এসে হাত পেতে দিচ্ছে। প্রাথমিকভাবে সবাই ভয় পেলেও কিছুই করার থাকে না। সবাই বহুরূপীকে টাকা দিয়ে হেঁটে যায়। বাংলাদেশের বাস্তবতায় আজকের দিনে এই ধরনের বহুরূপী চরিত্রের কথা কেউ চিন্তাও করতে পারবেন না। এখন বহুরূপীদের জায়গাটা ভিন্নভাবে নিয়েছে বাংলার হিজড়ে সমাজ। আজ অনেকে শুনলে অবাক হবেন যে ঢাকার পথে-ঘাটে এককালে ভাঁড় বা সঙ সেজে এবং নকল দাড়ি-গোঁফ লাগিয়ে মানুষকে আনন্দ দেওয়ার কাজকে পেশা হিসেবে নিয়েছিল কিছু লোক। এই পেশা মোগল যুগেও প্রচলিত থাকার কথা অনুমান করা চলে, যেহেতু কোম্পানি আমলের প্রথম ভাগেও এই পেশার সন্ধান মেলে। বহুরূপীরা শিব-পার্বতী সেজে, নেচে-গেয়ে, গলার স্বর পরিবর্তন করে মানুষকে আনন্দ দিত। তবে শিব-পার্বতী সাজার বিষয়টি এখনো পুরনো নয়। বিশেষত চৈত্রসংক্রান্তির চড়ক মেলায় যে অষ্টক গানের দল দেশের গ্রামে গঞ্জে টাকা তুলতে ঘুরে বেড়ায়। গান গেয়ে টাকা আদায় করে। তবে এটা একটা সাংস্কৃতিক আয়োজন; কিন্তু মোগল থেকে কোম্পানি যুগ পর্যন্ত স্বাধীনভাবে এ পেশা গড়ে উঠেছিল। আজ এটা একটা ইতিহাস।

শাঁখারী

শাঁখারী পেশাটি ঢাকার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে। ঢাকার একটি পুরনো পেশাজীবী শ্রেণি শাঁখারীরা। শাঁখারীবাজার নামটি এই পেশা থেকেই এসেছে। যেমন এসেছে শাঁখের করাতও। শংখ থেকে কেটে শাঁখা বানানো হয়। শংখ কাটার ওই করাত দু’পাশেই সমান কাটে বলে ‘শাঁখের করাত’ নাম হয়েছে। শাঁখারীরা ঢাকা থেকে বিলুপ্ত হয়েছে এমন বলা যাবে না। তবে এ পেশায় খুব কম লোকই টিকে আছে। ভারত থেকে যে শাঁখা আসে তার দাম হাতে বানানো শাঁখার চেয়ে কম। তাই ঢাকার শাঁখারীরা নামেমাত্র টিকে আছে। শাঁখার ব্যবসা থাকলেও এদের খবর আর রাখে না কেউ। জেমস ওয়াইজের বর্ণনা অনুযায়ী, বানানো শাঁখার কারণে ঢাকার শাঁখারীদের খুব নামডাক ছিল এবং ৮৫৩ জন শাঁখারীর বাস ছিল ঢাকায়। সেই রামও নেই, অযোধ্যাও নেই। এভাবেই টিকে আছেন শাঁখারীরা।

গন্ধবণিক

বণিক হিন্দুদের একটি পেশাজীবী সম্প্রদায়, ব্যবসা-বাণিজ্য যাদের প্রধান বৃত্তি। চতুর্র্বর্ণের মধ্যে বৈশ্যবর্ণের উল্লেখ থাকলেও প্রাচীন শাস্ত্রে বর্ণ বা উপবর্ণ হিসেবে বণিক সম্প্রদায়ের তেমন উল্লেখ নেই। মনুসংহিতায় বৈশ্যদের পেশা হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ও পশুপালনের কথা বলা হয়েছে; সম্ভবত পরবর্তীকালে এদের থেকেই উপবর্ণ হিসেবে বণিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছে। প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে একদল মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত ছিল। তারা বিশ্বের নানা স্থানে বাণিজ্য করত; মশলাদি দ্রব্য আমদানি-রফতানি করত। বারো-তেরো শতকে রচিত বৃহদ্ধর্মপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে সুবর্ণবণিক (সোনা ব্যবসায়ী), মোদক (ময়রা), তাম্বুলী (পান ব্যবসায়ী), তৌলিক ও গন্ধবণিকের উল্লেখ পাওয়া যায়। এসব শ্রেণির মানুষ ব্যবসায়ী ছিল বটে, কিন্তু সকলে বণিকের মর্যাদা পায়নি। বর্তমানে বাংলাদেশে হিন্দু সমাজে গন্ধবণিক, সুবর্ণবণিক, সাহা, কুণ্ডু, কর্মকার, মোদক প্রভৃতি অনেক শ্রেণির ব্যবসায়ী রয়েছে। এদের মধ্যে সাহা ও কুণ্ডু শ্রেণি ব্যবসাক্ষেত্রে অগ্রসর এবং ধনবান। বিভিন্ন ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ‘সাহা’ পদবি ব্যবহার করে। কুণ্ডুদের সম্পর্কে সবিশেষ জানা না গেলেও মনে করা হয় যে, তারা তিলি সম্প্রদায়ের উত্তরপুরুষ। এখনো তিলি সম্প্রদায় একটি অনুন্নত শ্রেণি হিসেবে হিন্দু সমাজে বিদ্যমান আছে। এরা ছিল মসলা বিক্রেতা। ঊনবিংশ শতকে কলকাতা অথবা মসলা উৎপাদনের স্থান থেকে সরাসরি মসলা আমদানি করে বিক্রি করা ছাড়াও হিন্দু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় চন্দন কাঠ ও মসলা এরা বিক্রি করত। কিছু রাসায়নিক দ্রব্য, ওষুধ, এমনকি আফিম, ভাং, চরস প্রভৃতি নেশাদ্রব্যও তারা বিক্রি করত। এসব বর্ণনা দিয়ে জেমস ওয়াইজ লিখেছেন যে তার সময়ে ঢাকা শহরে দেড় থেকে দুইশ’ গন্ধবণিক পরিবার এবং প্রায় এক হাজার গন্ধবণিক ছিল। জনশ্রুতি অনুযায়ী, লোককাহিনীর চাঁদ সওদাগরও ছিলেন একজন গন্ধবণিক।

চনরিওয়ালা

সেই যুগে বৈদ্যুতিক পাখা ছিল না। তালের ডগা কেটে তৈরি হতো পাখা। পাখা ছোট-বড় সব মানুষই ব্যবহার করতেন; কিন্তু অর্থবিত্তশালীরা পাখাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে ব্যবহার শুরু করল। বনেদীদের পাখাকে যারা বর্ণাঢ্য রূপ দিতো তাদের বলা হতো চনরিওয়ালা। তারা তালের পাখাকেই বিশেষ ধরনের পাখায় রূপান্তর করতেন সঙ্গে চামরও প্রস্তুত করতেন। তখনকার ঢাকায় শিয়া মতাদর্শীদের আধিক্য ছিল। তখনো নানাবিধ উপাচারে মহররমের তাজিয়া মিছিল হতো। মিছিলে অংশগ্রহণকারী মুসলমানদের হাতে পাখা বা চামর থাকত। সাজানোর ব্যাপারে পাখা ও চামরের ব্যবহার ছিল অনবদ্য। আবার হিন্দুদের পূজায় প্রতিমাকে বাতাস করা বা গা থেকে মশা, মাছি তাড়ানোর কাজে নিয়োজিত থাকত পাখা ও চামড়। এসব উৎসব-আনন্দকে বর্নাঢ্য করতে চামর ও পাখার ব্যবহার ছিল। এখনো ভক্তি পর্যায়ের গানের আসরে পদকর্তার হাতে চামড় থাকেই। তবে এখন বৈঠকী গান, রামায়ন, রয়ানি, কীর্ত্তনের দিন ক্রমশ ফুরিয়ে যাওয়ায় চামরের দেখা মেলে না। পাখাও এখন গল্পে এসে ঠেকেছে। বিদ্যুৎ চলে গেছে গ্রামের গহীন তল্লাটেও। তাই চনরিওয়ালাদের বংশ পরিক্রমা খুঁজলে দেখা যাবে তারা অন্য কোনো পেশা খুঁজে নিয়েছেন। আধুনিকতার ইতিহাসটা এমনই।

বলদিয়া

ব্যবসা বাণিজ্য ছিল এদের পারিবারিক পেশা। ব্যাপারী নামেই ছিল এদের পরিচিতি। লাম্বরি, লাম্বাদি বা বানজারা নামেও এদের পরিচিতি ছিল। বানজারা ও লাম্বাদিরা ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। সেকালের নাজুক নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা বিবেচনা করে এরা দলেবলে চলাচল করত এবং এই দলে ভাঁড় বা সঙরাও থাকত। এরা বাড়ি বাড়ি বিক্রি-বাট্টা করতে সঙদের ব্যবহার করে পরিস্থিতি আনন্দমুখর করে ফেলতো। তারপরে চলতো বিক্রিবাট্টা। এক কথায় বলা যায় বনিক, তবে লোকজন ডাকত ব্যাপারী বলে। অনেকের ধারণা, ব্যবসা-বাণিজ্যে বলদের ব্যবহার ছিল বলেই হয়তো এদের নাম বলদিয়া হয়েছে। বলদে টানা গাড়িতে করে এরা দ্রব্যসামগ্রী বহন করে নিয়ে যেত। এরা ছিল ঢাকা শহরের ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী। খুবই পরিশ্রমী ছিল এই ব্যবসায়ীরা। একেকজনের বা এক একটি পরিবারের কয়েক জোড়া বলদ থাকত। জেমস ওয়াইজের বর্ণনা অনুযায়ী, সপ্তদশ শতক পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের ভেতরে এরাই ছিল ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী। পথঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ থাকায় বলদিয়ারা এ দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এমন ব্যবসায়ীদের মধ্যে মুসলমানরাই প্রধান ছিল এবং তারা বলদ ব্যবহার করত সব সময়। তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের এই পেশাজীবীরা ঘোড়াও ব্যবহার করত। ওয়াইজ সাহেব এসব বর্ণনা দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে ঢাকায় তখন ৪০টির মতো বলদিয়া পরিবার ছিল। 

নাচাবন্দ

তখন ধূমপান বলতে হুকোর ওপর নির্ভরতা বেশি ছিল। সাহেব সুবোরা পাইপ খেলেও হুকোই ছিল সাধারণের ধূমপানের ব্যবস্থা। হুকো খাওয়ার ক্ষেত্রে শ্রেণি বিন্যাস ছিল, ছিল সাম্প্রদায়িকতাও। যেমন গৃহস্তের বাড়ির কামলার হুকো আর মালিকের হুকো এক ছিল না। উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণের হুকোয় খেতো না। পিতলের নিচটা মানে নৈচা ও বড় নলের সাহায্যে বনেদীরা, জমিদাররা খেতেন। তবে সবই বানাতো নৈচাবন্দরা। হুঁকোর নল বানানোর পেশায় নিয়োজিতরা নৈচাবন্দ নামেই পরিচিত ছিলেন। যদিও জেমস ওয়াইজের কালে পূর্ববঙ্গের হুঁকোর নল সরবরাহের প্রধান জায়গা ছিল সিলেট; কিন্তু ঢাকায় তখন প্রায় ১০০ পরিবারের লোকের প্রধান কাজ ছিল হুঁকোর নল বানানো এবং এটি সম্মানজনক পেশা বলে গণ্য হতো। ‘ঢাকা পাচাস বারাস পাহলে’কে হাকিম হাবিবুর রহমান উল্লেখ করেছেন যে, এই পেশার কিছু লোক ঢাকা শহরের ভেতরে এবং বাকি অংশ নদী তীরবর্তী নৈচাবন্দটোলায় বাস করত।

কাহার

পালকিবাহকদের কাহার বলা হতো। কাহারদের চলার তালই ‘কাহারবা’ নামে। উহুম না-উহুম না- বলে এরা পালকি বয়ে চলতো। অত্যন্ত শ্রমসাধ্য এ পেশার মানুষদের সামাজিক মর্যাদা তেমন ছিল না। কাহাররা পালকি বাড়িতে নামিয়ে বিভিন্ন ধরনের গান গাইতো। এগুলো এক ধরনের বিয়ের গিত হিসেবে ধরা হয়। ঢাকায় ঢুলি ও কাহার নামের পালকিবাহকরা ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত ভালোভাবেই টিকে ছিল। এমনকি বিংশ শতকেও পালকির চল এ এলাকায় ছিল। প্রধানত হিন্দু তবে অংশত মুসলিম সম্প্রদায়ের কাহারদের সন্ধান মেলে ইতিহাসের পাতায়। পালকি এখন আর চোখে পড়ে না। দু’একটা কখনো দেখা গেলেও সেগুলো সাধারণ মজদুর শ্রেণির মানুষ বহন করে। কাহাররা এ পেশায় আর নেই। নবাবগঞ্জের বারোয়াখালী বাজারের পাশে কাহাররা থাকলেও এ পেশার কথা বললে তারা অসন্তুষ্ট হয়। তবে এলাকায় তারা কাহার, মানে নিম্নবর্গের মানুষ। 

শেষ কথা

সভ্যতা যেখানেই আলো ফেলেছে সেখান থেকেই ক্রমশ কিছু পেশা, কিছু বস্তু, কিছু সংস্কৃতি বাদ পড়েছে। সেসব বস্তুকে সেকেলে, আর সংস্কারকে কুসংস্কার বলেছে কেউ কেউ। দিন যত বদলাবে-প্রগতি ধারায় সমাজ ততই এগোবে। তখন সব বিষয় যে চলবে তা নয়। যুগের চাহিদাকে মানতেই হবে। এন্ড্রয়েড ফোন হাতে নিলে আমরা পেছনে যতদূর দেখি সব পড়ে আছে। সেই ট্রাঙ্কলের যুগ থেকে এনালগ ফোন, পরে ডিজিটাল ফোন। তারপর মুঠো ফোন, তাও কত রকম হয়ে এসেছে বর্তমান অবস্থায়। নতুনকে যেমন মেনে নিতে হয়, পুরনোকে আঁকড়ে না থাকলেও বর্জনের মধ্যে এমন কোনো কৃতিত্ব নেই। এখনো ভবনের ওপরে টালি বা খড়ের গাদার ঘর চোখে পড়ে। এটা বিচিত্র নয়। সব মিলে মিশে থাকাই আধুনিকতা। সেবিচার করে চলাটা জীবনযাপনের জন্য কষ্টের বা দুঃখের নয়। 


তথ্যসূত্র  

১. জেমস টেলর ‘A Sketch of the Topography and Statistics of Dacca 1840.’

২. জেমস ওয়াইজের ‘Notes on the Races, Castis and Trades of Eastern Bengal’

৩. এইচ এইচ রিজলের ‘The Tribes and Castes of Bengal’ (১৮৯১ খ্রি.), 

৪. ঢাকার বিস্মৃত পেশার মানুষ খন্দকার মাহমুদুল হাসান 

১১ আগস্ট, ২০১৪, দৈনিক কালের কণ্ঠ

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫