বাংলা ভাষা-ভাষীদের শিশুসাহিত্য জগতের প্রধান পরিবার কোনটি যদি জানতে চাওয়া হয়, তবে নিঃসন্দেহে বলা যাবে কলকাতার রায় পরিবারের নাম। ১৯১৩ সালে এ পরিবারেরই কর্তা উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ছোটদের ‘সন্দেশ’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। আর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ বছরেই পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার। এই পরিবারেরই সন্তান লীলা মজুমদার।
যিনি ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’, ‘টংলিং’, ‘হলদে পাখির পালক’, ‘গুপীর গুপ্তখাতা’, ‘মাকু’র মতো বিখ্যাত সব শিশুতোষ রচনার সৃষ্টি করে অমর হয়ে রয়েছেন বাঙালির ছেলেবেলায়। সারা দুনিয়াজুড়ে যেমন রূপকথার সম্রাট হান্স ক্রিশ্চিয়ান আন্দেরসেন অমর এক স্রষ্টা, ঠিক তেমনি যেন বাঙালির জীবনে সুকুমারভগ্নী লীলা মজুমদারও শিশুসাহিত্যের অমর স্রষ্টা।
লীলা মজুমদার ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯০৮ সালে কলকাতার রায় পরিবারের গড়পাড় রোডের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা প্রমদারঞ্জন রায় ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ছোট ভাই। সেইসূত্রে লীলা হলেন বাংলায় ‘ননসেন্স ভার্স’-এর জনক সুকুমার রায়ের কাকাতো বোন এবং সত্যজিৎ রায়ের পিসি। যে বাঙালি সন্তান জীবনে সুকুমারের আবোল-তাবোল পড়েনি সে যেন ছেলেবেলা উপভোগ করেনি। ঠিক তেমনি লীলা মজুমদারও যার পড়া নেই তার ছেলেবেলায় ভয়, আনন্দ, বেড়াল, লুকোচুরি, ভুত এসবের কিচ্ছুটি জানবার নেই, বোঝারও নেই।
শিলঙের লরেটো কনভেন্টে পড়াশোনার মধ্য দিয়ে তিনি তার শিক্ষাজীবন শুরু করেন। এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ইংরেজি সাহিত্যে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া প্রথম বাঙালি হিসেবেও লীলা গৌরব অর্জন করেন তখনকার দিনে। লীলার জীবনের প্রথম এগারো বছর কেটেছে শিলংয়ে। ১২ বছর বয়সে ফিরে যান গড়পাড় রোডের রায় বাড়িতে। এ সময় দাদা সুকুমার রায় তাকে দিয়ে জীবনের প্রথম গল্প ‘লক্ষ্মীছেলে’ লিখিয়ে নিয়েছিলেন ‘সন্দেশ’ পত্রিকার জন্য। ‘সন্দেশ’ পত্রিকার মধ্যে দিয়ে লীলা মজুমদার তার জীবনের যতো নতুনত্ব খুঁজে পেয়েছিলেন। ছোটবেলায় লীলা বেশ দুষ্টু ছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘মার হাতে চড় কানমলা খাবার গৌরব আমার একার ছিল। লোক আমি ভাল ছিলাম না। আমার কথামতো না চললে দাদাকে পেটাতাম, দিদিকে পেটাতাম... দাদা উলটে মারত আর দিদি ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে কাঁদত।’
কে জানতো এই মায়ের হাতে কানমলা খাবার গৌরব অর্জন করা ছোট্ট লীলা শিশুদের মনে একদিন স্থায়ী আসন গেড়ে নেবেন অদ্ভুত অদ্ভুত সব গল্প-উপন্যাস লিখে। তার লেখা ‘বদ্যিনাথের বড়ি’ গল্পে আশ্চর্য এক বড়ির অলৌকিক ক্ষমতার কথা আজও আমরা ভুলিনি। কালুর বন্ধু বদ্যিনাথ কতকগুলো সাদা বড়ি এনে যখন বলে, ‘ওগুলো নাকি ছানা বাঁদরের রস দিয়ে তৈরি’, যেহেতু মানুষদের পূর্বপুরুষ বাঁদর ছিল এবং বাঁদরের রক্ত মানুষের রক্তে এখনও মিশে ‘আছেই আছে’, তাই সেই আশ্চর্য বড়ি খেলে তাদের আবার বাঁদর হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, ‘ওই একরকম ধাত কিনা’, অবিশ্বাস হয় না। অতএব রোজ পড়াতে আসা মাস্টারের হাত থেকে বাঁচতে এর প্রয়োগ কালুর কাছে বিশেষ জরুরি হয়ে পড়েছিল। সেই বড়ি দেওয়া পান খেয়ে অবশ্য মাস্টারের কিছু হয়েছিল কি না, কালু আর জানতে পারেনি। তিনি অন্য গ্রামের স্কুলে বদলি হয়ে গিয়েছিলেন; কিন্তু কালু রাতের অন্ধকারে পাঁচিল থেকে দুটো ল্যাজ ঝুলে থাকতে দেখত। এমন আশ্চর্য ভাবনা আর কার রচনায় মেলে?
আবার তিনি যখন কবি কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে ‘রংমশাল’ পত্রিকার জন্য কিশোর উপন্যাস ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’ লেখেন তা-ও হয়ে ওঠে আরো অনন্য। ১৯৭২ সালে ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’ খ্যাতনামা বাঙালি অভিনেত্রী ও পরিচালক অরুন্ধতী দেবী পরিচালিত বাংলা অ্যাডভেঞ্চার-কমেডি চলচ্চিত্র হিসেবে অনিন্দ্য চিত্রের ব্যানারে মুক্তিলাভ করে। সিনেমাটি এখনো দর্শকদের কাছে সমান জনপ্রিয়।
তিনি কর্মজীবন শুরু করেন বিশ্বভারতীতে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে। এরপর কিছুদিন আশুতোষ কলেজে পড়ানোর পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্বাধীনভাবে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। দীর্ঘ দুই দশক এভাবে কাটিয়ে আকাশবাণীতে যোগ দেন প্রযোজক হিসেবে। সাত-আট বছর কাজ করার পরে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফের শুরু করেন সাহিত্যচর্চা। এর পাশাপাশি তিনি ১৯৬৩ থেকে ১৯৯৪ সাল অবধি সত্যজিৎ রায়ের সন্দেশ পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। অমর এই কথাসাহিত্যিক ৯৮ বছর বয়সে ২০০৭ সালের ৫ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।
© 2022 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh