দুইটি পঙক্তি, স্বাধিকার আন্দোলন ও হেলাল হাফিজ

উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ছিল বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মাইলফলক। মুক্তিকামী নিপীড়িত জনগণের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ৬ দফার পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালের ৪ঠা জানুয়ারি স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ছাত্র সমাজ ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচি পেশ করে। এসময় পূর্ব পাকিস্তানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ প্রবল রূপ ধারণ করে।

এমন একটি প্রেক্ষাপটে হঠাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে দুইটি পঙক্তি ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ সকলের দৃষ্টি কারে। ক্রমান্বয়ে ছাত্র থেকে জনতা মুখে মুখে ছড়িয়ে পরে পঙক্তি দুটি। পঙক্তি দুইটি আন্দোলনকামী ছাত্রদের উজ্জীবিত করে তোলে।

পাকিস্তানী সামরিক শাসন উৎখাতের লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সংগ্রামী জনতা শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়ন ও সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে এদিন ঢাকায় সচিবালয়ের সামনের রাজপথে নবকুমার ইনস্টিটিউটের নবম শ্রেণির ছাত্র কিশোর মতিউর ও রুস্তম শহীদ হন। প্রতিবাদে সংগ্রামী জনতা সেদিন সচিবালয়ের দেয়াল ভেঙে আগুন ধরিয়ে দেয়। বিক্ষুব্ধ জনগণ আইয়ুব মোনায়েম চক্রের দালাল, মন্ত্রী, এমপিদের বাড়িতে এবং তাদের মুখপত্র হিসাবে পরিচিত তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান ও পাকিস্তান অবজারভারে আগুন লাগিয়ে দেয়। জনগণ আইয়ুব গেটের নাম পরিবর্তন করে আসাদ গেট নামকরণ করেন। 

কিন্তু যিনি এই পঙক্তি দুটি রচনা করেছিলেন তিনি মোটেও বিখ্যাত কেউ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ুয়া এক তরুণ। অদম্য ভালোলাগায় লিখেন কবিতা। সেসময় ডায়েরির পাতায় লেখা অপ্রকাশিত একটি কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ যার শিরোনাম। এই কবিতার প্রথম দুইটি চরণ ছিল “এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়”। আর এই চরণ দুটিই তাকে চিনিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ এমন একটি কবিতা যা  প্রকাশেরে আগেই কবিকে রাতারাতি দিয়েছে তারকাখ্যাতি।

তবে কবিতাটি লেখা ও দেয়াললিখনের পিছনেও একটি গল্প আছে। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে সেই উত্তাল দিনগুলোর একদিন সন্ধ্যায় কবি পুরাণ ঢাকা থেকে হলে ফিরছিলেন। তখন কবি বাংলা অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন। গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়ায় রিকশাটি থেমে যায়। সেখানে তখন মিছিল চলছিল। পাকিস্তানি ইপিআর (এখন বিজিবি) ও পুলিশ মিছিলকারীদের পেটাচ্ছে, ধাওয়া দিচ্ছে। মিছিল থেকেও ছোড়া হচ্ছে ইটপাটকেল। তখন বয়স্ক এক রিকশাচালক বলে উঠলেন, “মার, মার শালাদের। প্রেমের জন্য কোনো কোনো সময় মার্ডারও করা যায়।” কথাটা তরুণ কবির মনে ও মগজে গেঁথে যায়। আসলেই তো তাই! দেশপ্রেমের জন্যও তো মার্ডার করা যেতে পারে। তারপর হলে ফিরে কবি লিখে ফেললেন ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি।

লেখার পর কবি আহমদ ছফা ও হুমায়ূন কবিরকে কবিতাটি দেখালেন। তারাই মূলত কবিতাটির প্রথম দুই লাইন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে চিকা মেরে দিলেন মানে দেয়াললিখন করলেন। মাত্র দুই রাতেই গোটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে স্লোগান হিসেবে এই পঙক্তি ছেয়ে গেল, ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।

কবিতাটি সেসময় একুশের ফেব্রুয়ারিতে একটি লিটল ম্যাগাজিনে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। তবে গ্রন্থাকারে স্বাধীনতার অনেক পর ১৯৮৬ সালে  ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পর কবিতাটি ইংরেজি, হিন্দি, জার্মান, ফরাসিসহ বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। কোটি-কোটি বার এটি আবৃত্তি করেছেন। গোটা তিনেক গানও হয়েছে।

দেয়াললিখন হিসেবে এ কবিতার প্রথম দুই চরণ প্রকাশিত ও প্রচারিত হওয়ার পর কবি ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তা-গলি দিয়ে যাবার সময় ছেলে-মেয়েরা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলত, “ওই যে কবি হেলাল হাফিজ যায়, দ্যাখ দ্যাখ । অনেক সময়  নাম না নিয়ে এটাও বলত যে, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। মোটকথা, যেখানেই যাক, অন্য রকম সমাদর পেত। রোজ দুপুরে কবিকে কে খাওয়াবে, তা নিয়ে প্রতিযোগিতা হত। নিজের কোনো বিল দিতে হত না।

উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ অবধি যত আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে কবিতার চরণদুটি সাহস ও শ্লোগান হিসেবে তরুণ-যুবকদের মুখে মুখে ঘুরেছে। কবিতাটি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে তরুণ-যুবকদের ব্যাপক ভাবে প্রেরণা যুগিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই কবিতা রণাঙ্গনের মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। তরুণ ছাত্ররা যুদ্ধে মনোবল বৃদ্ধি করতে কবিতার চরণ দুইটি ব্যাবহার করেছে। স্বাধীনতার পরে, বিশেষত যারা বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন-হক, তোয়াহা ও সিরাজ সিকদারের দল-তারা কবিতাটিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতেন। এমন কি স্বাধীনতার এত বছর পরও যেকোনো আন্দোলন সংগ্রামে শিক্ষিত যুবকদের চরণ দুইটি ব্যবহার করতে দেখা যায়।

বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতা ও “এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়” এ দুইটি পঙক্তি এবং কবি হেলাল হাফিজের ঋণ শোধ হবার নয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //