সন্ত্রাসবিরোধী ফুলেরা

‘শিল্পী’ শব্দটাই বিদ্রোহবাচক। ‘শিল্পী’ সেই বেঁকে যাওয়া লোক, যিনি সমাজের, রাষ্ট্রের ক্ষতকে চিহ্নিত করে, মানুষের প্রেম, আনন্দ, দ্রোহ, বিষাদ, বেদনার অনুভূতিকে উস্কে দেন। যুগে যুগে কবি লেখক, চিন্তকরা দাঁড়িয়েছেন রাষ্ট্রীয় শোষণের বিরুদ্ধে, সমাজের প্রচল ভাঙার বিরুদ্ধে, কুপ্রথা আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।

মানুষের গভীরতম অনুভব-উপলব্ধিকে শিল্পী ছাড়া কেইবা চিত্রায়িত করতে পেরেছে? ইরানের কবি ও ফিল্মমেকার বাখতাস আবতিন তেমন-ই একজন কবি। প্রেম আর দ্রোহের কাব্য দিয়ে ইরান সরকারের শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। মানুষের বাক-স্বাধীনতার পক্ষে লড়ে গেছেন। চলচ্চিত্রের সেন্সরশিপ আর বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন। লেখকের এই অবস্থানের প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রের করা মামলায় খাটতে হয়েছে জেল। বন্দি এবং নিঃসঙ্গ অবস্থায় মরতে হয়েছে আবতিনকে। তবুও কী দেশে দেশে সরকারের জুলুমের বিরুদ্ধে কবি, লেখকরা থেমে ছিলেন, বা থেমে থাকবেন?

এ বিষয়ে হালের কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে- ভারতের তেলেগু রাজ্যের কবি ও সমাজকর্মী ভারভারা রাওকে ৭৯ বছর বয়সে এসেও তিন বছর জেল খাটতে হয়েছে। তিনি ২০২১ সালের মার্চ মাসে পেয়েছেন শর্তাধীন জামিন। তার বিরুদ্ধে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হত্যার অভিযোগ আনা হয়। আরেকটি অভিযোগ দেওয়া হয় মাওবাদীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার। 

দেশে দেশে কবি, লেখক, গায়কদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের চিত্র অনেকটা এরকমই। মিয়ানমারের কবি ও সমাজকর্মী খেত থিরকে মিয়ানমারের জান্তা সরকার নির্মমভাবে হত্যা করে। কবি খেত থির মিয়ানমারের সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে কবিতার ভেতর দিয়ে প্রতিবাদের ঘোষণা দিয়েছিলেন। জান্তা সরকারের নিকট খেত থিরের এই অহিংস প্রতিবাদও সহ্য হয়নি। ২০২১ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় শহর শোয়াবা থেকে তিনজন কবিকে তুলে নেয় জান্তা সরকারের পুলিশ বাহিনী। একজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়, বাকি দু’জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে আসা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদের সময় খেত থিরকে এমনভাবে নির্যাতন করা হয়- যে তার বিশেষ অঙ্গ পর্যন্ত কেটে ফেলা হয়। এই অমানসিক নির্যাতনের ফলে খেত থির মারা যান। খেত থিরের আগেও মিয়ানমারের জান্তা সরকার দু’জন কবিকে হত্যা করে। জেল, জুলুম, হয়রানি এসব নিত্যকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কবি খেত থির লিখেছিলেন- ‘তারা মাথায় গুলি করে;/ কিন্তু তারা জানে না/ বিপ্লব থাকে হৃদয়ে। ’ কবিতায় তিনি আরও লেখেন- ‘আমি কোনো নায়ক হতে চাই না/ আমি শহীদ হতে চাই/ আমি ভীরু হতে চাই না/ চাই না বোকা হতে। ’

তুরস্কের ব্যান্ড দল গ্রুপ ইয়োরোমের কথা না বললেই নয়। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যারা বেছে নিয়েছিলেন সংগীতকে। তুরস্কের জনপ্রিয় ব্যান্ড দল গ্রুপ ইয়োরোমকে আজও তার জন্য ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। শোষকগোষ্ঠী তাদের অ্যালবামের সমস্ত কপি নষ্ট করে দেয়, ভেঙে ফেলে তাদের সমস্ত বাদ্যযন্ত্র। অনুশীলন করার জায়গাটিও তছনছ করে দেওয়া হয়। এগুলো করেই শান্ত হয়নি শোষকের দল। তারা গ্রুপ ইয়োরোমের সদস্যদের দেশদ্রোহের অভিযোগ এনে নানান মামলা দায়ের করে। বারংবার তাদের গ্রেফতার করা হয়। জেল, জুলুম, নিপীড়ন যেন তাদের পিছু ছাড়ছিল না। এরই প্রতিবাদে গ্রুপ ইয়োরোমের সদস্য ইব্রাহীম গোকচেকে ও হেলিন বোলেক কারাবন্দি অবস্থাতেই অনশন শুরু করেন। হেলিন বোলেক ২৮৮ দিন অনশন করার পর ২০২০ সালের ৩ এপ্রিল মারা যান। মৃত্যুর পরেও প্রশাসন তার শেষ কৃত্যেও বাধা দিয়েছে। শববাহী গাড়িচালকসহ শেষকৃত্যে উপস্থিত অনেককে আটক করেছে। এমনকি হেলিন বোলেকের লাশকে শেষ গোসল পর্যন্ত করতে দেওয়া হয়নি। 

বাংলাদেশের চিত্র কী-এর চেয়েও ভিন্ন? একদম তা নয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২০২০ সালের ৬ মে গ্রেফতার হন কার্টুনিস্ট কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদ। মুশতাক আহমেদের অপরাধ ছিল কার্টুনিস্ট কিশোরের কার্টুন শেয়ার করাসহ করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে অব্যবস্থাপনা নিয়ে লেখালেখি করা। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগ এনে ২০২০ সালের ৫ মে মুশতাক আহমেদসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ৬ মে মুশতাক আহমেদকে গ্রেফতার করা হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে মুশতাক আহমেদের মৃত্যু হয়। মুশতাক আহমেদ আগে থেকেই হৃদরোগে ভুগছিলেন। তাকে সময় মতো হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। 

লেখক বাখতাস আবতিনের ঘটনাটা অনেকটাই মুশতাক আহমেদের মতোই। বাখতাস আবতিনের জন্ম ১৯৭৪ সালে ইরানের শহর ই-রেতে। খুব অল্প বয়সেই লেখালেখি শুরু করেন আবতিন। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতাও। লরিস চেকভারিয়ানকে নিয়ে তিনি নির্মাণ করেন ১৩ অক্টোবর ১৯৭৩। এ ছাড়াও আনসুর, দ্য স্লিপ পেনাট্রেশন, দি নেয়ার ড্রিম, পার্ক মার্ক, মরি ওয়ান্টস এ ওয়াইফ পরিচালনা করেন। বাখতাস আবতিনের তিনটি কবিতার বইও বের হয়েছে। ২০২১ সালে পেন অ্যাওয়ার্ড পান। 

ইরানের জাতীয় নিরাপত্তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগ এনে ২০১৯ সালের ১৫ মে ইরানের পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে এবং পাঁচ বছরের জন্য কারাদণ্ড দেয়। এর আগেও তিনি বেশ কয়েকবার বিরোধীদের দ্বারা মামলায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন। গ্রেফতার করে তাকে রাখা হয় ইরানের কুখ্যাত এভিন কারাগারে। 

ইরানের লেখক ও প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ আলি দস্তির সঙ্গেও ঘটেছিল এই ঘটনা। ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের পরপরই আশি বছর বয়সি লেখক ও রাজনীতিবিদ আলি দস্তিকে তার বই ‘বিশৎ সেহ্ সাল’ এবং তার প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার জন্য তার বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহের অভিযোগ আনা হয় এবং জেলে ভরা হয়। পুলিশ হেফাজতে তাকে এমনভাবে নির্যাতন করা হয় যে তার উরুর হাড় ভেঙে যায়। আলী দস্তি শেষের দিনগুলোতে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন ঠিকই তবে তেহরানের উত্তরে জারগান্ধের উপশহরে ছিলেন গৃহবন্দি। এবং সেখানেই তিনি মারা যান। 

ইরানের লেখক সংঘ ‘ইরানিয়ান রাইটার্স অ্যাসোশিয়েশন (আইডব্লিউএ)’ যা নিয়ে ছিল ফ্যাসিবাদী ইরান সরকারের মাথাব্যথা। আবতিন ছিলেন আই ডাব্লিউএ-এর সদস্য। নানা কারণে ইরানের ফ্যাসিবাদী সরকার ইরানের এই লেখক সমিতির সদস্যদের অহিংস প্রতিবাদকে ভয় পেতেন এবং এদের ওপর দমন পীড়ন চালাতেন। আবতিনের ওপর আনঅফিসিয়াল অভিযোগ ছিল লেখক সংঘের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। আবতিন আগে থেকেই হৃদরোগে ভুগছিলেন, এরপর ২০২১ সালের মার্চ মাসে করোনা আক্রান্ত হন এবং ২য় বারের মতো ডিসেম্বর মাসে আবারো করোনা আক্রান্ত হন; কিন্তু তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেও তখনি তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। ১৪ ডিসেম্বর পায়ে বেড়ি পরিয়ে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই ২০২২ সালের ৮ জানুয়ারি আবতিনের মৃত্যু হয়। আবতিনের মৃত্যু একটি পরিকল্পিত হত্যা বলেই আখ্যায়িত করেন বিশিষ্টজনরা। 

আবতিন, খেত থির, হেলিন বোলেক, মুশতাকরা মরে গেছে ঠিকই; কিন্তু সারা দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের জন্য তারা স্বপ্ন রেখে গেছে। রেখে গেছে কবিতা, গান, সিনেমা, চিত্র। শোষক, নিপীড়ক ও মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়া সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ফোঁটা তারা একগুচ্ছ লাল গোলাপ। মুক্তিমুখিন এইসব গোলাপদের জন্য অজস্র ভালোবাসা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh