ডুবুডুবু সূর্যের মিষ্টি আগুনে লাল হয়ে গেছে পশ্চিমের আকাশ। পুবের ধানক্ষেত ও বাড়ির পিছনের গাছগাছালি কালচে সবুজ থেকে ক্ষণে ক্ষণে রং বদল করে হয়ে যাচ্ছে ক্ষয়াটে লাল, পীতাভ লাল-কালচে আর তার মাঝে জেগে উঠছে সন্ধ্যার গম্ভীর অন্ধকার। বারান্দায় বসে থাকা মা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। তার আত্মার মাঝে একটা মুখ-----লুকানো আছে। নির্জন, বিষণ্ন মুহূর্তগুলোতে হঠাৎ হঠাৎ সে উঁকি মারে।
মায়ের পাশের চেয়ারে মেয়েও বসে আছে। হালকা-পাতলা শরীর হলেও গায়ের রং, গড়ন, উচ্চতায় মেয়ে ঠিক মায়ের মতো। অচেনা কেউ দেখলে ভাববে, দুই বোন। একজন একটু নাদুসনুদুস, অন্যজন একহারা গড়নের চম্পাকলি। মেয়ে মোবাইল থেকে চোখ তোলে, উঠানে একঝাঁক চড়াই পাখি খুনসুটি করছে, জাম্বুরা গাছের ডালে বসে ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে ভাব করছে একজোড়া শালিক । শেষদৃশ্যে মেয়ে শিহরিত হয়। সে তার সহপাঠী ইমরানকে ভালোবাসে। মা একদিন প্রেমে ব্যর্থ হয়েছিলেন এখন তার মেয়ে ভালোবাসার সবক নিচ্ছে। তাই ব্যর্থ-ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস, যৌবনের গোপন উচ্ছ্বাস ও ঈর্ষার আগুন এই বাড়ির বাতাসে ভেসে বেড়ায়, ক্ষণে ক্ষণে জ্বলে উঠতে চায়।
দুই
টিনের চালে বসে একটা কাক কা কা করে ডাকে। সুন্দরী মায়ের টানাটানা চোখের পাপড়ি অমঙ্গল আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে। পুত্রটি অকালপক্ব, কন্যাটি শরীরসর্বস্ব, স্বামী পরবাসে, আতঙ্ক তার পায়ে পায়ে।
পেছনবাড়ির জঙ্গল থেকে ভেসে আসে শালিকের ঝগড়া। মা কান পেতে পাখিদের কলহ শোনেন। উঠানে সৌর বিদ্যুতের প্যানেলে বসে দুইটা চড়াই পাখি মাত্র দেড়-সেকেন্ডে সঙ্গম শেষ করে। এই দৃশ্য দেখে একাদশ শ্রেণিতে পড়–য়া মেয়ের টানাটানা চোখ উজ্জ্বল হয়।
আকাশ থেকে রাত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। গ্রামের ঘরে ঘরে আলো জ্বলে ওঠে। বারান্দা, বাড়ির উঠানে উঠানে বিদ্যুতের বাতি। তবু অনেক অন্ধকার থেকে যায়। গ্রিলের কাছে, বাউন্ডারির আড়ালে, কাঠাল গাছের জাফরিতে আর মেহেদি গাছে গুচ্ছ গুচ্ছ অন্ধকার চুপচাপ শুয়ে-বসে থাকে। পেছনবাড়ির জঙ্গল থেকে দক্ষিণের মাঠ, নদীপাড়, খাল-বিল, পাকা সড়ক সবখানে অন্ধকারের রাজত্ব একটু একটু করে কায়েম হচ্ছে। মেয়ের মোবাইল ফোনে একটা কল আসে, মাই সুইট ড্রিম..., লাভ লাভ লাভ মাই...।
মেয়ে মোবাইল হাতে নিজের রুমের দিকে চলে যায়। মায়ের চোখ দুটো দপ করে জ্বলে ওঠে। অতৃপ্ত হৃদয়ের বিধ্বস্ত সাধগুলো সাপের মতো কিলবিল করে। তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে গালি দেন, কুত্তি।
তিন
আটত্রিশ বছর কি একটা বয়স? মা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। স্বামী বছরের পর বছর প্রবাসে। ভরা নদী এই শরীর, পানাম নগরীর মতো ধ্বংসপ্রাপ্ত হৃদয়..., তিনি বিড়বিড় করেন, কাজল ভাই নাকি দেশে আইছে, আমারে ফোন দিল না?
কাজল তার চাচাতো ভাই। যৌবনে একে অন্যের প্রাণভোমরা ছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি তাদেরকে আদম-হাওয়ার মতো নিক্ষিপ্ত করেছে দুই মেরুতে।
মা উঠানের জবাফুল গাছটার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে থাকেন। লাল লাল ফুলগুলো অন্ধকারে ভীষণ কালো দেখাচ্ছে! বুকটা টনটন করে। ক্লাস টেনে পড়–য়া একমাত্র ছেলে ইয়ার ফোনের লত কানে ঝুলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ফিরবে রাত দশটার পর। তার পোশাক, মাথার চুলের অদ্ভুত স্টাইল, ফ্যাংলা ফ্যাংলা দাড়ি-গোঁফ, মোবাইল নিয়ে রাত জাগতে জাগতে চেহারা-ছুরত গাঁজাখোরের মতো। তার দুই সন্তানই লেখাপড়া করে কিন্তু তারা কেউ পড়ার টেবিলে বসে না। বছর বছর পরীক্ষা দেয়, পাস করে। মোবাইল তাদের চব্বিশ ঘণ্টার শিক্ষক কাম সহবত। ওটা থেকে যা শেখে, তা বাস্তব জীবনে ফলাতে চায়। মা-বাবা-স্কুলের শিক্ষক সবাই এখন নীরব দর্শক ও শ্রোতা আর অভিভাবকরাও এখন সময়ের সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে বিকারগ্রস্ত জীব। এই সুবাদে অবুঝ পতঙ্গরা ঝাঁকে ঝাঁকে ঝাঁপ দিচ্ছে বিচিত্রসব আগুনে!
চার
টিভির সামনে মা বসে আছেন। বাইরে আলো-অন্ধকারের রহস্য, নির্জনতা, ভয়। তাই বুক কাঁপে। খালি বাড়িটা খাঁ খাঁ করে। সন্ধ্যার পর ছেলেটা নষ্ট বন্ধুদের সাথে আগাড়ে-বাগাড়ে ঘুরে বেড়ায়। মেয়েটা হয়তো বাঁশঝাড়ের আড়ালে কিংবা পুকুরপাড়ের অন্ধকারে তার ছেলে বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেছে। তিনি না পারেন বলতে, না পারেন সইতে। সন্তানকে শিশুকালে মারেননি মরে যাবে, এখন শাসন করতে গেলে তার চুলে ধরবে। তাই বুকটা শুধু পোড়ে।
মা তরকারির ঝুড়ি, বঁটি দা ও পিঁড়ি নিয়ে বারান্দায় বসেন। লেড বাল্বের সাদা আলোতে তার চোখের কোনায় দুই ফোঁটা পানি ঝলমল করে। পানি তোলার মোটর আর টিভির শব্দ তার কানে একটুও ঢুকছে না। আচানক এক বিষাদে ডুবতে ডুবতেও তিনি জেগে ওঠেন। লোডশেডিং! শুধু অন্ধকার আর বুক-কাঁপানো ভয়! এর মধ্যেই তিনি তার কাজল ভাইকে একটু একটু অনুভব করেন।
পায়ের শব্দে চেয়ে দেখেন, মেয়ে অভিসার সফল করে ফিরে এসেছে। তিনি অন্ধ হয়ে যান। কাঁপতে কাঁপতে ছুটে গিয়ে মেয়ের চুল ধরে হিড় হিড় করে টেনে তোলেন বারান্দায়। মেয়ে ফোঁস করে ওঠে, সাবধান! শরীরে হাত দিবা না। তোমার জামাই লাগে, আমার লাগে না?
পাঁচ
মেয়েটা তার পড়ার টেবিলে বই মেলে বসে আছে, পাতার আড়ালে ওপেন করা স্মার্টফোন। মা দেখেও দেখেন না। এই নিয়ে কলহ করতে করতে তিনি এখন লবেজান। ছেলের পড়ার টেবিলের অবস্থা ভয়াবহ। বই-খাতার ওপর ধুলার আস্তর, মাকড়সার জাল। সব ঝাড়ামোছা করে তিনি ছেলের বইয়ের ব্যাগটা খোলেন। কয়টা বই-খাতা আর একটা ক্যালকুলেটরের সাথে এক প্যাকেট কনডম ব্যাগ থেকে বেরিয়ে আসে। জিনিসটা দেখে তিনি পাথর হয়ে যান। পাগলের মতো চিৎকার দিয়ে উঠতে ইচ্ছা করে।
টিভিতে রাত দশটার খবর চলছে। বাইরে বিদ্যুতের বাতিগুলো ঘিরে অন্ধকার। উঠানের কাঁঠাল গাছে বসে একটা টু-পক্ষী টুও...ও...ও, টুও...করে ডাকছে। অকল্যাণ আশঙ্কায় মা মনে মনে আল্লাহর দয়া কামনা করেন। ইট-বালু বোঝাই করা একটা ট্রলি গুমগুম শব্দে ঘরের পেছনের সড়ক দিয়ে উত্তর দিকে ছুটে যায়। তারপর সব নিঝুম, খাঁ খাঁ...। শুধু প্রতিবেশীর একটা গরুর ডাক একটু পর পর নীরবতা ভেঙে দিচ্ছে। সেই সন্ধ্যা থেকে রহিমের গরুর খামারে একটা গাভী ডাকছেই। কী গভীর আর বুকফাটা আর্তনাদ! মা অবুঝ পশুর জন্য বুকে দরদ বোধ করেন। গাভীটা নিশ্চয়ই পাল খেতে চায়, বদমাশগুলো খাওয়ায় না কেন?
বাড়ির গেটের সামনে এসে একটা হোন্ডা থেমে যায়। মা পাকঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। ছেলে বাইরে থেকে ডাকছে, আম্মা গেট খোলো, কাজল মামা আইছে।
মায়ের বুক কেঁপে ওঠে। একটু আগেই তো তিনি কাজলকে ভাবছিলেন। কী আজব লীলা! সুখ ও শঙ্কায় তার বুক থরথর করে।
‘কাজল’ নামটা শুনবার পর পড়ার টেবিলে বসে থাকা মেয়ে তার লাল লাল ঠোঁট দুইটা একটু বাঁকা করে, টিকলো নাকটা কোঁচকায়। মা অস্থির পায়ে সিঁড়ির কয়টা ধাপ পেরিয়ে গেটের দিকে যান আর বিড়বিড় করে বলেন, ফোনটোন না দিয়া পাগলটা...।
তিনি কাঁপা কাঁপা হাতে রঙিন উড়নার আঁচলটা মাথায় তুলে দেন।
ছয়
গভীর রাত। মা দরজা খুলে সাবধানে বেরিয়ে আসেন। বারান্দায়, উঠানে বিদ্যুতের বাতির মরামরা চোখ ঘিরে হালকা কুয়াশার বৃত্ত, অন্ধকার। বারান্দার গ্রিলের বাইরে, ফাঁকা ফাঁকা উঠানের চিপাচাপায় দলাদলা অন্ধকার। তার মাথার চুল এলোমেলো, চোখের নিচে রাতজাগা-ক্লান্তি, দুরুদুরু বুকটা ভেঙে পড়তে চাইছে।
হ্যাঁ, কাজলের ঘরের দরজাটা খোলা! বারান্দার আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে তিনি শুধু নিজের কিম্ভূত ছায়াটা দেখতে পান। তারপর পা টিপেটিপে কাজলের রুমের দিকে যান। সে-ও জেগে ছিল। ভূতের মতো ছায়াটা বিছানার পাশে এসে দাঁড়াতেই তিনি প্রাণ ফিরে পাওয়া মানুষের মতো তড়াক করে উঠে বসেন।
কাজল মশারির পাড় তুলে, তার হাত ধরে বিছানায় বসায়। তিনি শত দুঃখের মধ্যেও হাসেন, এই বয়সেও পাগলামি গ্যাছে না?
না। পাগলামির জন্যই তো জীবনডা বিনাশ হইলো।
তারপর তিনি বড় করে শ্বাস ছেড়ে হাহাকার করে ওঠেন, মিনু, আমার নসিবে সুখ নাই।
মশারির ভোঁতা অন্ধকারে তিনি কাজলের হাত দুইটা ধরে ছোট্ট একটা ঝাঁকি দিয়ে বলেন, সুখ এক অচিন পাখি। আমি তার লাগি আর কান্দি না।
মিনু মাথার এলোমেলো চুল খোঁপা করে বাঁধতে বাঁধতে আবার বলেন, আমারে দ্যাখো না, কীরকম ধুলার সমান বাঁইচা আছি।
কাজল তার একটা হাত নিজের মুঠিতে তুলে নেয়, না, হইছে না রে মিনু...,আমার বড় ছেলেটা আরেক ব্যাডার বউ লইয়া ভাগছে। মেয়েটাও ভাগা দিত যদি বিদেশ থাইকা আইয়া তাড়াতাড়ি বিয়া না দিতাম।
মশারির ভেতর ঘন অন্ধকার আর নীরবতা। দুইজনই মুখ নিচু করে আকাশ-পাতাল ভাবছেন। তাদের নিজের মাথা নিজের কাছে টন টন ওজন লাগে। পাথরের মতো চাপচাপ স্তব্ধতা হঠাৎ ভেঙে দেয় পুরুষের ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলা, আমারে তুমি ক্ষমা কইরা দিয়ো।
মিনু বলেন, কে কারে ক্ষমা করে?
পুরুষের চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। নারীও নীরবে কাঁদছে। তারপর একজন উড়নার পাড় তুলে নিজের চোখ মোছেন। এবং হেরে যাওয়া পুরুষটার ভেজা ভেজা চোখ দুটো মুছে দিয়ে বলেন, আমারেও তুমি ক্ষমা কইরো। আর কোনোদিন এইদিকে আসবা না। মন টানলে ফোন দিয়ো। ছেলেমেয়েরা বড় হইছে। আমরা কেউ মা, কেউ বাপ।
একটা টিকটিকি মশারির বন্ধি অন্ধকারকে সাক্ষী রেখে ঠিক! ঠিক! শব্দে ডেকে ওঠে। একটা আরশোলা খাটের নিচে, জমাট অন্ধকার থেকে ফড়ফড় শব্দে নিষ্ঠুর অদৃষ্টের মতো তাদেরকে শাসায়। নারীর বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। তারপর তিনি কাহিল গলায় বলেন, আমি অহন যাই।
ভাঙাচুরা পুরুষটা কাতরে ওঠে। তারপর মিনুর হাত দুটো চেপে ধরে, না।
কেন?
আমার কপালে একখান চুমা খাইয়া কৈয়া যাও, আমারে মাফ করছো। তা না হইলে তো আল্লাও ক্ষমা করত না।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : ঈশ্বর শিল্প সাহিত্য
© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh